দেয়ালে দেয়ালে ছায়া দিয়ে লেখা মিথ্যা স্লোগান সত্যি হয়ে উঠুক একদিন ২২ মার্চ ২০১২, ২০তম বিশ্ব পানি দিবসে যুক্তরাস্ট্রের ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের ডিরেক্টরের অফিস থেকে বলা হয় আগামীতে দক্ষিন এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকাতে পানি সঙ্কটের ফলে খাদ্য এবং শক্তি উৎপাদন ব্যাহত হবে। আগামী ১০ বছর পরই সারা পৃথিবীর পানির চাহিদা প্রাপ্যতাকে ছাড়িয়ে যাবে, আর আগামী ২০৩০ সালের পানির চাহিদা হবে পানির প্রাপ্যতার চেয়ে ৪০% বেশী। একইসঙ্গে আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, পানি সঙ্কট অদূর ভবিষ্যতে সশস্ত্র যুদ্ধের রূপ নেবে। এ যুদ্ধ সম্ভবত অবশ্যম্ভবী।
পৃথিবীর তিন ভাগ পানি আর এক ভাগ স্থলেও প্রাচীনকাল থেকে পানি নিয়ে মানুষে মানুষে সংঘাত লেগে আছে; কেননা, মানুষের ব্যবহারয়োপযোগী যে স্বাদু পানি, তার পরিমাণ মাত্র ২.৫ ভাগ।
এরমধ্যে আবার ৭০% মেরুপ্রদেশে বরফ হিসেবে, বাকি ৩০% অধিকাংশ মাটির আর্দ্রতা এবং ভূগর্ভস্থ পানি হিসেবে বিরাজিত। অর্থাৎ ব্যবহারয়োপযোগী পানির ১% বা মোট পানির .০০৭% হলো সহজলভ্য পানি। এই পানির উৎস হল নদী, হ্রদ, পুকুর, খাল বিল এবং ভূগর্ভস্থ আধার। পৃথিবীর ব্যবহার উপযোগী পানির বন্টন আবার সুষম নয়। কোথাও বৃষ্টিপাত নেই বললেই চলে আবার কোথাও কোথাও অত্যধিক বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে।
মরু এবং অর্ধমরু এলাকা পৃথিবীর মোট স্থলভাগের ৪০% হলেও এই এলাকায় প্রাপ্য পানির পরিমান মাত্র ২%।
আবার বছরের বিভিন্ন সময়ে পানির প্রাপ্যতার পরিমানও ভিন্ন; বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি, শুস্ক মৌসুমে পানির সংকট। পৃথিবীতে বছরে বৃষ্টিপাতের পরিমান ১ লক্ষ ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। এরমধ্যে বেশীরভাগ বায়ুমন্ডলে বা¯পীভূত হয়ে যায় অথবা মাটি এবং গাছপালা শুষে নেয়। বছরে ৪২,৭০০ বর্গকিলোমিটার পরিমান পানি নদনদী দিয়ে প্রবাহিত হয়।
বর্ধিত জনসংখ্যার কারনে নদনদীতে বহমান মাথাপিছু পানির পরিমান ১৯৭০ সালের তুলনায় ১৯৯৫ তে কমেছে ৩৭%।
এশিয়া মহাদেশে যদিও এখানে সবচে বেশী পরিমান পানি নদ-নদী দিয়ে প্রবহমান হলেও এ অঞ্চলে মাথাপিছু পানির প্রাপ্যতা সবচে কম। কারন, এশিয়াতে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষের বসবাস। অন্যদিকে, অস্ট্রেলিয়ার ওসেনিয়া এলাকায় বেশিরভাগক্ষেত্রে শুষ্ক হলেও সেখানে মাথাপিছু প্রবহমান পানির পরিমান সর্বোচ্চ। কারণ, সেখানে জনবসতি অপেক্ষাকৃত কম।
বিশেষজ্ঞরা হিসেব করে দেখিয়েছেন যে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার জন্য প্রাপ্য সমস্ত নদ-নদী এবং জলাধারগুলোর সহজলভ্য পানির বাৎসরিক পরিমান ১২,৫০০ বর্গকিলোমিটার। এর অর্ধেক পরিমান পানি আমরা এখন ব্যবহার করে থাকি। এ থেকে মনে হতে পারে যে যথেস্ট পানি আছে, কিন্তু যদি নৌযোগাযোগ, পানি বিদ্যুৎ, পরিবেশ, গাছপালা এবং জলজ প্রানীর চাহিদা বিবেচনা করা হয় তা মোটেও যথেষ্ট নয়। জাতিসংঘের এক হিসেব অনুসারে ২০২৫ সাল নাগাদ ৩০টি দেশে পানি দুর্লভ হয়ে পড়বে, যা ১৯৯০ সালে ছিল ২০টি। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা ও ইউনিসেফ এর ২০০৬ সালের রিপোর্ট অনুসারে পৃথিবীর ৭৮ কোটি মানুষ বা ১১% মানুষ নিরাপদ পানি পায় না।
