উপমহাদেশের প্রথম গণতন্ত্র বাংলাদেশে
মাৎসন্যায়ম পোহিতং
প্রকৃতি র্ভিলক্ষ ন্যাঃ করংগ্রাহিত :
শি গোপাল ইতি ক্ষিতিশ
শিরোসাং চূড়ামনিস্তৎ সূত:
(ধর্মপালের খালিমপুর তাম্রশাসন (রাজ্যাঙ্ক ৩২,গৌড় লেখমালা,পৃষ্ঠাÑ৯)
¬
বপ্যট পুত্র রাজা ক্ষিতিশ গোপাল
কুলচূড়ামনি তিনি ইতি নরপাল
মাৎস ন্যায় দূর করিবার অভিপ্রায়ে
প্রকৃতি পুঞ্জ দ্বারা নির্বাচিত হয়ে
অরাজকতার রাজ্য করিলেন দূর
বরেন্দ্রী-মণ্ডলে রাজা হলেন মধুর ।
(অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় এর অনুবাদ অবলম্বনে)
সেই গঙ্গাহৃদয় (গঙ্গারিডাই) থেকে আজকের বাংলাদেশ আর সমস্ত ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে প্রথম গণতন্ত্র চর্চা হয়েছিলো এই বাংলাদেশেই। জাতি হিসেবে এ যে আমাদের কতবড় গর্ব ও গৌরবের বিষয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।
বিচিত্র ঐশ্বর্যমন্ডিত দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। প্রায় পঞ্চান্ন (৫৫০০০) হাজার বর্গ মাইল জুড়ে প্রকৃতি যেন এখানে কথা কয়।
সে কথায় ভেসে উঠে বহু দূরাগত অতীতের ছবি। উঠে আসে হারানো স্মৃতি, হারানো পরাক্রমশালী জাতি আর তাদের বিত্ত বৈভবের কথা। এদেশে মাটি খুঁড়লেই বেরিয়ে আসে অতীত। সারা পৃথিবীতে প্রতœসম্পদের এমন সহজলভ্যতা এরকম একক আর কোন অঞ্চলে নেই। কিন্তু জাতি হিসেবে আমরা বিস্মৃতিপরায়ন এবং অসচেতন বলেই আমাদের সমৃদ্ধ অতীতকে এখনো আমরা অবহেলা করে যাচ্ছি।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় আজ থেকে একান্ন বছর আগে ১৯৬১ সনে মহাস্থানের গোবিন্দ ভিটায় মাটির উপরিভাগ থেকে গভীরে মাত্র ২২/২৩ ফিট খনন করার ফলে একের পর এক অন্তত: সতেরটি সভ্যতা স্তরের চিহ্ন বেরিয়ে আসে এবং খননের ফলে প্রাপ্ত তথ্য থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, খ্রীষ্টপূর্ব ৪র্থ শতকের পূর্বেই অর্থাৎ আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগেও সেখানে জনবসতি বিদ্যমান ছিল। Ñ১
দুঃখজনক বিষয় হলো এই যে, পাকিস্তান আমলে মহাস্থান, পাহাড়পুর ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানে প্রতœতাত্ত্বিক জরিপ এবং খননের গুরুত্বপূর্ণ অনেক রিপোর্টই আজ পর্যন্ত জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। মহাস্থানের অধিকাংশ প্রতœতাত্ত্বিক গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন ঢিবি এখনও খননের অপেক্ষায় আছে। বৈজ্ঞানিক উপায়ে গুরুত্বসহকারে খনন করা হলে হয়তো বাংলার প্রাচীন সভ্যতা সম্পর্কে আরো বিশদ এবং চমকপ্রদ তথ্য আমরা জানতে পারবো।
এই উপমহাদেশ যেনো সোনার খনি।
