Only I know what is my goal, My heart is my temple. কাজী সায়েমুজ্জামান
ভূমিকাঃ
জীবনের উৎস পানি। পানির প্রাপ্যতা বিবেচনা করেই মানব জাতির বসতি, সভ্যতা, শহর, বন্দর গড়ে উঠেছে। পৃথিবীর ৭১% পানি হলেও পানের যোগ্য পানির পরিমাণ মাত্র তিন ভাগ। বাকী ৯৭ ভাগ পানিই লবণাক্ত বা ব্যবহারের অযোগ্য। পানের যোগ্য পানির ৯৭ ভাগ আবার তুষার, হিমবাহ আর বরফের আকারে জমাট বাধা রয়েছে।
পানির এই অপ্রতুলতাই বিশ্বে সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ। এ কারণে আগামী বিশ্বে পানির সংকট হবে সবচেয়ে বড় সমস্যা। পানিকে আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্ব দিতেই ১৯৯২ সালে জাতিসঙ্ঘ ২২ শে মার্চকে বিশ্ব পানি দিবস হিসেবে অনুমোদন দেয়। আর ১৯৯৩ সালের ২২শে মার্চ পালিত হয় প্রথম বিশ্ব পানি দিবস। ২০১২ সালের ২২শে মার্চ ২০তম বিশ্ব পানি দিবসে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের পরিচালকের অফিস থেকে বলা হয় আগামীতে দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকাতে পানি সঙ্কটের ফলে খাদ্য এবং শক্তি উৎপাদন ব্যাহত হবে।
আগামী ১০ বছর পরই সারা পৃথিবীর পানির চাহিদা প্রাপ্যতাকে ছাড়িয়ে যাবে। ২০৩০ সালের পানির চাহিদা হবে পানির প্রাপ্যতার চেয়ে ৪০% বেশী। ২০১৩ সালের ২১তম বিশ্বপানি দিবসে আশঙ্কা হচ্ছে, পানি সঙ্কট আর বাণিজ্যিকীকরণ অদূর ভবিষ্যতে সশস্ত্র যুদ্ধের রূপ নেবে। এ যুদ্ধ এড়াতে দেশগুলোর মধ্যে পানি সম্পদ নিয়ে অংশিদারিত্ব আর পারষ্পরিক সহযোগিতা প্রয়োজন। এ কারণেই সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করে এবারের পানি দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- পানি সহযোগিতা।
বাংলাদেশে পানি দিবসের গুরুত্বঃ
প্রশ্ন হচ্ছে- বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ বলে এখানে পানি নিয়ে ভাবনার কি আছে? বাস্তব কথা হলো-যে অবস্থার দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি তাতে নদীমাতৃক পরিচয় আর বেশি দিন থাকবে বলে মনে হচ্ছেনা। এদেশে এখন পানি সংকট ঘনীভূত হয়ে দেখা দিচ্ছে। পানি সম্পদ মন্ত্রী সংসদকে জানিয়েছেন,“দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীর সংখ্যা ৩১০টি হলেও ৯৭টি নদ-নদী মৃতপ্রায়। ইতিমধ্যে বাগেরহাট জেলার ভোলা নামের একটি নদীকে সরকারীভাবে মৃত ঘোষণা করা হয়েছে। বাকী ২১২টি নদ-নদীর নাব্যতাও দিন দিন কমছে।
উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মৃতপ্রায় নদ-নদী হচ্ছে ৪৪টি। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে রয়েছে ১৯টি। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এর সংখ্যা ১৬টি। ” সীমানার বাইরে নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণ করে গলাচেপে ধরা হয়েছে। ফলে একসময় যেখানে পালতোলা নৌকা চলাচল করতো এখন সেখানে পানির পরিবর্তে ধূ ধূ বালির চর।
