প্রবাসী মৃত্যু এবং কর্মক্ষমতা হারানোর দুটো বড় কারন হল স্ট্রোক এবং হার্ট এটাক। দুটো রোগই প্রকৃতপক্ষে ঘটে থাকে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হওয়ার ফলে। যে এলাকার রক্তনালী বন্ধ হয় সে এলাকার কোষগুলো মারা যায়, ফলে ঐ প্রত্যঙ্গ কর্মক্ষমতা হারায়। মস্তিস্কে কোষ মারা গেলে হয় প্যারালাইসিস আর হার্ট পাম্প করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে ফলে হার্ট ফেলিওর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। মস্তিস্কের রক্তনালী বন্ধ হলে তা হল স্ট্রোক আর হৃৎপিন্ডের ধমনী বন্ধ হয়ে গেলে তা হল “ মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশান(Myocardial Infarction) রক্ত নালী বন্ধ হওয়ার প্রধান কারন হল ধমনীর গায়ে কোলেস্টেরল জমে যাওয়া, যাকে বলা হয় এথেরোস্ক্লেরোসিস(Atherosclerosis) ।
ধমনীর গায়ে জমা হওয়া কোলেস্টেরলের উপর রক্তের অনুচক্রিকা(Platelet) এবং আরো কিছু পদার্থ জড় হয়ে রক্ত জমাট বেধে গেলেই হল থ্রম্বোসিস(Thrombosis) । থ্রম্বোসিস থেকে রক্ত সরবরাহ গেল বন্ধ হয়ে , ফলাফল হল মস্তিস্কের জন্য স্ট্রোক আর হার্টের জন্য মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশান।
এখন প্রশ্ন হল ধমনীর গায়ে কোলেস্টেরল কেন জমে বা জমা বন্ধ করা যায় কিভাবে? রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়া ধমনীর দেওয়ালে কোলেস্টেরল জমার প্রধান কারন। চর্বি বা তেল জাতীয় খাবার রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায়। ডাক্তাররা উপদেশ দিয়ে থাকেন “ বয়স বাড়ছে? ব্লাড প্রেসার? ডায়াবেটিস? – তেল এবং চর্বি জাতীয় খাবার কম খান” সব চর্বিই কি ক্ষতিকর? এস্কিমোরা তো সীল মাছের চর্বি খেয়েই বাচে কিন্তু তাদের কেন ধমনীর গায়ে কোলেস্টেরল জমে না, হার্ট এটাক হয় না, ব্লাডপ্রেসার হয় না ? অর্থাৎ সব চর্বি ক্ষতিকর নয়, কিছু কিছু চর্বি কিন্তু উপকারী।
এমনই এক উপকারী চর্বি হল ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড।
চর্বি , ফ্যাটি এসিড ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড কি জিনিস?
আমাদের খাদ্যের প্রধান উপাদান তিনটি। কার্বোহাইড্রেট,(Carbohydarte) প্রোটিন(Protein) এবং ফ্যাট(Fat) বা চর্বি। চর্বির প্রধান কাজ হল দেহে শক্তি যোগানো। চর্বি থেকে সমপরিমান কার্বোহাইড্রেট বা প্রোটিনের চেয়ে শক্তি মেলে দ্বিগুনেরও বেশী।
আমাদের শরীরের চর্বি বা লিপিড তিন ধরনের ১) ট্রাইগ্লিসারাইড(Triglyceride) ২) কোলেস্টেরল(cholesterol) ৩) ফসফো লিপিড(Phospholipid) । এদের মধ্যে সবচে বেশী হল ট্রাইগ্লিসারাইড । ট্রাই গ্লিসারাইড আবার তৈরী হয় তিনটে ফ্যাটি এসি্ডের(Fatty Acid) সাথে একটা গ্লাইসেরল মিলে। ফ্যাটি এসিড হল অনেক গুলো কার্বন একটার সাথে আরেকটা বন্ড করে তৈরী হওয়া লম্বা চেইনের জৈব যৌগ। এর অনুর এক প্রান্ত হল মিথাইল গ্রুপ( Methyl group- CH3) এবং আরেক প্রান্ত হল কার্বক্সিল গ্রুপ(carboxyl-COOH) ।
মিথাইল গ্রুপের প্রান্তকে ওমেগা(Ω) প্রান্ত বলা হয়। সমস্ত কার্বন গুলো যখন একটার সাথে অন্যটা একটা বন্ড(Single Bond) দিয়ে জোড়া থাকে তা হল স্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড(Saturated Fatty Acid) আর যদি চেইনের কোথাও পাশাপাশি দুটো কার্বন দ্বিগুন বন্ড(Double Bond) দিয়ে জোড়া থাকে তা হল আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড(Unsaturated Fatty Acid) । যদি পুরো চেইনে একটিমাত্র ডাবল বন্ড থাকে তাহলে সেটা হল মোনো (Mono Unsaturated Fatty Acid) আর একাধিক থাকলে তা হল পলিন স্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড(Poly un saturated fatty Acid) । যদি ৬ এর চেয়ে কম কার্বন পরমানু থাকে তাহলে সেটা হল শর্ট চেইন ফ্যাটি এসিড(Short Chain Fatty Acid) আর যদি ১২ এর অধিক হয় তাহলে হল লং চেইন ফ্যাটি এসিড (Long Chain Fatty Acid)।
