জাদুনগরের কড়চা
খুব ছোট্টবেলায় একদিন দেখলাম, হৈচৈ পড়ে গেছে আমাদের পাড়ায়, কারণ সেবার (১৯৮৫) আমাদের বাসার কাছেরই একজন ছাত্র পুরো কুমিল্লা বোর্ডে প্রথম স্থান পেয়েছেন। তখন বোর্ড স্ট্যান্ড কী, আর কুমিল্লা বোর্ডই কোথায়, তা বোঝার বয়স আমার হয়নি, কিন্তু মনে দাগ কেটে গিয়েছিলো সেই ছাত্রটির স্কুলের নাম – চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল। সেই বয়সেই পণ করেছিলাম, বড় হয়ে এই স্কুলটিতে পড়তেই হবে।
এক সময় স্বপ্নের সেই কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হলাম আমিও। ক্লাস সিক্সেই ভর্তি হবার কথা ছিলো, ভর্তি পরীক্ষার বৈতরণী পেরিয়ে নির্বাচিতও হয়েছিলাম দিবা-শাখায়, কিন্তু তার অল্প কিছুদিন আগেই সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ায় অত দূরের স্কুলে আর বাবা মা যেতে দেননি।
বছর তিনের পরে ক্লাস নাইনে গিয়ে আবারও পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হই কলেজিয়েটে।
আমাদের সময়েই প্রথম ক্লাস নাইনে ই-সেকশন খোলা হয়। অর্ধেক নতুন ছাত্র, আর বাকিরা অন্য বিভিন্ন সেকশন থেকে আসা। অন্য সব সেকশনের চরম দুরন্ত সব ছাত্রদের নির্বাসন এই ই-সেকশন। এই বৈচিত্র্যপূর্ণ ছাত্রদের কারণে কলেজিয়েটে আমার সময়টা কেটেছে খুব মজার সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে।
ক্লাসে যেমন পড়াশোনায় অতিমগ্ন ছাত্রের ঘাটতি ছিলোনা, তেমনি ক্রিকেট খেলায় চরম দক্ষ, কিংবা দুই ক্লাসের বিরতির মাঝে বেঞ্চে তবলা বাজিয়ে গলা ছেড়ে গান গাওয়া গায়কও ছিলো। তাই সব সময় আমাদের ই-সেকশনটি হয়ে থাকতো সরগরম, জমজমাট।
মাধ্যমিক পর্যায়ের সেরা শিক্ষকদের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম কলেজিয়েটে। সাত্তার স্যার ছিলেন শ্রেণী শিক্ষক, আর পরে কাদের স্যার। শামসুল মতিন স্যার, মোহনলাল স্যার, জহিরুল হক স্যার, আজিজ স্যার, আর বিমল কান্তি বড়ুয়া স্যারের আদর মাখা শাসনের কথা মনে পড়ে।
মনে পড়ে স্কাউট দলের কথা, মিলাদের সেই বিশাল খাবার দাবার হাপুস হুপুস করে খাবার কথা, আরো অনেক অনেক স্মৃতি। স্কুলের খেলার দিনে স্টেডিয়ামে গিয়ে জয়ধ্বনি দিয়ে গলা ভাঙা, জাতীয় প্রতিযোগিতায় স্কুলের পক্ষ থেকে অংশ নেয়ার সেই উত্তেজনা, তা কি আর ভোলা যায়?
সোনালী সেই দিনগুলোর শেষে ১৯৯৪ সালে এসএসসি পাস করি, সেবছর কলেজিয়েট স্কুল এসএসসিতে সর্বকালের সবচেয়ে ভালো ফল করে। বিজ্ঞান বিভাগে কুমিল্লা বোর্ডে ১ম ৪টি স্থানই পায়, এছাড়া মেধা তালিকায় সম্ভবত ১৫ জন স্থান করে নিয়েছিলো। এক স্কুলের এরকম ভালো ফল পুরো দেশেই ছিলো অদ্বিতীয়।
প্রিয় কলেজিয়েট স্কুলের সেই কয়েকটি বছর সারাজীবন মনে থাকবে।
পরবর্তীতে প্রকৌশল শিক্ষার সময়ে সাথে পেয়েছি আমার কলেজিয়েটের প্রচুর বন্ধুকে। সময়ের সাথে সাথে চট্টগ্রাম শহর ছেড়েছি, কিন্তু আজও দেশে বেড়াতে গেলে আইসফ্যাক্টরি রোডে একবার ঢুঁ মারি। দেখে আসি আমার প্রিয় এই শিক্ষানিকেতনকে। বাইরে থেকে দেখতে পাই, নতুন প্রজন্মের ছাত্রদের কলতান, মনে পড়ে আমার কৈশোরের সেই সোনালী দিনগুলোর কথা, চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের করিডোরে কেটে যাওয়া স্মৃতিময় ক্ষণ।
আজ আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের অনেকেই আর কলেজিয়েটে নেই।
কিন্তু শিক্ষাজীবন শেষ করে এটা উপলব্ধি করতে পারি, জ্ঞানের যে বুনিয়াদ গড়ে দিয়েছিলেন সেই শিক্ষাগুরুরা, তা আমার পরবর্তী জীবনের পাথেয় হয়ে থেকেছে। আমার প্রিয় কলেজিয়েট স্কুলের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি, সেই সাথে কলেজিয়েট স্কুলের সব শিক্ষক এবং ছাত্রদের জানাই প্রাণঢালা শুভেচ্ছা। কলেজিয়েট স্কুলের মনোগ্রামের লেখাটার কথা মনে পড়ছে – Truth Shall Prevail – সত্যের মৃত্যু নেই। এই মহান বাক্যটিকে সঙ্গে নিয়ে কলেজিয়েট স্কুল এগিয়ে যাক উত্তরোত্তর সাফল্যের পথ ধরে, স্রষ্টার কাছে এই রইলো প্রার্থনা।
(রচনাকাল - ২০১০, মায়ানগর) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।