বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এক উজ্জ্বল নাম। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী প্রাণপণ যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ। এশিয়ার এই অঞ্চলে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জনের আর কোনো নজির নেই। আর সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলো ঘোষণার মাধ্যমে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে অর্জন করে স্বাধীনতা। এর ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশের মানুষই।
কিš‘ কি ছিল বা কি আছে এদেশের মানুষের চেতনার ভেতরে? কেন তারা মেনে নিল না পাকিস্তানীদের শাসন? কেন তারা বরাবরই নিজেদের স্বাধীন অস্তিত্বের জন্য, আত্মমর্যাদার জন্য লড়াই করে এসেছে? কেন কখনও পরাভব মানতে চায়নি? তার জন্য আমাদের তাকাতে হবে পেছনে।
আমরা যদি ইতিহাস সচেতন না হই, যদি আমরা এ জনপদের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত না হই, যদি না জানি জাতিসত্তার যথার্থ পরিচয়, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ নির্মাণ পরিকল্পনাও হবে বিশৃঙ্খল এবং মর্যাদাবান জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবো না কোনোদিন। কিš‘ অব¯’া ক্রমশ এমনই দাঁড়া”েছ যে, জাতি হিসেবে আমাদের প্রকৃত পরিচয়, আমাদের গর্ব, আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের স্বাতন্ত্র্য মুছে ফেলে একটি উন্মূল জনগোষ্ঠী হিসেবে জনসাধারণকে দাঁড় করানোর অপচেষ্টা চলছে, অনেক ক্ষেত্রে অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী রূপ নিয়েছে, নতুন প্রজন্মকে ক্রমান্বয়ে অন্ধকারে নিক্ষেপ করা হ”েছ। ফলে অজ্ঞানতা পরিণত হ”েছ এক ধরনের অহঙ্কারে। অজ্ঞানতা পেশি শক্তির বিস্তার ঘটায়।
অব¯’া এমন দাঁড়িয়েছে যে, পেশি শক্তির কাছে হেরে যা”েছ প্রকৃত ইতিহাস চর্চা ও জ্ঞান-শক্তি।
অথচ বাংলাদেশের রয়েছে হাজার বছরের পুরনো ইতিহাস ও ঐতিহ্য। রয়েছে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক বুনিয়াদ। তেমনিভাবে আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ইতিহাস। কিš‘ এসব সম্পর্কে সম্যক ধারণার অভাব প্রকট রূপ ধারণ করেছে।
বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মানুষের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য, ভাষাগত বৈশিষ্ট্য, জাতিসত্তাগত স্বাতন্ত্র্যের ইতিহাস সহস্র বছরের। খ্রিষ্টীয় সপ্তম-অষ্টম শতকে এই অঞ্চলের মুসলিম বণিক ও ধর্মপ্রচারকদের আগমনের পর এখানে ইসলামের প্রভাব পড়তে শুর“ করে। তারপর দ্বাদশ শতকে মুসলিম বিজয়ের পর এই জনপদের প্রায় সবাই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে স্বতন্ত্র জাতিসত্তার বিকাশ ঘটাতে শুর“ করে। আর ধর্মীয় কারণেই এখানে গড়ে ওঠে ভাষা ও সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য। তাছাড়া পূর্ববাংলার প্রকৃতি এখানকার মানুষকে দেয় ভিন্ন জীবনবোধ ও সংগ্রামী চেতনা।
