শরীরে শরীর নয়, ঠোঁটে ঠোঁট রাখাও নয়, মূহুর্তের ছোঁয়াও নয়, একটু দেখাতেই লিটার খানেক অগ্নিজলের ঘোর। স্বাধীন চিটাগাং
২৫ শে মার্চ রাতে ভাল ঘুম হয় নি। কয়েক মাস ধরেই পাড়ার কুকুর গুলো কাঁদতো। মা শিউরে উঠতেন। আমার নানীর কাছে শোনা তার, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় একটা দুর্ভিক্ষ হয়েছিল।
গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে গিয়েছিল না খেতে পেয়ে। সেই দুর্ভিক্ষ আসার আগে নাকি কুকুর এভাবে কাঁদতো। মা একথা বল্লেই বাবা দেখতাম থমথমে মুখ করে থাকতেন। কুকুরের কান্না খুব বেড়ে গেলেই তিনি রেডিওগ্রামের আওয়াজ বাড়িয়ে দিতেন যাতে কান্না না শোনা যায়। অনেক পরে বাবা বলেছিলেন যে তিনি যখন স্কুলের নীঁচু ক্লাসে পড়তেন তখন তিনিও শুনতেন সেই কুকুরের কান্না।
মন্বন্তর তার কিছুদিন পরেই তার কালো থাবা বিস্তার করে। তা ছিল ওলাওঠা বা গুটি বসন্তের চেয়েও ভয়াবহ ও সর্বগ্রাসী। সর্বোপরি তা ছিল মানবতার চরম অবমাননা। মানুষগুলো এক আঁজলা ফ্যানের (ভাতের মাড়) জন্যে রাস্তার সারমেয়র মত কামড়া কামড়ি করতো। বাবাদের আখাউড়া আর আগরতলায় কিছু দোকান পাট ছিল।
যুদ্ধের সময় সে দোকান গুলোর ভাড়া ১০/১২ গুন বৃদ্ধি পাওয়ায় পারিবারিক ভাবে সে মন্বন্তরের আঁচ থেকে তারা বেঁচে গিয়েছিলেন।
তো তাজ্জবের ব্যাপার হ'ল সে রাতে (২৫শে মার্চ, ১৯৭১) কোন কুকুরের কান্না শোনা যায়নি। চারিদিকে শুনশান। বোধ হয় কান্নার সুরে এতই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম যে, ওটাই হয়ে উঠেছিল ঘুমপাড়ানি গান।
খুব ভোরে উঠে পড়লাম।
আমাদের বাড়িটা ছিল ডুপ্লেক্স (পোষ্টাল এড্রেস: ২২৭ সিডিএ রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া, আগ্রাবাদ, চিটাগং। তখন সড়ক নম্বর ছিলনা)। দোতলায় সব ক'টা শোবার ঘর আর নীচ তলায় বসার ঘর, খাবার ঘর, রান্না ঘর আর অতিথি ঘর। মুখ হাত ধুয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছি - সুলতান চাচার ভরাট গলা, একটু উত্তেজিত "চুদানীজঝিরে............" । বসার ঘর দিয়ে চাচার গলা অনুসরন করে লনে বেরিয়ে এলাম।
বাবা আর সুলতান চাচা একটা কাগজ দেখছেন। কাগজটার রং হলদেটে। অনেকদিন রেখে দিলে কাগজের যে রং হয়। সুলতান চাচা ছিলেন নিরক্ষর। কাগজটা পেয়েই বাবার কাছে ছুটে এসেছেন, কি লেখা জানতে, যদিও ঘটনা তিনি জেনেই এসেছেন।
বাবার হাতের কাগজটির ওপর আমি ঝুঁকে পরলাম। ইংরেজীতে লেখা দু'টি প্যারাগ্রাফ। আজ কিছুই মনে নেই কি লেখা ছিল সে কাগজে তবে একটি বাক্যাংশ স্মৃতিতে এখনো জ্বলজ্বল করে: "Bengalees are fighting the enemy with great courage for an independent Bangladesh". কাগজটার প্রথম বাক্যের বাংলা ছিল সম্ভবত: "আজ বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র"। আমার গায়ের লোম সব খাড়া হয়ে গেল। মাথা বোঁ বোঁ করে ঘুতে লাগলো-সেই করে বাবা মা শিখিয়েছিলেন বাংগালী জাতীয়তাবাদের কথা, আমাদের শোষনের কথা, বন্চনার কথা, অক্ষরজ্ঞান দানের আগে।
