অনিক কেঁপে উঠল। লোকটা ঢলে পড়ে চিৎকার করল। বাকীরা মেয়েটিকে নিয়ে চলে গেল। মেয়েটির শাড়ি খানিকটা ছিড়ে গেল। শরীরের অর্ধাংশ উলঙ্গ।
অনিক পিস্তলটা শক্ত করে ধরল। কিন্তু ব্যবহার করল না। বৃদ্ধ লোকটার কাছে গেল। সে মৃত প্রায়। অনিকের অনেক সাড়া শব্দের পর লোকটা একটু নড়ল।
বলল, “তুমি কে? হয় পালাও নয় মেয়েটিকে বাঁচাও। ওরা মেয়েটিকে নষ্ট করে ফেলবে। ”
“ওরা কোথায় গেল আমিতো জানি না। ”
“আমাকে নিয়ে চলো। ”
বৃদ্ধাকে তার ঘোড়ায় উঠিয়ে অনিকও উঠে বসল।
ঘোড়া সেই ঘন ঘেরা বনের ভিতর দিয়ে দ্রুত ছুটল। গাছের পাতায় মাঝে মাঝে খুব জোরে ধাক্কা লাগে। তবু ঘোড়া ছোটে। এক সময় ঘোড়া থেমে গেল। দু’জন নেমে পড়ল।
কিছু পথ অগ্রসর হওয়ার পরই লোকটা ঢলে পড়ল। বলল, “তুমি যাও। এ পথের সামনেই একটা পাথরের দরজা রয়েছে। ওটা খুললেই আমাদের আস্তানা। ”
অনিক পথ চলতে থাকল।
হঠাৎ পায়ের পাশে একটা ফুটো দিয়ে আলো দেখতে পেল। অনিক সেদিক ল্য করেই দু'টো গুলি ছুড়ল। কিন্তু ঢুকতে পারল না। খানিক এগিয়ে গেল। দেখা গেল দশ বারটা ঘোড়া।
ওরাও গুলির আওয়াজে সবাই প্রস্তুত। কিন্তু এই অপ্রস্তুত গুলির জন্য ওরা প্রস্তুত ছিল না। ঘোড়া দৌঁড়িয়ে পালিয়ে গেল। কিন্তু মেয়েটাকে দেখা গেল না। অনিক গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকল।
অনিক এগিয়ে গেল। চারিদিকে গাছপালার থম থমে আঁধার। পা ছিটকে পড়ে গেল। দেখল একটি দরজা। দরজাটি খোলা।
দরজা দিয়ে ঢুকে গেল। পথটি আঁকা বাঁকা। শুধু ধাক্কা খেল। হঠাৎ চোখে পড়ল একটি মোমের বাতি। মোমের বাতিটির দিকে গেল।
মেয়েটি পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার গা দিয়ে ঘাম ঝরছে। অনিক হাত বাড়িয়ে দিল। মেয়েটি ভীতু এবং অসহায়। হাত বাড়াতে ভয় পেল।
তবু হাত বাড়িয়ে দিল। অনিক ওর হাত ধরল। ওর সারা শরীর এখনও থর থর করে কাঁপছে। অনিক মেয়েটিকে নিয়ে বেরিয়ে এলো।
শুরু হলো পথ চলা।
মেয়েটি অনিকের সাথে পেরে উঠছে না। তবু ছুটতে হচ্ছে। হঠাৎ মেয়েটি অনিকের হাত থেকে ছুটে গেল। গড়িয়ে গেল অনেক দূর। অনিক তাকে খুঁজে পাচ্ছে না আবার ডাকতেও পারছে না।
অনিক দাঁড়িয়ে থাকল। এদিকে মেয়েটিও কোন কথা বলছে না। অনিক বলল, “তুমি কোথায়? আমার দিকে ফিরে এসো। নইলে আমাকে ডাকো। ”
কিছুণের মধ্যে একটি কালো মূর্তি অনিকের দিকে ফিরে এলো।
