আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্ট্রোক ঃ প্রতিরোধ করুন মূর্তমান আতঙ্ক



আমজাদ হোসেন। ৬৫ বছরের বিপতœীক অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার। ছেলেমেয়েরা সবাই প্রতিষ্ঠিত, দেশের বাইরেও থাকে কয়েকজন। তাদের নিয়ে বেশ দুচিন্তা করেন তিনি। বেশ বয়সে এসে রোগ তার পিছু ছাড়ছেই না।

এ বয়সে তাকে প্রতিদিন মুঠো ভরে ওষুধ খেতে হয়। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্টের অসুখ আরোও কত কি। মাঝে মাঝে জীবনটা বিস্বাদ লাগে তার কাছে। ওষুধ খেতেও ভাল লাগে না। মাঝে মাঝে ওষুধ জালানা দিয়ে ফেলেও দেন তিনি।

চিকিৎসকরা শত চেষ্টা করেও তার উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস কনট্রোল করতে পারেন না। ওষুধ জানালা দিয়ে ফেললে নিয়ন্ত্রন হবেই বা কেমনে? একদিন রাত তিনটার দিকে হঠাৎ শরীরের ডানপাশ অবস হয়ে আসে, কথা বলতে গেলে জড়িয়ে যায়, অজ্ঞান হওয়ার মত অবস্থা হয়, বমিও করেন কয়েকবার। ছোট ছেলে তার বন্ধু চিকিৎসককে রাত তিনটায় ফোন দিয়ে জাগালে চিকিৎসক বন্ধু আমজাদ হোসেনকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে বলেন। হাসপাতালে ভর্তি করলে সিটি স্ক্যান করে দেখা যায় তার মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ কমে গেছে। চিকিৎসকরা বললেন স্ট্রোক করেছেন আমজাদ হোসেন।

হাসপাতালে বেশ কিছু দিন ভর্তি রেখে চলে চিকিৎসা। কথা আগের চেয়ে ভাল বলতে পারলেও হাত দিয়ে কোন কিছু ধরতে পারেন না। হাটতেও পারেন না ঠিকমত। চিকিৎসকরা বললেন ফিজিওথেরাপি করাতে হবে। একজন ফিজিওথেরাপিস্টের তত্বাবধায়নে চলে থেরাপি।

বেশ কয়েকমাস থেরাপি করলে তার অবস্থা কিছুটা ভাল হলেও পুরোপুরি ভাল হতে কত দিন লাগবে তা জানেন না কেউ। বাসায় বসে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রমত ওষুধ ও ফিজিওথেরাপি করে জীবনামৃত সময় পার করছেন আমজাদ হোসেন। দেশে এ রকম কত আমজাদ হোসেন আছেন তা আমাদের জানা নেই। আমজাদ হোসেনের মত অনেকের কাছে স্ট্রোক একটি মুর্তমান আতঙ্ক। আমেরিকার মৃত্যুর তৃতীয় কারন স্ট্রোক।

প্রতিবছর ৭ লাখ লোক স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ১ লাখ ৬০ হাজার মারা যায়। আমাদের দেশেও এ সংখ্যা কিন্তু কম নয়। স্ট্রোকে আক্রান্তদের দুই-তৃতীয়াংশই মারা যান বা চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান। দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে স্ট্রোকের ঝুকি অনেক বেশি। সহজ করে বলতে গেলে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল কমে গেলে ও অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দিলে মস্তিষ্কের কোষগুলো মারা যেতে শুরু করে।

একে বলে স্ট্রোক বলা হয়। স্ট্রোক দুই প্রকার। একটিকে বলে ইসকেমিক স্ট্রোক। এক্ষেত্রে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল কমে যায়। সাধারনত রক্তনালীর ভেতর জমাটবাধা রক্তপিন্ড এ সমস্যা করে থাকে।

