লেখক/কবি
এই বৈশাখে বাছাই করা কিছু খাবার খেয়ে শরীরের চর্বি কমানো সম্ভব। এই সব খাবারের প্রতিটিই কোন না কোন ভাবে ওজন কমাতে সাহায্য করে। প্রচুর পানি আছে এমন শাক-সবজি, ফল ও স্যুপে ক্যালরির পরিমাণ কম থাকে। নিয়মিত এই সব খাবার খেয়ে শরীরের কিছু অতিরিক্ত মেদও ঝড়িয়ে নেওয়া যায়। বৈশাখের প্রচণ্ড দাবদাহে এরা দেহের ভারসাম্য রাখতেও সহায়ক হতে পারে।
আর যারা দ্রুত ওজন কমাতে চান তাদের জন্যেও এ ধরনের খাবার খুব ভাল বিকল্প হতে পারে। এ ক্ষেত্রে লক্ষ রাখতে হবে দেহ থেকে অতিরিক্ত তরল বেরিয়ে যাবার কারণে ওজন যেন কমে না যায়। এটি বেশীর ভাগ সময় দীর্ঘ স্থায়ী হয়না। তাই সঠিক খাবার বাছাই করা আসলেই জরুরি।
আঁশ ওয়ালা খাবার: শাক-সবজি, ফল-মূল এবং সম্পূর্ণ শস্য শরীরের অতিরিক্ত মেদ ঝরাবার পাশাপাশি পরিপাক তন্ত্রকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে।
এই ধরনের খাবার দেহের ইনসুলিন এর মাত্রাকে স্থির রেখে শরীরে বাড়তি মেদ জমতে বাধা দেয়। আবার হজম হতে বেশী শক্তি খরচ হয় এমন খাবারও কিন্তু শরীরের বাড়তি চর্বি পোড়াতে সহয়তা করে, তাই মাংস স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রচলিত এমন ধারনা আসলেই ভুল।
১. পান্তা-ইলিশ: বাঙ্গালির বৈশাখ শুরুই হয় পান্তা-ইলিশ দিয়ে। ইলিশ যেমন উপাদেয় একটি খাবার তেমনি স্বাস্থ্যেও জন্যও ভালো। দেশের সব বড় বড় নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যায়।
সাগর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে এরা মিঠা পানিতে ডিম ছাড়তে আসে। ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি এসিডের চমৎকার একটি উৎস এই মাছটির তেল অযথা মুটিয়ে যাওয়া থেকে আপনাকে বাঁচাতে পারে। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে এটি শরীরের ইনসুলিন এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। কম তেলে রান্না করা যায় বলে এটি স্বাস্থ্যের জন্য আরো ভালো। এক মাছ দিয়ে কত পদের রান্না করা সম্ভব তা সম্ভবত ইলিশ রাধুনিদের ছাড়া আর কারোরই জানা নেই।
পান্তা দিয়ে দিন শুরু করা গ্রামীণ কৃষক আর তার বউ ছেলেপেলের মেদহীন শরীরই বড় প্রমাণ পান্তা মেদ নিয়ন্ত্রনে কতটা ভূমিকা রাখতে পারে।
২. লাল আটা রুটি ও গুড়: লাল আটা একটি আঁশ বহুল খাবার। গরমে ঘামের সাথে শরীরের অতিরিক্ত পানি বেরিয়ে নিয়মিত পানি ঘারতি দেখা যাবার পরও নিয়মিত এই আটার রুটি খাওয়া অভ্যেস করলে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখাদেয় না, মল এর পরিমাণ বাড়ে ফলে অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। সাদা আটা এবং ময়দার চেয়ে এতে ক্যালরির পরিমাণও কম থাকে। তাই মুটিয়ে যাওয়ার একদমই ভয় থাকে না।
গুড়েও চিনির থেকে ক্যালরির পরিমাণ কম এবং লৌহ সহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য খনিজ ও আঁশ বেশী পরিমাণে থাকে। গুড় খাওয়া তাই স্বাস্থ্য সম্মত। নিয়মিত গুড় আর লালআটার রুটি দেহের ইনসুলিন ও কোলেস্টেরলের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে।
৩. ভাতের মাড়: ভাতের মাড় ভাতের খনিজ সমৃদ্ধ তরল অংশ। তবে পুষ্ঠিগুন সম্বন্ধে ধারনা না থাকার কারণে শহরের বেশীর ভাগ বাড়িতেই এটি ফেলে দেওয়া হয়।