অনিক হাত বাড়িয়ে আবার তার হাত ধরল। দু’জনে আবার শুরু করল পথ চলা। জোছনার আলো ভেসে আসছে। ওরা একটি গাছের আড়ালে দাঁড়াল। জঙ্গলের ভিতর থেকে বন মোরগের ডাক ভেসে আসছে।
দূরে কোথায় শিয়াল হাঁকছে। তার সাথে যেন আবার ঘোড়ার খুড়ের শব্দ ভেসে আসছে। ওরা আবার শুরু করল পথ চলা। একেতো অচেনা তার পর আবার উঁচু নিচু পাহাড়ী পথ। আঘাতের পর আঘাত লাগছে পায়ে।
মেয়েটি যেন আর পেরে উঠছে না। এদিকে নাও বলতে পারছে না। জীবন মরণ পথ চলা। একটি উঁচু ডিবির উপর উঠে অনিক মেয়েটিকে উঠাতে গেল। পায়ের তলার মাটি সরে দু’জনেই গড়িয়ে গেল অনেক দূর।
আঁধার ধীরে ধীরে কমে আসছে। আকাশের নীল জোছনা সাদা হয়ে আসছে। অনিকের জ্ঞান ফিরে এলো। দেখল মেয়েটি ওর বুকের উপরে জ্ঞান শূন্য হয়ে আছে। কোমল এবং নীরব।
ও যেন জোছনার পাখায় ভর করে ধরণীর বুকে নেমে আসছে। ওর রূপের আগুনে ঝলসে উঠছে আরেক জোছনার আলো। ও যেন মূর্তিমান মানবী। অনিক বুঝল বাঘ কেন হরিণকে শিকার করে; হরিণের থক থকে মাংস বাঘকে মাতাল করে তোলে। এ শিকারের জন্য হরিণের দুলে ওঠা মাংসও দায়ী।
অনিক উঠতে চেষ্টা করল। কিন্তু উঠতে পারল না। মেয়েটির মাথা ধরে ঝাঁকি দিল। সে নড়ল চড়ল না। আবার সে ভাবেই পড়ে থাকল।
অনিক মেয়েটাকে ডাকল। অনেকণ পরে তার জ্ঞান ফিরল। জ্ঞান ফিরে লজ্জাবোধ করল। কিন্তু ওঠার চেষ্টা করল না। অনিক আবার ডাকল।
মেয়েটি আস্তে ডাকে সাড়া দিল। অনিক বুঝল ওর জ্ঞান ফিরেছে। পাথরের মত শীতল দেহটা নিভীড় আবেগে গরম হয়ে উঠছে।
অনিক বলল, “পথ চলতে হবে। ওরা এখানে এসে পড়তে পারে।
”
মেয়েটি বলল, “আমি আর পথ চলতে পারব না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। ”
অনিক মেয়েটিকে ধরে উঠাল। ওরা জঙ্গলের ফাঁকা জায়গায় বেরিয়ে এলো। মেয়েটির ভয় অনেকটা কমে গেল।
ওর ভীরু চোখে এবার লাজুকতা ছড়াছে। মেয়েরা লজ্জাবতী কিন্তু একবার লজ্জা ভাঙ্গলে ওরা নির্লজ হয়ে ওঠে। মেয়েটির আর যেন কোন অভিযোগ নেই। যার বুকে মাথা রেখে পড়ে থাকা যায় তার কাছে লুকানোর আর কি আছে।
মেয়েটি অনিকের দিকে নীরবে তাকিয়ে আছে।
ও যেন সাহস খুঁজে পেয়েছে। ধীরে ধীরে অনিকের দিকে হেঁটে এসে, “আপনি আমাকে বাঁচাতে এলেন কেন?”
“একজন অসহায়কে সাহায্য করা মানুষের কর্তব্য। ”
“আপনি পারতেন ওদের সাথে?”
“বাঁচতে না পারলেও মরতে পারতাম। ”
“আমাকে একদিন বাঁচিয়ে কি লাভ? আমারতো কোন নিরাপত্তা নেই। ওরা আমার বাবাকেও মেরে ফেলছে।
”
“যত সময় আমি আছি তত সময় তোমার নিরাপত্তা আছে। ”
“সকালে আপনি যখন ফেলে যাবেন তখন আমি কি করব?”