এর ঐশ্বর্য লুটে নিতে তাই যেনো যুগে যুগে এসেছে আর্য,অনার্য, শক ,হুন, মোগল, পাঠান এংরেজ আর পাকিস্তানীরা। যার বাহুতে ছিলো বল আর মাথায় ছিলো কূচটক্রান্ত এদেশে সেই হয়েছে রাজা। এমনকি লুটেরাদের এই দীর্ঘ মিছিলে আবিসিনিয়ার হাবশী ক্রীতদাস আর খোজারাও বাদ যায়নি। বাংলার মসনদ ছিলো এমনই মধুর ---মধুভাণ্ডস্বরুপ।
এর মধ্যে এক দল তাড়িয়েছে আরেক দলকে।
দানা বেঁধেছে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। ছেলে খুন করেছে বাবাকে, ভাই খুন করেছে ভাইকে। মসনদের মোহে সেই উন্মত্ত পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ আর ষড়যন্ত্রে অধীর হয়ে আবার প্রতিরোধও গড়ে উঠেছে এই বাংলার মাটিতেই। সেই প্রতিরোধে বাংলার প্রজাদের ভূমিকাই ছিলো মূখ্য।
রাজা কিভাবে কাকে মেরে কাকে সরিয়ে রাজা হলেন প্রজা তার খবরদারী না করলেও আসলে রাজা প্রজা দুই মিলেই তো রাজত্ব।
তাই রাজার কার্যক্রম প্রজার কল্যাণে নিবেদিত হলে রাজত্ব হয় সুখের। তিনি প্রজার প্রতিপালনে সুনির্দিষ্ট কল্যাণমুখী নিয়মকানুন প্রণয়ন করেন এবং তার আওতায় প্রজা সাধারণকে পরিচালনা করেন। প্রজা, রাজাকে দেন কর, রাজা আর রাজত্বের সম্মান রক্ষার জন্য কখনো অকাতরে দেন জীবন বির্সজন। মহানুভব রাজার জন্য দেন হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধা আর ভালবাসা। রাজা আর প্রজার সর্ম্পক এমন হলেই তৈরি হয় স্বর্গ রাজ্য।
অপরপক্ষে এর ব্যতিক্রম হলেই নেমে আসে ভয়াবহ বিপর্যয়। রাজা হন অসুখী, দুর্বল আর অ^জনপ্রিয়, প্রজারা হন অত্যাচারিত, শোষণ নির্যাতনের শিকার। অবস্থা আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করলে মুক্ত হয় সকল বন্ধন। কারো উপরে থাকেনা কারো নিয়ন্ত্রণ, স্বাভাবিক নিয়ম-কানুনের পথ রুদ্ধ হয়ে চালু হয় জলাশয়ের আইন। তখন সবল দুর্বলের রক্ষক না হয়ে ভক্ষকে পরিণত হয়।
তখন ঐ অত্যাচারিত রাজাকে সরানোর জন্য স্বতঃর্স্ফুত ভাবে প্রজারাও চেষ্টা করেন।
সারা বাংলাদেশে একবার এমন অবস্থার উদ্ভব হয়েছিল। সে আজ থেকে প্রায় সাড়ে তেরোশত (১৩৫০)বছর আগের কথা। এই অবস্থাকে তখন কার পণ্ডিতেরা অভিহিত করেছিলেন মাৎস্যন্যায় হিসেবে। জলাশয়ে যেমন ছোট মাছ তার চেয়ে ছোট মাছকে খায়।
তাকে আবার খায় তার চেয়ে আর একটু বড় মাছ--- এই পরম্পরাকেই বলে মাৎস্যন্যায়। স্বাভাবিক নিয়ম কানুনের পথ সেখানে রুদ্ধ। যে যাকে পায় সে তাকে শোষণ করে এই হল মাৎস্যন্যায়। এই মাৎস্যন্যায়ের উদ্ভবের কাহিনী এবং তার পরবর্তী জনগণতন্ত্রের চর্চা বাংলাদেশের এক গৌরবোজ্জল কাহিনী হয়ে রয়েছে।
মূলত: বাংলাদেশের পুণ্ড্র-বরেন্দ্র অঞ্চল এবং পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশ নিয়ে ইতিহাস প্রসিদ্ধ গৌড় রাজ্যের উদ্ভব।