গ্রামে ব্যাবহার হয় পশুখাদ্য হিসেবে। তবে নতুন চালের ভাত হতে যে গাঢ় মাড় পাওয়া যায় তা গ্রামে গঞ্জে বেশীর ভাগ জায়গাতেই খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। সাধারণত লবণ, শুকনা মরিচ পোড়া ছিটিয়ে এটি পরিবারের সদস্যদের মাঝে পরিবেশন দেশের অনেক জায়গাতেই প্রচলিত আছে। নিয়মিত ভাতের ফেন খান এমন লোকেদের মেদ বাড়ার সমস্যা দেখা যায় না। এছাড়াও আরো অনেক রোগ অকালে তাদের শরীরে বাসা বাধতেও দেখা যায় না।
তাই কেবল দরিদ্র মানুষের খাবার নয় অল্প ক্যালরির এই ভাতের মাড় হতে পারে বিদেশী স্যুপের বিকল্প। তাই পরিবারের মুটিয়ে যাওয়া সদস্যদের মাঝে এটি একটু ভিন্ন ভাবে পরিবেশন করে দেখতে দোষের কী।
৪. কাওনের জাউ ও পায়েস: এক সময় দেশের বেশীর ভাগ জায়গাতে কাওন চাষ হতো। বৈশাখে কাওনের চাল দিয়ে বাড়িতে বাড়িতে রান্না হত নানা উপাদেয় খাবার। আবার অভাবের সময় গ্রামের পর গ্রাম এই কাওনে রান্না করা জাউয়ের উপরই ভরসা করে থাকতে হতো।
সেই সময় দেশে মানুষের মুটিয়ে যাওয়ার এমন ঝোঁক চোখেই পড়তো না। ডায়াবেটিকস আর হৃদ রোগের মত আজকের অতি পরিচিত রোগ গুলোও অনেক কমই চোখে পড়ত। তবে খাবার হিসেবে কাওনের ব্যবহার কিন্তু একদমই বন্ধ হয়ে যায়নি। এখনো ফলনের পর পরই শহরের রাস্তা জুড়ে কাওন বিক্রির ধুম পড়ে। আজো অনেক বাড়িতেই কাওন চালের জাউ আর পায়েস রান্না হয়।
কিন্তু বাঙ্গালির শরীর স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে কাওনের আগেকার সেই জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনা চাই। সেটা এই বৈশাখ থেকেই আবার শুরু করলে দোষ কী।
৫. শালুক ও পানিফল: শীতের শুরুতেই খাল-বিল আর পুকুরের পানি কমতে থাকে। জলজ আগাছারা মরে গিয়ে তাদের কান্ড আর কন্দ সমেত মাটির নীচে সুপ্ত হয়ে থাকে। তারপর আরো কয়েকটা দিন, জল আরো শুকিয়ে আসে।
খাবার হিসেবে ব্যবহারের জন্য সেসবের সংগ্রহ শুরু হয়। এখন আবার সারা বছরই শহরের পথে পথে পানিফল আর শালুক বিক্রি হতে দেখা যায়। কম ক্যালরির শালুক সেদ্ধ খেতে উপাদেয়, ভিটামিন আর খনিজ সমৃদ্ধ এই খাবারে আঁশের পরিমাণও বেশী।
তাই মুটিয়ে যাওয়া প্রতিরোধ ছাড়াও এর সাহায্যে আরো ডজন খানেক রোগকে দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব।
৬. ভুট্টা: ভুট্টাকে এখন আমাদের দেশে গমের বিকল্প বলে মনে করা হচ্ছে।
এই বৈশাখ জুড়ে পথে পথে ভুট্টা পোড়া আর ভুট্টার খই খাওয়ার ধুম চোখে পড়ে। আঁশ যুক্ত এই খাবার স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। ক্যালরির পরিমাণ কম থাকায় বাড়তি মেদ যোগ হবার ভয় একদমই নেই। দরকারি খনিজ আর ভিটামিনতো আছেই। তাই যত ইচ্ছে খান ভুট্টায় তৈরি খাবার স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা চিন্তা না করেই।
৭. পাটিসাপটা ও চিতই পিঠা: ফাস্ট ফুডের দোকান গুলোতে পিঠার প্রচলন বেশী দিনের নয়। এই দৌড়ে এগিয়ে আছে পাটিসাপটা পিঠা। ভেতরে মজাদার পুর দেওয়া এই পিঠার একটিই রসনা তৃপ্ত করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু সামান্য একটি পিঠাতেই ক্ষুধা কমলে মেদ বাড়ার ভয়তো থাকেই না।
এই বৈশাখে পথ ঘাটের প্রায় জায়গাতে বিক্রি হচ্ছে চিতই পিঠা শীত আর বসন্ত চলে যাবার পরও এর আবেদন যেন একটুও কমেনি।
চালের গুড়ায় তৈরি তেল ছাড়া এই পিঠা খাওয়া হয় শুটকি বা ধনিয়া পাতার ভর্তা দিয়ে। এই সব গুলি উপাদানই স্বাস্থ্য সম্মত আর কম ক্যালরি যুক্ত খাবার। তাই চর্বিকে সব দিক দিয়েই দূরে রাখতে সক্ষম।
৮. লেবুর শরবত: বৈশাখের তীব্র দাবদাহে এক গ্লাস লেবুর শরবত ছাড়া আর কোন কিছুই মনে হয় ঘামে ভেজা কাউকে এতটা শ্রান্তি এনে দিতে পারে না। শুধু কী তাই মেদ কমাতে সক্ষম এই লেবুর রয়েছে অনেক গুন।