ফসলের মাঠগুলো এখন বিরানভূমিতে রূপান্তরিত হয়েছে। পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার ফলে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে দ্রুতগতিতে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ছে। এখন পুরো দেশ কৃষিকাজ আর নিত্যদিনের ব্যবহারের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় নদী, ভূগর্ভস্থ পানি সবোর্পরি পানি ব্যবহারের প্রতি যত্নশীল না হলে বাংলাদেশে পানি সমস্যা সমাধান করা কঠিন হবে। এখন থেকেই বৃষ্টির পানির ব্যবহার বাড়িয়ে পানির মজুদ বাড়াতে প্রাকৃতিক রিজার্ভার তৈরী করা প্রয়োজন।
এছাড়াও বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে আন্ত:নদী বিষয়ক সমঝোতার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ নদীসমূহকে রক্ষার জন্য সুষ্ঠু নীতিমালার বাস্তবায়ন জরুরী। বিদ্যমান আইনের প্রয়োগ করে নদীকে দখল ও দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। নদীর নাব্যতা রক্ষায় খননের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থও বরাদ্দ জরুরী। পানি দিবস এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে একবারের জন্য সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বাংলাদেশে পানির ঐতিহাসিক বিবর্তনঃ
হিমালয় ও অন্যান্য পর্বতমালা থেকে নেমে আসা এবং বৃষ্টি ধোয়া নদী-বাহিত পলি জমে বাংলাদেশ নামের ব-দ্বীপ ভূমি জেগে উঠেছে।
আর এ ব-দ্বীপের মানুষ বেড়ে উঠেছে নদী-নালা-খাল-বিল-হাওড়-বাওড়, বন-বাদাড় সমৃদ্ধ পরিবেশ-প্রকৃতির কোলে। এই পরিবেশই একটা ক্ষুদ্র ভূমিতে এত বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও স্বাস্থ্য রক্ষা করে চলেছে। এ কারণেই নদ-নদী আমাদের জীবন ও সংস্কৃতির সাথে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। নদ-নদীর প্রবাহই বাংলার প্রাণ-প্রবাহ। একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশের হৃদয়-জুড়ে বারো শত নদ-নদীর নাম পাওয়া যেত।
এখন তা ২শ'৫৪টিতে নেমে এসেছে। তাও শুষ্ক মৌসুমে ১৭/১৮টির বেশি নদী সচল থাকে না। এ ভূখন্ড গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকার সৃষ্টি। ভারত, নেপাল, ভুটান, চীন ও বাংলাদেশ এই পাঁচটি দেশজুড়ে প্রবাহিত এসব নদীর এলাকা প্রায় সাড়ে দশ লাখ বর্গকিলোমিটার। নদীগুলো বাংলাদেশের ভিতর মাত্র ৭.৫% এলাকা দখল করে প্রবাহিত হয়ে সাগরে গিয়ে পড়েছে।
এই অববাহিকা অঞ্চল পৃথিবীর মোট স্থলভূমির মাত্র ১.২ ভাগ। কিন্তু পৃথিবীর প্রায় ১০ ভাগ মানুষ বাস করে এ অঞ্চলে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সব অংশ জুড়েই রয়েছে পানি । খাওয়া, গৃহস্থালিসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যবহার করা, উৎপাদন বৃদ্ধিসহ প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ নানা প্রয়োজন পূরণ করে। প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশের মানুষ নদী, খাল, বিল, পুকুর, দীঘি আর কূপের পানি নিত্য নৈমত্তিক কাজে ব্যবহার করে।
