বাবা উচ্চরক্তচাপ জনিত সমস্যায় ভূগছিলেন। বিকেল বেলা হটাৎ তার মুখ বেঁকে যায়। মুখ দিয়ে লালা ঝড়তে থাকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনি অজ্ঞান হয়ে পরে যান। পরে তার ডান হাত ও পা অবশ হয়ে যায়।
অথবা,
ভালো মানুষটা রাতে ঘুমালেন, সকালে উঠে দেখি এক পাশের হাত-পা নাড়াতে পারছেন না।
সাধারণত এরকমই হয়ে থাকে স্ট্রোক আক্রান্ত্ রোগীর আত্মীয়ের রোগী সম্পর্কে বর্ণনা।
পৃথিবিতে প্রতি ছয় সেকেন্ডে একজন স্ট্রোকে মারা যায়। স্ট্রোকের ফলে মানুষ হারাচ্ছে কার্যক্ষমতা এবং ব্যায় হচ্ছে প্রচুর অর্থ। শুধুমাত্র ভুল চিকিৎসার কারনে স্ট্রোক আক্রান্ত্ রোগী হয়ে যাচ্ছে শারিরীক, মানষিক ও কর্মক্ষেত্রে অক্ষম।
আমাদের দেশে প্রচলিত একটি ধারণা আছে, হার্টে বা হৃদপিন্ডে স্ট্রোক হয়। আসলে এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারনা। স্ট্রোক একটি মস্তিস্কের রক্তনালীর জটিলতা জনিত রোগ। আসুন এবার জেনে নেয়া যাক স্ট্রোক কি, কেন হয় এবং স্ট্রোক রোগীর ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপির প্রয়োজনিয়তা সম্পর্কে।
স্ট্রোক কি:
কোন কারনে মস্তিস্কের নিজস্ব রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হওয়ার ফলে স্মায়ুকোষ নষ্ট হয়ে যাওয়াকে স্ট্রোক বলে।
স্ট্রোককে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় সেরিব্রো ভাসকুলার এ্যাকসিডেন্ট বলা হয়। যা বাংলা করলে দাড়ায়, মস্তিস্কের রক্তনালীর দূর্ঘটনা। আমাদের মস্তিস্কের বিভিন্ন জায়গা আমাদের শরীরের বিভিন্ন কাজের জন্য নির্দিষ্ট থাকে। তাই মস্তিস্কের কোথায়, কতটুকু আক্রান্ত্ হয়েছে তার উপর নির্ভর করে স্ট্রোকের ভয়াবহতা।
স্ট্রোকের কারনসমূহ:
সাধারনত দুটি কারনে স্ট্রোক হয়ে থাকেbr /> ১. মস্তিস্কের রক্তনালীতে কোন কিছু জমাট বাধলে: যার ফলে রক্তের নালীকা বন্ধ হয়ে যায় এবং মস্তিস্কের আক্রান্ত্ অংশের স্মায়ুকোষগুলো অক্সিজেনের অভাবে মারা যায়।
২. মস্তিস্কে রক্তক্ষরন ঘটলে: উচ্চ রক্তচাপ এই স্ট্রোকের অন্যতম কারন যেখানে ছোট ছোট রক্তনালীকা ছিড়ে রক্তক্ষরন হয়, ফলে মস্তিস্কের মধ্যে চাপ বেড়ে যায় এবং অক্সিজেনের অভাবে মস্তিস্কের স্মায়ুকোষগুলো মারা যায়।
স্ট্রোক এর প্রাথমিক উপসর্গ সমূহ:-
US. National Institute of Neurological Disorder and stroke এর মতে স্ট্রোকের প্রাথমিক ৫ টি উপসর্গ দেখা যায়br /> ১. হঠাৎ অতিরিক্ত মাথা ব্যথা।
২. হঠাৎ মুখ, হাত ও পা অবশ হয়ে যাওয়া (সাধারণত শরীরের যে কোন এক পাশ)। অনেক সময় মুখের মাংস পেশি অবশ হয়ে যায়, ফলে লালা ঝড়তে থাকে।
৩. হঠাৎ কথা বলতে এবং বুঝতে সমস্যা হওয়া।
৪. হঠাৎ এক চোখে অথবা দুই চোখে দেখতে সমস্যা হওয়া।
৫. হঠাৎ ব্যালেন্স বা সোজা হয়ে বসা ও দাড়াতে সমস্যা হওয়া, মাথা ঘুরানো এবং হাটতে সমস্যা হওয়া।
স্ট্রোক পরবর্তী সমস্যা:
শরীরের এক পাশ অথবা অনেক সময় দুই পাশ অবশ হয়ে যায়, মাংসপেশীর টান প্রাথমিক পর্যায়ে কমে যায় এবং পরে আস্তে আস্তে টান বাড়তে থাকে, হাত ও পায়ে ব্যথা থাকতে পারে, হাত ও পায়ের নড়াচড়া সম্পূর্ন অথবা আংশিকভাবে কমে যেতে পারে, মাংসপেশী শুকিয়ে অথবা শক্ত হয়ে যেতে পারে, হাটাচলা, উঠাবসা, বিছানায় নড়াচড়া ইত্যাদি কমে যেতে পারে, নড়াচড়া কমে যায় যার ফলে চাপজনিত ঘা দেখা দিতে পারে, শোল্ডার বা ঘাড়ের জয়েন্ট সরে যেতে পারে ইত্যাদি।
স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়:-
বয়স সাধারণত ৫০ এর উপরে হলে, বংশে স্ট্রোক রোগী থাকলে, উচ্চ রক্তচাপ থাকলে, উচ্চ কোলস্টেরল লেভেল থাকলে, ধূমপায়ী হলে, ডায়াবেটিস থাকলে, ইতিপূর্বে একবার স্ট্রোক করলে, অ্যালকোহলিক হলে, রক্তের নালীকাতে কোন সমস্যা থাকলে।
স্ট্রোক প্রতিরোধের উপায়:
