আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রোগের নাম সেরেব্রাল পাল্‌সি

শারিরীক প্রতিবন্ধি বা বুদ্ধি প্রতিবন্ধি এই শব্দ দুটির সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় শিশুর এই সমস্যাকেই সেরেব্রাল পালসি বলে। অনেকের ধারণা, বাবা-মা'র পাপের ফলে শিশু প্রতিবন্ধি হয়। বাবা-মায়ের কর্মফল শিশু কখনো ভোগ করতে পারে না এবং প্রতিবন্ধি হতে পারে না। সেরেব্রাল পালসি: আমাদের মস্তিষ্কের একটি অংশের নাম সেরেব্রাম।

সেরেব্রামের কাজ হলো বুদ্ধিমত্তা, বিচার শক্তি, মাংসপেশির ঐচ্ছিক কাজ করার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রন করা। যদি শিশু জন্মের আগে, জন্মের সময় বা জন্মের ২ বছরের মধ্যে কোন কারনে মস্তিষ্কের এই অংশটি ক্ষতিগ্রস্থ হয় তাহলে শিশুর শারিরীক বা বুদ্ধি জনিত যে সমস্যা দেখা দেয়, তাকেই সেরেব্রাল পালসি বলে। ব্রিটিশ ডাক্তার ড: জন লিটল সর্বপ্রথম এই রোগের আবিস্কার ও নামকরণ করে থাকেন। তাই এই রোগকে লিটল ক্লাব রোগ ও বলা হয়ে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেরেব্রাল পালসিতে আক্রান্ত শিশুর শারিরীক এবং বুদ্ধি জনিত দুইটি সমস্যা হতে পারে।

কখনও কখনও শারিরক সমস্যার তুলনায় বুদ্ধিজনিত সমস্যা কম থাকে আবার অনেক ক্ষেত্রে শিশুটির শারিরীক সমস্যা থাকলেও বুদ্ধিজনিত সমস্যা নাও থাকতে পারে। যে সব কারনে সেরেব্রাল পালসি হতে পারে:  গর্ভাবস্থায় মা অপুষ্টিতে ভূগলে  গর্ভাবস্থায় মায়ের জন্ডিস হলে  গর্ভাবস্থায় মায়ের কিডনিতে বা পস্রাবের রাস্তায় ইনফেকশন হলে  মা যদি গর্ভাবস্থায় ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওষুধ সেবন করে  জন্মের সময় শিশুটি যদি অক্সিজেনের অভাবে ভোগে  শিশুটির জন্মের ১ সপ্তাহের মধ্যে যদি খুব বেশি জন্ডিস হয়  জন্মের সময় শিশুর মাথায় আঘাত পেলে; বিশেষ করে ফোরসেপ ডেলিভারীর সময়  জন্মের পর শিশুটি যদি মস্ত্মিষ্কের কোনো ইনফেকশনে ভোগে। য়েমন: এনকেফালাইটিস, মেনিন্‌জাইটিস ইত্যাদি।  শিশুটি পড়ে গিয়ে বা কিছু দ্বারা মাথায় আঘাত পেলে  নির্দিষ্ট সময়ের আগে ডেলিভারী করালে সেরেব্রাল পালসিতে আক্রান্ত শিশুর প্রাথমিক লক্ষণ সূমহ: -জন্মের পর শিশু কান্না না করলে বা অনেক্ষন পর কান্না করলে -জন্মের পর শিশুর খিচুনি হলে -শিশুটির শরীরের গঠন বা ভঙ্গিমা অস্বাভাবিক হলে -শিশুটির ব্যবহার অস্বাভাবিক হলে -বিছানায় শোয়াবস্থায় কুজো হয়ে থাকলে -হাত পা শক্ত থাকলে -ঘাড় সোজা করতে না পারলে -শিশুটির বসা বা দাড়ানো অবস্থায় ভারসাম্য রাখায় সমস্যা হলে -শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হলে -একটি স্বাভাবিক শিশুর মতো যে বয়সে উপুর হওয়া, হামাগুড়ি দেয়া, বসতে শেখা, দাড়ানো বা হাটার কথা; সেটা করতে না পারলে সেরেব্রাল পালসি'তে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায় যেসব কারনে: ক. মা-বাবার বয়স সংক্রান্ত সমস্যা: ১. মায়ের বয়স ৪০ বছরের বেশী হলে ২. মায়ের বয়স ২০ বছরের কম হলে ৩. বাবার বয়স ২০ বছরের কম হলে খ. বাচ্চা সংক্রান্ত সমস্যা: ১. পরিবারের ১ম বাচ্চা, ৫ম বা তার অধিক বাচ্চা হলে ২. বাচ্চার শারীরিক ওজন ৩-৫ পাউন্ডের নিচে হলে ৩. বাচ্চা ৩৭ সপ্তাহের আগেই ডেলিভারী হলে। গ. অন্যান্য সমস্যা: ১. মা ও বাচ্চার রক্তের Rh ফ্যাক্টরে অমিল থাকলে ২. প্রাথমিক গর্ভাবস্থায় মা যেকোন ধরনের ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে ৩. কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে জীবাণু সংক্রমন করলে।

