অভিলাসী মন চন্দ্রে না পাক, জোছনায় পাক সামান্য ঠাই বাংলাদেশের সামনে এক বিরাট সুযোগ হাজির হয়েছে। অর্থনৈতিক এই সুযোগ মূলত ফরেন পলিসি নির্ভরশীল। সরকারের কিছু সিদ্ধান্ত ও বৈশ্বিক চাহিদা, দুয়ে মিলে এই প্রথমবারের মত বাংলাদেশ দক্ষিন এশীয় আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে কার্যকরী ভূমিকা রাখার মত অবস্থানে প্রবেশের সুযোগ পেল। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য এবং নেপাল ও ভুটান, দেশ ৩টির সাথে বাংলাদেশ সম্ভাবনাময় বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য দারপ্রান্তে রয়েছে।
নেপাল-ভুটান-বাংলাদেশ এবং ত্রিপুরা (সেভেন সিস্টার্স) মিলে একটি সম্ভাবনাময় বাজার এবং অফিসিয়াল বা আনঅফিসিয়াল আঞ্চলিক জোট গঠনের সম্ভাবনা শুধু একটি প্রয়োজনই নয় বরং আমাদের টিকে থাকার একমাত্র উপায়ও বটে।
আমাদের ভুখন্ড ব্যবহার করে অপরদেশগুলোকে ট্রানজিট দেয়া কেন দরকার এবং দিলে আমাদের কি কি লাভ হবে, এই পোস্টে সেই দিকগুলোই আলোচনা করা হয়েছে।
প্রথমে দেশগুলোর সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত্তিতে বিশ্লেষন। এবং এরপরের অংশে বাংলাদেশের ফরেন পলিসি'র সার্বিক লক্ষ্য এবং এই প্রজেক্টের সফলতার সম্ভাবনা!
ভারত তথা ত্রিপুরা তথা সেভেন সিস্টার্স :
ত্রিপুরা তো আমাদের বুকের ভেতর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া অংশ। মানচিত্রটি দেখুন!
ত্রিপুরা এবং মেঘালয় ভারতের রাজ্য। কিন্তু দুর্ভাগ্য ওদের! কোন নৌবন্দর নেই এমন কি অন্যান্য সেভেনসিস্টার্সের মতই বরং তাদের তুলনায় একটু বেশিই দুঃখজনক ভাবে ভারতের মূল ভু-খন্ডের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভয়াবহ দুর্বল! ওদের অর্থনীতির উন্নয়ন বাংলাদেশের সাহায্য ও ভুখন্ডের সাথে একই সূত্রে গাঁথা।
সেভেন "আনলাকি" সিস্টার্স নামে পরিচিত, ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় এই রাজ্যগুলোর কোন নৌবন্দর নেই। ভারতের মূল ভুখন্ডের সাথে স্বাভাবিক সড়ক যোগাযোগ থেকেও তারা বেশ বিচ্ছিন্ন। এমন পরিস্থিতিতে ওদের রাজ্যগুলো নিজেদের সম্পদ ব্যবহার করে অর্থনৈতিক সুবিধাগুলো আদায়ের কোন সুযোগ পর্যন্ত করতে পারছে না। বাংলাভাষী বাংলাদেশ যদি ওদের ট্রানজিট দেয়, ওরা যদি আমাদের বন্দর ব্যবহার করতে পারে তবে, ওদের রপ্তানী ও আন্তর্জাতিক আমদানী নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পাবে। ত্রিপুরা সরকারের মত অন্যান্য রাজ্যের সরকারগুলোও বিষয়টি সম্পর্কে বেশ ভালমতই অবগত।