২০০৮ সালের হিসেবে এ সংখ্যা ৮৮ কোটি এবং ২০১২ সালের হিসেবে ১০০ কোটি মানুষ পানি সঙ্কটে ভুগছে। বিশুদ্ধ পানি এবং পয়ঃনিস্কাশনের অভাবে বছরে মোট ৩৫ লক্ষ মানুষ পানিবাহিত রোগের কারনে মারা যায়। ১৪ লক্ষ শিশু মারা যায়। সে হিসেবে প্রতিদিন মারা যায় ৪,০০০ জন এবং প্রতি ২০ সেকেন্ডে অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করছে একজন করে শিশু। দূষিত পানির কারনে মৃত্যুর পরিমান যেকোনো সময়ে যুদ্ধে মারা যাওয়া লোকসংখ্যার চেয়ে বেশী।
অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার হিসেবমতে বিশুদ্ধ পানি, পয়নিস্কাশন এবং স্বাস্থ্যবিধিমালা মেনে চলে ডায়রিয়া জনিত রোগ ৬৫% কমানো সম্ভব। ইউএনডিপি’র মতে পানি এবং স্যানিটেশনের পেছনে ১ ডলার খরচ ৮ ডলারের সমপরিমান উৎপাদনের নিশ্চয়তা দেয়। বস্তি এলাকায় বসবাসরত লোকেরা একই শহরে ধনী ব্যাক্তিদের তুলনায় ৫-১০ গুণ বেশি খরচ করেন। একজন আমেরিকান ৫ মিনিট ¯œান করতে যে পরিমান পানি ব্যবহার করেন তা উন্নয়নশীল দেশে ১ জনের সারাদিনের পানি ব্যবহারের সমান। উত্তর আমেরিকায় প্রতিজন প্রতিদিন ব্যবহার করে ৪০০ লিটার, সেখানে উন্নয়নশীল বিশ্বে প্রতিদিন প্রতিজন ব্যবহার করে মাত্র ১০ লিটার।
(ডধঃবৎ ঝঁঢ়ঢ়ষু ধহফ ঝধহরঃধঃরড়হ ঈড়ষষধনড়ৎধঃরাব ঈড়ঁহপরষ (ডঝঝঈঈ))।
একইভাবে, একজন ইসরাইল নাগরিক যেখানে প্রতিদিন ৩০০ লিটারেরও বেশি পানি ব্যবহার করে থাকে, সেখানে একজন ফিলিস্তিনী পায় মাত্র ৩০ লিটার। বিশ্বজুড়ে ধনী-দরিদ্রে আয় বন্টন, খাদ্য বন্টন ইত্যাদির মতো পানি বন্টনেও বিরাজিত অসাম্য এই প্রাকৃতিক সম্পদকে ক্রমশ সাধারণ মানুষের কাছে দুর্লভ করে তুলছে। ফলে সকলের জন্য নিরাপদ পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করা বিশ্বজুড়ে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইতিহাসে প্রাপ্ত তথ্যমতে, পৃথিবীতে পানি নিয়ে প্রথম যুদ্ধ হয় আজকের ইরাক ভূখন্ডে।
যিশুখ্রিস্টের জন্মের ৩১শ’ বছর আগে ইউফ্রেতিস নদীর পানি নিয়ে তৎকালীন ইরাক বা মেসোপটেমিয়ার দু’টি ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্রের মধ্যে সংঘাত দেখা দেয়। এ দু’টি নগর রাষ্ট্রের একটির নাম ছিল 'ল্যাগাস' এবং অন্যটির নাম ছিল 'উম্মা'।
কৃষিকাজের জন্য ইউফ্রেতিস নদীর ওপর নির্ভরশীল ছিল এ দু’টি রাষ্ট্রের অধিবাসীরা। একসময় উজানের রাজ্য ল্যাগাসের রাজা তার দেশকে কৃষিতে আরও সমৃদ্ধ করতে নদীতে একটি প্রশস্ত খাল কেটে নদী থেকে পানি সরিয়ে নিতে শুরু করেন। এতে পানি সংকটের কারণে ভাটির দেশ উম্মার কৃষিসহ আর্থ-সামাজিক অবস্থা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে।
