আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জোনাকি

আমার ঘরের চাবি পরের হাতে ...... ১ দোকানের সামনে রাখা বেঞ্চিতে বসে চা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছিলাম আমি আর ইরফান। আমাদের দোতলা ঘরের জানালা থেকে এ জায়গাটা দেখা যায়। তাই আমি একটু ভিতরের দিকে বসলাম। মায়ের চোখে পড়ে গেলে সমস্যা হয়ে যাবে। তাঁর ধারণা পৃথিবীর সকল বখাটে চায়ের দোকান থেকে উঠে আসে।

কথায় কথায় তাঁর ভাইদের টেনে নিয়ে এসে বলবেন, “জানিস আমার ভাইরা চা সিগারেট তো দূরে থাক পানি খাওয়ার জন্যও কখনো চায়ের দোকানের ভিতরে যেতনা। কোন জিনিস কেনার দরকার হলে দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে নিত”। জানালার চোখ বাঁচিয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছিলাম। ইরফানের হাতে ধরা সিগারেটটা নিয়ে টানও দিচ্ছিলাম মাঝে মাঝে। একটু আধটু সিগারেট খেলেও এখনো ঠিক অভ্যস্থ হয়ে উঠতে পারিনি।

সিগারেট খাওয়া মাত্র বুক জ্বালা পোড়া করে। আজও দেখছি বুক জ্বলছে। কেউ যাতে বুঝতে না পারে,মুখের ভাব যথাসম্ভব ঠিক রেখে জ্বলুনিটা হজম করার চেষ্টা করছি। ঠিক তখুনি, জানিনা কোত্থেকে, ঝড়ের বেগে ছুটে আসল তানভীর। বেঞ্ছিতে না বসেই উত্তেজিত কন্ঠে বলতে শুরু করল “চেয়ারম্যনের লোকেরা লিটনকে মেরে ফেলেছে,শুনেছিস! বাজারে লাশ পড়ে আছে”।

দুজনই দাঁড়িয়ে পড়লাম। আক্ষরিক অর্থেই হতভম্ব হয়ে পড়েছি। ইরফান বলল, “মজিদ ড্রাইভারের ছেলে লিটন”? “হ্যাঁ” আমি বললাম “কেন”? “বেতন নিয়ে নাকি কথা কাটা কাটি হয়েছিল। আর চাকরি করবেনা বলেছিল ও। এ কথা সে কথার পর এক পর্যায়ে হাতাহাতি হয়ে যায়।

তারপর তো মেরেই ফেলল ছেলেটাকে ওরা” এটুকু বলার পর সে বলল “চল” বললাম “কোথায়”? “বাজারে। দেখে আসি”। “চল” দুজনই বললাম একসাথে। বাজারে গিয়ে দেখি, লোকজন বেশ স্বাভাবিক চলাফেরা করছে । জিনিসপত্র দরাদরি করে কিনছে।

বাজারের পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া তরুণীদের দিকে তাকাচ্ছে লোভাতুর চোখে। কে বলবে ঘন্টা চারেক আগে এখানেই ঘটে গেছে ভয়াবহ এক হত্যাকান্ড। ঘটনাস্থলে গিয়ে জানতে পারলাম, লাশ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। চলাফেরার অসুবিধা হবে বলে ধুয়ে ফেলা হয়েছে রক্তের দাগও! কারো মৃত্যুতে কারও জীবন কি আর থেমে থাকে? থাকেনা। ২ ঘটনার দু একদিন পর তানভীর এসে বলল, “কোন মামলা করা হয়নি।

লিটনদের পরিবার থেকে কেউ আসেইনি নাকি মামলা করতে”। মনে মনে ভাবছি ঠিক-ই করেছে ওরা। বুদ্ধিমানের পরিচয় দিয়েছে। যা গেছে তা যখন আর ফিরে পাওয়া যাবেনা এর জন্য নতুন করে বিপদ ডেকে আনার কোন মানে নেই। “ভাবছি” বলল তানভীর “লিটনের পক্ষ হয়ে আমরাই মামলা করব”।