নদীমাতৃক এই দেশের মানুষ নদী-সমুদ্র, ঝড়-ঝঞ্ঝা, প্রকৃতির সমস্ত বৈরিতার বির“দ্ধে লড়েছে অকুতোভয়, লড়ে লড়ে গড়ে তুলেছে লড়াকু এক ঐতিহ্য। আর বিশাল প্রকৃতি এদেশে হৃদয় করেছে প্রশস্ত। অধ্যাপক হুমায়ুন কবির তার ‘বাংলা কাব্য’ গ্রšে’ সেকালেই দুই বাংলার মানুষের প্রকৃতিগত স্বাতন্ত্র্য এবং বিরোধও তুলে ধরেছেন। পশ্চিম বাংলার কাঁকর ভরা লাল মাটি আর শ্যামলিমাহীন র“দ্র প্রকৃতি যে তাদের হৃদয়কে সংকীর্ণ করেছে সে কথাও উল্লেখ আছে ‘বাংলার কাব্যে’।
বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন যে চর্যাপদ, তার ভাষাও পূর্ব বাংলার।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, দীনেশচন্দ্র সেন প্রমুখ দীর্ঘ বিতর্কের পর এই মীমাংসায় উপনীত হন যে, চর্যাপদের ভাষা পূর্ববাংলার ভাষা। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকেই পূর্ববাংলা ও পশ্চিম বাংলার ভাষাগত এই পার্থক্য থেকে এই দুই অঞ্চলের জনপদের জীবনযাত্রার পার্থক্য তথা স্বাতন্ত্র্য নির্ধারণ করা যায়। এই অঞ্চলের মুসলমান শাসনামলে এই স্বাতন্ত্র্য আরও বিকশিত হয়ে উঠে। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, সাহিত্য চর্চা, শিক্ষা-দীক্ষায় মুসলমানগণ অগ্রসর জাতিসত্তারূপে পরিচিতি লাভ করেন। প্রাচীন আমলে যেমন বর্তমান আমলেও তেমন বাংলা ভাষী জনপদে মুসলমানই সংখ্যাগরিষ্ঠÑযারা বাংলায় কথা বলেন, তাদের ৭০ শতাংশ এখনও মুসলমানই, তখনও মুসলমান ছিলেন।
ফলে বাংলা ভাষায় যে মুসলমানী প্রভাব পড়বে, সেকথা অস্বীকার করার উপায় নেই। এমকি ‘কলিকাতা কমলালয়’ গ্রšে’র ভাষাও আদি বাংলা ভাষা, তাতেও মুসলমানী শব্দের প্রাচুর্য লক্ষ্য করা যায়। কিš‘ ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হবার পর এই ভাষায় খোল-নলচে বদলে একে মৃতপ্রায় সংস্কৃত ভাষার অনুগামী করেন সেখানকার সংস্কৃতনবিশ পণ্ডিতেরা। তাদের দাপটে মুসলিম বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ভাষা সাহিত্য প্রায় লোপ পায়, যার রেশ চলে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে অধ্যাপক আবুল ফজলকে দাওয়াত, জিয়াফৎ, দস্তরখানা, নাস্তা প্রভৃতি শব্দ বদলে ‘বাংলা’ শব্দ রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন, আবুল ফজল সেকথা নিজেই লিখে গেছেন রবীন্দ্রনাথকে লেখা তার পত্রে।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদদৌলার পতনের পর বাংলার দৃশ্যপটে ভিন্ন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ইংরেজরা এদেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর রাষ্ট্রভাষা ফারসীর বদলে হয় ইংরেজি। ইংরেজদের প্রতি স্বাভাবিক বিদ্বেষ থেকে মুসলমান সমাজে ইংরেজি ভাষার প্রতিও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। ফলে তারা স্বভাবতই ইংরেজি শিক্ষার দিকে মনোযোগী হয়নি। অপরদিকে মুসলমান সমাজের প্রচলিত শিক্ষা ব্যব¯’া ছিল মাদ্রাসা-মক্তব ঘিরে।
