মানুষের মুক্তি সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি ও প্রতিধ্বনি অম্লান করে ধরে রাখতে এবং এ সত্য ভাষণ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিতে ক্যামেরাবন্দী ফুটেজ এবং সেই ফুটেজগুলোকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে বেশ কিছু সংখ্যক চলচ্চিত্র। পদে পদে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে, যুদ্ধের মাঝে ভীষণ বিপদজনক সময়ে চলচ্চিত্রকারগণ জড়িয়ে পড়েন আরেক যুদ্ধ - বন্দুকের বদলে ক্যামেরা নিয়ে। আর এ সচিত্র প্রামাণ্যগুলো বিশ্ববিবেককে উপলব্ধি করায় গণহত্যার ভয়ংকর বিভীষিকা কী করে সাধারণ জনগোষ্ঠীকে বিপণœ করে, আর মানুষেরা কী ভাবে তার প্রতিরোধে যুদ্ধ করে । আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সেই ভয়ংকর দুঃসময় এবং পাকিস্তানি শত্র“দের প্রতিরোধ করে সামনে এগিয়ে বিজয়কে ছিনিয়ে আনার প্রত্যয়কে ধারণ করে নির্মিত হয়েছে অসম্ভব শিল্পসম্মত এবং মর্মস্পর্শী বেশ কিছুসংখ্যক প্রামাণ্য চলচ্চিত্র।
ডিজিটাল প্রযুক্তির উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির নিদর্শন আমরা প্রতিদিন দেখতে পাই তার একটি সহজতম উদাহরণ হচ্ছে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, জনপ্রিয় অথবা বাণিজ্যিক যে- ধরনের নামেই অভিহিত করি না কেন, বাজারে তার সহজলভ্যতা।
আজ যথেষ্ট উৎকৃষ্ট প্রিন্টে এবং অনেক সুলভে আমরা চলচ্চিত্রগুলো বাজার থেকে সংগ্রহ করতে পারছি, অথচ বছর পাঁচেক আগেও অনেক কষ্টে, নিকৃষ্ট প্রিন্টের এবং অধিক দামে আমাদের চলচ্চিত্রগুলোকে যোগাড় করতে হত এবং আজকের মতো এত সহজলভ্যও ছিল না। কিন্তু একটু প্রশ্ন রাখি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক যে প্রামাণ্যচিত্রগুলো নির্মিত হয়েছিল বর্তমানে বাজারে কি এর তার পূর্ণাঙ্গ সংগ্রহ বা কালেকশন পাওয়া যায়? লজ্জাজনক হলেও উত্তরটি হচ্ছে না।
মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা উপলব্ধি করতে এবং করাতে এই প্র্মাাণ্য চলচ্চিত্রগুলো অসামান্য ভূমিকা রাখতে পারে। জহির রায়হান নির্মিত ‘স্টপ জেনোসাইড’ দেখে শিউড়ে ওঠেননি এমন দর্শক বিরল। বাংলাদেশে তাও বেশ কিছূ সংখ্যক দর্শক ’স্টপ জেনোসাইড’ দেখেছেন, কিন্তু ‘স্টপ জেনোসাইড’ এর সাথে যে আরও তিনটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র (এ স্টেট ইজ বর্ন -জহির রায়হান, ‘লিবারেশন ফাইটারস’- আলমগীর কবীর, ইনোসেন্ট মিলিয়নস- বাবুল চৌধুরী) নির্মাণ করা হয়েছিল- তার দর্শক সংখ্যা খুবই সামান্য।
মুক্তি সংগ্রামের অজেয় শক্তি, দুঃসহ যন্ত্রণার জ্বলন্ত দলিল এ প্রামাণ্য চলচ্চিত্রগুলো। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ‘বাংলাদেশ বার্থ অফ এ নেশন’ শিরোনামে চারটি পর্বে এ প্রামাণ্য চলচ্চিত্রগুলো নির্মিত হয়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঞ্চারিত করার প্রচণ্ড শক্তি ধারণ করে এ চলচ্চিত্র চারটি। দুঃখজনক হলেও সত্য, ‘স্টপ জেনোসাইড’ সহ এ চারটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের কোন ডিভিডি ভার্সন বাজারে পাওয়া যায় না।
আরেকটু চিন্তা করে দেখি, আলমগীর কবীর নির্মিত ‘ফেইস ইন দ্য মিলিয়নস’, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’, ‘রিমেম্বারেন্স ৭১’, ‘টু ওয়ার্ডস এ গোল্ডেন বেঙ্গল’, গীতা মেহতার ‘ডেটলাইন বাংলাদেশ’, সুখদেবের ‘নাইন মান্থনস টু ফ্রিডম’, দুর্গা প্রসাদের ‘দূরন্ত পদ্মা’, গ্রানাডা টেলিভিশনের ‘ওয়ার্ল্ড ইন অ্যাকশন: মেজর খালেদস্ ওয়ার’, নাগিসা ওশিমার (জাপান) ‘বাংলাদেশ ডায়েরি, ‘জয় বাংলা’, ‘দ্যা গোল্ডেন ল্যান্ড অফ বেঙ্গল’, ক্রিস্টোফার মিচেলের ‘পার্টিশন অফ পাকিস্তান: লিগাসি অফ ব্ল্যাড’ অথবা সংবাদভিত্তিক প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘পিগরাস’, ‘এ চাইল্ড উইল ক্রাই’, ‘সানরাইজ, সান ডাউন’ সহ মুক্তিযুদ্ধের সময়কার আরো অনেক প্রামাণ্য চলচ্চিত্রগুলো - আমরা কয়জন দেখেছি? কিন্তু কেন প্রযুক্তির এই উৎকর্ষের যুগে এই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রগুলোর সমগ্র বা কালেকশনের ডিভিডি পাওয়া যাবে না?
ম্ুিক্তযুদ্ধের পরে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে, যেমন, ‘মুক্তির গান’, ‘মুক্তির কথা’, ‘ওম্যান এন্ড ওয়ার’, ‘টিয়ারস অফ ফায়ার’, ’সে রাতের কথা বলতে এসেছি’, ‘স্মৃতি ৭১’, ‘একাত্তরের শব্দ সেনা’, ‘বেগমস ব্যাটেল’, ‘ওয়ার ক্রাইমস ফাইল’ সহ আরো অনেক।
প্রামাণ্য চলচ্চিত্র হিসেবে এদের গুরুত্বও অসীম। লজ্জাজনক যে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী এ সব প্রামাণ্য চলচ্চিত্রগুলোরও ডিভিডি ভার্সন বাজারে খুব বেশি পাওয়া যায় না।
এ প্রামাণ্য চলচ্চিত্রগুলো আমাদের রক্তকণিকার মাঝে উত্তাল ঢেউ বয়ে আনে, মর্মের মাঝে বেদনা জাগায়, আমরা কেঁদে উঠি, আবার একই সাথে উদ্দীপ্ত হয়ে পড়ি। আজ আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপরে কাছে অনুরোধ করছি- মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত ইতিহাসকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্য চলচ্চিত্রগুলো ডিভিডিতে রূপান্তরিত করে বাজারজাত করা হোক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।