আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্মৃতির জাদুঘর

...ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাচিয়া,সদাই ভাবনা, যা কিছু পায়, হারায়ে যায়, না মানে স্বান্তনা...
বিজ্ঞান মন্ত্রনালয়ের প্রধান কিরন গাড়ি থেকে নামতেই দায়িত্বে থাকা কর্মচারীরা এগিয়ে গেলো। ঝা চকচকে জাদুঘর ভবনটার দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো কিরনের মুখে। তিনি মোটামুটি নিশ্চিত এমন অভিনব একটা জাদুঘরের ধারনাকে সবাই উৎসাহিত করবে। বিশেষ করে উদ্ভোধনের দিন যখন প্রধানমন্ত্রীকে এখানে আনা হবে তিনি নিশ্চয়ই অবাক হয়ে যাবেন এই জাদুঘরটি দেখে। দেশ বিদেশ থেকে পর্যটকরা ছুটে আসবে এই অভিনব জাদুঘর দেখতে।

আর সাথে সাথে তার নামও লেখা হয়ে যাবে ইতিহাসের পাতায়। জাদুঘরের ভারপ্রাপ্ত কিউরেটর তাকে এসে এগিয়ে নিয়ে গেলো। উদ্ভোধনের আগে তিনি একবার পুরো জাদুঘরটা ঘুরে দেখাবেন জনাব কিরনকে। প্রথম তলাতেই অনেকগুলো ঘর। প্রতিটি ঘরের সামনে একজন করে মহা মনিষীর নাম লেখা।

সেই সাথে তাদের আবক্ষ মূর্তি যা দ্বারা বোঝানো হচ্ছে কোন ঘরটিতে কোন মনিষীর স্মৃতি রাখা হয়েছে। এ সকল মনিষীর প্রত্যেকেই গত দশ বা পনেরো বছরের মাঝে মারা গেছেন। অথচ এই দেশের জন্য কতই না তাদের অবদান। সাহিত্য,সংস্কৃতি,রাজনীতি সব ক্ষেত্রেই তাদের অবদান মানুষ শত শত বছর ধরে স্মরণ করবে। মানুষের জীবন খুবই ক্ষণস্থায়ী।

পৃথিবীর হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের কাছে যা নিতান্তই নগন্য। তাই একজন মানুষ তার সমস্ত জীবনে যে সব অভিজ্ঞতা অর্জন করে, যে সব স্মৃতিকে ধারন করে মৃত্যুর পরপরই তা হারিয়ে যায়। সাধারন মানুষ তার বেশীর ভাগ অংশই জানতে পারে না। তাই গত শতাব্দীর শেষদিকে যখন নিউরন রেজোন্যান্সের ইলেক্ট্রিক কনভার্শন পরীক্ষা সফলভাবে শেষ হলো, তখনই বিজ্ঞান মন্ত্রনালয়ের অধীনে এই প্রজেক্ট শুরু করা হয়। এরপর থেকে যে কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তির মৃত্যু হলেই খুব দ্রুত তার নিউরন ম্যাপিং করে ফেলা হতো।

সবগুলো কেস সফল না হলেও কমে করে হলেও ত্রিশজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তির সম্পূর্ণ স্মৃতিকে ধারন করা সম্ভব হয়েছে এ পর্যন্ত। আর সেই স্মৃতি নিয়েই এই স্মৃতির জাদুঘর গড়ে তোলা হয়েছে। যেটা কয়েকদিন পরই খুলে দেয়া হবে সাধারন মানুষের জন্য। বিজ্ঞান মন্ত্রনালয়ের প্রধান কিরনকে প্রথমেই নিয়ে যাওয়া হলো বিখ্যাত বিজ্ঞানী ড. রিমন এর স্মৃতি সংরক্ষণ কক্ষে। ফলিত পদার্থ বিদ্যায় তার অসামান্য অবদানের জন্য আট বছর আগে তিনি বিজ্ঞান একাডেমীর পদক পান।