এসব মাদ্রাসা-মক্তব পরিচালিত হত ওয়াকফ ও লাখেরাজ সম্পত্তির আয় থেকে। ব্রিটিশ সরকার লাখেরাজ ও ওয়াকফ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ফলে মুসলমানদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যব¯’া সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে।
১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত বাংলার মুসলমানদের দুর্গতি এক চরম সীমায় পৌঁছে। চির¯’ায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে মুসলমান জমিদার শ্রেণীকে প্রজায় রূপান্তরিত করা হয়, আর হিন্দু নব্যোত্থিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী জমিদার শ্রেণীতে রূপান্তরিত হয়। পরি¯ি’তি এমন দাঁড়ায় যে, ইংরেজ সরকারের চাকরিতে আর্দালি-পিয়ন ছাড়া অন্য কোনো পদে মুসলমান নিয়োগ বন্ধ হয়ে যায়।
এমনকি বহু চাকরির বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় এই বলে যে, ওই পদে মুসলমানরা দরখাস্ত করার অযোগ্য।
১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লবের পর উপমহাদেশে মুসলমানদের অব¯’া আরও কর“ণ হয়ে দাঁড়ায়। এই বিপ্লবে মুসলমানদের ভূমিকা অবিসংবাদিত। সিপাহী বিপ্লবের মাধ্যমেই শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ পুনরায় কিছুদিনের জন্য বাদশাহ হন। ফলে এই বিপ্লব মুসলমানদের পুনর“ত্থান বলে চিহ্নিত হয়।
কিš‘ ওই সময় হিন্দু ‘প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় লেখেন : “সিপাহী বিদ্রোহ কেবলমাত্র কুসংস্কারা”ছন্ন, সিপাহীদের কর্ম মাত্র। দেশের প্রজাবর্গের সহিত তার কোন যোগ নেই। প্রজাকুল ইংরেজ গভর্নমেন্টের প্রতি অনুরক্ত ও কৃতজ্ঞ এবং তাহাদের রাজভক্তি অবিচল রহিয়াছে। ” ইতিহাসকার আর. সি মজুমদার বলেছেন, “এর সঙ্গে দেশবাসীর কোনো যোগাযোগ ছিল না, এটা নিছক কিছু হঠকারী সৈন্যের কাজ। ” অথচ কার্ল মার্কস ১৮৫৭ সালের বিপ্লবকে ‘প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করে লেখেন : ‘‘এর আগেও ভারতীয় সৈন্যবাহিনীতে বিদ্রোহ হয়েছে, কিš‘ বর্তমান বিদ্রোহ কতগুলো বৈশিষ্ট্যসূচক ও মারাত্মক লক্ষণে চিহ্নিত।
এই প্রথম সিপাহী বাহিনী হত্যা করল তাদের ইউরোপীয় অফিসারদের; মুসলমান ও হিন্দুরা তাদের পারস্পরিক বিদ্বেষ পরিহার করে মিলিত হয়েছে সাধারণ মনিবদের বির“দ্ধে; হিন্দুদের মধ্য থেকে হাঙ্গামা শুর“ হয়ে আসলে তা শেষ হয়েছে দিল্লির সিংহাসনে একজন মুসলমান সম্রাটকে বসিয়ে; বিদ্রোহ শুধু কয়েকটি অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকেনি এবং পরিশেষে ইঙ্গ-ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর বিদ্রোহ মিলে গেছে ইংরেজ প্রাধান্যের বির“দ্ধে। বড় বড় এশীয় জাতিগুলোর এক সাধারণ অসন্তোষের সঙ্গে, বেঙ্গল আর্মির বিদ্রোহ নিঃসন্দেহে পারস্য ও চীন যুদ্ধের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কিত। ’’ [প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ, ১৮৫৭-১৮৫৯, পৃ. ৪০-৪১]