এসব উৎস থেকে সরাসরি পানি পান করে। তবে এ পানি কখনো কখনো তাদের জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়। কলেরা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এতে বিভিন্ন এলাকা জনশুণ্য হয়ে পড়ার নজির তৈরী হয়। এক সময় জানা যায়, কলেরা আসলে একটি পানিবাহিত রোগ।
ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের পানি সরাসরি পান করার ফলেই এ রোগের সংক্রমণ হয়েছে। এরপরই ভাবনা আসে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের। এ পানি ব্যবহার আর সচেতনতার কারণে কলেরার প্রদুর্ভাব কমে আসে। কিন্তু দেখা দেয় আরেক মরণব্যধি আর্সেনিকোসিস। ভূগর্ভের শিলার ফাঁকে ফাঁকে আটকে থাকা আর্সেনিক নলকূপের মাধ্যমে উপরে উঠে আসছে।
এটি মানব দেহে প্রবেশ করছে। এমনকি ফসলের ক্ষেতে এ পানি প্রয়োগ করার ফলে উৎপন্ন ফসলের মাধ্যমেও আর্সেনিক মানব দেহে ছড়িয়ে পড়ছে।
১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার বড়ঘরিয়া ইউনিয়নের ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি আবিষ্কৃত হয়। ২০০১ সালে ব্রিটিশ জিওলজিক্যাল সার্ভে বাংলাদেশের ৬১টি জেলার নলকূপের পানি পরীক্ষা করে জানায়, ৪২% নলকূপের পানিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান প্রতি লিটারে .০০১ পিপিএম চেয়ে বেশি মাত্রায় আর্সেনিক রয়েছে। ২৫% নলকূপের পানিতে বাংলাদেশের মান .০০৫ পিপিএম চেয়ে বেশি রয়েছে।
২০১০ সালের ২২ মার্চে বাংলাদেশ সরকার ও ইউনিসেফ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ৫৪টি জেলার নলকূপের পানি-পরীক্ষার তথ্য পরিবেশিত হয়। এ থেকে জানা যায়, ৪৭টি জেলার ২’শ ৩৩টি উপজেলার ২ হাজার ইউনিয়নের ৩১ হাজার ৪শ ৯৭টি গ্রাম আর্সেনিক দূষণের শিকার। আর আর্সেনিকোসিসের রোগীর সংখ্যা ৫৬ হাজার ৭৫৮ জন। বাংলাদেশের মান অনুযায়ী কোন এলাকায় ৫% নলকূপের পানিতে আর্সেনিক পাওয়া গেলে আর্সেনিক দূষণের শিকার এলাকা বলে চিহ্নিত করা হয়। এ হিসেবে চুয়াডাঙ্গা জেলা একটি আর্সেনিক দুষিত এলাকা।
২০১২ সালের মার্চ মাসের হিসেব অনুযায়ী এ জেলার মোট আর্সেনিকোসিস রোগীর সংখ্যা এক হাজার ৫৫৫ জন। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল কর্তৃক পরিচালিত ২০০৩ সালের জরিপ অনুযায়ী চুয়াডাঙ্গা জেলায় সরকারীভাবে স্থাপিত মোট নলকূপের সংখ্যা পাঁচ হাজার ৩১টি। এর মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক পাওয়া যায় ৩ হাজার ৫৬২টি নলকূপে। গত ফেব্রুয়ারি মাসেও জেলায় ১৫ জন আর্সেনিকোসিস রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে।
১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে প্রথম আর্সেনিক আবিষ্কৃত হলে অনেকেই ধারণা করেছিলেন সার, কীটনাশক ইত্যাদির ব্যবহার, কারখানার বর্জ্য নিষ্কাশন, আর্সেনিক যৌগ দ্বারা পরিশোধিত পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের খুঁটি আর্সেনিক সমস্যার মূল কারণ।
তবে ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত ‘ঢাকা ঘোষণা’য় জানানো হয় যে, আর্সেনিক দূষণের কারণটি ভূতাত্ত্বিক।
