স্বাগতম আমার ব্লগে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল রাশেদ। এটাকে ফুলশয্যা বলে! বাসরঘর জীবনে অনেক দেখা হয়েছে। নিজের হাতেও সাজিয়েছে কিছু, কবির মামার বিয়ের টুকটাক কাজ পুরোটাই রাশেদকে করতে হয়েছিল। কিন্তু আজ এই ঘরটাকে ঠিক অন্যগুলোর মতো মনে হচ্ছে না। ঘরের চারপাশ এতো সুন্দর করে সাজানো! ঘরটা যে সাজিয়েছে, তাকে একটা ধন্যবাদ না দিলেই নয়।
ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় রাশেদের খাট, ফুল দিয়ে সাজিয়ে যে পর্যায়ে নিয়ে গেছে, এটাকে কোনভাবেই পুরনো খাট চিহ্নিত করা সম্ভব না।
খাটে গুটিসুটি মেরে বসে আছে বর্ষা। বর্ষার দিকে চোখ পড়তেই বুকের মাঝখানটায় চিনচিন করে উঠলো। রাশেদ ঘরে ঢুকেছে এটা বর্ষা টের পায় নি। অথবা ইচ্ছে করেই টের না পাওয়ার ভান করছে।
দরজা বন্ধ করে পিছনে ফিরতেই বর্ষার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল, খুব সম্ভবত দরজা বন্ধ করার শব্দে তাকিয়েছে। মুচকি একটা হাসি দিয়ে আবার মুখ নিচু করল। রাশেদের বুকটা ধক করে উঠলো। উত্তেজনায় কলজেটা বেরিয়ে আসবে মনে হচ্ছে! পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে বর্ষার পাশে বসে পড়ল রাশেদ।
ঘরে হালকা নীল একটা বাল্ব জ্বলছে।
বর্ষা মুখ নিচু করে আছে। মুখের কিছু অংশ ঘোমটায় ঢাকা। হালকা নীলাভ আলো পড়েছে মুখে! রাশেদ ফিসফিস করে বলল- ‘তুমি এতো সুন্দর কেন!’
বর্ষার সাথে রাশেদের পরিচয় কলেজে। রাশেদ তখন কলেজ পাশ করে ভার্সিটিতে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে। কী একটা কাজে কলেজে গিয়েছিল সেদিন।
কলেজের ক্যান্টিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছু একটা খাচ্ছিল। ক্যান্টিনের দরজা দিয়ে হাসতে হাসতে এক কিশোরী ঢুকল। রাশেদ বিষম খেল, হার্টবিট বন্ধ হয়ে গেল। মানুষ এতো সুন্দর হয় কী করে! ওপাশটায় গিয়ে আইসক্রিম কিনল মেয়েটা, তারপর যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই উধাও হয়ে গেল! বিহ্বল রাশেদ একটু পর বেরিয়ে এসে মেয়েটাকে আর খুঁজে পেল না। পরের টানা কয়েকদিন মেয়েটা রাশেদের চোখে ভেসে চলল।
হঠাৎ একদিন নিলুর সাথে ওকে দেখে অবাক হয়ে গেল রাশেদ। নিলু রাশেদদের পাড়ার মেয়ে, দুই-এক ক্লাস জুনিয়র। রাশেদ নিলুর সাথে খাতির লাগিয়ে ফেলল। সপ্তাহখানেকের মধ্যে খোঁজ পেয়ে গেল। বর্ষা, নিলুর ক্লাসমেট।
মামার বাসায় থেকে পড়াশুনা করছে। বুদ্ধিমতি নিলু যা বোঝার বুঝে ফেলল। এরপর নিলুর মাধ্যমেই বর্ষার সাথে প্রথম কথা বলা, পরিচয়। এরপর ভালোলাগা-ভালবাসার প্রহরগুলো। বর্ষা তখন কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে।
তা-ও ছয়-সাত বছর আগের কথা। রাশেদ ভার্সিটি থেকে পাশ করে বের হল। একটা ভালো জব পেয়েছে। নিলু থার্ড ইয়ারে পড়ছে। এই দুর্মূল্যের যুগে এতো লম্বা সময় সম্পর্ক টিকে থাকাটা অস্বাভাবিক, দুজনের অপরিসীম ইচ্ছে আর পারস্পরিক বোঝাপড়া সেটাকে সম্ভব করে দিল।
দরজায় কেউ নক করছে। বর্ষা নড়েচড়ে বসল। রাশেদ বলল- ‘কে?’