তাই তারা বাংলাদেশ সরকারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে সচেষ্ট হয়ে উঠেছে। এবং ত্রিপুরা এক্ষেত্রে অগ্রগামি।
ভারত একটি ফেডারেল রাষ্ট্র। যেখানে রাজ্যগুলো ফ্রেমের মধ্যে তাদের নিজ নিজ লক্ষ্য ও কর্মকান্ড নির্ধারনে স্বাধীন। তাই দিল্লি বা কলকাতার বিরোধীতার কথা ভেবে চিন্তিত হবার কারন নেই।
এবং আমাদের কারো স্বার্থে আঘাত করার কোন দুরভিসন্ধিও নেই। বরং,
ওদের এবং আমাদের উন্নতি একই সুতোয় গাঁথা। কারন,
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ নেই। আমাদের যা করতে হবে তা হচ্ছে আমাদের মাটি ও মানুষ, এই দুটির সর্বোচ্চ নিরাপদ প্রয়োগ।
সেভেন সিস্টার্সকে, ট্রানজিট দিলে আমাদের প্রধান লাভ হচ্ছে অর্থনৈতিক।
ওদের পণ্য পরিবহন হবে আর আমরা শুধু ট্যাক্স নিব! দ্বিতীয় লাভ হচ্ছে ত্রিপুরার সাথে সম্পর্কে স্থাপনের ধারাবাহিকতা ভারতে "সেভেন সিস্টার্স" ক্রমেই আমাদের বন্দর এবং সড়ক পথের অবকাঠামোগত সুবিধা গ্রহনে আকৃষ্ট হবে। যা শুধু আমাদের উন্নতিই নয় বরং আমাদের আভ্যন্তরীন ব্যবসা বাণিজ্যের স্পিডআপ করার জন্যও প্রয়োজনীয়। তৃতীয়ত, আমাদের মানুষ ও ব্যবসায়ীদের কর্মসংস্থান হবে। ত্রিপুরা রাজ্যের বর্ডার পর্যন্ত মালামাল পরিবহনে আমাদের শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের জন্য কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বাড়বে। চতুর্থ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকার ও ব্যবসায়ীরা অভিজ্ঞ হবে।
---ফরেন পলিসি এনালিস্ট হিসেবে, আমার প্রধান লক্ষ্য ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরা এবং ধারাবাহিকতায় অন্যদের সাথে আমাদের সম্পর্ক উন্নতির সাথে সাথে অর্থনৈতিক উন্নয়নের খাতিরে তারা আমাদের প্রতি নির্ভরশীল হবে। বাংলা ভাষাভাষী এই প্রতিবেশী রাজ্যটিতে প্রচুর সংখ্যক বাংলাদেশী মাইগ্রেশন করায় তাদের বিশ্বস্ততা সম্পর্কে আমাদের নিশ্চয়তা ইতিমধ্যেই রয়েছে। এবং ত্রিপুরার অর্থনীতির চাবিকাঠি আমাদের হাতে থাকা মানে ভারতের সাথে সার্বিক সম্পর্কে আমরা নজিরবিহীন "আপ হ্যান্ড" লাভ করবো। কারন, বাংলাদেশ যদি বিশ্বের সাথে ওদের যোগাযোগ ব্যবস্থা করিয়ে দিতে সক্ষম হয় যা ওদের নিজ রাষ্ট্রের পক্ষে অসম্ভব, তাহলে বাস্তবিকভাবেই ওরা ভারতের তুলনায় আমাদের প্রতি নির্ভরশীল থাকবে। আর এটা হবে ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্কের ভারসাম্য নির্ধারনের "ডিপ্লোম্যাটিক টুল"।
ভুটান :