স্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড দিয়ে তৈরী চর্বি বা ফ্যাট শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে এথেরোস্ক্লেরোসিস বা ধমনী ক্রমশঃ ছোট হয়ে আসতে সাহায্য করে।
এদের মধ্যে আছে দুধ , ঘি, মাখন, মাংশ, ক্রীম, ডিম, চকোলেট ইত্যাদি। সুতরাং স্যাচুরেটেড ফ্যাট বা চর্বি হল সমস্ত অনিস্টের মুল। সমস্ত স্যাচুরেটেড ফ্যাট স্বাভাবিক তাপমাত্রায় কঠিন পদার্থ আর আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট গুলো তরল হয়।
মোনোআনস্যাচুরেটেড চর্বি পাওয়া যায় সমস্ত ধরনের বাদাম, জলপাই তেল, এবং ক্যানোলা তেল এ। মোনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল এল,ডি,এল(LDL-Cholesterol) কমায় ।
স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং চিনি গুড় ইত্যাদি সহজ পাচ্য কার্বোহাইড্রেটের পরিবর্তে মোনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটের ব্যবহার নিসন্দেহে রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল বা এল,ডি,এল এর মাত্রা কমিয়ে কোলেস্টেরল জনিত ধমনীর রোগ প্রতিহত করে। পলি আনস্যাচুরেটেড চর্বি পাওয়া যায় সয়াবিন, সুর্য্যমুখীর তেল, ভুট্টা ইত্যাদিতে।
এই আনস্যাচুরেটেড চর্বি বা ফ্যাটি এসিডের মধ্যে একান্ত দরকারী হল ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড। যে সমস্ত আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড শরীরে যথেস্ট পরিমান তৈরী হয় না অর্থাৎ তা খাবারের সাথে খেতেই হবে সে গুলো হল প্রয়োজনীয় বা “এসেনশিয়াল ফ্যাটি এসিড” (Essential Fatty Acid)
ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড হল সেই সমস্ত ফ্যাটি এসিড যে গুলোর অনুতে ৩নং কার্বন পরমানু পরবর্তী কার্বনের সাথে ডাবল বন্ড দিয়ে যুক্ত থাকে। অনুর গঠনের মিথাইল গ্রুপ দিয়ে শুরু হওয়া প্রান্ত হল ওমেগা (Ω) প্রান্ত আর ৩ নং কার্বন পরমানুতে ডাবল বন্ড থেকেই এই নাম(Ω-3 Fatty Acid) ।
একই ভাবে যে সমস্ত ফ্যাটি এসিডে ৬ নং কার্বন পরমানুতে ডাবল বন্ড থাকে সেটা হল ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিড(Ω-6 Fatty Acid)। ওমেগা-৩ এর মত ওমেগা-৬ ও এসেনশিয়াল আনসাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড। খাদ্যে ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিড(Ω-6 Fatty Acid) এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডের অনুপাতও রক্তের চর্বি নিয়ন্ত্রনে গুরুত্বপূর্ন। এখনকার কালের খাদ্যে ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিডের পরিমান বেশী , যা কমিয়ে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডের পরিমান বাড়ানো উচিৎ।
ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড বেশী পাওয়া যায় অধিকাংশ মাছ বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছে, যেমন ইলিশ মাছ, চিংড়ি মাছ, মাগুর মাছ ইত্যাদিতে।
শাকসবজী যেমন পালং শাক , ব্রক্কোলী, তিষির তেল, ওয়ালনাট, ক্যানোলা তেল ইত্যাদিতে যথেস্ট পরিমান ওমেগা-৩ ফ্যাটী এসিড থাকে। ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডের মধ্যে ইকোসাপেন্টাইনোইক এসিড( eicosapentaenoic acid (EPA), ) এবং, ডোকোসাহেক্সাইনোইক এসিড( docosahexaenoic acid (DHA) )বেশী পাওয়া যায় মাছের তেলে এবং অপরটি আলফা লিনোলিনিক( alpha-linolenic acid (ALA) ) এসিড আসে উদ্ভিজ তেল থেকে । এদের মধ্যে আবার মাছ থেকে পাওয়া ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড উদ্ভিজ ফ্যাটি এসিডের চেয়ে বেশী উপকারী।