কেউ উত্তর দিল না। শব্দ বেড়ে চলছে। রাশেদ উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল।
হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকল তন্বী। তন্বী বর্ষার চাচাতো বোন, ওর বছর দুয়েকের ছোট হবে। সোজা গিয়ে বর্ষার পাশে বসল। একটা প্যাকেট বের করে বর্ষার হাতে দিয়ে বলল- ‘মিলি আপু পাঠিয়েছে। ’
মিলি বর্ষার বান্ধবী।
বিয়ে করে স্বামীসহ প্রবাসিনী। বর্ষা বেশ অবাক হল। ‘তোর কাছে কেন?’
-‘কুরিয়ারে পাঠিয়েছে, কাল পেয়েছি। ফোন করে বলল যেন তোমাকে আজ রাতে পৌঁছে দেই। আমি যাই।
’ উঠে দাঁড়িয়ে রাশেদকে দেখে হাসল। ‘কী ভাই, খুব কি বিরক্ত করলাম?’ বলেই খিলখিল করে হাসতে লাগলো। রাশেদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বেরিয়ে গেল।
দরজা বন্ধ করে বর্ষার পাশে গিয়ে বসল রাশেদ। বর্ষা প্যাকেট হাতে নিয়ে বসে আছে।
দুজনই নিরব। কিছু একটা বলা দরকার, রাশেদ বলল- ‘কী আছে প্যাকেটে?’
-‘জানি না। খুলে দেখো। ’ বর্ষার কণ্ঠ এতো লাজুক কখনোই ছিল না। রাশেদ অবাক হল।
-‘আমি কেন খুলব? কী অদ্ভুত! তোমাকে দিয়েছে তুমি খোলো। ’
বর্ষা প্যাকেটটা খুলে ফেলল। একটা খাম আর একটা বক্স। খামের ভিতরে একটা চিরকুট, লেখা ‘ছোট পরিবার, সুখী পরিবার। ’! বক্সে কী আছে আঁচ করতে পারছে বর্ষা।
লজ্জায় লাল হয়ে গেল বর্ষার দুধেআলতা গাল!
বর্ষার হাত ধরল রাশেদ। কেঁপে উঠলো বর্ষা। পুরো শরীর শিরশিরিয়ে উঠলো। রাশেদ ফিসফিস করে বলল- ‘কেমন আছ বর্ষা?’
বর্ষা হাসল, ‘তোমার কী মনে হয়?’
রাশেদ অবাক হয়ে গেল। বর্ষার হাসি সুন্দর, এ কথা রাশেদ অনেকবার বলেছে।
কিন্তু এতো সুন্দর সেটা জানত না! বলল- ‘তোমার হাসিটা সত্যি অনেক সুন্দর। হাসি দেখে তো অন্তত মনে হচ্ছে না খারাপ আছ। ’
সাড়ে এগারোটার দিকে উঠে গিয়ে আলো নিভিয়ে দিল রাশেদ। বর্ষা শুয়ে পড়েছে, পাশে শুয়ে পড়ল। ‘ঘুমিয়েছ?’
-‘উঃ’
-‘ঘুমাবে?’ রাশেদ হাত বাড়িয়ে বর্ষাকে জড়িয়ে ধরল।
সযত্নে রাশেদের হাতটা সরিয়ে দিল বর্ষা। ‘উঁহু!’
-‘কী?’
-‘আমার শরীর খারাপ!’ বর্ষা আরও একটু সরে গেল।
হা হা করে হাসতে লাগল রাশেদ। ‘আমি ওরকম কিছু ভাবি নি বর্ষা! সব ব্যাপারেই আমরা দুজন একসাথে সিদ্ধান্ত নেব। আচ্ছা, একটা বিষয় কি খেয়াল করেছ?’
-‘কী?’
