আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শয়তান

আমি আঁধারে তামাসায় ঘেরা জীবন দেখেছি, আমার বুকের ভেতর শূন্যতা থেকে শূন্যরা এসে বাসা বেঁধেছে, আমি খুঁজেছি তোমাকে সেই আঁধারে আমার মনের যত রঙলীলা; আজ সাঙ্গ হতেছে এই ভবের বাজারে। রাতের বেলা লিয়াকত সাহেবের ঘুম পায়না। তিনি বাড়ির ভেতর হাটা চলা করেই রাত কাটিয়ে দেন। মাঝে মাঝে রাস্তায় নেমেও হাটেন তবে সেটা খুব কমই করে থাকেন। কুকুর ভীষণ ভয় পান তিনি।

আর রাতের বেলা কুকুরগুলো যেভাবে রাস্তা দখল করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে বেড়ায় সেখানে লিয়াকত সাহেবের মত রীতিমত একজন কুকুর ভীতু লোকের পক্ষে রাতের রাস্তায় হাটা চলা করা একটি ভয়ংকর ব্যাপার হয়ে দাড়ায়। বয়স বাষট্টি বছর। কিছু দিন হল চাকরী হতে অবসর নিয়েছেন। এখন এই অলস সময়গুলোতে সময় কাটানো ভীষণ কষ্টকর একটি ব্যাপার তার কাছে। জীবন অসহনীয় হয়ে উঠেছে মাত্র এই অল্প কিছু দিনের মধ্যেই।

সারারাত না ঘুমিয়ে সারাদিন পরে পরে ঘুমানো একটি নিয়মিত অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। এই ব্যাপারে তার দর্শনটি চমৎকার। সারারাত নাঘুমানো তার শুধু মাত্র সারাদিনের অবসর সময়গুলো নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়ার জন্যই। এতে করে তার অলস সময়গুলো সুন্দর কেটে যায়। অফিসের প্রতি মায়া ভুলে থাকতে পারেন।

প্রায় পঁয়ত্রিশ বছরের চাকরী জীবনের মায়া কি আর এত সহজেই ভোলা সম্ভব। লিয়াকত সাহেবের স্ত্রী মারা গেছেন তা আজ প্রায় আট বছর হলো। হৃদপিণ্ডের ধমনীগুলো সঙ্কুচিত হয়ে একসময় রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। একটি সরকারী অফিসের সাধারন কেরানী হিসেবে আর কতইবা বেতন পেতেন যা দিয়ে স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে পারতেন। যেখানে সামান্য সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হতো সেখানে স্ত্রীর চিকিৎসা করানো তার পক্ষে সম্ভব ছিলোনা।

অবশ্য এ নিয়ে তার স্ত্রীর মনে কোন প্রকার ক্ষোভ ছিলোনা। শুধু মৃত্যুর আগে বলে গিয়েছিলেন তাদের একমাত্র মেয়েটিকে একটি ভাল ছেলে দেখে যেন তিনি বিয়ে দেন। কিন্তু লিয়াকত সাহেব সেই প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেন নাই। মা মারা যাওয়ার পর থেকে মেয়েটি একটু বড় বেশী অভিমানী হয়ে উঠেছে। কোন কিছুকেই সহজ ভাবে মেনে নিতে পারেনা।

এইতো কিছুদিন আগেও একটি বিয়ের প্রস্তাব এনেছিলো পাশের বাড়ির খোকন সাহেব তার ছেলের জন্য। লিয়াকত সাহেব ছেলেটিকে তেমন পছন্দ করতেন না। এলাকার মাস্তান হিসেবে বেশ নাম ডাক রয়েছে ছেলেটির। শুধু মাত্র এলাকায় থাকেন তাই ভদ্রতার খাতিরে ছেলেটির কাছে মেয়েটিকে দেখাবেন বলে রাজী হলেন। চন্দ্রাকে সেদিন সন্ধ্যায় দেখতে এসেছিলো ছেলে পক্ষ।

কিন্তু সে মেহমানদের চায়ে মরিচ দিয়ে একটি অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করল যেন ছেলে পক্ষ সেখান থেকে ভেগে যায়। আর হলও তাই। বিয়ে ভেঙ্গে গেলো। কিন্তু এক ধরনের চাপা ক্ষোভ রয়ে গেলো ছেলেটির ভেতর। এর শোধ একদিন সুযোগ বুঝে সে নিবেই এই আসায় অপেক্ষা করতে থাকল।