মোট স্ট্রোকের শতকরা ৮০ ভাগই এ ধরনের স্ট্রোক। অপরটি হল হেমোরেজিক স্ট্রোক। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরন হলে এটি দেখা যায়। স্ট্রোকের আগেই বুঝুন আপনি স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন ঃ মস্তিষ্ক সঠিকমাত্রায় অক্সিজেন না পেলে কিছু সর্তকতামুলক লক্ষণ দেখায়। এগুলো হল হঠাৎ করে শরীরের যেকোন একপাশে দুর্বলতা অনুভুত হওয়া ও অবস হয়ে যাওয়া, হঠাৎ করে কথা বলতে সমস্যা হওয়া, হঠাৎ করে এক বা দু চোখে দেখতে সমস্যা হওয়া, হাঁটতে না পারা, শরীরের ভারসাম্য ধরে না রাখতে পারা, কোন কারন ছাড়া প্রচন্ড মাথাব্যথা হওয়া।

এছাড়াও হতে পারে বমি বমি ভাব বা বমি, ঘুম ঘুম ভাব, চোখে একটি জিনিস দুটি দেখা। এ লক্ষণগুলো দেখা দিলে অতি দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। দ্রুত চিকিৎসকের শরনাপন্ন হলে স্ট্রোকের জটিলতা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। অনেক সময় এ লক্ষনগুলো কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘন্টা পর্যন্ত থাকতে পারে। ২৮ ঘন্টা পর আক্রান্ত ব্যাক্তি আপনা-আপনি ভাল হয়ে যান।

এ সময় পর রোগী পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়। এটাকে বলে ট্রানজিয়ান্ট ইসকেমিক ্অ্যাটাক, সংক্ষেপে টিআইএ। অনেকে এটাকে আমলে আনতে চান না। এটাও কিন্তু এক ধরনের মিনি স্ট্রোক। এক্ষেত্রেও আক্রান্ত ব্যক্তিকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

ঝুকিপূর্ণ যারা ঃ বয়স্ক ও পুরুষ ব্যক্তি, বংশে স্ট্রোক আক্রান্ত কেউ থাকলে, পূর্বে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও এমবলিজম হলে তাদের স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এগুলো কখনও পরিবর্তন করা যায় না। কিন্তু দুচিন্তার কারন নেই। সঠিক জীবন পদ্ধতি মেনে চললে স্ট্রোক থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। যাদের উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের অসুখ যেমন, হার্ট ফেইলুর, এনডোকার্ডাইটিস, অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন, ডায়াবেটিস, শরীরে লিপিড, কোলস্টেরল বেশি , ধুমপায়ী, মদ্যপায়ী, রক্তরোগ- পলিসাইথেমিয়া, জন্মনিয়ন্ত্রন পিল খেলে স্ট্রোকের ঝুকি অনেকাংশে বাড়ে।

এ সমস্যাগুলো কিন্তু সহজেই নিয়ন্ত্রন করা যায়। প্রতিরোধ করুন স্ট্রোক ঃ ধুমপান পরিহার করুন ঃ গবেষনায় দেখা গেছে, ধুমপান করলে স্ট্রোকের ঝুঁকি দ্বিগুন বৃদ্ধি পায়। ধুমপানের ফলে রক্তনালীতে চর্বি জমা হয়ে রক্তনালী বন্ধ করে দেয়। ফলে মস্তিষ্কে পরিমিত রক্ত পৌছুতে পারে না। মস্তিষ্কে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়।

সিগারেটের নিকোটিন রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়, রক্তে কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমান বাড়িয়ে অক্সিজেনের পরিমান কমিয়ে দেয় ও রক্তের ঘনত্ব বাড়িয়ে রক্তপিন্ড তৈরীতে ভুমিকা পালন করে। চিকিৎসকদের মতে যে কোন বয়সেই ধুমপান ত্যাগ করা হোক না কেন তা স্ট্রিাকের ঝুকি কমায়। শুধু তাই নয় স্ট্রোক ছাড়ায় ফুসফুস, হার্ট ও বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তাই আর দেরী নয় আজই ধুমপান ত্যাগ করুন। নিয়ন্ত্রন করুন উচ্চ রক্তচাপ ঃ উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রন করুন।

