আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সংবাদপত্রের পাঠক শ্রেণীবিভাগ

শফিক হাসান সাক্ষর মানুষমাত্রই সংবাদপত্র পাঠক! এমন কাউকে পাওয়া যাবে না, যিনি সাক্ষর হওয়া সত্ত্বেও সংবাদপত্র পড়েননি বা পড়তে পছন্দ করেন না! পত্রিকার পাঠকেরও যে নানা শ্রেণী বিভাগ আছে_ কে কোন ধরনের খবর পড়তে পছন্দ করেন তা কি কখনও ভেবে দেখেছি? বিনোদনের পাঠক এ শ্রেণীর পাঠকের কাছে সংবাদপত্র মানেই বিনোদনের আকর। এরা বেছে বেছে সেই পত্রিকাটাই রাখে যে পত্রিকার প্রথম পাতায় মাস্ট হেডে বিনোদন দুনিয়ার তারকাদের খবর ও ছবি ছাপা হয়। তারকাদের ঝলমলে, চটকদার ছবিতে খুব সহজেই অভিভূত হয় এরা। কোন তারকা কোথায় আছাড় খেলেন, কে লুকিয়ে-চুরিয়ে প্রেম করছেন কিন্তু মিডিয়ার কাছে মুখ খুলছেন না, কে এক মাসের ছুটিতে বেড়াতে যাচ্ছেন_ সবকিছুই এ শ্রেণীর পাঠকের মুখস্থ। শুধু তারা বলতে পারে না, বৃদ্ধা মা ঠিকমতো ওষুধ খেয়েছেন কি-না, ছোট বোনটা স্কুল থেকে ফিরেছে কি-না, নিজের কর্তব্যকর্মটুকু যথাযথভাবে পালিত হয়েছে কি হয়নি ...।

সেটা না পারুক, কিন্তু কোন তারকাদের প্রিয় খাবার পান্তা ভাত-শুঁটকি ভর্তা, কোন তারকার প্রিয় ফুল ডুমুর, তা হড়বড় করেই বলতে পারে। সাহিত্যপিয়াসী পাঠক এরা মূলত শুক্রবারেই ভালোভাবে পত্রিকা পড়তে পছন্দ করে। তাই বলে যে সপ্তাহের অন্যান্য দিন পত্রিকা পড়ে না, তা নয়। পড়ে, সেই পড়া সংবাদ শিরোনাম পড়ার মাঝেই সীমাবদ্ধ। শুক্রবারের প্রতি এদের বিশেষ আগ্রহের কারণও আছে।

২-১টি ব্যতিক্রম বাদে প্রতিটি পত্রিকার সাহিত্যপাতা শুক্রবারেই প্রকাশিত হয়। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, রিভিউ, সাহিত্য সমালোচনা ইত্যাদি গোগ্রাসে গেলে। আরও একটি জিনিস গেলে_ লেখকদের নাম। কোন লেখকের নাম বাবা-মা কী রেখেছেন, তারপর লেখকরা নাম পাল্টে কী রেখেছেন_ 'পল্টি' দুনিয়ার খোঁজখবর রাখায় ব্যাপক আগ্রহ। যদিও বিসিএস কিংবা গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারভিউতে এই জানাটা কাজে লাগে কমই।

এরা একেকজন কঠোর সাহিত্য সমালোচক। প্রায়ই এই-ওই লেখককে তুলোধুনো করে। মন চাইল তো কাউকে সপ্তম আসমানে বসিয়ে দিল, আবার কাউকে এমন বাণে বিদ্ধ করল, লেখক বেচারার মনে হবে_ তিনি কেন লিখতে গেলেন, তার সাত পুরুষের অপরাধ! ক্রীড়ামোদী পাঠক খেলা অপছন্দ করে এমন পাঠক কমই আছেন। অত্যুৎসাহী পাঠকরা সংবাদপত্রে পাঠযোগ্য সংবাদ বলতে খেলার খবরটুকুকেই বোঝে। খেলার খবর কেন ভেতরে, প্রথম পৃষ্ঠার পুরোটায় কেন খেলা স্থান পায় না_ বৈষম্য নিয়ে এদের মনে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ দীর্ঘদিনের।