অন্য উল্লেখযোগ্য ক্ষতিকর চর্বি বা ফ্যাট হল ট্রান্স ফ্যাট(Trans Fat) । বিভিন্ন ধরনের তরল তেলকে হাইড্রোজেন যোগ করে তৈরী হয় কঠিন চর্বি, যেমন ডালডা, মার্গারিন ইত্যাদি।
আর হাইড্রোজেন যোগ করার এই পদ্ধতি বা হাইড্রোজেনেশানের ফলে তৈরী হয় ট্রান্স ফ্যাট। তেলকে যদি উচ্চ তাপমাত্রায় গরম করা হয় বা বার বার একই তেল গরম করে ব্যবহার করা হয় তা হলেও তার মধ্যে ট্রান্স ফ্যাট তৈরী হয়। ট্রান্স ফ্যাট রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল- এল,ডি,এল, বাড়ায়, ভাল কোলেস্টেরল - এইচ, ডি, এল কমায় এবং কোলেস্টেরল জনিত ধমনীর রোগ যেমন করোনারী হার্ট ডিজিজ (Coronary Heart Disease) ইত্যাদির সম্ভাবনা বাড়ায়।
.
ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড যে কাজগুলো করে তা হল – প্রদাহ কমানো,(Inflammation) রক্ত জমাট বাধা প্রতিহত করা,(Prevents Blood clotting) ইনসুলিনের কার্য্যকারিতা বাড়ানো(Increases efficiency of Insulin) রক্তের কোলেস্টেরল কমানো, প্লেটলেট বা অনুচক্রিকা জড়ো হওয়া কমানো,(Inhibits Platelet Aggregation) রক্তে ট্রাই গ্লিসারাইড কমানো,(Decreases Triglyceride) ক্যান্সার কোষের বাড়া প্রতিহত করা, রক্ত নালীর পুরু হয়ে যাওয়া, রক্তনালীর প্রসারনে সহায়তা,(Vasodilation) শরীরের রোগ ক্ষমতা (Immunity) বাড়ানো ইত্যাদি।
যে সমস্ত রোগে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড উপকারী
১) হৃদ রোগ প্রতিরোধ,(Prevnts Ischemic heart Disease) হৃৎপিন্ডকে সবল রাখা (Stabilises cardiac Rhythm)
২)রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইড এবং কোলেস্টেরল(Decreases Triglyceride and LDL Cholesterol)
৩) স্ট্রোক প্রতিরোধ।
(Stroke Prevention)
৪) শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো। (Increases Immunity)
৫)রক্ত চাপ কমানো(Dcreases Blood preassure)
৬) মানসিক রোগ যেমন ডিপ্রেশান,(Depression) ডিমেনসিয়া,(Dementia),এটেনশান ডেফিসিট হাইপার এক্টিভিটি ডিজর্ডার ( ADHD)
৭ ) বাচ্চাদের সুস্থ্য সবলভাবে বেড়ে ওঠার জন্য যথেস্ট পরিমান ওমেগা- ৩ ফ্যাটি এসিড প্রয়োজন। (Groth and Development of children)
৮) রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস*
৯) ক্যান্সার প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা। *
*= সম্ভাব্য
উপসং হারঃ – ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডের উপকারিতা বিবেচনা করে খাদ্যে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড যোগ করা হয়ে থাকে(Food Supplement) । সরাসরি খাদ্য যেমন মাছ এই যোগ করা ফ্যাটি এসিড থেকে বেশী উপকারী।
এর নির্দিস্ট দৈনিক পরিমান কতটা হওয়া উচিত তা নিয়ে আমেরিকান হার্ট এসোসিয়েশানের মত হল - সপ্তাহে অন্তত দুই দিন দুই আউন্স বা ৬০ গ্রাম পরিমান মাছ খাওয়া দরকার। ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, আলো বাতাসে বেশীদিন থাকলে তার গুনগত মান কমে যায় সুতরাং যথাসম্ভব তাজা মাছ এবং শাকশব্জি খাওয়া উচিৎ। আমিষাশীরা ডিম বা মাংসের পরিবর্তে মাছ খান, আর নিরামিষাশীরা বেশি করে শাক সব্জি খান ।
কলেস্টেরল সম্পর্কে জানতে চাইলে এখানে দেখুন ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।