রক্তচাপ স্বাভাবিকের মধ্যে রাখুন। এজন্য অতিরিক্ত লবন পরিহার করুন, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করুন ও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে নিয়মিত ওষুধ সেবন করুন। হার্টের রোগের চিকিৎসা নিন ঃ হার্ট অ্যাটাক, অনিয়ন্ত্রিত হৃদস্পন্দন, হার্ট বড় হয়ে গেলে, ভাল্বের সমস্যা ইত্যাদি কারনে রক্তজমাট বেঁধে রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। তাই এ রোগগুলোর চিকিৎসা করান। রক্তজমাট বাধা প্রতিরোধে আপনাকে অ্যাসপিরিন খেতে হতে পারে।

এ ব্যাপারে আপনার চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নিবেন। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখুন ঃ ডায়াবেটিসে রক্তের শর্করা ঠিকমত ব্যবহার হতে পারে না। ফলে রক্তে শর্করার পরিমান বেড়ে যায়। গবেষনায় দেখা গেছে, স্ট্রোকের সময় রক্তে শর্করার পরিমান বেশি থাকলে মস্তিষ্কে কোষ বেশি পরিমানে ধ্বংস হয়। এছাড়াও ডায়াবেটিসের কারনে রক্তনালীতে চর্বি জমে যায়।

ফলে রক্তনালী সরু হয়ে রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। চিকিৎসকের পরামর্শমত পরিমান মত খাবার গ্রহন, নিয়মিত ওষুধ সেবন করুন আর শৃংখলা মেনে চলুন, মিষ্টি জাতীয় খাবার কম খান ও ানয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখুন। পুষ্টিকর খাবার খান ঃ প্রচুর শাকসবজী ও ফলমুল খান। প্রতিদিনের খাবারে পাচ ভাগের একভাগ ফলমুল ও শাকসবজী খান। রেড মিট যেমন, গরু, ছাগল, ভেড়ার মাংস খাবেন না।

চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করুন। এতে বেশি স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে যেটা ধমনীতে চর্বির আস্তরন পড়তে সহায়তা করে। লবন রক্তচাপ বাড়ায়। লবন খাবেন না। আঁশযুক্ত খাবার বেশি বেশি করে খান।

কমিয়ে ফেলুন শরীরের অতিরিক্ত ওজন। অতিরিক্ত খাবার খাবেন না। এতে শরীরে মেদ জমবে। খাবার খান শারীরিক পরিশ্রমের সাথে মিল রেখে। পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার যেমন সবুজ শাকসবজী, সয়াবিন তেল, মাছের যকৃত খান।

ব্যায়াম করুনঃ গবেষনায় দেখা গেছে যারা প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে ৫ ব্যায়াম করে তাদের রক্তচাপ, রক্তে কোলস্টেরলের মাত্রা কমে ও ওজন নিয়ন্ত্রনে রেখে স্ট্রোকের ঝুকি কমায়। হাটা ভাল ব্যায়াম। হাটার অভ্যাস গড়ে তুলুন। প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময় মেনে হাটুন। সপ্তাহে কমপক্ষে ৩ থেকে ৫ মাইল হাটুন।

এছাড়াও সাতার কাটা, সাইকেল চালানো, নাচা, টেনিস, গলফ খেলতে পারেন। প্রথমদিকে খুব বেশি ব্যায়াম করবেন না। ধীরে ধীরে ব্যায়ামের পরিমান বাড়িয়ে ৩০-৪০ মিনিট করতে পারেন। ব্যায়ামের আগে হালকা ব্যায়াম করুন। ব্যায়ামের সময় বুকে ব্যথা, মাথা ঝিম ঝিম ও শ্বাসকষ্ট হলে ব্যায়াম বন্ধ করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