সেরেব্রাল পালসি'র প্রকারভেদ: এই রোগকে সাধারনত ৪ ভাগে ভাগ করা হয়: ১. স্পাস্‌টিক ২. অ্যথেটয়েড ৩. অ্যাটাক্‌জিক ৪. মিক্সড্ -স্পাস্‌টিক সেরেব্রাল পালসি স্পাস্‌টিক সেরেব্রাল পালসিতে মাংসপেশীতে টানটান ভাব অনেক বেশী থাকে। জয়েন্টের নড়াচড়া অনেক শক্ত হয়ে যায়। সেরিব্রাল পালসি বাচ্চাদের ক্ষেত্রে স্পাস্‌টিক খুব বেশি দেখা যায়। -অ্যথেটয়েড সেরেব্রাল পালসি: এই ধরনের বাচ্চাদের হাত-পায়ের নাড়াচাড়া অনেক ধীর হয় এবং অনিয়ন্ত্রিত থাকে। মাংসপেশীর টানটান ভাব কম থাকায় বাচ্চার সোজা হয়ে বসা বা দাড়ানো অনেক কঠিন হয়ে পড়ে।

-অ্যাটাক্‌জিক সেরেব্রাল পালসি: এ ধরনের বাচ্চারা নিজে থেকে কিছু করতে গেলে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভিতর সমন্বয় করতে পারেনা এবং ভারসাম্যেও সমস্যা থাকে। মাথা, ঘাড় ও কেমড় স্থির রাখতে পারেনা। -মিক্সড্ সেরিব্রাল পালসি: এ ধরনের বাচ্চাদের লক্ষণ সমূহ বিভিন্ন প্রকার সেরিব্রাল পালসি'র সমন্বয়ে হয়ে থাকে। সেরিব্রাল পালসি বাচ্চাদের চিকিৎসা পদ্ধতি: উপরিঊক্ত বর্ণনার সাথে যদি আপনার বাচ্চার লক্ষণ মিলে যায়, তাহলে অতি দ্রুত একজন শিশু বিশেষজ্ঞের সরণাপন্ন হতে হবে। কিছু টেষ্ট যেমন: MRI, CT-Scan, EEG ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা নিশ্চত হতে পারি শিশুটি সেরেব্রাল পালসিতে আক্রান্ত কি না।

এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, ঔষধ শিশুর খিচুনিসহ কিছু সমস্যা দূর করতে পারলেও তার শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে পারে না। শিশুর শারিরীক বিভিন্ন সমস্যাগুলো দূর করে স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজন সঠিক ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা। সেরেব্রাল পালসি'র ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা: একজন ফিজিওথেরাপিষ্ট রোগীর রোগ বর্ণনা, ফিজিক্যাল টেষ্ট, ফিজিওথেরাপিউটিক স্পেশাল টেষ্ট, বিভিন্ন রেডিওলজিক্যাল টেষ্ট এবং প্যাথলজিক্যাল টেষ্ট এর মাধ্যমে কি ধরনের সেরেব্রাল পালসি হয়েছে এবং শারিরীক সমস্যা সূমহ নির্ণয় করে থাকেন। অত:পর রোগীর সমস্যানুযায়ী চিকিৎসার পরিকল্পনা বা ট্রিটমেন্ট প্লান করেন এবং সেই প্লান অনুযায়ী নিন্মোক্ত পদ্ধতিতে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা সেবা প্রদান করে থাকেন।  সঠিক পজিশনিং  মাংস পেশীর স্বাভাবিক দৈর্ঘ্য বজায় রাখা  মাংস পেশীর স্বাভাবিক টান ফিরিয়ে আনা  দূর্বল মাংসপেশিকে সবল হতে সাহায্য করে  শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টের স্বাভাবিক নাড়ানোর ক্ষমতা বা মুভমেন্ট ফিরিয়ে আনা  শরীরের ভারসাম্য ধরে রাখতে  শিশুর স্বাভাবিক হামাগুড়ি দেয়া, বসা, দাড়ানো, হাটা ইত্যাদি শিখতে  শিশুর অনুভূতি শক্তি স্বাভাবিক করতে  শিশুর স্বাভাবিক বিকাশে  এছাড়াও কিছু কিছু শিশুর জন্য বিভিন্ন ধরনের স্পেশাল ইক্যুইপমেন্ট যেমন: স্পেশাল চেয়ার, জুতা, দাড়ানো বা হাটার ফ্রেম ইত্যাদি ব্যবহার করে শিশুকে আত্ননির্ভরশীল করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে সাহায্য করে  সর্বোপরি শিশুর বাবা-মা বা অভিভাবককে শিশুর সমস্যা এবং যত্ন নেয়া সম্পর্কে শিক্ষা দান করার মাধ্যমে।

শেষ কথা: শিশুর শারিরীক সমস্যা দুর করে কার্যক্ষমতা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার ভূমিকা অপরিসীম। তবে ফিজিওথেরাপি'র নামে শুধূমাত্র মেশিন যেমন: হিট, ভাইব্রেশন, ইলেকট্রিক্যাল ষ্টিমুলেশন ইত্যাদি ব্যবহার করে যে অপচিকিৎসা দেয়া হয় তা থেকে বেঁচে থাকাই ভালো। সুতরাং সেরেব্রাল পালসি শিশুকে পরিবারের বা সমাজের অভিশাপ না ভেবে সঠিক সময়ে সঠিক ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা দিয়ে শিশুর সুস্থ জীবন নিশ্চিত করতে আমাদের সচেষ্ঠ হতে হবে। ডাঃ ফৌজিয়া পারভীন ক্লিনিক্যাল ফিজিওথেরাপিষ্ট নিউরোলজি ইউনিট(আউটডোর) ফিজিওথেরাপি বিভাগ সিআরপি-মিরপুর, ঢাকা। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.