-‘এই যে তুমি বললে শরীর খারাপ! কেন? কেন এটাকে তোমরা শরীর খারাপ হিসেবে নিয়েছ?’
-‘সবাই বলে।
’ বর্ষা কিছুটা আড়ষ্ট।
-‘হ্যা, সবাই বলে। এখানেই সমস্যা। তোমাদের, মেয়েদের মগজটাই তৈরি হয়েছে এভাবে। এটা একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার, কোটি বছর ধরেই আছে; অথচ তোমরা এখনো এটাকে শরীর খারাপ বলছ!’
-‘হুম!’
-‘তোমরা যারা আধুনিক, তারাও এখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারো নি।
এরকম আর বলো না। তাছাড়া শুনতেও ভালো লাগে না, মনে হয় তোমরা খুব অসন্তুষ্ট। ’
-‘ওকে। ’
রাশেদ বুঝতে পারল, বর্ষা আলোচনায় একদমই আগ্রহী না। ‘ঘুমিয়ে পড়।
কাল থেকে তোমার নতুন জীবন, নতুন সংসার। আরেকটা কথা বর্ষা-’
-‘বল। ’
-‘আমি জানি এটা তোমাকে বলে দিতে হবে না, তবু বলি, আমাদের পরিবারের সবাইকে নিজের মতো করে দেখো। বাবা-মা’কে কখনো কষ্ট দিও না, আমাকে এ পর্যন্ত আনতে ওদের অনেক কষ্ট হয়েছে। ’
-‘শোন, রাশেদ!’ রাশেদের হাতটাকে চেপে ধরল বর্ষা।
-‘বল। ’
-‘আমাকে কিচ্ছু বলতে হবে না। তুমি আমাকে যা চেন, আমি কথা দিচ্ছি তার ব্যতিক্রম হবে না। ’
-‘কাল তোমার জন্যে একটা সারপ্রাইজ আছে। ’
-‘আচ্ছা!’ অন্ধকারে মুচকি হাসল বর্ষা।
নিদ্রাদেবী এসে দুজনকে তলিয়ে নিয়ে গেল।
**
সকালে মা নামাজ পড়ে মাত্র উঠেছেন, দরজা খোলার শব্দে এগিয়ে গেলেন। রাশেদ পাঞ্জাবী পড়ে বের হয়ে যাচ্ছে। মা বললেন- ‘কোথায় যাস রাশেদ?’
-‘জরুরী একটা ফোন এসেছে মা, ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই ফিরবো। ’
-‘তাই বলে এতো সকালে?’
পাঞ্জাবীর বোতাম লাগাতে লাগাতে রাশেদ বলল- ‘হ্যা, মা।
যাব আর আসব। বর্ষা ঘুম থেকে উঠলে বল আমি জরুরী কাজে বাইরে গেছি। ’ রাশেদ বেরিয়ে গেল।
রাশেদ বেরিয়েছে পাঁচ ঘণ্টার উপরে। বর্ষা সকালে নাস্তা করে নি, মা বেশ জোরাজুরি করেছেন।
বর্ষা জানে, রাতে বলা সারপ্রাইজ বিষয়ক কোনও কারণে রাশেদ বাইরে গেছে। কিন্তু দুই ঘণ্টার কথা বলে এতো দেরী করবে, এটা কেমন কথা!
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। বাসায় সবাই খুব চিন্তিত। আশেপাশে আত্নিয়স্বজনের বাসায় খোঁজ নেওয়া হয়েছে, কেউ কোনও খবর দিতে পারে নি। শফি বলল ওদের বাসাতেও যায় নি।
বর্ষা সারপ্রাইজের কথা ভুলে গেছে। দরজা বন্ধ করে কেঁদেছে কিছুক্ষণ, একটা মানুষ এরকম খামখেয়ালী হতে পারে!
পরিশিষ্টঃ
সন্ধ্যার কিছু আগে বাসার পাশের ডোবায় রাশেদের লাশ পাওয়া গেছে। পুরো শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। যে নম্বর থেকে সকালে রাশেদের মোবাইলে ফোন এসেছিল, সেটা বন্ধ। পুলিশ ধারণা করছে পূর্ব-শত্রুতার জের ধরে রাশেদকে খুন করা হয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।