কম ক্যালরির লেবুর রসে রয়েছে দরকারি ভিটামিন-সি। যা বাড়ন্ত শিশু সহ ছেলে বুড়ো সবারই সমান দরকার। এত কম দামের ভিটামিন-সি এর উৎসের খোজ বোধ হয় আর কারো পক্ষেই দেয়া সম্ভব নয়। সম্প্রতি এক গবেষণা হতে জানাগেছে কমলা, লেবু ও টক জাতীয় ফলের রস কিডনিতে পাথর জমতে বাধা দেয়।
৯. পানি: নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে পানিয় জল শরীরের বাড়তি মেদ ঝড়িয়ে ওজন কমাতে সহায়তা দিয়ে থাকে।
জার্মানির গবেষকেরা ইঁদুরকে খাবারের সঙ্গে গড়ে সতেরো আউন্স করে পানি দিয়ে বিপাকের গতি ত্রিশ শতাংশ হারে বাড়াতে পেরেছেন। পরিমাণ মতো পানি পান ক্ষুধাকেও নিয়ন্ত্রনে রাখতে সাহায্য করে। পানির সাহায্যে শরীর থেকে অতিরিক্ত খনিজ আর দূষিত বর্জ্য উপাদান গুলি বেরিয়ে যায়।
১০. সবুজ চা: সবুজ চা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। এটি শরীরের রাসায়নিক গতি বাড়িয়ে বাড়তি চর্বি পোড়াতে ভূমিকা রাখতে পারে।
হৃদরোগ প্রতিরোধ করে আর ক্যান্সারের ভালো প্রতিষেধক এই কথা জানা থাকার কারণে সব বাসা বাড়িতেই সবুজ চা খুবই সমাদর পায়। তাই গরমে চা খাবেনে না চা ভক্তেরা এই কথায় মোটেই কান দিবে না।
১১. মুরগি আর ডিমের সাদা অংশ: মুরগীর মাংস আর ডিমের সাদা অংশ চর্বি পোড়ানোর জন্য খুবই শক্তিশালী খাবার। এরা বিপাকে গতি বাড়িয়ে অতিরিক্ত ক্যালরি পুড়িয়ে ফেলার কাজটি করে।
পরিচিত যে কোন বডি বিল্ডার কে জিজ্ঞেস করলেই এই বৈশাখে তার খাবারে মেনু কি তা জানতে পারবেন।
দেখবেন লাল আটার রুটি, বাদামি চাল, শাক-সবজি আর ফলমূলের সঙ্গে মুরগীর মাংস আর ডিমের সাদা অংশ যেনো বাধা ধরা ভাবেই আছে।
১২. কাঁচা মরিচ: কাঁচা মরিচ বিপাক কাজের গতি বাড়িয়ে শরীরের উদ্যম ফিরিয়ে আনে। দেহের শক্তি বাড়ায় ও তেজীভাব বজায় রাখতে সহায়তা করে। আসলে এর ভেতরে থাকা বিশেষ রসায়নই আমাদের আরো সতেজ করে তোলে, তাই যতই ঝাল লাগুক বৈশাখের এই গরমের মধ্যেও গৃহীনিরা খাবার আর সালাদে ঝাল দিয়েই যাবেন যাতে বাড়ির আর সব সদস্যের গায়ে বাড়তি মেদ একদমই জামতে না পারে। কারণ কাঁচা মরিচ বাড়তি মেদ ঝরাবার জন্য গৃহীনিদের আরেকটি শক্ত হাতিয়ার।
১৩. চিড়া-মুড়ি-খই: বাঙ্গালির প্রিয় খাবার এই চিড়া, মুড়ি, খই। এই খাবার গুলিতে ক্যালরির পরিমাণ খুবই কম। তাই পথ্য হিসেবেও এদের ব্যবহার খুব বেশী। আবার শুকনো খাবার হিসেবে ব্যবহার করা যায় বলে যেখানে সেখানে এদের বয়ে নেয়াও অনেক সহজ। এদের সাহায্যে আবার অনেক উপাদেয় খাবারও তৈরি করা যায়।
যার প্রতিটিতেই ক্যালরি থাকে খুবই নিয়ন্ত্রণে। চিড়া বা মুড়ির মোয়া আর দৈ চিরা অথবা খৈ এরকমই কিছু খাবার যার সঙ্গে মিশে আছে আমাদের হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি। এই খাবার গুলোকে তাই লালন করতে হবে এই কথা মাথায় রেখে যে এরা আমাদের অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে। এরা যতদিন আমদের ডাইনিং রুমে থাকবে ততদিন আমাদের বাঙ্গালির স্বাস্থ্য নিয়ে খুব বেশী ভাবার দরকারও হবে না।
যত দিন পর্যন্ত আমরা আমাদের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে খাবার খেয়ে নিজেদের রসনাকে তৃপ্ত করেছি ততদিন পর্যন্ত নিজেদের স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে আমাদের আলাদা করে তেমন একটা ভাবার দরকারই হয়নি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।