ফলে জনগণের দুর্দশা লাঘবে উম্মার রাজা পানির জন্য ল্যাগাসের রাজার কাছে আবেদন করেন। কিন্তু ল্যাগাসের রাজা এ আবেদনে সাড়া না দিলে দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। পানির জন্য প্রাণ হারান দুই দেশের দুই রাজাসহ হাজার হাজার নাগরিক। পানি নিয়ে এমনি অসংখ্য সংক্ষুব্ধ পরিস্থিতি অবলোকন করেছে পৃথিবী, যার মধ্যে শাত-ইল-আরব জলাধার নিয়ে ইরাক-ইরান বিরোধ, সুয়েজ খাল নিয়ে মিশর ও ইঙ্গ-ফরাসী যুদ্ধ, ইসরাইল, জর্ডান এবং প্যালেস্টাইনের মধ্যে জর্ডান নদী এবং গ্যালিলি সাগর( ঝবধ ড়ভ মধষরষবব), পানামা খাল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র- পানামা বিরোধ, ইউফ্রেটিস- টাইগ্রীস বা দজলা ফোরাত নদীর পানি নিয়ে সিরিয়া, ইরাক এবং তুরস্কের মধ্যে বিরোধ ইত্যাদি। পানি নিয়ে এই বিরোধ চলছে খরাপীড়িত আফ্রিকায়, চলছে নদ-নদীবহুল এশিয়ায়, দক্ষিণ এশিয়ায়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, বিরোধ চলছে দুই প্রতিবেশি ও বন্ধুপ্রতিমদেশ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে।
দক্ষিন এশিয়ার দেশগুলো বাঙ্গলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এবং চীন তথা দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীর বসবাস। জনঘনত্বের মতো নদ-নদীর সংখ্যাও বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এখানে বেশি। এখানকার বড় বড় নদীগুলো একাধিক দেশের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত। এরমধ্যে সিন্ধু, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র এই তিনটি নদ-নদী পৃথিবীর ১০টি বিরোধপূর্ণ নদীর অন্যতম। উল্লিখিত তিনটি নদীর মধ্যে দুটি তথা গঙ্গা ও বৃহ্মপুত্রের পানি বন্টন নিয়ে বাংলাদেশ ভারতের অর্ধশত বছরব্যাপী টানাপোড়েন চলছে।
এপ্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কয়েকশত নদ-নদী বিরাজমান থাকলেও এগুলোর প্রবাহিত পানির প্রায় ৯০ শতাংশ আসে উজানের দেশ ভারত থেকে। গঙ্গা, তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের মতো বেশকয়েকটি বড় বড় নদ-নদীসহ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৫৪/ ৫৫ টি যৌথনদী রয়েছে। পৃথিবীতে এরকম অনেক নদী রয়েছে যেগুলো একইসঙ্গে একাধিক দেশের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নীল নদ ১০টি দেশের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত। এসকল নদ-নদীর পানি বন্টন ও ব্যবহার নিয়ে যাতে কোনো বিরোধ না ঘটে সেলক্ষ্যে হেলসিংকি চুক্তির মতো যৌথনদীর পানি বন্টন সংক্রান্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরাম, চুক্তি ও নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।
এসকল চুক্তি ও নীতিমালায় যৌথনদীর পানি সমবন্টনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভারত তার অন্যান্য প্রতিবেশিদেশগুলোর যৌথনদীর পানি বন্টনের ক্ষেত্রে সাবেক মার্কিন এটর্নি জেনারেল হরমনের হরমন ডকট্রিনের বাস্তবায়ন ঘটাতে প্রয়াস পায়। এই তত্ত্বে পানির ওপর ভাটির দেশের অধিকারকে অস্বীকার করা হয়। কেননা, হরমন বিশ্বাস করতেন নদী কখনো অভিন্ন স¤পদ হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের পার্শ্ববতী ছোট্ট দেশ মেঙ্কোর সঙ্গে পানি বিরোধে তিনি এই তত্ত্ব হাজির করেন।