একটি সুসংবাদ দেখলাম "কালের কন্ঠ" পত্রিকায়। ভুটান বাংলাদেশের সৈয়দপুর বিমানবন্দর ব্যবহারে আগ্রহী! ভুটানের থিম্পু বিমানবন্দরে আবহাওয়াজনিত সমস্যার কারনে মাত্র ১৫০ কিলোমিটার দুরের বাংলাদেশের সৈয়দপুর বিমানবন্দর ব্যবহার করতে চায় ওরা। চমৎকার সংবাদ। যদি এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়ে যায় তবে আমাদের জন্য সেটা অতি সুসংবাদ। এর সাথে ওদেরকে আমাদের নৌবন্দর ব্যবহার করতে দেয়া দরকার।
--- প্রথম কারন হলো, বাংলাদেশের ভেতর আরেকটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হবে যা মূলত তৃতীয় একটি দেশের প্রয়োজনীয়তা সরবরাহে নিয়জিত। এর ফলে ভুটানের সাথে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নতুন মাত্রায় পৌছে যাবে। ছোট হোক যাই হোক, একটি "ঝামেলাহীন ও ক্লিন ইমেজের" স্থায়ী মিত্র দেশ আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও পর্যটক প্রিয় ভুটানে যারাই আসবে, তারা বাংলাদেশ সম্পর্কেও আগ্রহী হবে এবং বাংলাদেশের নাম প্রচার ও ব্র্যান্ডভ্যালু বৃদ্ধি পাবে। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের জন্য দরকার হয় একটি সম্ভাবনা'র হাইপ।
এবং সেই হাইপ তৈরীতে প্রচার একটি বড় প্রয়োজন। আমাদের যত প্রচার বৃদ্ধি পাবে ততই আমাদের বৃহৎ বাজারের কথা আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা জানবে। এবং এভাবেই আমাদের দেশের বিনিয়োগ আসবে।
নেপাল:
আরেকটি ল্যান্ডলক দেশ নেপাল। ভৌগলিক দিক থেকে বাংলাদেশের খুব কাছের এবং বন্ধু্ত্বপূর্ণ এই দেশটিও বাংলাদেশের নৌবন্দর ব্যবহার করতে আগ্রহী।
সারা বিশ্বের সাথে ওদের যোগাযোগে বড় বাঁধা ওদের ভৌগলিক অবস্থান। আমরা ওদের এই সমস্যা কাটিয়ে উঠায় সাহায্য করতে পারলে ওরা নিজ অর্থনীতি গিয়ার আপ করতে পারবে। এর সাথে মংলা পোর্ট দিয়ে, ওদের ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশের পশ্চিম দক্ষিনাঞ্চলের শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বাড়বে। চট্রগ্রাম পোর্টের মাধ্যমে পূর্ব দক্ষিনাঞ্চল এবং মংলা দ্বারা পশ্চিম দক্ষিনাঞ্চলের উন্নতি। এছাড়াও নেপাল যেসব খাতের মালামাল পরিবহনে আমাদের যুক্ত করবে সেইসব সেক্টরে বাংলাদেশের পরিচিতি বাড়বে।
পরিচিতি আমাদের অন্যতম লক্ষ্য। আর সংশ্লিষ্ট খাতের বাংলাদেশী লোকজনের দক্ষতাও বাড়বে। ফরেন পলিসি'র হিসেবে, নিয়ন্ত্রনযোগ্য তৃতীয় আরো একটি দেশের অর্থনীতির লাগাম আমাদের হাতে থাকায় আমাদের আঞ্চলিক শক্তি বৃদ্ধি পাবে।
সব শেষে কি দাড়ায় তাহলে?
