আমারে দিবো না ভুলিতে
রাত তখন ১২টা বেজে গেছে। স্ত্রীসহ ২ মেয়েকে নিয়ে বাসায় ফিরছি। বড় মেয়েটি বেশ অসুস্থ। সাড়ে নয়টায় ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। কিন্তু ডাক্তার সাহেবের ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে মাঝখানে তিনি বাড়ি চলে যান।
তবে ফিরে এসে আবার রোগী দেখেন। সে সূত্রে সপরিবারে আমার এত রাতে বাড়ি ফেরা।
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে দেখি রাস্তা প্রায় ফাঁকা। সাতমসজিদ রোড ধরে লম্বা বিরতিতে যে ক’টা রিক্সা যাচ্ছে কেউ আমার গন্তব্যে যেতে রাজি না। এসময় শুনি রাস্তার ওপাশ থেকে কে যেন ডাকছে, কই যাইবেন স্যার?
আমি গন্তব্য জানাতেই জবাব আসে- আপনারা এপাড়ে আসবেন না আমি আসমু?
ঢাকার হিসেবে সাত মসজিদ রোড মোটামুটি চওড়া রাস্তা।
মাঝখানে কাঁটাতারের বেড়া আর বেড়ার সঙ্গে ছোটছোট ফুলগাছ লাগানো। তাই সোডিয়াম লাইটের ভৌতিক রহস্যময় আলোয় আর আঁধারিতে দেখতে পেলাম না কণ্ঠস্বরধারীকে। তবে বুঝলাম তিনি একজন রিক্সাচালক। মনটা ভাল হয়ে গেল। বললাম, আপনি দাঁড়ান।
আমরা আসছি। একটু বাঁয়ে ঘুরে ইউটার্নটার দিকে এগিয়ে গেলাম। ইউটার্নটার মুখে আসতেই দেখি রিক্সাটি চলে এসেছে সে পর্যন্ত। তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে দেখলাম, হাল্কাপাতলা গড়নের ড্রাইভারের বাম পায়ের পাতাটি নেই। ঘোড়ার খুড়ের মত সেই পাতাটি প্যাডেলে রাখা।
রিক্সা চলতে শুরু করতেই দেখি ড্রাইভার কেমন যেন লাফিয়ে লাফিয়ে প্যাডেল চালাচ্ছে। মনে হয় ডান পায়ের পাতাটি না থাকার কারণে এমন হচ্ছে। একটু খারাপ লাগলেও অসময়ে রিক্সাটি পেয়েছি সেই স্বস্তিতে চুপ করে থাকি।
কিন্তু সামনে নিয়ন সাইনের একটু জোড়ালো আলোতে যা দেখলাম তাতে আমি বিমূঢ় হয়ে গেলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠি- ‘এই রিক্সা! থামাও। আমাকে নামিয়ে দাও!’
আমার বাচ্চারা আর স্ত্রীও বিষয়টি এবার দেখতে পেয়ে অস্বস্তিতে পড়ে গেছে।
এ দৃশ্য দেখে রিক্সায় থাকা যায় না। তার ওপরে পাশ দিয়ে মাঝেমধ্যেই তীরবেগে ছুটে যাচ্ছে রাতের ফাঁকা রাস্তা পাওয়ার উল্লাসে নিজেদেরকে ফর্মুলা-ওয়ান মনে করা নিশাচর গাড়িগুলো। যে কোনও সময় একটু ডান-বাও হলেই যে কোনও একটি যন্ত্রদানবের ধাক্কায় চালকসহ পুরো পরিবার চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে।
আমার বিস্ময়াহত আর ভীতসন্ত্রস্ত নির্দেশের জবাবে বেঁচে থাকার পাগল করা নেশায় বুঁদ অকুতোভয়, বেপরোয়া আর অপরাজেয় অমানবিক প্রচেষ্টায় রত এই দুঃসাহসী বীর প্রাণখোলা হাসি হাসলেন। এ যেন নজরুলের সেই ‘আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি’র চিত্ররূপ দেখলাম।
সিদ্ধান্ত নিলাম এই সারথীর রথেই আমি গন্তব্যে ফিরবো।
এরপর তার বেদনা-বিমূঢ় রূপকথার বয়ান শুনলাম। নাম মোহাম্মদ খোকন(৩২)। ১৪ বছর আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দু’টি ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে উভয় ট্রাকের ড্রাইভার-হেলপার মিলিয়ে মোট ৫ জনের ৪ জনই নিহত হন। এদের মধ্যে একমাত্র বেঁচে যাওয়া ভাগ্যবান ব্যক্তিটি হচ্ছেন খোকন।
তিনি ছিলেন ট্রাক হেল্পার। ওই দুর্ঘটনায় একটি পা ও অপর পায়ের পাতাটি হারাতে হয় তাকে।
খুশীমনে বললেন, আল্লাহ আমারে ওই অবস্থায়ও বাঁচায়া দিছে, এটাই বড় কথা!
মনে পড়লো প্রথম এভারেস্ট জয়ী হিলারি-তেনজিং জুটির একজন শেরপা তেনজিং খোঁড়া ছিলেন। ধারণা করলাম, মানসিক দিক দিয়ে আমাদের খোকন সাহেব সেই গোত্রীয় হবেন।
বললাম- আপনার চেয়ে ভাল অবস্থায় থাকা অনেকেই তো ভিক্ষা করে।
আপনি...(ভিক্ষাবৃত্তি আমিও অপছন্দ করি। তারপরেও আমি প্রকারান্তরে তাকে ভিক্ষার পরামর্শ দিচ্ছিলাম) ওদিকে, অনিবার্য নির্মম শারীরিক অক্ষমতার বিরুদ্ধে মানসিক সক্ষমতার অসম লড়াইয়ে বিজয়ী খোকন জবাব দিলেন-
‘যার যা পেশা! আমি কাজ কইরাই খাইতে চাই!’