ভারত যৌথনদী ব্যবহারের আন্তর্জাতিক চুক্তি ও নীতিমালার বিপরীতে উল্লিখিত তত্ত্ব বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার শুরু করে। একইভাবে তিস্তা নদীর ওপর ব্যারেজ নির্মাণ করে। সম্প্রতি বরাক নদীর ওপর টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ শুরু করেছে এবং ব্রহ্মপুত্রসহ অবশিষ্ট নদ-নদীর পানি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ব্যাপক উচ্চাভিলাসী আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়াস পাচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য যে, কেবল গঙ্গা ও তিস্তার পানি বন্টন নিয়ন্ত্রণের ফলে যেখানে বাংলাদেশের বিপুল অংশ ক্রমান্বয়ে মরুময় হয়ে উঠছে, সেখানে টিপাইমুখ বাঁধ ও আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প চালু হলে যে বাংলাদেশের কৃষি, পরিবেশ, প্রকৃতি তথা ১৬ কোটি মানুষের জীবনযাত্রার সামগ্রিক পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
একথাও এখানে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ ভূখন্ডগত, জনবল, অর্থবল ও সামরিকশক্তির দিক থেকে অনেক ছোট।
তাই ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করে পানির অধিকার আদায় করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে ভারতের এই স্বৈরাচারী ভূমিকা তার পার্শ্ববতীদেশ চীনকেও একই ধরনের আচরণে উস্কানী দিচ্ছে। এ অঞ্চলের অন্যতম দীর্ঘ নদ ব্রহ্মপুত্রের উদ্ভব চীনের তীবব্বত অংশে। চীন তার প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটিয়ে এ নদীর গতিপথ পরিবর্তন করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। আর চীন এ নদীর নিয়ন্ত্রণ হাতে নিলে ভারতের এক বিশাল অংশ সামগ্রিক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
এক বিস্তৃত উর্বর ভূখন্ড পুরোপুরি মরুভূমিতে পরিণত হবে। তাই এক্ষেত্রে যৌথনদী ব্যবহারে কোনো সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা না পেলে অদূর ভবিষ্যতে একটি ভয়াবহ সংঘাত অনিবার্য।
অন্যদিকে, ভারতের কাছ থেকে যৌথনদীর আন্তর্জাতিক হিস্যা আদায়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ব্যর্থতাও অনেকাংশে দায়ী। পানি রাজনীতিতে বাংলাদেশের ব্যর্থতার প্রসঙ্গে অস্ট্রেলিয়ান গবেষক ম্যাক গ্রেগর বলেন, বাংলাদেশ নদীর পানি নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনায় বসার আগেই পরাজিত হয়; যদিও তারই পানি পাওয়ার ন্যায্য অধিকার রয়েছে। কারণ কূটনৈতিক দক্ষতার অভাব।
এদেশের কূটনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এখন পর্যন্ত যৌথনদীর ন্যায্য হিস্যা নিয়ে কোনো মডেল বা কাঠামোগত হিসেব বিশ্বদরবারে এমনকি ভারতের কাছেও পেশ করতে পারেনি (ড. মো. আমিনুর রহমান : ২০১২)।
