বসন্তে মাতাল আমি এক অপূর্ণতা ... মাহতাব হোসেন: খয়রাত নগর স্টেশন। নীলফামারী জেলার মফস্বলের একটি রেলওয়ে স্টেশন। জীর্ণ প্লাটফরম, নেই স্টেশন মাস্টার। ইলেকট্রিসিটির বালাই নেই। রেল স্টেশনের পশ্চিমে একটি ছোট বাজার, সেখানে হাতে গোনা কিছু চা,আনাজের দোকান।
দুর্বল কিছু ইলেকট্রিক সোলার প্যানেল দিয়ে সেই সব দোকানে আলো জ্বলে, ক্যাসেট প্লেয়ারে গান বাজে। সন্ধ্যা নামার পর সেই বাজার প্রাণহীন হয়ে গেছে। এখন বাজে রাত দেড়টা। শীতের রাত, কুয়াশা ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিক। এই শীতের রাতে ভগ্ন প্লাটফরমে আমরা ৫ জন বসে আছি।
নিরবতা ঘনীভূত হয়ে আসছে। বাস স্ট্রাইক তাই সন্ধ্যা থেকে লোকাল ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। গোয়ালন্দঘাট নামে রাত দশটায় একটা ট্রেন আসার কথা অথচ এখন সেই ট্রেনের হদিস নেই। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী কথা বলে শাহেদ,সেই শাহেদও হাজার বার ট্রেনের গুষ্টি উদ্ধার করে এখন চুপ। একটানা ঝিঁঝিঁ ডেকে যাচ্ছে।
এই নির্জন মধ্যরাতে একটি মফস্বল স্টেশনে বসে আঁধার দেখছি ৫ তরুন। সোহেলের কথা শুনলে অবশ্য এই দুর্ভোগ পোহাতে হত না। আমরা যদি পায়ে হেঁটে অন্তত সৈয়দপুর পর্যন্ত যেতে পারতাম তাহলে হয়তো এই শীতের রাতে দুর্ভোগ পোহাতে হত না। ইশ! কেন যে অলস রিফাতের কথা শুনে থেকে গেলাম। নিজের উপরেই রাগ লাগছে।
এরই মধ্যে জুয়েলের কাছে থেকে একটা গল্প শুনে সবাই চুপসে গেছে। চুপসে যাবেই বা না কেন, এটা তো গা শিউরে ওঠার মত গল্প। এই রেলপথে নাকি মাঝে মাঝে একটি অভিশপ্ত ট্রেন চলাচল করে। ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের সময় সৈয়দপুরের হিন্দু মাড়োয়ারীদের নিরাপদে ভারত পৌছে দেয়ার কথা বলে একটি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্হা করে পাক মিলিটারীরা। তাদের কথায় বিশ্বাস করে কয়েক’শ পরিবার সেই ট্রেনে আরোহন করে।
ট্রেন সৈয়দপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে খয়রাত নগর-সৈয়দপুরের মাঝামাঝি পৌঁছলে ট্রেন আকস্মিক থামিয়ে সমস্ত যাত্রীকে হত্যা করে পাকিস্তানী মিলিটারীরা। গুলি, ব্রাশফায়ার, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে সবাইকে হত্যার পর মালামাল, স্বর্ণালংকার লুট করে নেয় তারা। তারপর থেকে নাকি এই রেলপথে মাঝে মাঝে ভৌতিক এই ট্রেনের আবির্ভাব ঘটে। এই গল্প জুয়েল তার দাদুর কাছে ঢাকাতেই শুনেছিল। দাদুর একবন্ধু তখন সৈয়দপুর রেলকারখানায় চাকরি করতো।
না! ট্রেনের কোন চিহ্নই নেই। আজ আসবে কিনা তাও আর বলা যাচ্ছে না। স্টেশন মাস্টার থাকলে তাও বুকে সাহস থাকতো। পেটে ক্ষুধা কিছুটা জানান দিচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে কেন এই সফরে আসলাম।
উফ! অবশ্য একেবারে অকারন সফর ছিলনা এটা। আমরা এসেছিলাম এখানকার টেক্সটাইল মিলে। আমাদের প্রত্যেকেরই অনার্স সাবজেক্ট টেক্সটাইল ইন্জ্ঞিনিয়ারিং। তাই প্রত্যক্ষ কার্যক্রম পর্যবেক্ষন বিশেষ করে সরকারি টেক্সটাইলে মিলের জন্যই এই ভ্রমন। এই মফস্বল এলাকার টেক্সটাইল মিলটিকে বেছে নেয়ার জন্য অবশ্য আরেকটি কারন আছে।