মনে পড়ে গেল বুয়েটে থাকা কালীন কাক ঢাকা ভোরে বাবার ঘুম থেকে জাগিয়ে দেবার কথা, শীত শীত ভোরে খালি পায়ে শহীদ মিনারে বাবা-মার মাঝখানে থেকে ফুল দেয়া, আপোষ না সংগ্রাম-সংগ্রাম সংগ্রাম, জয় বাংলা বাংলার জয়...............মনে পড়ে গেল অবাংগালীদের করুনার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকানো- মনে পড়ে গেল আমাদের ফৌজদারহাটের ড্রিল স্টাফের হুংকার: " বাংলা বোলনে সে সাস নিকাল দেগা" ,... অন্তর গেয়ে উঠলো মাত্র পাঁচ দিন আগে স্বজন, সখা, সুহৃদের গাওয়া গানটি' "আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি"। আপনাদের কারো মনে আছে কি প্রথম বড় হয়ে ওঠার প্রমানের সময়কার অনুভূতিটি? আমি তখনো বড় হয়ে উঠিনি কিন্তু সেই অসহ্য সুখ, অপ্রাকৃত ভাললাগা, স্বর্গীয় আনন্দ আমি বড় হয়ে ওঠার আগেই পেয়েছিলাম।
আমার শোনা ভাষাগুলোর মধ্যে পান্জাবীর পরই মনে চাঁটগাইয়্যা ভাষা সবচেয়ে সমৃদ্ধ- মনের ঝাল মেটানোর জন্য। "ওৎতুর মা........" বলতে পারার সংগে সংগে রাগ অর্ধেকটা নেমে যায়। সুলতান চাচার অবিশ্রান্ত গালিগালাজ আমাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে।
সেটা ছিল বার্তাটির বংগানুবাদ শোনার পর তাঁর তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া। আমার সেটা মুখস্ত আছে কিন্তু এখানে প্রকাশ করলে রাগীমন, দূঃখিত, রাগ ইমন আমাকে খেয়ে ফেলবেন।
চাচার সাথে একাধিকবার জহুর আহমদ চৌধুরী (স্বাধীন বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রক তাঁর অধীনে ছিল। সেটা ছিল একটা বাস্তব কৌতুক। তাঁর বাড়ি ভর্তি ছিল অসংখ্য আত্মজ, আত্মজা দিয়ে), এম আর সিদ্দিকী (আংগুলে গোনা বাংগালী শিল্পপতিদের একজন, বিশিষ্ট শিল্পপতি এ কে খানের মেয়ের জামাই, রেনেঁস ব্যান্ডের বোগীর বাবা) ও হান্নান-মান্নানের কথা হয়েছে।
এম আর সিদিকী তাঁকে যেতে অনুরোধ করেছেন। হলদেটে কাগজটা নিয়ে তিনি চলে গেলেন। ঐ কাগজটাই ছিল ইপিআরের মাধ্যমে পাঠানো বংগবন্ধুর ওঅরলেস মেসেজ। তখন বলতাম-টেলিগ্রাম।
সেদিন ছিল শুক্রবার (সম্ভবত।
আমার বাবা ছিলেন খাঁটি ওঅর্কোহোলিক (কাজ পাগলা)। পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকাতে (১৯৬৭-৬৮) থাকার সময় রোববার ছাড়া (অতি অল্প সময়ের জন্যে) তাঁকে কোনদিন দেখিনি। আমরা ঘুম থেকে ওঠার আগে চলে যেতেন সাইটে, ঘুমিয়ে পড়বার পর আসতেন বাসায়। আব্বার বন্ধুরা মজা করে বলতো র....কে বাচ্চারা কত বড় হয়েছে জানতে চাইলে হাত দুটি দুদিকে প্রসারিত করে সাইজ দেখায়, কেন জিজ্ঞেস করলে বলে আমি তো ওদের শোয়া অবস্থায় দেখি, কত লম্বা হয়েছে তা কিভাবে বলবো? কে কোন ক্লাসে পড়ে জীবনেও তাকে সঠিক ভাবে বলতে পারতে দেখিনি। তো সেদিন জীবনের প্রথম বাবাকে অফিস কামাই করতে দেখলাম।
আমি বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম। এমনিতেই তখন সব মিলিয়ে এগারোটি দালান। তার মধ্যে বেশীরভাগই ওয়ান ইউনিট। বাজে তখন বড় জোর সাতটা। পুরো রাস্তায় কারো সাথে দেখা হ'ল না।
বাসায় এসে মুরগীগুলোকে খাবার দিলাম ( আমাদের ২১টি মুরগী ছিল, পাহাড়তলী ফার্ম থেকে আনা। রোড আইল্যান্ড রেড, হোয়াইট লেগ হর্ণ আর নিউ হ্যাম্পশায়ার ব্রিডের। প্রত্যেকটি মুরগীর নাম ছিল, আব্বার রাখা, এ্যালফাবেটিক্যাল অর্ডারে)। একটা স্নাইপ (কাদা খোঁচা, ডানা ভাংগা) ছিল তার জন্যে বাজার থেকে মাছ কিনে এনে খেতে দিলাম ।
সকাল দশটার মধ্যেই বাসা ভরে গেল পাড়ার বড়দের দিয়ে।
শুধু অবাংগালীদের কাউকে দেখলাম না। দুপুরের মধ্যে ঢাকার গণহত্যার খবরের বিষদ বিবরন পৌঁছে গেল। আমার চোখের সামনে বিহারীদের ওপর রাগ সমস্ত অবাংগালীদেরকেও গ্রাস করলো।
-২৬ শে মার্চ, ১৯৭১।
+ ঊনসত্তর থেকে পঁচাত্তর, পৃষ্ঠা-৫১, ত্রিশোনক্ শব্দশৈলী, ৩৮/৪, বাংলাবাজার, ঢাকা।
পাঠশালা, আজিজ সুপার মার্কেট, ঢাকা। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।