এর পরিবর্তে সকল সমস্যা সমাধানকল্পে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ও ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির ওপর নির্ভর করা হচ্ছে। এমনকি ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন নদীর পানি বন্টন ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে এ পর্যন্ত সরকারগুলো কী কী চুক্তি করেছে তার বিস্তারিত বিবরণ জনগণকে জানানো হয় না। জনগণ কেবল গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানতে পায়- বাংলাদেশ ফারক্কার ন্যায্য হিস্যা পাচ্ছে না, তিস্তার পানি বন্টনের বিষয়ে কোনো ফয়সালা হয়নি, টিপাইমুখে বাঁধ হচ্ছে এবং এ বাঁধ হলে নাকি বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না, ভারত তার বিভিন্ন খরাপ্রবণ অঞ্চলগুলোতে পানি সরবরাহের জন্য আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মতো বিশাল কর্মযজ্ঞের আয়োজন করছে ইত্যাদি। বিগত একচল্লিশ বছরে কেবল একের পর এক বেঠক করার সংবাদ ছাড়া তেমন কিছুই এদেশের মানুষ জানতে পারেনি।
অর্ধশতাধিক নদীর পানি প্রাপ্তি নিয়ে আলাদা আলাদা চুক্তি করার বদলে সবগুলোর ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে একটি কার্যকর যৌথনদী কমিশন করা যায় কিনা সে দাবি জোরালোভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। অন্যদিকে, টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা, মানবন্ধন ইত্যাদি চললেও বাংলাদেশের জন্য সমূহ অশনিসংকেত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে তেমন কিছু হচ্ছে না। এমনকি একটি আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদও করা হয়নি। অথচ আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প ৫,৬০০ বিলিয়ন রুপির প্রকল্প, ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প। এ পরিকল্পনায় হিমালয়ের নদীগুলো নিয়ে যে অংশ তাতে বলা হয়েছে যে, ব্রহ্মপুত্র, কোসী, গন্দক, ঘাগড়াসহ বৃষ্টিভেজা ও পানির দিক থেকে ধনী পূর্বদিক থেকে শুকনো ও পানির দিক থেকে গরিব গঙ্গার পশ্চিম অববাহিকা এবং যমুনায় নিয়ে যাওয়া হবে।
এখানে কৌশল হিসেবে ভারত তার সুপ্রীম কোর্টের মাধ্যমে সরকারকে এটি বাস্তবায়ন করার নির্দেশ প্রদান করে, যাতে সরকারের বাধ্যবাধকতা প্রকাশ পায়। সুদূরপ্রসারী এ প্রকল্প ১৮৩৯ সালে স্যার আর্থার কটন পেশ করলেও তা দীর্ঘদিন নিভৃতে থাকে। কিন্তু ২০০২ সালে স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে প্রস্তাবটি ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবুল কালামকে দিয়ে উত্থাপন করিয়ে তা বাস্তবায়নের আনুষ্ঠানিক প্রয়াস শুরু হয়। এবছরই ভারতের সুপ্রিমকোর্ট নির্দেশ প্রদান করে যে, ২০১৬ সালের মধ্যে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে হবে। বলাবাহুল্য- এই আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব একটি পরিত্যক্ত ভূখন্ডের দশায় আসীন হবে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের এই একুশ শতকে মানুষ তার ভোগ ও বিলাসিতার জন্যে অন্য অনেককিছু আবিষ্কার ও উদ্ভাবন করতে সক্ষম হলেও নদী-নালা ও ভূগর্ভস্থ পানির বিকল্প হিসেবে সাগর- সমুদ্রের বিপুল জলরাশিকে শোধন করে ব্যবহার উপযোগী করে তোলার সহজ ও স্বল্পব্যয়ী কোনো প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে পারেনি। অথচ ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলা জনসংখ্যার জন্যে বাড়তি খাদ্য ও অন্যান্য সেবাসামগ্রীর যোগান দিতে প্রতিনিয়তই বাড়ছে পানির চাহিদা। অতিরিক্ত চাপ পড়ছে স্বাদু পানির সহজলভ্য উপরস্থ ও ভূগর্ভস্থ আধারের ওপর।