শারীরিক পরিশ্রম করুন। লিফটে না ওঠে হেটে উঠুন, গাড়ীতে না চড়ে হাটার অভ্যাস করুন, পথের আগেই বাস থেকে নেমে হেটে চলুন। মানসিক চাপ কমানঃ অতিরিক্ত দুঃচিন্তা, রাগ-ক্ষোভ, মানসিক চাপ থেকেও হতে পাওে বিভিন্ন হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাক। গবেষনায় দেখা গেছে রাগী ও টাইপ-এ ব্যক্তিরা বেশি হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হন। তাই রাগ কমান, কমিয়ে ফেলূন মানসিক চাপ।

জোর কওে হলেও হাসুন প্রান খুলে। মেডিটেশন করতে পারেন। এত কমবে মানসিক চাপ, বাড়বে আত্মবিশ্বাস। রক্তে কোলস্টেরল কমিয়ে ফেলুনঃ রক্তে কোলস্টেরল বেশি হলে রক্তনালীতে চর্বি জমে রক্তনালী বন্ধ হয়। সুস্থ মানুষের ১ ডেসিলিটার রক্তে কোলস্টেরলের পরিমান ২০০ মিলিগ্রেিমর কম, ভাল চর্বি বা এইচ ডি এল ( যা হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করে)-এর পরিমান ৪০ মি.গ্রা এর বেশি ও খারাপ চর্বি বা এল ডি এল ( যা হার্ট অ্যাটাকের ঝুকি বাড়ায়) এর পরিমান ১৬০ মি.গ্রামের কত থাকে।

এর মধ্যে রাখুন কোলস্টেরলের মাত্রা। তাই স্যাচুরেটেড ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার যেমন গরু বা খাসি বা পাতিহাঁস, শুকুরের মাংস, চিজ, বিভিন্ন ধরনের কেক, আইসক্রিম, ইয়োগাট, কনডেন্সড মিল্ক ও কোলস্টেরল সমৃদ্্যধ খাবার ডিমের কুসুম, চুপড়ি আলু, বিভিন্ন প্রানী মস্তিষ্ক ও যকৃত, চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করুন। এয়াড়াও নিয়মিত ব্যায়াম করুন। আর তাতেও যদি রক্তে কোলস্টেরল না কমে তবে চিকিৎসকের পরামর্শমত ওষুধ খেতে হবে। মদপান ত্যাগ করুন।

জন্মনিয়ন্ত্রন পিল ঃ পিল রক্তকে ঘন ও জমাট বেধে ফেলতে পারে। সেই সাথে রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। পিল সেবনের আগে চিকিৎসকের শরনাপন্ন হোন। প্রতিরোধ করুন দ্বিতীয় স্ট্রোক ঃ একবার স্ট্রোক হলে স্ট্রোকের ঝুকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। আমেরিকার ৭ লক্ষ স্ট্রোক আক্রান্তের শতকরা ৫-১৪ ভাগ এক বছরের মধ্যে ও ২৪ ভাগ মহিলা ও ৪২ ভাগ পুরুষ পরবর্তী পাচ বছরের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়।

দ্বিতীয়বার স্ট্রোক প্রতিরোধের জন্য উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলস্টেরল, ডায়াবেটিস, হার্টের অসুখের জন্য চিকিৎসকের দেয়া ওষুধ সেবন করুন ও এ রোগগুলো নিয়ন্ত্রনে রাখুন। রক্ত জমাট বাধা প্রতিরোধে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে অ্যাসপিরিন, ক্লোপিডগরেল, টাইক্লোপিডিন জাতীয় ওষুধ সেবন করুন। ব্যায়াম করুন, লবন কম খান, ধুমপান ও মদপান ত্যাগ করুন। পরিবারের সদস্যদের লক্ষ্য রাখতে হবে আক্রান্ত ব্যক্তি যেন ওষুধ সেবনে অনিয়ম না করেন।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.