এভাবে এত কষ্ট করে রিক্সা না চালিয়ে অন্য কোনও কাজ করতে পারেন না?
সবজি বিক্রি করতাম। কিন্তু ছিনতাইকারীরা একদিন সব পুঁজি লয়া গেল...
জানা গেল, বিয়ে করেছেন। তিন সাড়ে তিন বছর বয়সী একটি কন্যারত্মও আছে।
মোবাইল ফোন নাম্বার চাইলাম।
নাই।
যখন বাসার সামনে এসে আমার মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় তার ছবি তুলছিলাম তখন এত রাতেও আশপাশে বেশকিছু লোক জমা হয়েছেন। সব খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। সবাই নানান প্রশ্ন করছে। এরমধ্যে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে কে যেন একজন খোকনকে উদ্দেশ্য করে খামোখাই বাজে মন্তব্য করে গেল।
ছোটখাট সমাবেশটা একসঙ্গে হই হই করে উঠলো বিবেকহীন মন্তব্যকারীর উদ্দেশে। চললো অশ্রাব্য গালি-গালাজও। খোকন তাদের কাছে হিরো। কারণ এইমাত্র ৪জন মানুষকে সে পাতাবিহীন ওই একটিমাত্র পা দিয়ে টেনে নিয়ে এসেছে তার রিক্সায়! সেই নায়কের অসম্মান তারা হতে দিবে না।
দীর্ঘদিন পর ওই গভীর রাতে রাস্তায় দাঁড়ানো অবস্থায় আমার মনটা অসীম আনন্দে ভরপুর হয়ে গেল।
ক্রিকেটে আশরাফুলদের বারবার যুক্তিহীন হার, খাবারে ফর্মালিন, প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রায় অসম যুদ্ধজয়ী জাতির স্বাধীনতার পর থেকে গত ৪০ বছরে সরকারগুলোর বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্ষমাহীন ব্যর্থতা, একাত্তরেরর নরাধম-পিশাচ স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকারগুলোর গাড়িতে জাতীয় পতাকা, সীমান্তে কাঁটাতারে ঝুলন্ত ফেলানীর লাশ, ট্রাফিক জ্যামের যন্ত্রণা, বিশ্বজুড়ে মার্কিনি যথেচ্ছাচার, প্রিয়জনের প্রতারণা বা বিশ্বস্ত বন্ধুর কলিজা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেওয়া মীরজাফরি- আমার এ যাবতকালের জাতীয়, আন্তর্জাতিক আর একান্ত ব্যক্তিগত সব বিদঘুটে দুঃখগুলো যাদেরকে কোনওভাবেই কবর দিতে পারছিলাম না অ্যাদ্দিন- মুছে যেতে যাকে যেন পরম নিরাময়কারী কোনও তালিসমানের ছোঁয়ায়।
খোকনদের মত মানুষ যেদেশে আছেন- সেখানে মানুষ পিছিয়ে থাকতে পারে না। আমি দীর্ঘদিন ধরে মনে মনে একটি অংক করতাম- আজ এখানে আপনাদের সঙ্গে তা শেয়ার করি। আচ্ছা, গণিতের-সংখ্যার যাদুকরি অনেক খেলা তো আমরা খেলি। কখনো কি ৫২ আর ৭১ যোগ করে দেখেছেন কত হয়? যোগফলটা খুবই চমকপ্রদ।
৫২ আর ৭১ যোগ করলে হয়-১২৩ অর্থাৎ ১, এরপর দুই এবং এরপর ৩। কি অসাধারাণ ধারবাহিকতার প্রতীক! ১ হচ্ছে সবকিছুর শুরু (কেউ কেউ বলেন শূন্য থেকেই শূরু), এরপর ২...৩... অসীম সম্ভাবনার পথে শতকরা ১০০ভাগ সাফল্যের পথে এগিয়ে চলা।
প্রায় দু’টি পা’ই যার নেই- সেই রিক্সাচালক খোকনের কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, সম্পদ নেই, মামু-খালু নেই, নেই তেমন কোনো মেধাও, তারপরেও তিনি যেভাবে জীবনযুদ্ধে অপরাজেয় বিদ্রোহী বীরের মত লড়ে যাচ্ছেন- স্রেফ মনের জোরটাকে সম্বল করে- দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমাদের অনেক ক্ষেত্রেই অনেক অনেক সক্ষম মানুষগুলো কি তার থেকে কিছুটা অনুপ্রাণিত হবেন- এদেশটার জন্য কিছু করতে?
বিবেক-অনুভূতির চামড়ার পুরুত্বে গণ্ডারকেও হার মানানো নেতা-মন্ত্রী-আমলা-সচিবরা না শুনুন- আমি অনুরোধ করছি ছাত্রলীগ-ছাত্রদলসহ জাতির অগণন যুবক-তরুণদেরকে- আসুন আমরা সব বিষন্নতা-ক্লান্তি-হতাশা আর অক্ষমতা ঝেড়ে ফেলি, ৫২ আর একাত্তরের যোগফল যে ১২৩ এর ধারাবাহিকতা তৈরি করে- তাকে স্বার্থক করে একবার একখান লড়াই দিয়ে ফেলি খোকনের দৃষ্টান্তকে সামনে রেখে- ভাষা শহীদ দিবসের আজকের এই অসাধারণ দিনটিতে আসুন সেই শপথ নেই!
সবশেষে- খোকন, আপনাকে সশ্রদ্ধ সালাম!
Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।