কেননা, আন্তর্জাতিক নদীতে ভারতের অন্যায্য বাঁধের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরের এবং বিশেষকরে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোর নদী-নালা, খাল-বিল ভয়ানক আগ্রাসন ও দূষণের শিকার হচ্ছে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে একশ্রেণীর সরকারি-বেসরকারি আমলা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী অগ্রণী ভূমিকায় আসীন হচ্ছেন।
ঢাকা ও তার আশপাশের অঞ্চলের ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে নদীগুলোর বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে নেয়া হয়েছে, খালগুলো ভরাট করে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হগয়েছে। শহরের সন্নিকটস্থ জলাধারগুলো কর্পোরেট আবাসনজীবীদের দখলীভূত হয়ে গেছে। পাশাপাশি কল-কারখানাসহ গৃহস্থালীর বর্জ্য পদার্থ এখানে যত্রতত্র ফেলায় ঢাকার প্রধান নদী বুড়িগঙ্গার পানি বিষাক্ত হয়ে গেছে; নিকটস্থ শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, তুরাগ, বালু প্রভৃতিও একই দশায় উপনীত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। ওয়াসার সূত্রমতে, রাজধানী ঢাকার ৮২ শতাংশ মানুষের মলমূত্র মিশছে বুড়িগঙ্গায়। এরসঙ্গে রয়েছে গৃহস্থালী ও ব্যবসায়িক বর্জ্য।
প্রতিদিন রাজধানীর বিভিন্ন ধরনের বর্জ্যরে ৪৯ শতাংশ ফেলা হচ্ছে বুড়িগঙ্গায়। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, প্রতিদিন হাজারিবাগ শিল্পাঞ্চল থেকে ১৬ হাজার ঘনলিটার, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থেকে ৩ হাজার ৭ শ’ ঘনলিটার দূষিত বর্জ্য মিশ্রিত পানি রাজধানীর নদীগুলোতে মিশ্রিত হচ্ছে। সুশীল সমাজ ও সাধারণ মানুষের দাবির প্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময় সরকারের পক্ষ থেকে এসকল নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে অভিযান চালিয়ে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হলেও প্রশাসন ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের যোগসাজসে দখলদাররা পুণরায় স্থানু হয়ে বসে।
গত দু’দশকে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনপদগুলোতে শুধু ভূপৃষ্ঠের পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে এখানকার অধিবাসীরা পানির ভূগর্ভস্থ আধারের ওপর অধিকাংশে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কিন্তু এ আধারের অতিরিক্ত ব্যবহারের দরুণ একদিকে আর্সেনিকের দূষণ ঘটেছে, অন্যদিকে ভূউপরস্থ লবণাক্ততার প্রভাবে ভূগর্ভের পানি এমনকি মাটিতেও বহুগুণ লবণাক্ততা বেড়ে গেছে।