তবে মেয়ের বিয়ে নিয়ে লিয়াকত সাহেব মোটেও বিচলিত নন। বরং তিনি বিষয়টিকে বেশ উপভোগ করছেন। রাত জেগে জেগে তার মাথায় অদ্ভুত এক খেয়াল চেপে বসেছে। তিনি ঈশ্বরকে দেখতে চান। কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব হবে তাই নিয়েই তিনি ব্যাস্ত থাকেন সবসময়।

ধর্মীয় আর বিজ্ঞান বিষয়ক কিছু বই কিনে এনেছেন। ছোট খাটো একটা গবেষণার কেন্দ্রে পরিনত করে ফেলেছেন তার শোবার ঘরটিকে। কিন্তু চন্দ্রার এসব কিছু নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই। সেও কিছুটা গবেষণা কেন্দ্রিক হয়ে পরেছে তবে তার গবেষণার বিষয় হল শয়তান নিয়ে। তার খুব ইচ্ছে জীবনে একবার হলেও শয়তানের মুখোমুখি বসে প্রেম নিবেদন করা।

তার শোবার ঘরের দেয়ালে আগে যেখানে বাবা-মার একটি যৌথ ছবি ঝুলানো ছিলো সেখানে এখন শোভা পাচ্ছে বাফোমেটের ছবি। ঘর ভর্তি মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে থাকে সিগারেটের ফিল্টার আর ছাই। ইদানীং ধূমপান করতে বেশ ভালই লাগে তার। মাঝে মাঝে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়ে রাতের বেলা মোমবাতি জ্বালিয়ে মোমবাতির সামনে বসে থেকে ধ্যান করে। চন্দ্রা মনে করে এভাবেই হয়ত সে একদিন শয়তানের দেখা পাবে।

হঠাত করে লিয়াকত সাহেবের মাথায় ভূত চাপল তিনি কিছুদিন দূরে কোথাও হতে ঘুরে আসবেন। অতপর এক সকালে অজানার পথে যাত্রা শুরু করলেন। তিনি পৌঁছালেন পাহাড়ি একটি এলাকায়। একটি কুঁড়ে ঘর ভাড়া নিয়ে নিলেন কিছুদিনের জন্য। এখানে হোটেল বলতে ছোট ছোট কুঁড়ে ঘরকেই বোঝায়।

প্রতিদিন তাকে একটি পাহাড়ি মেয়ে এসে খাবার দিয়ে যায়। মেয়েটির নাম সুনেতা। চারিদিকে উঁচু উঁচু পাহাড়। পুরো পাহাড়ি এলাকা জুড়ে অনেক রকম গাছপালা আর দুই পাশের পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে বয়ে চলে গেছে সরু একটি নদী। নদীর গভীরতা খুব কম।

নীচে পাথর জমে জমে এই অবস্থা হয়েছে। পানি এতই স্বচ্ছ যে পাথরগুলো স্পষ্ট দেখা যায়। পানির শীতলতা লিয়াকত সাহেবকে ভীষণ মুগ্ধ করেছে। তিনি এই জায়গাটিকে তার মেয়ে চন্দ্রার সাথে তুলনা করে ফেললেন। চন্দ্রার রূপেও যেন এমন এক পাহাড়ি মায়া বিদ্যমান।

জায়গাটা অপরিচিত বলে তিনি সুনেতাকে তার গাইড হিসেবে পেতে চাইলেন। সুনেতাও খুসি মনে রাজী হয়ে গেলো। এমনই একদিন ঘুরতে ঘুরতে তারা এমন এক গভীর জঙ্গলে যেয়ে পৌঁছালো যে রাত হয়ে এলো। রাতের এই অন্ধকারে এতটা দূরের পথে ফিরে না গিয়ে অগ্যতা সেখানেই রাত কাটানোর জন্য মন স্থির করল তারা। এমনিতেই পাহাড়ি এলাকা তার উপর আবার জঙ্গল।

বড় বড় মশার কামড়ে অস্থির হয়ে গেলেন লিয়াকত সাহেব। কিন্তু সুনেতার কোন সমস্যা হচ্ছেনা। তার এভাবে এমন অনেক রাত কাটিয়ে অভ্যাস আছে। রাতের শেষ ভাগে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাস প্রবাহিত হওয়া শুরু হল। লিয়াকত সাহেবের শরীরে ভীষণ জ্বর জ্বর অনুভূত হল।