রাজনীতির খবর যেহেতু প্রাধান্য পায়, সেহেতু ক্ষোভ দেখানোর সুযোগও নেই। অনেকেই রাজনীতিকে ভয় পায়! রাজনীতিকদের আরও বেশি! তাই বলে যে পাঠকরা রাজনীতির বাইরে থাকতে পারে মোটেও নয়। এদের ছোট একটা অংশ ক্রিকেটে পাকিস্তানের অন্ধভক্ত। পাকিস্তানি ক্রিকেটাররাই ধ্যানজ্ঞান। যেদিন বাংলাদেশ-পাকিস্তানের খেলা থাকে সেদিনও পাকিস্তানকেই সাপোর্ট করে।

বিশেষ সময়ে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করতেও দ্বিধা করে না। কেউ এ নিয়ে প্রশ্ন করলে জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব নিয়ে বলবে, 'খেলা আর রাজনীতি এক জিনিস নয়। এ দুটিকে মেলানোর চেষ্টা করবেন না!' ক্রীড়ামোদী পাঠকদের মধ্যে বুদ্ধিজীবী টাইপ পাঠকরা পিওর দেশি খেলা কুতকুত, গোল্লাছুট, নৌকাবাইচ, ডাঙ্গুলিকে সগৌরবে ফিরিয়ে আনা এবং জনপ্রিয় করার জন্য সরকারি-বেসরকারিভাবে কেন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না তা নিয়ে খুবই ভাবিত! ধর্ষণপ্রেমী পাঠক অপ্রিয় হলেও সত্য, কুলাঙ্গার শ্রেণীর পাঠকও রয়েছে, যাদের একমাত্র আগ্রহ ধর্ষণের খবরের দিকেই। 'ব্যাড নিউজ গুড নিউজ'-এ বিশ্বাসী এরা। ধর্ষণের খবর মনোযোগ দিয়ে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে।

বর্তমানের কোনো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী 'ধর্ষণ বেড়েছে, অপরাধ কমেছে' জাতীয় বেফাঁস মন্তব্য করেননি ঠিক, তাই বলে ধর্ষণ থেমে নেই। প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাশাপাশি জনাকীর্ণ শহরেও অহরহ ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেই চলেছে। রাতের অন্ধকারে তো বটেই, প্রকাশ্য দিবালোকেও। খবরের ছোট একটা অংশই আসে পত্রিকার পাতায়। সে খবর পড়ে কুলাঙ্গার শ্রেণীর পাঠকরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে।

যেদিন পত্রিকায় ধর্ষণের খবর ছাপা হয় না, সেদিন এদের পুরো ৮ টাকাই লোকসানের খাতে পড়ে! জ্ঞানমুখী পাঠক যা কিছু মুদ্রিত, অনেকের কাছে সেটাই জ্ঞানের প্রতীক। সে হিসেবে সংবাদপত্রই জ্ঞানের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র! সংবাদপত্রে জ্ঞানান্বেষণ করে অসংখ্য জ্ঞানী পাঠক। অবশ্য একাধিক সংবাদপত্র পড়ার অভ্যাস থাকলে জ্ঞানে গিট্টু লেগে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা! এক পত্রিকার বিতরণকৃত 'জ্ঞানের' সঙ্গে অন্য পত্রিকার জ্ঞানধারা নাও মিলতে পারে। রাজনৈতিক বিবেচনায় এই জ্ঞান মাঝে-মধ্যে এমন মাত্রা ছাড়ায়, তাতে পাঠকের আন্ধিমুন্ধি লাগে! সুতরাং সতর্কতা হিসেবে পাঠককে এক 'বিদ্যালয়' থেকেই জ্ঞান আহরণ সীমাবদ্ধ রাখতে হবে! কার্টুন, কৌতুক, শব্দফাঁদ, কুইজের পাঠক গণমানুষের বিনোদনের প্রাথমিক স্তর কার্টুন ও কৌতুক। খুব ছোট একটা অংশ আছে যারা শব্দফাঁদ মিলিয়ে নিজের জ্ঞানকে শাণিত রাখে।

বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নিজের শব্দসম্ভার বাড়িয়ে চলে। বলাবাহুল্য, এ শ্রেণীর পাঠকের এক বা একাধিক অভিধান রয়েছে। যারা এই স্তরের চেয়ে আরও বুদ্ধিমান, তারা পত্রিকার কুইজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে, ১০০/২০০ টাকার প্রাইজবন্ড পাওয়ার লোভে কুইজের উত্তর পাঠায়। ৫০০ টাকার পোস্টকার্ড খরচের পর হয়তো কারও কপালে ১০০ টাকার একটা প্রাইজবন্ড জোটে। তাও বাকিতে! রসিক এবং তির্যক দৃষ্টিভঙ্গির পাঠকরা কার্টুন পছন্দ করে।

যে জিনিসটার জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি, সেটা কৌতুক। কৌতুক রচয়িতাদের নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। গেলে তারাই হতো এদেশের সেরা লেখক! আপাতদৃষ্টিতে ছোটখাটো এসব বিষয়ের পাঠকই সবচেয়ে বেশি! রাজনীতিসচেতন পাঠক নিজেকে রাজনীতির হর্তাকর্তা না ভাবলেও অনেক পাঠকই নিজেকে রাজনীতি-বোদ্ধা ভাবতে পছন্দ করে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের খবরাখবর পড়ার পাশাপাশি সম্পাদকীয় পাতার ঢাউস ঢাউস জ্ঞানগর্ভ কলাম পড়তে পছন্দ করে। সেই কলাম লেখকের বয়ান মতে নিজের যুক্তিকে আরও শাণিত করে তোলে।

দেশে যখনই রাজনৈতিক ক্যাঁচাল লাগে, এরা নড়েচড়ে বসে। যেন কাজের কাজ পেয়েছে এতদিনে! এই রাজনৈতিক দলকে গালাগালি, ওই দলের মূর্খামি ইত্যাদি বিষয়ে এরা মহল্লার চায়ের দোকানে ঝড় তুলতে পছন্দ করে। পত্রিকায় পড়া কলাম লেখকের অনেক বিশেল্গষণই নিজ নামে চালিয়ে দেয়। বলাবাহুল্য, এই শ্রেণীর রাজনীতিসচেতন পাঠকের জ্ঞানের ঠেলায় পড়ে অনেকের ঠাণ্ডা চা-ও গরম হয়ে যায়! পত্রলেখক পাঠক দেশটার যে আসলে কী হবে, কোন অন্ধকার গহ্বরে যাত্রা করছে প্রিয় স্বদেশ_ এসব আকাশকুসুম ভাবনায় যার রাতের ঘুম নষ্ট হয় সে অবশ্যই পত্রিকার পত্রলেখক। অমুক রাস্তায় গর্ত হয়েছে এবং সেই গর্তে বৃষ্টির পানি জমে; ফলশ্রুতিতে জনসাধারণের চলাচল মারাত্মকভাবে বিঘি্নত।

ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এ পত্রলেখকরা প্রায়ই সরব হয়। বলা হয়ে থাকে, ডাকবিভাগ এবং ডাকবিভাগের খামকে টিকিয়ে রাখতে এদের ভূমিকাই সর্বাধিক। একই চিঠি কমসে কম ১০ পত্রিকায় পাঠালেও অনেক সময় দেখা যায়, কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষিত হয় না। তাতেও আক্ষেপ নেই। লিখে যায় আপন গতিতে, মনের মাধুরী মিশিয়ে চলে পত্র রচনা।

সমমনা দু'জন মানুষ হলেই এরা সংগঠন করে ফেলে। অমুক পত্রলেখক গোষ্ঠী নামে! ফান ম্যাগাজিন পাঠক অস্বীকার করার উপায় নেই, প্রতিটি 'আদর্শ' দৈনিকের একটি ফান ম্যাগাজিন থাকবেই থাকবে। ফান ম্যাগাজিন থাকা মানেই বাড়তি কিছু পাঠক সৃষ্টি করা। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য, দুঃখকষ্টে নিমজ্জিত থাকা অনেক মানুষই হাস্যরস মারাত্মকভাবে পছন্দ করে। কোনো কাঠখোট্টা প্রবন্ধ যদি রম্যরচনা শিরোনামে ছাপা হয়; পরে এরা ঠিকই একচোট হেসে নেবে।