অনিক মেয়েটির দিকে একটু হেঁটে এলো। হাত দুটি ধরে বলল, “আমি তোমাকে ফেলে যাব না। ”
মেয়েটি আরো কাছে এসে দাঁড়াল। বাতাসের উথল তরঙ্গ ওদেরকে এলোমেলো করে তুলছে।
মেয়েটি মাথা নিচু করে আছে। অনিক দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল। মেয়েটি কিছুই বলল না। অনিকের বুকে এলিয়ে পড়ল। পৃথিবী যেন ঘুমিয়ে গেছে।
কেউ কোন কথা বলল না। আবার ঘোড়ার খুড়ের শব্দ ভেসে এলো। দু’জনে একটা গাছের আড়ালে লুকালো। শুরু হলো বিপরীত দিকে পথ চলা। মাঝে মাঝে মেয়েটি অনিকের হাত ছাড়া হয়ে যায়।
হঠাৎ একটা চিতা ওদের তাড়া করল। অনিকের ডান হাতের পেশী থেকে একখণ্ড মাংস ছিড়ে নিল। ওর সাথে ধস্তা ধস্তি করতে করতে অনিকের অনেক জায়গাই ছিড়ে গেল। মেয়েটি তার আঁচল ছিড়ে অনিকের হাতে ব্যাণ্ডেজ করে দিল।
দু’জনে আরো এগিয়ে গেল।
একটা গর্তের মধ্যে লুকালো। পিস্তলটা এগিয়ে ধরে সেটাকে পর্যবেণ করল। চিতা বাঘটার সময় পিস্তলের কথা ভুলেই গিয়েছিল। চিতার কামড়ে অনিকের সারা গা অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। মেয়েটির কোলে মাথা বিছায়ে অনিক মাটিতে বিছিয়ে পড়ল।
মেয়েটি মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “খুব কষ্ট হচ্ছে?”
“তুমি আছো না?”
“সে কেবল এক রাত্রি। ”
“তারপর?”
“আপনি ফেলে চলে যাবেন। আর আমি আবার ঐ ডাকাত দলের কবলে থাকব। তারপর কি হবে আমি নিজেও জানি না। ”
“আমাকে বিশ্বাস কর?”
“না করলেইবা কি করতে পারব?”
অনিক কোন কথা বলল না।
মেয়েটির পানে তাকিয়ে আছে। আর ভাবল, একটু আগে তুমি কি ছিলে আর এখন কি হয়েছো? এই মূহুর্তে তুমি আমার সবচেয়ে কাছের। তুমি আর আমি সবচেয়ে কাছের মানুষ। মেয়েটি আঁচল দিয়ে অনিকের মুখখানা মুছে দিল।
অনিকের খুব লেগেছে।
তার পরও তা অনুভব করছেনা। পুরুষের কাছে তার সঙ্গিনী থাকলে যে কোন জিনিসই সাধারণ বলে মনে হয়। এ নারীর মতা নয় পুরুষের অহংকার। অনিক বলল, “তেমন কিছুই হয়নি। ”
আবার চিতাটার গর্জন শোনা গেল।
অনিক আবার বেরিয়ে যেতে চাইল। মেয়েটি তাকে বাঁধা দিল। অনিক মেয়েটির দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। মেয়েটি নীরব। ওর চোখে ফুটে উঠছে অন্য রকম ভয়।
ও যেন কিছু একটা হারানোর ভয় পাচ্ছে।
“আমি হারিয়ে যাব না। ”
“সত্যি বলছো। ” কখন যেন মনের অজান্তে তুমি হয়ে গেল।
“এরপরও কি আমি হারাব?”
অনিক বেরিয়ে এলো।
এবার পিস্তলটা শক্ত করে ধরল। চিতাটাকে গুলি ছুড়ল। গুলির আওয়াজে বন কেঁপে উঠল। আবার ঘোড়ার খুড়ের শব্দ ভেসে এলো। দু’জনে প্রাণ পণে ছুটতে চেষ্টা করল।
মেয়েটি হাঁপিয়ে উঠল।
“আর একটু। ”
“আর পারব না। ”
“দু’জনের নতুন সকাল দেখবে না?”