তানভীরের কথা শুনে আমাদের চেহারা হল দেখার মত। ফুটো হওয়া বেলুনের মতই চুপসে গেল লিটনকে নিয়ে আমাদের যত ভাবাবেগ। চেহারা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বললাম, “মামলা যে করবি টাকা পয়সা কোথায় পাবি?” “আগে কেইসটা লিখিয়ে নিই। টাকাপয়সার ব্যাবস্থা একটা হবেই। মাঠে নামলে খেলোয়াড়ের অভাব হবেনা” “ঠিক” বলল ইরফান “তবে আমাদের বিপক্ষে” “তোরা আমার সাথে যাবি কিনা বল?” “মানে?” বললাম আমি।

“মানে তোরা না গেলেও আমি যাব” “একলা চলরে?” “হু” “দামি দামি কথা বাংলা পরীক্ষার উত্তর দেওয়ার জন্য জমা রাখ” বলল ইরফান। ৩ কোনভাবেই অমান্য করা যায়না এমন কোন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি করল্লার জুস খেতে বললে যেরকম চেহারা হয় সেরকম চেহারা নিয়ে আমরা দুজন তানভীরের সাথে থানায় যাচ্ছি। আমরা দু জনই তানভীরকে খুব পছন্দ করি,এক সাথে চললেও সে ঠিক আমাদের মত নয়। সমাজের অসঙ্গতি গুলো বদলে ফেলার এক তীব্র ইচ্ছে সে সবসময় তার বুকের ভিতর পুষে রাখে। তাই এক ধরনের দুর্বলতা ওর প্রতি আমরা ফিল করি।

আর সে জন্যই হয়তো তার সাথে যেতে রাজী হয়ে গেলাম, তাছাড়া লিটন ছেলেটাও খুব ভাল ছিল। অভাবের সংসার প্রায় একাই টেনে নিয়ে যাচ্ছিল সে। ছেলেটার জন্য কিছু একটা করার ইচ্ছেও হচ্ছিল। থানায় এক পুলিশ অফিসার(পোস্ট জানা নেই, তার বোধ হয় দরকারও নেই। সব পুলিশ অফিসার-রা দেখতে একই রকম)আমাদেরকে বসালেন।

আমাদের নাম,বাবা কি করে,কোথায় থাকি,এসব তথ্য জেনে নিয়ে বললেন “যাও বাড়ি যাও” তানভীর অবাক হয়ে বলল “মানে? কেইস লিখবেন না?” অফিসার কানি আঙ্গুল দিয়ে কান চুলকাতে চুলকাতে বলল “না” “কেন” তানভীর এবার একটু উত্তেজিত। “তুমি লিটনের কে?” “কেউ না হলে কি কেইস নেয়া যায়না ?একটা নিরীহ মানুষ রাস্তায় লাশ হয়ে পড়ে থাকবে তার হয়ে কেউ কেইস করতে পারবেনা কারন সে আত্বীয় নয় এটা কোন আইনে লিখা আছে?” “দেখ ছোকরা আমাকে আইন শিখাতে এসোনা। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও। ” কোন একটা অদ্ভুত কারনে অফিসারটা আমাদের সাথে ভাল ব্যাবহার করছেন,কিন্তু কেইস যে তিনি লিখবেন না তা তার চেহারা দেখেই বুঝ যাচ্ছে। বুঝতে পারছি পরস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে যাবার আগেই এখান থেকে কেটে পরাই ভাল।

তানভীরকে আমরা একপ্রকার জোর করেই থানার বাইরে নিয়ে আসলাম। ও নিজেও কনফিউসড হয়ে গিয়েছিল। সাহস যতই থাক অভিজ্ঞতার অভাব কিংবা অন্য কোন কারনে অফিসারের কথার পিঠে সে কিন্তু যুৎসই কোন জবাব দিতে পারেনি। “হেরে গেলাম” এমন একটা ভঙ্গিতে সে দাঁতে দাঁত ঘষছে। থানা থেকে ফেরার সময় কেউ কোন কথা বলিনি।