আগে দেখি দক্ষিন এশিয়ার একটা ম্যাপ :
এই ম্যাপ অনুযায়ী দেখুন, ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশের ইনফ্লুয়েন্স ও বাজার কত ছোট্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ! যা ১৭ কোটি মানুষকে সার্ভ করতে পুরোপুরি অক্ষম! এবং এত কম প্রভাব নিয়ে আমরা আন্তর্জাতিক তো দুরে দক্ষিন এশিয় আঞ্চলিক রাজনীতিতে কোন নিয়ন্ত্রন তো দুরে, ভূমিকাটুকুও রাখতে পারি না। কারন বিশাল আকৃতির ভারত ও পাপীস্তান! ওদের আগ্রাসনের মুখে টিকে থাকতে হলে ওদের কাউন্টার ওয়েট হবার বিকল্প নাই।
এবং কাউন্টার ওয়েট হতে হলে নিজেকে বড় করার বিকল্প নাই। এই শতকে এসে তো আর অন্যের জমি দখল করা সম্ভব নয়। এবং এখন জমি দখলে কোন লাভও নেই। কারন এখন হচ্ছে বাজারের যুগ। তাই আমাদের যা করতে হবে তা হচ্ছে বাজার দখল।
বাংলাদেশ যতই দরিদ্র বা সাইজে ছোট হোক না কেন, ১৭ কোটি মানুষের হিসাবে এটা বিশ্বের প্রথম সারির সাইজের একটি বাজার। এটা মাথায় রেখে এগুতে হবে।
তাই আমাদের যা করতে হবে, নিজেদের জীবন বাঁচানোর জন্য, নিজেদের অর্থনীতি গতিময় করার জন্য অপরের অর্থনীতির সাথে নিজেদের অর্থনীতি জুড়ে দিতে হবে। এবং এভাবেই একটি উল্লেখযোগ্য এলাকার উপর প্রভাব বিস্তার করতে হবে।
শুধুমাত্র ট্রানজিট দিয়ে আমরা যা করতে পারি তা হচ্ছে, বৈধভাবে, কারো ক্ষতি না করে, সবার সুবিধা ও সবার সাথে সুসম্পর্ক নিশ্চিত করে একটি অর্থনৈতিক ইনভিজিবল জোট গঠন।
নিচের ছবি'র মানচিত্র অনুযায়ী দেখুন, নেপাল-ভুটান ও সেভেন সিস্টার্সদের ট্রানজিট দিয়ে ওদের বাজার প্রতিষ্ঠা করাতে পারলে নিজেদের "এরিয়া অব ইনফ্লুয়েন্স" কতটুকু হয়।
কালো দাগের ভেতরের অংশটুকুতে ৩টি স্বাধীন দেশ এবং অপর আরেকটি দেশ ভারতের বিশাল অংশ রয়েছে। ৪টি দেশের এই জোট দক্ষিন এশিয়ার যেকোন পরিস্থিতি প্রভাবিত করার যোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হবেই।
এবং এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বাংলাদেশ-নেপাল-ভুটান ও পূর্ব ভারতের টিকে থাকা ও উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদের ভিত্তিতে জরুরী প্রয়োজন।
আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো।
নেপাল-ভুটান ও পূর্বভারতীয় রাজ্যগুলো সাথে নিজেদের যুক্ত করা আমাদের জন্য নিরাপদ। ভারত-পাপিস্তান এমনকি শ্রীলংকা হলেও আমাদের চিন্তিত হবার কারন খুঁজে পাওয়া যেত। কিন্তু বন্ধুত্বপূর্ন এই ছোট ছোট দেশগুলো এবং আমাদের ব্যাকগ্রাউন্ড এক, চাহিদা এক এবং লক্ষ্য অভিন্ন! যা প্রতিটি দেশের সাথে অপর দেশের সম্পর্কে ভারসাম্য রক্ষায় প্রাকৃতিক সুবিধা বিবেচিত হবে। বরং, ভাল করে দেখলে, আকৃতি- অভিজ্ঞতা এবং অবস্থানগত কারনে বাংলাদেশই হবে এদের নেতা! অন্য কোন সমিকরনে আমরা এই সুবিধা পাবো না।
সুতরাং, প্রাকৃতিক সম্পদহীন আমাদের ১৭ কোটি মানুষের উন্নতির জন্য আমাদের যা কিছু রয়েছে তা নিয়েই মাঠে নামতে হবে।
যেহেতু আমাদের রয়েছে শুধু মাটি ও নদী তাই এগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমেই অর্থনৈতিক উন্নয়ন করার জন্য দরকার আমাদের নৌ-বন্দর, বিমানবন্দরগুলো ব্যবহার করে ট্রানজিট সুবিধা ছড়িয়ে দেয়া। যা একই সাথে আমাদের আঞ্চলিক আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কাঙ্খিত রাজনৈতিক ক্ষমতাও এনে দিবে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।