খ্রীষ্টীয় ষষ্ট শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই গৌড় একটি বিশিষ্ট জনপদরূপে প্রসিদ্ধি লাভ করতে থাকে। এ প্রসঙ্গে রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন,-“শিলালিপির প্রমাণ হইতে অনুমিত হয় যে, ষষ্ঠ শতাব্দীতে এই দেশ প্রায় সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, সপ্তম শতাব্দীতে মুর্শিদাবাদের নিকটবর্তী কর্ণসুর্বণ গৌড়ের রাজধানী ছিল এবং এই দেশের রাজা শশাঙ্ক বিহার ও উড়িষ্যা জয় করিয়াছিলেন। সম্ভবত এই সময় হইতেই গৌড় নামটি প্রসিদ্ধি লাভ করে। কিন্ত তাহা হইলে বলিতে হইবে যে মালদহের নিকটবর্তী গৌড় নগরী সপ্তম শতাব্দীর পরে নির্মিত হইয়াছে এবং গৌড় দেশের সংজ্ঞাও ইহার পরে পরিবর্তিত হইয়াছে। ভবিষ্য পুরানে ইহার সমার্থক প্রমাণ পাওয়া যায়।
ইহাতে বলা হইয়াছে যে গৌড় ও অন্য ছয়টি প্রদেশ মিলিয়া পুণ্ড্র দেশ গঠিত হইয়াছে। ’’Ñ১
গৌড়ের সাথে রাজা শশাঙ্কের নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত কারণ কারণ গৌড়ের প্রসিদ্ধি শশাঙ্কের কারণেই এবং শশাঙ্কই ছিলেন বাঙালী রাজাগণের মধ্যে প্রথম সার্বভৌম নরপতি, যিনি আর্যাবতে বাঙালী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন এবং তা অনেকাংশে কার্যকরও করেন।
বাংলাদেশের পুন্ড্র -বরেন্দ্র অঞ্চলকে কেন্দ্র করেই মূলতঃ শশাঙ্কের উত্থান। শশাঙ্কের রাজধানীই ছিল পুন্ড্রনগরী। (আজকের বগুড়ার মহাস্থানগড়)
‘আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প’ নামক বৌদ্ধ গ্রন্থ থেকে এই তথ্য জানা যায়।
শশাঙ্ক প্রবল প্রতাপ থানেশ্বর রাজ রাজ্যবর্ধণকে হত্যা করলে তার ছোট ভাই ইতিহাসখ্যাত হর্ষবর্ধণ তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করেন। এ প্রসঙ্গে আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্পে বলা হয়েছে- “অসাধারণ পরাক্রমশালী তাহার (রাজ্যবর্ধণে’র) কণিষ্ঠ ভ্রাতা হর্ষবর্ধণ বহু সৈন্যসহ শশাঙ্কের রাজধানী পুণ্ড্রনগরীর বিরুদ্ধে অভিযান করেন। ’’Ñ২
যা হোক “শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে বাংলার রাজনৈতিক অবস্থা অতিশয় শোচনীয় হইল। বিশাল সাম্রাজ্যের আশা ও আকাক্সক্ষা তো বিলীন হইলই কয়েক বৎসরের মধ্যে তাহার রাজ্য শত্র“র করতলগত হইল। ”-৩
আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্পে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, শশাঙ্কের মৃত্যুর পর গৌড় রাষ্ট্র অভ্যন্তরীণ কলহ ও বিদ্রোহে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় এবং প্রায় শতর্বষ ব্যাপী মাৎসন্যায় অবস্থা বিরাজ করতে থাকে।