দমবন্ধ হওয়া নিস্তব্ধতা নিয়ে যে যার ঘরে ফিরলাম। ৪ রাতে ফিজিক্স বইয়ের ভিতরে রাখা হুমায়ুন আহমেদের নবনী পড়ছিলাম। নিচতলায় শুনলাম বাবা রাব্বি!রাব্বি! বলে চেঁচিয়ে আমাকে ডাকছেন। বাবার কন্ঠে এমন একটা ব্যাপার ছিল যে সারা শরীরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। দোতলা থেকে নিচে নেমে দেখি বাবার পরনে কোট টাই।

তার মানে বাবা এই মাত্র অফিস থেকে এসেছেন। ঘটনা কি বুঝতে পারছিনা। বাবার আওয়াজ শুনে ততক্ষনে মাও ছুটে এসেছেন। আমি কাছে গিয়ে বললাম “কি হয়েছে বাবা ডাকছেন কেন?” বলতে না বলতেই পাঁচ কিলো উজনের এক হেভী চড় বসিয়ে দিলেন আমার বাম গালে! প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম। কোন মতে নিজেকে সামলে নিয়ে মায়ের দিকে থাকালাম।

হতভম্ব হয়ে গেছেন উনি। চোখ বিস্ফোরিত। বাবা তখন চড়া গলায় বলেই যাচ্ছেন “নেতা হয়েছিস,মানব দরদি হয়েছিস?ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো হচ্ছে। ” ক্লাশ এইটে উঠার অনেক বছর পর বাবা আমার গায়ে হাত তুললেন! দশ পনের মিনিট পর আসল ঘটনা জানা গেল। চেয়ারম্যানের এক ছোটভাই বাবার অফিসে গিয়ে অত্যন্ত ভদ্রভাবে নাকি বলে গিয়েছেন “ছেলেকে সামলে রাখুন,আজেবাজে ছেলেদের সাথে মিশতে দিয়েন না।

একটু শাসন করুন ছেলেকে। বাইরের লোক শাসন করলে কি ভাল দেখাবে?” বাম গালে হাত বুলাতে বুলাতে উপরে উঠে এলাম। ইরফানকে ফোন করলাম ওর কি খবর জানার জন্য। যা শুনলাম তাতে বেশ মন খারাপ হল,ওর মা নাকি একপ্রকার হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়েছে ওদের কাছ থেকে। কি লজ্জা!কি লজ্জা!।

এ অপমান ইরফান ভুলতে পারছেনা। ইরফান আর একটা অদ্ভুত কথা শুনাল “তানভীরকে নাকি এলাকায় ড্রাগ সাপ্লাই এর সাথে জড়িত সন্দেহভাজন হিসেবে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে!” বুঝতে পারলাম তানভীর ভালই ঝামেলায় পড়েছে। জলে থেকে কুমির ক্ষ্যাপানো কি আর ঠিক? ৫ দু একদিন পর। সকাল দশটা এগারটার মত বাজে। তিনজনই বসে আছি সেই চায়ের দোকানটিতে।

টুকটাক কথা বলছি। চা সিগারেট খাচ্ছি। তানভীরকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “তোকে কে ছাড়িয়ে আনল রে?” “বাবা” “তোর বাবা কিছু বলেনি” “বলবেনা কেন। বকেছে খুব” তারপর কিছুক্ষন চুপচাপ। কেউ কিছু বলছিনা।