আর ৩ কোটি মানুষের এই বিস্তৃত অঞ্চলে এই লবণাক্ততা বৃদ্ধির জন্য প্রথমত এবং প্রধানত দায়ী ধনিক বণিক মুনাফাখোরদের অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ। দ্বিতীয়ত, উজানে ফারাক্কা বাঁধসহ ভারতের আরো কিছু বাঁধের কারণে নদ-নদীগুলোয় মিঠাপানি প্রবাহের অভাব এবং মাথাভাঙ্গা, ইছামতি, কপোতাক্ষের মতো ঐতিহ্যবাহী নদ-নদীগুলোর মৃত্যু। তৃতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি এবং সিডর-আইলার মতো ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বৃদ্ধি। এখানে একদিকে মুষ্টিমেয় কিছুসংখ্যক ধনী ও ক্ষমতাশালী মানুষের জন্য এবং আপাতদৃষ্টিতে দেশের রপ্তানি-আয়ের ক্ষেত্রে বিষয়টি ইতিবাচক ও লাভজনক হলেও ক্ষতায় পিছিয়ে থাকা সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের জন্য এটা মরণজল হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথমোক্ত শ্রেণীটি অতিরিক্ত মুনাফার আশায় গত দু-তিন দশক যাবত উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষিজমিতে কৃত্রিমভাবে লোনাপানি ঢুকিয়ে চিংড়িচাষ সম্প্রসারিত করায় পুরো এলাকা লবণবিষে ভরে গেছে।
লবণ দ্রুত ঢুকে পড়ে পুকুর-ডোবা এবং ভূগর্ভস্থ পানির আধারও দখল করে ফেলেছে। ফলে তারা নিরাপদ পানীয়জল প্রাপ্তির মতো একটি মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তাদের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি তথা সামগ্রিক জীবনযাত্রা ব্যহত হচ্ছে। জীবন বাঁচানোর তাগিদে খুলনা অঞ্চল বিশেষকরে সাতক্ষীরার কোনো কোনো এলাকার মানুষকে ১০/১৫ কিলোমিটার দূর থেকেও খাবার পানি আনতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে ১০ লিটারের সমপরিমাণ ১ কলসি পানির জন্য ৩০ টাকা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। একেকটি পরিবারের খাবার পানি জোগাড় করতে দিনের অর্ধেক সময় পার হয়ে যাচ্ছে।
সংস্কৃতিগতভাবে ঘরেরকাজের দায়িত্ব নারীদের পালন করতে হওয়ায় এ পরিস্থিতিতে তারাই সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছে। কখনো কখনো পানির কারণে দাম্পত্যকলহ থেকে সংসারে ভাঙন ঘটছে।
পাশাপাশি নিরুপায় হয়ে আর্সেনিকযুক্ত ও লবণযুক্ত পানি ব্যবহার করতে গিয়ে এ অঞ্চলের দরিদ্র মানুষেরা গ্যাষ্ট্রিক-আলসার, চর্মরোগ, কিডনীরোগ ইত্যাদিতে আক্রান্ত হচ্ছে। জীবনীশক্তি হ্রাস পেয়ে কাজে অনীহা সৃষ্টি করছে। নোনামাটিতে তেমন ফসল না ফলায় হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী কৃষিপেশা, জীবিকা হারিয়ে ফেলছে সাধারণ দরিদ্র মানুষ।
হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র, ব্যাপকহারে হ্রাস পাচ্ছে হাস-মুরগী, গরু-ছাগলের মতো গৃহপালিত প্রাণীদের হার। আর পরিস্থিতি মোকাবেলায় হেরে গিয়ে বাপ-দাদার ভিটেমাটি ফেলে অনিশ্চিত অজানার পথে নিয়মিত স্থানান্তরিত হচ্ছে এ অঞ্চলের অধিবাসীরা। এর প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আদমশুমারি প্রতিবেদনে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, সারাদেশে যেখানে জনসংখ্যা বাড়ছে, সেখানে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোর জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। ক্ষমতা আর ক্ষমতার রাজনীতির কাছে এভাবেই নিরাপদ পানির মৌলিক অধিকার হারানোর নির্মম বঞ্চনার শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ, দরিদ্র মানুষ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।