এই সময়ে এখানে একাধিক রাজার অভ্যুদয় হয়। তাহাদের মধ্যে কেহ এক সপ্তাহ কেউবা একমাস রাজত্ব করেন। স্বয়ং শশাঙ্কের পুত্র মানব আট মাসের বেশি রাজত্ব করতে পারেননি। এক পর্যায়ে নৈরাজ্য যখন অসহনীয় হয়ে ওঠে তখন জনগণ নিজেরাই ঐক্যবদ্ধ হন এবং তাদের প্রতিপালনের জন্য দণ্ডধর বা রাজা হিসেবে গোপাল নামক এক ব্যক্তিকে রাজপদে নিযুক্ত করেন।
পরবর্তী পাল রাজা গোপালপুত্র ইতিহাস-বিশ্রূুত ধর্মপালদেবের তাম্রশাসনে গোপালের রাজপদে নির্বাচন এবং তার পূর্ববর্তী পটভূমির বিষয়ে অনেক কিছু জানা যায়।
মালদহ জেলার অর্ন্তগত খালিমপুর গ্রামে আবিস্কৃত ধর্মপালের তাম্র শাসনে উক্ত বিষয়টিরই উল্লেখ করে শ্লোক উৎকীর্ণ করা হয়েছে---
‘মাৎস্যন্যায়ম পোহিতুং প্রকৃাতর্ভিলক্ষন্যাঃ করংগ্রাহিতঃ শি গোপাল ইতি ক্ষিতিশ শিরোসাং চূড়ামনিস্তৎ সূতঃ। ’
অর্থাৎ “দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচারমূলক মাৎস্যন্যায় বা অরাজকতা দূর করিবার অভিপ্রায়ে প্রকৃতিপুঞ্জ যাহাকে রাজলক্ষীর কর গ্রহণ করাইয়া রাজা নির্বাচিত করিয়া দিয়াছিল, নরপালকূল চূড়ামণি গোপাল নামক সেই প্রসিদ্ধ রাজা বপ্যট হইতে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। ’’Ñ৪ (অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় এর অনুবাদ)
এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন -“শশাঙ্কের মৃত্যুর পর শতবর্ষব্যাপী অনৈক্য, আত্মকলহ ও বর্হিঃশত্র“র পূণঃ পূুণঃ আক্রমণের ফলে বাংলার রাজতন্ত্র ধ্বংসপ্রায় হইয়া ছিল। প্রায় সহস্র বৎসর পরে তিব্বতীয় বৌদ্ধ লামতারনাথ এই যুগের বাংলা সম্বন্ধে লিখিয়াছিলেন যে, -‘সমগ্র দেশের কোন রাজা ছিল না। প্রত্যেক ক্ষত্রীয় সম্ভ্রান্ত লোক ব্রাহ্মণ এবং বণিক নিজ নিজ এলাকা স্বাধীনভাবে শাসন করিতেন।
ফলে লোকের দুঃখ-দুর্দশার আর সীমা ছিলনা। সংস্কৃতে এরূপ অরাজকতার নাম মাৎস্যন্যায়----- এই চরম দুঃখ র্দূর্দশা হইতে মুক্তিলাভের জন্য বাঙালী জাতি যে রাজনৈতিক বিজ্ঞতা দুরদর্শিতা ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়াছিল ইতিহাসে তাহা চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবে। দেশের প্রবীণ নেতাগণ স্থির করিলেন যে পরস্পর বিবাদ বিসম্বাদ ভূলিয়া একজনকে রাজপদে নির্বাচিত করিবেন এবং সকলেই স্বেচ্ছায় তাহার প্রভূত্ব স্বীকার করিবেন। দেশের জনসাধারণ এই মত সানন্দে গ্রহণ করিল। ইহার ফলে গোপাল নামক এক ব্যক্তি বাংলাদেশের রাজপদে নির্বাচিত হইলেন।
”-৫
লামাতারনাথের মতে গোপাল পুন্ড্রবর্ধন নিবাসী এক ক্ষত্রীয় পরিবারে জন্মগ্রহন করেন এবং পুন্ড্রবর্ধনেই তার শক্তির প্রাথমিক উত্থান, বিকাশ এবং পরিণতি লাভ ঘটেছে। ফলে একথা নি:সন্দেহে বলা যায় যে গোপালকে কেন্দ্র করে প্রথম গণতন্ত্রের চর্চা মূলত: বাংলাদেশের বরেন্দ্রভূমি ভিত্তিক সংঘটিত হয়েছিল।