যেন এর চেয়ে মজার রম্য লেখা আর হয় না! এই শ্রেণীর পাঠকের আশ্রয় এবং প্রশ্রয়েই পত্রিকার ফান ম্যাগাজিনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে ভাঁড়ামি এবং কাতুকুতু দেওয়া। বুদ্ধিমান এবং সিরিয়াস পাঠকরা ফান ম্যাগাজিন এবং এর পাঠকদের কারবার দেখেই হেসে কূল পায় না! সংগঠক পাঠক সব পত্রিকারই পাঠক সংগঠন লাগবে নইলে সমাজসেবা মারাত্মকভাবে বিঘি্নত হবে_ এই মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে প্রায় সব পত্রিকাই পাঠক সংগঠন চালু করেছে। পাঠকরাও নিজেদের প্রতিভাদীপ্ত লেখাগুলো, নায়কোচিত মুখখানা দেশবাসীকে দেখানোর জন্য এসব সংগঠনের সঙ্গে একাত্মবোধ করে। পথশিশুদের ফলাহার, শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ, নিরক্ষরকে সাক্ষর করা_ অজস্র সেবামূলক কাজ করে থাকে এরা।

বিনিময়ে প্রশান্তির পাশাপাশি পত্রিকায় এদের নামধাম, ছবি ছাপা হয়। পত্রিকায় নিজের নামটা নির্ভুল ছাপা হতে দেখলে এরা খুশি হয়। বড় করে এবং ভালো ক্যাপশন দিয়ে ছবি না ছাপলে মনে মারাত্মক চোট লাগে। চোটের ঠেলায় কেউ সংগঠন করাই ছেড়ে দেয়। আর কেউ লাফ দিয়ে অন্য পত্রিকার সংগঠনে চলে যায়! আশাবাদী পাঠক সবকিছু ইতিবাচকভাবে দেখতে পায় এমন পাঠকের সংখ্যা খুবই কম।

কম হলেও আশাবাদী পাঠকরা স্বমহিমায় চারপাশে বিরাজ করে। বিরোধী দল ইচ্ছা করলে ছোটখাটো একটা ইস্যুকে পুঁজি করে আগামীকাল হরতাল ডাকতে পারত, কিন্তু ডাকেনি; সরকারি দল বিদ্যুতের প্রতি ইউনিট আরও ৫ টাকা, তেল-গ্যাস লিটার ও মিটার প্রতি আরও ১০ টাকা বাড়াতে পারত, কিন্তু বাড়ায়নি দেখে এরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এবং জাতির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলতা কল্পনা করে আশান্বিত হয়। পত্রিকায় যদি লেখে, চালের কেজি ৫০ টাকা : সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস। তাতেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে ভোলে না। ৫০ টাকা মানে ১০০ থেকে আরও ৫০ টাকা কম! চালের কেজি ১০০ টাকা হলেও কে রুখতে পারত! আশার মাধ্যমে এরা যেমন জেগে থাকতে চায়, অন্যদেরও মাতিয়ে রাখার চেষ্টা করে।

খুব একটা সফল যে হয়, এমনটা বলা যাবে না! সর্বভুক পাঠক টাকা খরচ করে পত্রিকা কিনেছি, সুতরাং এক ইঞ্চিও না পড়ে ছাড়বো না_ আপসহীন মনোভাবে উদ্দীপ্ত এরা। পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠা থেকে শেষ পৃষ্ঠা, মাগনা হিসেবে পাওয়া ফিচার পাতা, দরকারি-অদরকারি বিজ্ঞাপনগুলোও পাঠ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত। সর্বভুক পাঠক হিসেবে এই পাতাটা পড়ব, ওটা পড়ব না; অমুকের লেখা ভালো লাগে না, তার লেখা পড়ে কী হবে_ ধরনের কোনো বালখিল্যতার প্রকাশ এদের মাঝে দেখা যায় না। গণতন্ত্র নিয়ে যদিও তাদের আলাদা কোনো ভাবনা নেই; কিন্তু এই সাম্যবাদী আচরণকে গণতান্ত্রিক মনোভাব হিসেবেও আখ্যা দেওয়া যায়। বলাবাহুল্য, এ শ্রেণীর পাঠকের অফুরন্ত অবসর, এদের জরুরি কাজ মানে খাওয়া এবং ঘুম! ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.