এর আশেপাশে তিস্তার বিশাল বিশাল কৃত্রিম সেচ ক্যানেল তৈরী করা হয়েছে। সেইসব ক্যানেল দিয়ে স্বচ্ছ টলটলে পানি প্রবাহিত হয়। আছে সাইফন। সামনে ছোট ছোট নদী পড়লে নদীর উপর দিয়ে ক্যানেলের পানি প্রবলবেগে ছুটে যায়-এই সব রোমাঞ্চকর দৃশ্য দেখার জন্যই উত্তরবঙ্গের এই এলাকা সফর। রাত যত গভীর হচ্ছে শীত ততই বাড়ছে।
শাহেদ আর রিফাতের মধ্যেও এই শীতেও চলছে খুনসুটি। তবে যতই কষ্ট হোক না কেন সোহেল আর আমি এই ভ্রমন দারুন এনজয় করেছি। নদীর উপর দিয়ে আরেকটি নদীর মত ক্যানেল দিয়ে ছুটে যাচ্ছে পানির স্রোত-সেই স্রোতে ভেসে গেছি আমি আমার পিছনে সোহেল উফ! কী রোমাঞ্চকর ব্যাপার। জুয়েলের রিস্টওয়াচে রাত দু’টার সংকেত পড়ে। ভাগ্যিস জুয়েল এই রিস্টওয়াচ টা সাথে নিয়ে এসেছিল না হলে এই মুঠোফোনের যুগেও এই রাতবিরেতে সময় জানা হত না।
আমাদের কারো ফোনে চার্জ নেই।
হঠাত্ করে রিফাত আর সোহেল চিত্কার দিয়ে উঠে ‘ট্রেন আসছে’। দূরে ট্রেনের ইঞ্জিনের ক্ষীণ আলো রেখা দেখা দেয়। কুয়াশা ভেদ করে আলো আরো কাছে আসে। এই নিকশ আঁধারে সকলের মুখের উচ্ছ্বাস বোঝা যাচ্ছে।
ট্রেন এসে থামতে না থামতেই আমরা হুড়মুড়িয়ে ট্রেনে উঠে পড়ি। কামরায় আলো বিন্দুমাত্র আলো নেই। লোকাল ট্রেনের কমন বৈশিষ্ঠ। অন্ধকারে কারো মুখ দেখা যায় না। ট্রেনের সীটগুলো অস্বাভাবিক নরম, গদির মত।
গার্ডও মনে হয় ঘুমিয়েছে কারন হুইসেল ছাড়াই ট্রেন চলতে শুরু করে। কামরায় অন্য কোন যাত্রী নেই আমরাই শুধু ৫ জন। আলো না থাকলেও অন্যান্য লোকাল ট্রেনের চেয়ে এই ট্রেনের বগিগুলোর ভেতরটা অনেকট উন্নত এমনকি জামালপুর কমিউটার ট্রেনের চেয়েও শতগুনে ভালো। নাকি বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধি আসছে। রিফাত তার ঢাকার পরিকল্পনার কথা বলতে শুরু করে, ঢাকায় গিয়ে কি করবে, এই সেই আরো কত হাবিজাবি…।
ট্রেন খুবই ধীরগতিতে চলতে শুরু করে। শাহেদ ব্যাগ থেকে দু দিন আগের স্যান্ডউইচ আর পানি বের করে খেতে শুরু করে। এইবার নাকে উত্কট গন্ধ এসে ধাক্কা খায়। হঠাত্ শাহেদ উফ করে শব্দ করে, পানির বোতল ছিটকে আমার গায়ে এসে পড়ে। গোঙাতে গোঙাতে সামনের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
সেদিকে তাকাতেই বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে আমার। আবছা আলোয় অনেকগুলো কাঁটা মাথা লুটোপুটি খাচ্ছে ট্রেনের কামরায়। ট্রেনের গতিতে রকেটের চেয়ে বেড়ে গেছে। সোহেল আর আমি বাকী তিনজন কে ধরে ট্রেন থেকে লাফ মেরেই জ্ঞান হারালাম। চোখ যখন মেলি দেখি আমি হাসপাতালের বেডে।
মনে পড়ে যায় ট্রেনের কথা। কারো কারো হাতে পায়ে ফ্র্যাকচার ছাড়া তেমন ক্ষতি হয়নি। বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। তবে আম্মুর হাত থেকে রেহাই নেই। সবারই আব্বু অথবা আম্মু রংপুর আসছে।
খুব সকালে জমি চাষ করতে গিয়েছিল তারাই আমাদের অজ্ঞান অবস্হায় উদ্ধার করে রংপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তি করিয়েছে এবং ঢাকায় খবর দিয়েছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই হয়তো এসে পৌছবে। নতুন খবর পেলাম যে এই অভিশপ্ত ট্রেনে চড়ে ওই এলাকার অনেকেই নিরুদ্দেশ হয়েছে। গোয়ালন্দঘাট ট্রেনটি গতরাতে চিলাহাটিতে লাইনচ্যুত হয়েছে তাই আসতে পারেনি।
Advertisement: ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।