দশম শতাব্দিতে রচিত বাংলার ইতিহাসের একমাত্র প্রামান্য পুঁথি সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতেও একই বক্তব্য প্রকাশ পেয়েছে। সন্ধ্যাকর নন্দীর বর্ণনা অনুযায়ী বরেন্দ্রই হচ্ছে পাল রাজাদের পিতৃভূমি। এ থেকে পণ্ডিতেরা অনুমাণ করেন যে, যেহেতু গোপাল বরেন্দ্রের অধিবাসী ছিলেন সেই হেতু গোপালের রাজা নির্বাচন বা শতবর্ষব্যাপী মাৎস্যন্যায় পরবর্তী সময়ে প্রকৃতি পুঞ্জ কর্তৃক গণতন্ত্রের চর্চা যে বাংলাদেশের পুন্ড্র- বরেন্দ্র অঞ্চল ভিত্তিক সংঘটিত হয়েছিল সঙ্গত কারণেই এ অনুমান করা যেতে পারে।
এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন, ‘‘সন্ধ্যাকর নন্দী সুস্পষ্ট বলিতেছেন পাল রাজাদের জনকভূমি বরেন্দ্রী দেশ..... মনে হয় ইহাদের আদিভূমি বরেন্দ্র ভূমি এবং সেখানেই গোপাল কোনো সামন্ত নায়ক ছিলেন। রাজা নির্বাচিত হইবার পর তিনি বঙ্গদেশেরও রাজপদে প্রতিষ্ঠিত হন। এবং বোধ হয় গৌড়েরও। তারনাথ ঠিক এই কথাই বলিতেছেন। পুন্ড্রবর্ধনের কোনো ক্ষত্রিয় বংশে গোপালের জন্ম কিন্তু পরে তিনি ভঙ্গলেরও রাজা নির্বাচিত হন।
”-৬
গোপালের রাজপদে নির্বাচন বা বাঙলাদেশে আদিমতম গণতন্ত্রের চর্চা প্রথম বরেন্দ্র ভিত্তিক এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। তবে গোপাল সরাসরি জনসাধারণের দ্বারা নির্বাচিত হয়েছিলেন কিনা সে বিষয়ে ঐতিহাসিক দের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে যদিও প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রমা প্রসাদ চন্দ এবং রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় দুজনই বলেন যে, সরাসরি জনসাধারণের দ্বারাই গোপাল রাজা নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে কিছু বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ যারা বিভিন্ন অঞ্চলে রাজা বা সামন্তনায়ক বলে গণ্য হতেন তারা মিলিত হয়ে গোপালকে সমগ্র দেশের রাজা বলে নির্বাচিত এবং স্বেচ্ছায় তার অধীনতা স্বীকার করলে সমগ্র দেশের লোকও এ নির্বাচন সানন্দে গ্রহণ করেন।
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ও রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতের প্রতিধ্বনি করে বলেছেন, ‘‘গোপালদেব বরেন্দ্রী ও বঙ্গে রাজা হইয়াই দেশে অন্য যত ‘কামকারি’ বা যথেচ্ছপরায়ন শক্তি বা সামন্ত নায়কেরা ছিলেন তাহাদের দমন করেন। এবং বোধ হয় সমগ্র বাংলাদেশে আপন প্রভূত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন।
এই প্রভূত্ব প্রতিষ্ঠা সম্ভব হইয়াছিল বহু সামন্ত নায়কের সহায়তায় সন্দেহ নাই, এই সামন্ত নায়কেরাই তো স্বেচ্ছায় তাহাকে তাহাদের অধিরাজ নির্বাচিত করিয়াছেন। ”Ñ৭
উপরোক্ত সমস্ত আলোচনার জের টেনে বলা যায় যে----------