অদ্ভুত একটা শান্ত ভাব এসে গেছে সবার মধ্যে। সময়টা সকাল হলেও বাইরে তখন বৈকালিক বিষণ্ণ রোদ। দোকানদার আর আমরা তিনজন ছাড়া দোকানে আর কেউ নেই। বেঞ্ছিতে ছলকে পড়া চায়ের ফোঁটার উপর মাছি উড়ছে। কোনার দেয়াল ঘেষে একটা মোটা টিকটিকি ধীর গতিতে বেয়ে উঠে যাচ্ছে উপরের দিকে।

“আমি একটা প্ল্যান করেছি” আমাদের মনযোগ আকর্ষণ করে বলল তানভীর “আজই প্ল্যান অনুযায়ী প্রথম পদক্ষেপ নেয়া হবে। ” কিসের প্ল্যান আগ বাড়িয়ে জানতে ইচ্ছে হলনা। ও নিজেই বলে যাচ্ছে, “আজিজ চৌধুরিকে তো চিনিস। বাজার সমিতির সভাপতি। ওনার কাছে যাব।

ওনাকে দিয়েই এই খুনের একটা ব্যাবস্থা করব। আজ বিকেলেই যাব। ” যা ভয় পাচ্ছিলাম তাই। ওর মাথা থেকে লিটন খুনের ভুত নামেনি। উল্টো আমাদের ঘাড়ে-ও চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে।

আজিজ চৌধুরি আর চেয়ারম্যান এর মধ্যে পুরনো শ্ত্রুতা। এ সহজ অংকটাই তানভীর কাজে লাগাতে চাচ্ছে। কিন্তু যতই শত্রু হোক আজিজ চৌধুরি এক জন বুদ্ধিমান লোক,চেয়ারম্যান কে ঘাটাতে চাইবে বলে মনে হয়না। বরং তানভীরেরই ডাবল বিপদে পড়ে যাবার সম্ভাবনা। তাছাড়া তানভীরের মত এক তরুণকে তিনি পাত্তাই বা দেবেন কেন? তানভীর বলল “অনেক কাজ সারতে হবে এখন যাই।

বিকেলে রেডী থাকিস!” ৬ বিকেলে ও আসলে তানভীরকে আমি আর ইরফান ইনিয়ে বিনিয়ে জানিয়ে দিয়েছি যে আমাদের পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। ও আমাদের সব কথা শুনে অবাক হল। অদ্ভুত একটা কন্ঠে বলল, তাহলে তোরা যাবিনা? বুঝতে পারলাম ওকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়াটাই ভাল। তাই আমি দৃঢ়ভাবে বললাম “না!” ও বলল, “তোরটা তুই বল। ইরফানেরটা ইরফান কে বলতে দে।

ইরফান তুই যাবি?” ইরফান মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। তানভীরের চোখে ঘৃণা আর হতাশা। তার ঐ দৃষ্টি দেখে আমি বললাম, “তুই শুধু শুধু পাগলামি করছিস তানভীর। এতে কি লিটন ছেলেটা আর ফিরে আসবে? আসবেনা। উল্টো তুই বিপদে পড়ে যাবি”।

ও কিছু না বলে উঠে দাঁড়াল। ইরফান বলল, "তাহলে তুই যাচ্ছিস?" “হ্যাঁ” আমি বললাম “ভাল থাকিস। ” মনে হয় কৌতুক বোধ করল। ম্লান হাসল সে। সে চলে যাচ্ছে।

তার চলে যাওয়ার দিকে আমরা দুজন থাকিয়ে আছি। কিছুদূর চলে যাবার পর ইচ্ছে হল বলি, “আমাকেও সঙ্গে নে তানভীর!” কিন্তু পারিনি। ভিতরের কাপুরুষ টা বাঁধা দিল। তা দিক। আমরা না গেলেও তানভীরের এগিয়ে যেতে কোন সমস্য নেই।

সে তো আর আমাদের মত না। সে তো সেই সব মানুষদের একজন যারা অন্ধকার যত ঘন আর ভয়ঙ্করই হোক, সেই অন্ধকারের বিরুদ্ধে অন্তত একটি জোনাকি হয়ে জ্বলে উঠতে চায়! ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।