এরপর মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর ইংরেজ নির্যাতন চরম রূপ নেয়। উইলিয়াম হান্টার তার ‘ইন্ডিয়ান মুসলমান’ গ্রšে’ এ চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, “মুসলমানদের প্রতি ব্রিটিশ নির্যাতন-অবহেলার জন্যই ১৮৫৭’র বিদ্রোহ হয়।
” তিনি বলেন, ‘‘এই অবহেলার দর“ন বাংলার মুসলমান তর“ণদের কি সর্বনাশ হয়েছিল তা বলে শেষ করা যায় না। আমাদের মনে রাখা উচিত যে, এক পুর“ষ আগে আমরা হুগলীর ওয়াকফ সম্পত্তি আত্মসাৎ করে নেয়ার পর কলকাতার মাদ্রাসাই ছিল একমাত্র শিক্ষায়তন, যেখানে তাদের উ”চশিক্ষা পাওয়ার আশা ছিল। কিš‘ সে আশা নস্যাৎ হয়ে যায়। ’’ হান্টার সাহেব লিখেছেন যে, “মাদ্রাসাগুলো সরকারি নজর না পেয়ে মুসলমান সন্ত্রাসবাদীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। ” তিনি মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষার ওপর গুর“ত্ব আরোপ করে বলেন, এতে নয়া পুর“ষের মুসলমানরা হিন্দুর মতো নতুন পথে চলতে শিখবে এবং তাদের মত সহজে উদারনৈতিক হয়ে উঠবে।
... এই হিন্দুরাই মাত্র কিছুদিন আগেও ছিল দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে গোঁড়া জাত। এদিকে সরকারেরও কর্তব্য হবে, বাঙালি মুসলমানদের অসন্তোষ যেমন কঠোর হস্তে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া, তেমনি তার পুঞ্জীভূত হওয়ার কোনো কারণ না ঘটতে দেওয়া। আমাদের বিজয়ের ফলে ও শাসন ব্যব¯’ার পরিবর্তনের দর“ন মুসলমান সম্প্রদায় আজ অবনতির গহ্বরে পড়ে গেছে। শুধু তার জন্য নয়, আমাদের দরদের অভাবে তাদের এই সর্বনাশ আরও সম্পূর্ণ ও অসহনীয় হয়ে উঠেছে। ’’
এই দরদের অভাব যে কত প্রকট ছিল তার প্রমাণ মেলে ১৮৪৩ সালে ডিউক অব ওয়েলিংটনের খোলাখুলি ভাষণ থেকে।
এদিকে দিল্লির দুর্গ পুনর্দখলের পর ১৮৫৭ সালের ২২ জুন ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় লেখা হয় : ‘হে পাঠক সকলে ঊর্ধ্ববাহু হইয়া পরমেশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়া জয়ধ্বনি করিতে করিতে নৃত্য কর,- রাজ সৈন্যরা ন্যূনধিক ৪০ তোপ এবং শিবিরাদি কাড়িয়া লইয়াছেন, হতাবশিষ্ট পাপিষ্ঠেরা দুর্গ প্রবিষ্ট হইয়া কপাট র“দ্ধ করিয়াছে, আমাদিগের সৈন্যরা দিল্লির প্রাচীরের উপর উঠিয়া নৃত্য করিতেছে। সম্বাদ পাইয়াছি পরদিনই দুর্গ লইবে, কি মঙ্গল সমাচার, পাঠক সকল জয় জয় বলিয়া নৃত্য কর, হিন্দু প্রজা সকল দেবালয়ে সকলে পূজা দেও, আমাদিগের রাজ্যেশ্বর শত্র“ জয়ী হইলেন। ”