উচ্চ রক্তচাপ সর্ম্পকে জানা, রক্তনালীর কোন ধরনের সমস্যা থাকলে তার চিকিৎসা করা, ধূমপান বন্ধ করা, কোলস্টেরল, সোডিয়াম এবং ফ্যাটের পরিমান নিয়ন্ত্রনে রাখা, চর্বি ও শর্করা জাতীয় খাবার (যেমন: ফাষ্টফুড, মাখন, ঘি, মিষ্টি, পোলাও, গরু-খাশির গোশত, চিংড়ি, ডিমের কুসুম ইত্যাদি) কম খাওয়া, অ্যালকোহল সেবন থেকে বিরত থাকা, ডায়াবেটিস এর সঠিক চিকিৎসা করা, নিয়মিত ৪৫ মিনিট হাঁটা বা ব্যায়াম করা, অতিরিক্ত ঔষধ সেবন না করা।
চিকিৎসা পদ্ধতি:
একজন স্ট্রোক রোগীর চিকিৎসার জন্য মাল্টি ডিসিপিস্ননারি টিম (MDT) পদ্ধতিতে চিকিৎসা প্রয়োজন। এই টিমে থাকেন নিউরোলজিষ্ট, জেনারেল ফিজিশিয়ান, ফিজিওথেরাপিষ্ট, অকুপেশনাল থেরাপিষ্ট, নার্স, ভোকেশনাল ট্রেইনার ইত্যাদি। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, ঔষধ স্ট্রোক রোগীকে মেডিকেলি ষ্ট্যাবল করতে পারলেও তার শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে পারে না। স্ট্রোক পরবর্তী সমস্যাগুলো দূর করে শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজন সঠিক ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা। তাই রোগী স্ট্রোকে আক্রান্ত্ হলে যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাবেন এবং ২৪ ঘন্টার ভেতরে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা শুরু করার ব্যাপারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে নিশ্চিত করবেন।
যদি সেই হাসপাতালে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা না থাকে, তাহলে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা সমৃদ্ধ যে কোন হাসপাতাল, ক্লিনিক বা চেম্বারের সাথে কথা বলুন। প্রয়োজনে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা ও পূণর্বাসনে অন্যতম সিআরপি: সাভার, মিরপুর, সিলেট, চট্টগ্রাম শাখায় যোগাযোগ করুন। মনে রাখবেন, স্ট্রোকের পর যত দ্রুত ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা শুরু করা যাবে, রোগীর কার্যক্ষমতা ফিরে আসার সম্ভাবনা তত বেশি থাকে।
স্ট্রোকের পরবর্তী ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা:
একজন ফিজিওথেরাপিষ্ট রোগীর রোগ বর্ণনা, ফিজিক্যাল টেষ্ট, ফিজিওথেরাপিউটিক স্পেশাল টেষ্ট, বিভিন্ন রেডিওলজিক্যাল টেষ্ট এবং প্যাথলজিক্যাল টেষ্ট এর মাধ্যমে কি ধরনের স্ট্রোক হয়েছে এবং শারিরীক সমস্যা সূমহ নির্ণয় করে থাকেন। অত:পর রোগীর সমস্যানুযায়ী চিকিৎসার পরিকল্পনা বা ট্রিটমেন্ট প্লান করেন এবং সেই প্লান অনুযায়ী নিন্মোক্ত পদ্ধতিতে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা সেবা প্রদান করে থাকেন।
স্ট্রোকের প্রাথমিক অবস্থায় ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা :
ঙ্ শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করণ
ঙ্ সঠিক পজিশনিং
ঙ্ মাংস পেশীর স্বাভাবিক দৈর্ঘ্য বজায় রাখা
স্ট্রোকের ২-৩ সপ্তাহ পর ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা:
ঙ্ মাংস পেশীর স্বাভাবিক টান ফিরিয়ে আনা
ঙ্ শরীরের স্বাভাবিক অ্যালাইনমেন্ট ফিরিয়ে আনা
ঙ্ শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টের স্বাভাবিক নাড়ানোর ÿমতা বা মুভমেন্ট ফিরিয়ে আনা
ঙ্ ব্যালেন্স ও কো-অরডিনেশন উন্নত করা
ঙ্ স্বাভাবিক হাঁটার ÿমতা ফিরিয়ে আনা
ঙ্ রোগীর কর্মদÿতা বাড়ানো
ঙ্ রোগীর মানষিক অবস্থা উন্নত করা
ঙ্ রোগীকে সমাজের মূল স্রোতে ফিরে যেতে সাহায্য করা
পূনশ্চ:
রোগীর শারিরীক সমস্যা দুর করে কার্যক্ষমতা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার ভূমিকা অপরিসীম। তবে ফিজিওথেরাপি'র নামে শুধূমাত্র মেশিন যেমন: হিট, ভাইব্রেশন, ইলেকট্রিক্যাল ষ্টিমুলেশন ইত্যাদি ব্যবহার করে যে অপচিকিৎসা দেয়া হয় তা থেকে বেঁচে থাকাই ভালো। সঠিক ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নিন, সুস্থ থাকুন।
ডাঃ নুরজাহান আক্তার শাপলা
ক্লিনিক্যাল ফিজিওথেরাপিষ্ট,
স্ট্রোক রিহ্যাবিলিটেশন ইউনিট,
ফিজিওথেরাপি বিভাগ, সি. আর. পি.
সাভার, ঢাকা। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।