কিন্তু পুরস্কার গ্রহনের আগেই মারা যান। কক্ষের একপাশে ড. রিমনের ব্যবহৃত জিনিসপত্র প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে। আর একপাশে একটা ত্রিমাত্রিক প্রজেক্শন সিস্টেম। কিরন ড. রিমনকে চিনতেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দু’জন পাশ করেছেন।

কিরন কিউরেটরকে অনুরোধ করলেন ড. রিমনের মেমরী প্রজেক্শন চালু করতে। ত্রিমাত্রিক ডিসপ্লেতে ভেসে আসলো ড. রিমনের ছোটবেলার স্মৃতি। চরম দুষ্ট ছিলেন বোঝাই যায়। স্কুলের শিক্ষদের নাজেহাল করার স্মৃতি দেখা গেলো। তারপর তরুন ড. রিমনের স্মৃতি শুরু হলো।

কিছু কিছু স্মৃতি বেশ স্পষ্ট। আবার কিছু কিছু বেশ ঝাপসা। ছাড়া ছাড়া। ঘটনার পরম্পরা বোঝা যায় না। ঠিক যেভাবে আমরা স্মৃতি মনে করি সে রকম।

ফ্ল্যাস ব্যাকের মতো এসে চলে যায়। দেখা গেলো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রিমনকে। দেখা গেলো একটা মেয়েকে। সম্ভবত তার স্ত্রী। কি ভয়ানক ।

ড. কিরন তার স্ত্রীর সাথে এতো খারাপ ব্যাবহার করতেন। কি জঘন্য। স্ত্রীর সাথে ড. কিরনের খারাপ ব্যাবহার দেখে গা রি রি করে উঠে কিরনের। তিনি প্রজেক্শন বন্ধ করতে বললেন। হালকা চিন্তার রেখা দেখা গেলো তার কপালে।

এরপর কিরনকে নিয়ে যাওয়া হলো পরের কক্ষে। কি আশ্চর্য এটা বিখ্যাত সাহিত্যিক জুরানের স্মৃতির ঘর। এই লেখকের লেখা কিরন পাগলের মতো সংগ্রহ করে পরতেন। তার মনে আছে তরুন বয়সে একবার এই লেখকের অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য সারারাত তার বাড়ির সামনে দাড়িয়ে ছিলেন। আজ থেকে নয় বছর আগে সাহিত্যিক জুরান মারা যান।

তখনো কিরন রাজনীতে আসেন নি। এখনো সাহিত্যিক জুরানের নাম শুনলেই তার ভেতর ঠিক সেই তরুন বেলার মতো শিহরন জাগে। মনে হয় এই লেখকের একটা অটোগ্রাফের জন্য এখনো তিনি জীবন দিয়ে দিতে পারবেন। তার আদর্শ এখনো এই জাদুকরী লেখক। সাহিত্যিক জুরানের স্মৃতির ঘরে ঢুকে তাই কিরনের মাঝে অন্য রকম শিহরন জাগে।

তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির স্মৃতির পুরোটুক দেখতে পারবেন এখন তিনি। দেখতে পারবেন তরুন বয়সে পড়া সেই সব অসাধারন উপন্যাস কিভাবে তৈরী হলো। কিরন অজানা শিহরনে শিহরিত হন বার বার। সাহিত্যিক জুরানের স্মৃতি প্রজেকশনের শুরুতেও তার ছেলেবেলা দেখা গেলো। খুব দারুন খেলোয়ার ছিলেন তিনি।

খুব ভালো ছিলেন ফুটবলে। এটা অবশ্য কিরন আগেই জানতেন। কেননা সাহিত্যিক জুরানের জীবনী নিয়ে লেখা প্রায় সব বই তিনি পড়ে ফেলেছেন। সব টিভি সাক্ষাৎকার দেখতেন গোগ্রাসে। এরপর দেখা গেলো তরুন জুরানকে।

একজন বন্ধুর প্রভাব খুব বেশী দেখা যাচ্ছে তার স্মৃতিতে। কিরন অবশ্য এই বন্ধুটি সম্পর্কে কিছুই জানেন না। ধীরে ধীরে স্মৃতি এগুতে থাকে। কিরন খুব বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করলেন, এই বন্ধুটি একজন ভালো লেখক। বন্ধুটির দুঃসময়ে আর্থিক সাহায্যের বিনিময়ে সাহিত্যিক জুরান তার সব লেখা কিনে নেন।