এর পরের ইতিহাস কমবেশি অনেকেরই জানা আছে। মুসলমানদের প্রতি ইংরেজের বিদ্বিষ্ট মানসিকতাকে অভিনন্দন জানিয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়। সে কাল সম্পর্কে ইতিহাসকার রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, “উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যে হিন্দুর জাতীয়তা জ্ঞানের উন্মেষ হয়েছে, তার প্রকৃত রূপ ছিল হিন্দু ধর্মের পুনর“জ্জীবন, যার একমাত্র লক্ষ্য ছিল ‘রামরাজ্য’ ¯’াপন।
তখন বাংলাদেশে হিন্দু মেলা প্রতিষ্ঠায়, পুনরায় সার্বজনিক সভা ও মাদ্রাজে মহাজন সভা প্রতিষ্ঠায় মূলত প্রাচীন হিন্দুত্বের পুনর“জ্জীবন প্রচেষ্টাই লক্ষিত হয়েছিল। দায় নন্দের ১৮৮২ সালে ‘গোরক্ষিণী সমিতি’ প্রতিষ্ঠা ও ১৮৯৬ সালে বালগঙ্গাধর তিলকের ‘শিবাজী উৎসব’ অনুষ্ঠান একই অনুপ্রেরণা প্রসূত। বঙ্কিম চন্দ্রের সাহিত্য সাধনাও একই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তার আনন্দমঠ গ্রš’ ও বন্দেমাতরম মন্ত্র সমস্বরে প্রচারিত করেছে হিন্দু ধর্ম, জাতি ও জাতীয়তা জ্ঞান-এও অবিভাজ্য বিষয়-এই তিনের একই চিন্তাধারার অভিব্যক্তি। এ জন্য মুসলিম শিরে তার অভিশাপ, গালাগালি ও বিদ্বেষ-বিষ বর্ষণে কিছুমাত্র কৃপণতা ছিল না।
’’ [উদ্ধৃত, আবুল মওদুদ, মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ, পৃ. ২৬৭]।
এই গোটা সময়ে বাঙালি জাতি বা বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলা আবশ্যক বলে মনে করি।
ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার তার ‘ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঋৎববফড়স গড়াবসবহঃ’ গ্রšে’র দ্বিতীয় খণ্ডের ১৫০-১৫১ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘‘১৮৩৩ সালে কি ভারতীয় জাতীয়তার অস্তিত্ব ছিল? এ প্রশ্নের উত্তর হবে- না। তখন বাঙালি নেতা রাজা রামমোহন রায় ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছেন, অন্যান্য ভারতীয় শক্তির বির“দ্ধে যুদ্ধে ব্রিটিশের জয়লাভের জন্য। ... ১৮৩৩ সালে বাংলাদেশে দুটি জাতের মানুষ ছিল-হিন্দু ও মুসলমান।
যদিও তারা ছিল একই দেশের বাসিন্দা, তবু এক ভাষা ব্যতীত অন্য বিষয়ে তারা ছিল ভিন্ন। ধর্মে, শিক্ষায়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে তারা ছয়শ’ বছর ধরে বাস করেছে যেন দুটি ভিন্ন পৃথিবীতে। রামমোহন রায়, দ্বারিকানাথ ঠাকুর, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর প্রমুখ কলিকাতার বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ মুসলমানদের জ্ঞান করতেন হিন্দুদের যত দুর্গতি ও অসম্মানের মূল উৎস হিসাবে-যা হিন্দুরা ন’শ’ বছর ধরে সহ্য করতে বাধ্য হয়েছেন। আর ব্রিটিশ শাসনকে জ্ঞান করতেন বিধাতার আশীর্বাদ হিসাবেÑ যার প্রসাদে হিন্দু মুসলমান-শাসন থেকে পরিত্রাণ পেয়েছে। সমস্ত বাংলা সাহিত্যে ও পত্র-পত্রিকায় মুসলমানদের উল্লেখ করা হত ‘যবন’ বলে।