ক. শশাঙ্কের মৃত্যুর পর বিশেষ করে গৌড় বরেন্দ্রসহ সারাদেশে যে মাৎস্যন্যায়ের উৎপত্তি হয়েছিল তা প্রায় একশত বছর প্রবাহমান থেকে জনজীবনকে একেবারে অতিষ্ট এবং পর্যুদস্ত করে তোলে।
খ. এর ফলে জনসাধারণ নিজেদের জীবন ও সম্পদ এবং মানসম্মান রক্ষাসহ নিরুপদ্রব জীবন যাপনের আকাঙ্খায় স্বেচ্ছায় গোপাল নামক এক ব্যক্তিকে রাজপদে নির্বাচিত করেন।
গ. গোপালের ‘জনকভূ’ বা পিতৃভূমি বরেন্দ্রে বিধায় তার প্রাথমিক রাজপদে নির্বাচন বাংলাদেশের বরেন্দ ্রঅঞ্চলে সংঘটিত হয়েছিল বলে প্রায় সকল পণ্ডিত এবং ঐতিহাসিক বৃন্দ সুনিশ্চিত মত প্রকাশ করেছেন।
ঘ. ফলে একথা নি:সন্দেহে বলা যায় যে উপমহাদেশের প্রথম উল্লেখযোগ্য গণতন্ত্র চর্চা মূলত: বাংলাদেশের বরেন্দ্রভূমিকে কেন্দ্র করেই সংঘটিত হয়েছে।
ঙ. পরবর্তীতে গোপাল শুধুমাত্র বরেন্দ্রই নয় বরং সমগ্র বাংলাদেশেরই রাজা হন। তার প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ জনগণের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বলেই বোধহয় সুদীর্ঘ চারশত বছর টিকে থাকে। এতো দীর্ঘ সময় ধরে নিরবচ্ছিন্ন একটি রাজবংশের রাজত্ব পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল আর বরেন্দ্রে এদের প্রাথমিক উত্থান বিধায় এদের কর্মকান্ডে বারে বারে বিশেষ করে এদের জনকভূ বা পিতৃভূমি বরেন্দ্র উজ্জল জ্যোতিস্কের মত হয়ে জগতের কাছে প্রতিভাত হয়েছে।
এ বিষয়ে ড. আব্দুল মমিন চৌধুরীর মতামতও প্রণিধানযোগ্য,- ‘‘রামচরিত গ্রন্থে বরেন্দ্র পাল রাজদের জনকভূ বলিয়া উল্লেখ আছে। বৈদ্যদেবের কমৌলি তাম্রলিপিতেও ঐ একই ইঙ্গিত আছে।
প্রথম মহীপালের বানগড় তাম্রলিপিতে যে ‘রাজ্যম পিত্রম’ এর উল্লেখ আছে তাহাও উত্তর বঙ্গ বলিয়া মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। এই সব তথ্য হইতে ইহা নি:সন্দেহে অনুমান করা যাইতে পারে যে, উত্তরবঙ্গ (বরেন্দ্র) পাল বংশের বা গোপালের আদি বাসস্থান ছিল এবং এ অঞ্চলেই তাহারা প্রথম ক্ষমতা বিস্তার করিয়াছিলেন। ’Ñ৮
তথ্য নির্দেশ
১। বাংলাদেশের ইতিহাস (প্রাচীন যুগ), রমেশ চন্দ্র মজুমদার, পৃষ্ঠা-১২
২। তথ্যসূত্র,প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৪৫
৩।
প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৪৭
৪। খালিমপুর তাম্রশাসনের অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় কৃত অনুবাদ,গৌড়
লেখমালা, রাজশাহী -১৩১৯
৫। বাংলাদেশের ইতিহাস । রমেশচন্দ্র মজুমদার। পৃÑ৫৪
৬।
বাঙালীর ইতিহাস, নিহাররঞ্জন রায়, পৃষ্ঠা-৩৮৫
৭। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৩৮৫
৮। বাংলাদেশের ইতিহাস, (অরাজকতার যুগ ও পাল বংশের উদ্ভব)
ড. এ.এম. চৌধুরী, পৃষ্ঠা-৪১
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।