অদ্ভুত সব স্মৃতি সেই সময়টিকে ঘিরে সাহিত্যিক জুরানের স্মৃতি ঘিরে আছে। এক পর্যায়ে দেখা গেলো সাহিত্যিক জুরান তার এক পরিচিত লোককে টাকা দিচ্ছেন তার এই বন্ধুটিকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলার জন্য। দুর্ঘটনায় বন্ধুটির মৃত্যুর সংবাদ শুনে জুরানের আনন্দে উদ্বেলিত হবার স্মৃতিটি যখন আসলো, তখন কিরনের মনে সাহিত্যিক জুরান সম্পর্কে কেবলই ঘৃণা। তার আদর্শ, তার এতো শ্রদ্ধার মানুষটির কদর্য রূপটি দেখে কিরন ভয়াবহ ভাবে ভেঙ্গে পড়লেন। প্রজেকশন বন্ধ করতে বলে তিনি নিরব বের হয়ে এলেন সাহিত্যিক জুরানের স্মৃতির রুমটি থেকে।

-কেমন দেখলেন স্যার। আমাদের ধারনা এই অসাধারন জাদুঘরটি উদ্ভোধনের পরই খুব সাড়া ফেলবে। হাজার হাজার মানুষ এসে এখানে ভীড় করবে। অতি উৎসাহী জাদুঘরের কিউরেটর কিরনের মুখ থেকে তার প্রশংসা শুনতে চাইছে এই জাদুঘর প্রজেক্টটা সম্পর্কে সেটা সহজেই বুঝলেন কিরন। কিন্তু কিরন কি বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না।

এখনো তার মনে সাহিত্যিক জুরানের প্রতি প্রচন্ড ঘৃণা আর সেই সাথে কেমন জানি একটা শূণ্যতা তাকে ভর করে আছে। -স্যার এখন থেকে আমরা সকল উচ্চ পদস্থ কর্তা এবং সাধারন মানুষেরও মস্তিষ্ক ম্যাপিং করবো ঠিক করেছি। আমার ধারনা এটা সত্যিই একটা দারুন ব্যাপার হবে। আমরা জানতে পারবো বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ কিভাবে চিন্তা করে। যেটা মনস্তত্ববিদদের গবেষনায় অনেক সাহায্য করবে।

কিরন চমকে উঠলেন। ‘তারমানে, আপনারা আমার মৃত্যুর পর আমার মস্তিষ্কও ম্যাপিং করতে পারেন?’ -কেন নয় স্যার। আপনার জীবনের অভিজ্ঞতা আমাদের অনেক কিছু শেখাবে। কিরন এবার আতঙ্কিত বোধ করলেন। কাউকে কিছু না বলে নিরবে গাড়িতে উঠে বসলেন।

শৈশব থেকে জমে থাকা তার একান্ত স্মৃতিগুলো এবার মনে হয় হাতড়ে দেখার সময় হয়েছে। খুব ছোটবেলা থেকে নিজের স্মৃতিগুলোকে সাজিয়ে ভাবতে চেষ্টা করলেন চোখ বুজে । তারুন্যে এসে থেমে গেলো সেই স্মৃতি। তিনি আঁতকে উঠলেন। এতোটা বয়স হয়ে গেছে তারপরও স্মৃতি তার সাথে প্রতারনা করেনি! ------------ ----------------- ------------------- ------------------ সপ্তাহখানেক পর বিজ্ঞান মন্ত্রনালয় থেকে প্রকাশ করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, মনিষীদের মস্তিষ্ক ম্যাপিং করে গড়ে তোলা স্মৃতির জাদুঘর প্রকল্পটি অনির্বায কারনে বাতিল করা হয়েছে।

উক্ত জাদুঘরের সকল তত্ব উপাত্ত ধ্বংস করে ফেলতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং মানুষের মস্তিষ্ক ম্যাপিংকে সরকারী ভাবে সম্পূর্ণ বেআইনী ঘোষণা করা হয়েছে।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।