... তখন ব্রিটিশকে বিতাড়িত করে হিন্দু বা ভারতীয় শাসন ¯’াপনের কোন ই”ছাই ছিল না। এমনকি রাজা রামমোহন রায়েরও এমন ই”ছা জন্মেনি। প্রসন্ন কুমার ঠাকুরের মত বিশিষ্ট নাগরিক প্রকাশ্যে বলতেন যে, যদি ঈশ্বর তাকে ‘স্বরাজ’ ও ব্রিটিশ শাসনের মধ্যে বেছে নিতে বলেন, তাহলে শেষেরটাই বিনা দ্বিধায় বেছে নেবেন। ’’ [উদ্ধৃতি এস এ সিদ্দিকী, ‘ভুলে যাওয়া ইতিহাস’, পৃ. ৯০]
আর ভারতের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ এম এন রায় তার ‘ঞযব ঐরংঃড়ৎরপ জড়ষব ড়ভ ওংষধস’ গ্রšে’ লিখেছেন : “ভারতের অধিবাসীদের মধ্যে সনাতনপš’ী হিন্দুদের সংখ্যাই অধিক। এদের কাছে সদ্বংশজাত, সুশিক্ষিত এমনকি প্রশংসনীয় সংস্কৃতি সম্পন্ন মুসলমানেরা পর্যন্ত ‘ম্লে”ছ’-অসভ্য বর্বর রয়ে গেল।
নিম্নতম হিন্দুরা এদের কাছ থেকে যে সামাজিক ব্যবহার পায়, মুসলমানদেরও তাদের কাছ থেকে তার চেয়ে কিছু উন্নততর ব্যবহার পাবার অধিকারী বলে তারা মনে করে না। শত শত বছরব্যাপী দুটি সম্প্রদায় এক সঙ্গে একই দেশে বসবাস করল, অথচ পরস্পরের সভ্যতা-সংস্কৃতি-সহানুভূতির সঙ্গে বুঝবার চেষ্টাই করল না, পৃথিবীর ইতিহাসে সত্যি এমন দৃষ্টান্ত মেলে না। পৃথিবীর কোন সভ্য জাতিই ভারতীয় হিন্দুদের মত ইসলামের ইতিহাস সম্বন্ধে এমন অজ্ঞ নয় এবং ইসলাম সম্বন্ধে এমন ঘৃণার ভাবও পোষণ করে না। ভারতীয় হিন্দুদের জাতীয়তাবাদের আদর্শ হল আধ্যাত্মিক সাম্রাজ্যবাদ। কিš‘ ইসলাম তথা মোহাম্মদের ধর্মের সঙ্গে সম্বন্ধ বিচারে হিন্দুদের এই অপ্রশংসনীয় মনোবৃত্তি আরও উগ্র আকার ধারণ করে।
ইসলামের অসাধারণ বৈপ্লবিক গুর“ত্ব আর তার বৃহত্তর সাংস্কৃতির তাৎপর্য সম্বন্ধে অধিকাংশ শিক্ষিত হিন্দুরই সহৃদয় অনুশীলন তো দূরের কথা সামান্যতম ধারণাও নেই। ’’ [পৃ. ৩-৪]
এই প্রেক্ষাপটে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনকে দেখা দরকার। বাংলার মুসলমানের শিক্ষা-দীক্ষার পশ্চাৎপদতার কারণে তাদের ওপর হিন্দু মধ্যবিত্ত জমিদার শ্রেণীর শোষণ ছিল সীমাহীন। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকার প্রশাসনিক প্রয়োজনেই বাংলা ভাগ করেছিলেন, মুসলমানদের বড় ধরনের কোনো সুবিধা দেবার জন্য নয়। বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ববাংলার মানুষের মনে উন্নতির আশা সঞ্চারিত হয়েছিল।
কিš‘ মুসলমানদের ওপর শোষণের কাঠামো বন্ধ হয়ে যাবে বলে হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী প্রতিবাদে নামে। অথচ অদৃষ্টের এমনি নির্মম পরিহাস যে, ১৯৪৭ সালে স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেছে এই কট্টরপš’ী হিন্দুরাই।