জ্বর চলেও এলো। জ্বরের তীব্রতা বেড়েই চলল। মনে হল এই বুঝি তার শেষ সময় ঘনিয়ে এসেছে। এবার বুঝি আর রক্ষা নেই। সুনেতা এই ঘুট ঘুটে অন্ধকার রাতেও অনেক দূর হতে সাথে করে নিয়ে আসা পানির বোতলে করে পানি এনে মাথায় পানি পট্টি দিতে লাগল।

এভাবে কখন যে ভোর হয়ে এলো সুনেতা টের পায়নি। ভোরের দিকে লিয়াকত সাহেবের জ্বর কমে এলো। সুনেতার কাঁধে ভর দিয়ে তিনি ফিরলেন। পাহাড়ি উঁচু নিচু এমন ভয়কর পথ যেখানে সামান্য অসাবধানতায় কয়েকশ ফুট উপর থেকে পরে গিয়ে মৃত্যু ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই সেই পথ শুধুমাত্র সুনেতার কাঁধে ভর দিয়ে চলতে চলতে তিনি ভাবলেন এইতো তার ঈশ্বর। এই ঈশ্বরের সাথে যদি জীবনের শেষ কয়েকটা দিন কাটিয়ে দেয়া যেত তবে মরে গিয়ে দোযখ পেলেও তার আর কোন আফসোস থাকবেনা।

ওদিকে একা একা চন্দ্রার দিনগুলো বেশ কেটে যাচ্ছে। যেন বহুদিন ধরেই এমন একটি ঘরের সন্ধান সে করছিলো। এক রাতের বেলা প্রতিদিনের মত ঘরের বাতি নিভিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে ধ্যানে বসল সে। কিছুক্ষন এভাবে ধ্যানে থাকার পর পেছন থেকে দুটি হাত এসে তাকে স্পর্শ করল। চোখ বন্ধ করে রেখেই চন্দ্রা ভাবল আজ তার সাধনা পূর্ণ হয়েছে।

শয়তান এসেছে তার ডাকে সাড়া দিয়ে। সেই অচেনা দুটি হাতের কাছে চোখ বন্ধ রেখেই নিজেকে সম্পূর্ণ বিলিয়ে দিল চন্দ্রা। এভাবেই রাত কেটে গেলো তাদের। খুব ভোর বেলা লিয়াকত সাহেব ফিরলেন সাথে সুনেতা নিয়ে। তিনি সুনেতাকে বিয়ে করেছেন।

এই নিয়ে বেশ উৎফুল্ল মেজাজেই তিনি কলিং বেল চাপলেন। তার বিশ্বাস তার মেয়ে এই বিয়েকে খুব সহজ ভাবেই মেনে নেবে। কিছুক্ষন কলিং বেল চাপার পর ভেতর থেকে কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে তিনি দরজায় ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেলো। তিনি ভাবলেন না মেয়েটি এত বড় হয়েগেছে তবু মাথায় এখনো কোন বোধ জ্ঞান হলনা। তিনি মেয়েকে আজ কঠিন ভাবে বকাঝকা করবেন এই বিষয়ে তাই চিৎকার করতে করতে মেয়ের ঘরে প্রবেশ করলেন।

ঘরের মেঝেতে রক্তাক্ত সম্পূর্ণ নগ্ন নিথর দেহ পরে আছে চন্দ্রার। পুরো শরীরে আঘাতের চিহ্ন। লিয়াকত সাহেব মেয়ের এমন পরিনতি দেখে শুধু একবার অস্পষ্ট কণ্ঠে বলে উঠলেন শয়তান। ------------------------------------------------------------------- আজ বহুদিন পর আমার একটি পুরানো ডায়েরি নিয়ে পড়তে বসেছিলাম। তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি।

সে সময়ের আমার লেখা এই গল্পটি পড়ে ভীষণ নষ্টালজিক হয়ে পরলাম। গল্পটি কোন ভাবনা থেকে লিখেছিলাম মনে করতে পারছিনা তবে ঠিক এই প্লটেই নতুন করে একটি গল্প লেখার ইচ্ছে হলো। যদি লেখা শেষ করতে পারি তবে ব্লগে পোস্ট দেয়ার ইচ্ছে রইল। তাই এখন এই পুরানো গল্পটি ব্লগে প্রকাশ করার লোভ কিছুতেই সংবরণ করতে পারলাম না।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।