“তুমি নতুন সকাল দেখাবে?”
অনিক মেয়েটিকে আবার জড়িয়ে ধরল। মেয়েটির কপালে একটি চুমু খেল।
“তোমাকে অনন্ত সকাল দেখাব। ’’
“চিরদিন তাই যেন হয়। তোমার চোখেই যেন দেখতে পারি অনন্ত সকালের আলো, নতুন দিনের স্বপ্ন। ” ঘোড়ার খুড়ের শব্দ ভেসে এলো। দু’জনে শুরু করল পথ চলা।
হঠাৎ পায়ের তলার মাটি সরে অনিক গড়িয়ে গেল অনেক দূরে।
ভোর হলো। অনিক দেখল একাকি শুয়ে আছে। সারা দেহে রক্তের দাগ। উঠে মেয়েটিকে খুঁজতে লাগল।
কিছু দূর এগিয়ে গেলে মৃত চিতাটাকে দেখতে পেল। চিতাটার বভেদ হয়ে গুলিটা চলে গেছে অনেক দূর। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখল অচেনা মেয়েটির আঁচল এখনও ব্যাণ্ডেজ হয়ে আছে। ও হাঁটতে হাঁটতে সেই গর্তের মুখের কাছে এলো। মেয়েটির হাতের একটি বালা পড়ে আছে।
ওটাকে হাত দিয়ে নিল। ধীরে ধীরে ওর নষ্ট গাড়িটার দিকে গেল। গাড়িটা নষ্ট হওয়ায় এক রাত্রে তার জীবনে আঁকা হলো এক নতুন ইতিহাস।
তারপর অনেক দিন কাটল। মাস গড়াতে গড়াতে বছর।
বছর থেকে যুগ, যুগ হতে যুগান্তর। অচেনা মেয়েটি লুকিয়ে গেছে কল্পনায় আর স্মৃতিতে।
একদিন গোদাবরী মন্দির থেকে তীর্থ কাজ শেষ করে অনিক দেশের দিকে ফিরছে। হঠাৎ দেখল অচেনা মেয়েটি তার স্বামী সন্তান নিয়ে ঐ মন্দিরে প্রবেশ করছে। ও ঘুরে দাঁড়াল।
মেয়েটির সিঁথির সিঁদুর স্বগর্বে ফুটে উঠছে উন্নত ললাট পরে। মন্দিরে প্রণাম করে স্বামীকে কি যেন বলল। হয়তো স্মৃতির পাতায় ধুলো পড়ে চাপা পড়েছে সে রাতের কথা।
নারীর মনের মাঝে অনেক কিছুই চাপা পড়ে থাকে একটা শক্ত পাথরে। চাপা পড়া কথাগুলো মাঝে মাঝে ঐ ভারী পাথরখানাকে ধাক্কা মারে।
কিন্তু বেরুতে পারে না। সে কেবল পুরুষেরই জন্য। নারী এক পুরুষের জন্য তারা আরেক পুরুষকে চাপা দেয় মনের গহীন অরন্যে। কারণ, কোন পুরুষই চায়না তার প্রিয়ার মাঝে অন্য কেউ প্রিয় হয়ে থাক। কিন্তু কোন পুরুষই জানে না তার প্রিয়ার মাঝে লুকিয়ে আছে আরো প্রিয় কিছু।
মেয়েটিও হয়তো অনিককে ভুলে যায়নি।
অনিক মাঝে মাঝেই সেই বালাটি নিয়ে গোদাবরী মন্দিরে আসে কিন্তু অচেনা মেয়েটি আর কোনদিন এলো না। চিতার পুরাণো কামড়ের দাগ নতুন করে ফুটে উঠছে অনিকের শরীরে।
০৬.০৬.২০০৬ইং
ডায়না প্যালেস
ঢাকা, কেরাণীগঞ্জ-১৩১০।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।