বঙ্গভঙ্গ সম্পর্কে ১৯১২ সালের ৬ এপ্রিল মওলানা মুহম্মদ আলী একটি পত্রিকায় লেখেন : ‘‘দরিদ্র ও অজ্ঞরা সর্বত্রই যেমন কষ্ট ভোগ করতে বাধ্য, তেমনি তারা (মুসলমানরা) এদেশে ভোগ করেছে সব রকমের অসুবিধা ও অবিচার এবং সরকারের বিশেষ ধরনের শাসনতন্ত্র ও ইংরেজদের রাজনৈতিক ঐতিহ্য তাদের পক্ষে মুসলমানদের প্রতি যৎসামান্য সুবিচার দুঃসাধ্য করে তুলেছে। অব¯’ার এমনি পরি¯ি’তিই অস্বাভাবিক করে তুলেছিল ১৯০৫ সালের বঙ্গ-বিভাগকে। আগেই বলেছি গত ছয় বছরে যা ঘটেছে তার আলোচনায় যাব না।
কিš‘ এই সত্য গোপন করার কোন কারণ নেই যে, (গত ছয় বছরে) পূর্ব বাংলার মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি আরও আশাপূর্ণ হয়ে উঠেছিল এবং যদিও প্রশাসনকে সাম্প্রদায়িক ভারসাম্য সংশোধন করার উদ্দেশ্যে খুবই সামান্য পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল, তাতে প্রাসঙ্গিকভাবে মুসলমানরা যথেষ্ট উপকৃত হয়েছিল। ’’
এই প্রসঙ্গে মুসলমানদের শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণের ওপর গুর“ত্ব দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘পূর্ব বাংলার মুসলমানদের যা দরকার তা হ”েছ, স্কুলের বই এমনভাবে লিখিত হওয়া উচিত নয় যাতে অপরিহার্য মুসলিম অনুপ্রেরণা, ফার্সী ও আরবী রূপকল্প এবং এসব উৎসব থেকে উদ্ভূত শব্দাবলীকে অবহেলা করে হিন্দু অনুপ্রেরণা, তার রূপকল্প শব্দাবলী জোর করে চাপিয়ে দেয়া হবে। বাংলাদেশ জুড়ে এই অভিযোগ রয়েছে যে, স্কুল-কলেজের আরবী ও ফার্সী পড়বার কোন ব্যব¯’া রাখা হয়নি এবং এইভাবে মুসলমান ছাত্রদের ছাড়িয়ে নেয়া হ”েছ তাদের বিশেষ সংস্কৃতির উৎস থেকে, সে সংস্কৃতিকে তারা জাতীয়তাবাদের বেদীতে পুরোপুরি বলি দিতে পারে না। ’’
ব্রিটিশ যুগেই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্র গঠনের যারা প্রয়াসী ছিলেন তারা হলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, শরৎচন্দ্র বসু প্রমুখ। বাংলার কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ রাজি হলে তাতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহরও কোনো আপত্তি ছিল না।
কিš‘ এর চরম বিরোধী ছিলেন জওহরলাল নেহর“, মোহনচাঁদ করমচাঁদ গান্ধী এবং বাংলার শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী। ১৯৪৭ সালের ১৯ মার্চ শ্যামাপ্রসাদ সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন অবিভক্ত ভারতেও বাংলা ভাগ করতে হবে।
১৯৪৭ সালের ১১ মে ও ১২ মে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী, অর্থমন্ত্রী মুহম্মদ আলী এবং বাংলার মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম ‘সার্বভৌম বাংলা’ বিষয়ে আলোচনা করেন গান্ধীর সঙ্গে। ১৯৪৭ সালের ২০ মে শরৎ বসুর বাসায় সোহরাওয়ার্দী, ফজলুর রহমান, মুহম্মদ আলী, আবুল হাশিম, আবদুল মালেক, কিরণ শঙ্কর রায় ও সত্যরঞ্জন বকশী এক বৈঠকে মিলিত হয়ে সার্বভৌম বাংলা সম্পর্কে একটি পরীক্ষামূলক প্রস্তাব তৈরি করেন। শরৎ বসু ২৩ মে (’৪৭) খসড়াটি গান্ধীর কাছে পেশ করেন।
২৪ মে গান্ধী ঐ খসড়া সম্পর্কে লেখেন, ‘‘খসড়াটিতে প্রতিশ্র“তিমূলক এমন কিছু নেই, যাতে শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠার দ্বারা কিছু করা যাবে না। সরকারের শাসনকার্য পরিচালনা এবং আইন প্রণয়নের প্রত্যেকটি কাজের পেছনে থাকতে হবে অন্তপক্ষে হিন্দু সংখ্যালঘিষ্ঠের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সহযোগিতা। এই স্বীকৃতিও তাতে থাকা উচিত যে, বাংলার রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিধৃত এক অভিন্ন সংস্কৃতি যার মূল নিহিত আছে উপনিষদসমূহের দর্শনে। ’’
[চুবৎবষধষ : গড়যধঃসধ এধহফযর ঞযব খধংঃ ঢ়যধংব, ঠড়ষ ওও, ঘধাধলরনধহ ঢ়ঁনষরংযরহম ঐড়ঁংব, অযসবফধনধফ, ১৯৫৮]
মি. গান্ধীর এই অগণতান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক দাবি সঙ্গত কারণেই কেউ মেনে নেননি।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়, সেই সঙ্গে বাংলাও।
তবু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলকাতায় থেকে গিয়েছিলেন সার্বভৌম বাংলার আশা নিয়ে। কিš‘ কলকাতায় মি. গান্ধীর প্রার্থনা সভায় যোগ দিতে গিয়ে তিনি চরম শিক্ষা পেয়ে ফিরে আসেন। যে শিক্ষার বিবরণ নিম্নরূপ, হিন্দু জনতা তার চারপাশে গুঞ্জন তুলে বলছিল, ‘‘মুসলমান শুওর, খুনী ও চোর। ’’ তারা এমন চীৎকার তুলেছিল যা শুধুমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ ভারতেই শোনা যেতে পারে। তারা বলেছিল এই ‘অধঃপতিত গর“ খোরকে ফাঁসিতে লটকানো হোক।
’ এই পরি¯ি’তিতে প্রশংসনীয় শান্তভাবে আগাগোড়া বসে থাকলেন মি. সোহরাওয়ার্দী।
[খবড়হধৎফ গড়ংষবু, ঞযব খধংঃ ফধুং ড়ভ ঃযব ইৎরঃরংয জধল, ডবরফবহভবষফ ্ গরপড়ষংড়হ, খড়হফড়হ ১৯৬১]
এখানে আর একটা কথা বলেই এই আলোচনায় ইতি টানতে চাই। তাহলো হিন্দু নেতৃবৃন্দ কেন বাংলা বিভক্তি চাইলেন? এর কারণ, অবিভক্ত বাংলায় মুসলমানই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যব¯’ায় মুসলমানদের সরকার গঠনে সম্ভাবনা ছিল বেশি। সেই অব¯’া মেনে নিতে চাননি হিন্দু নেতৃবৃন্দ।
এটাই ইতিহাসের সত্য।
অখণ্ড বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের জাতিসত্তাগত পার্থক্য বহু আগেই নিরূপিত হয়ে গিয়েছিল। পূর্ববাংলার মানুষ বাংলার ভেতরেই নিজেদের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে টিকে ছিলেন। পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ধর্মীয় সাজুয্যের কারণেই। কিš‘ সে সাজুয্য দিয়ে যখন পাকিস্তানী শাসকদের অর্থনৈতিক শোষণ ক্ষেত্রে পরিণত হল পূর্ব বাংলা, তখন আবারও প্রতিবাদ প্রতিরোধে ফুঁসে ওঠে এদেশের মানুষ এবং শেষ পর্যন্ত বহু ত্যাগের বিনিময়ে লড়াই করে অর্জন করে স্বাধীনতা।
প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র-বাংলাদেশ। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।