আর এর ফলেই এখন সময় এসছে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বাদ দিয়ে পুনরায় ভূপৃষ্ঠের পানি বিশুদ্ধ করে ব্যবহার করা। বিভিন্ন সরকারী, বেসরকারী সংগঠন এবং বিভিন্ন দাতব্য সংস্থাকে এটি কার্যকর করে পানি সমস্যাকে মোকাবেলা করতে এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু এত পানির সরবরাহ কোথা থেকে সম্ভব হবে- সেটাই ভাবনার বিষয়।
বিশুদ্ধ পানি ও বাণিজ্যিকীকরণঃ
একজন সুস্থ মানুষের জন্য দিনে কমপক্ষে পাঁচ লিটার বিশুদ্ধ পানি পান করা জরুরী।
দেহ থেকে গড়পড়তা প্রতিদিন ২.৩ লিটার পানি বের হয়ে যায়। নিচের উপাদানগুলো পানির মধ্যে পাওয়া গেলে বা সংরক্ষিত থাকলে সেটিকে বিশুদ্ধ বা পান যোগ্য পানি বলা চলে। ভূগর্ভের ৪৫০ ফুট নিচের পানি উত্তোলন করা হলে এসব উপাদানগুলো পাওয়া যায়। বিশুদ্ধ পানি আর্সেনিকমুক্ত হবে। ক্যাডমিয়াম < ০.০০৩ এর কম থাকবে।
লেডমুক্ত হবে বা > ০.০০১ এর কম থাকবে। নাইট্রেট ৪.৫ এর মধ্যে থাকবে। সায়ানাইড ০.০১ এর মধ্যে থাকবে। ক্লোরাইড ২৫০ এর মধ্যে থাকবে। ম্যাগনেসিয়াম < ৩৫ এর নিচে থাকবে।
ক্লোরিন এর উপস্থিতি থাকবেনা।
বর্তমানে দেশের বাজারে পানির বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে। এক সময় এ দেশের মানুষ চিন্তাই করেনি পানিকে বোতলজাত করে বিক্রি করা হবে। বাস্তবতা হলো- বর্তমানে এক বোতল ৫০০ মি.লি. এর পানির দাম ১৫ থেকে ২০ টাকা। বিশুদ্ধ পানির প্রায় ৮০ ভাগ প্রাকৃতিক ভাবেই পাওয়া যায়।
বাকি ২০ ভাগ জার্মান ওজোন প্রযুক্তি ও রিভার্স অসমোসিস পদ্ধতির মাধ্যমে পরিশোধন করা হয়। এদেশে ভূগর্ভস্থ পানি অবাধে বিনামূল্যে কারো অনুমতি ছাড়াই পাওয়া যাচ্ছে। অথচ মাত্র ২০ ভাগ প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য ৫০০ মি.লি. পানির মূল্য ১৫ টাকা থেকে ২০ টাকা দিতে হচ্ছে। ভারতে ইতোমধ্যে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা আরোপের জন্য আইন করতে যাচ্ছে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পানি তুলতে হলে অর্থ দিতে হবে।
বর্তমানের এ চিত্র আগামী দিনের পানি সংকটে ভয়াবহ বাণিজ্যিকীকরণের দিকটি তুলে ধরেছে। যথেস্ট পানি না পাওয়া গেলে তা হল ভৌতিক পানি স্বল্পতা (Physical Scarcity)। আবার পানি হয়ত আছে কিন্তু তার জন্য অত্যধিক দাম দিতে হচ্ছে তাকে বলে অর্থনৈতিক পানি সঙ্কট (Economic Scarcity)। বাংলাদেশে পানি বাণিজ্যিকীকরণের দিকটি বিবেচনা করলে অর্থনৈতিক পানি সংকটে পড়তে যাচ্ছে বলে ধারণা করে নেয়া যায়। সরকার এ কারণে ১৯৯৯ সালে প্রণীত পানি-নীতির আলোকে পানি আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে।
আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, পানির অপচয় ও অপব্যবহার রোধ করে সমন্বিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকার পানি ব্যবহার মূল্য নীতিমালা প্রণয়ন করবে। মূল্য আরোপ নীতি প্রসঙ্গে বলা হয়, গৃহস্থালি ও সাধারণ কৃষি কাজে ব্যবহারের পানির জন্য কোনো মূল্য দিতে হবে না। তবে বাণিজ্যিকভাবে পানি ব্যবহারের জন্য মূল্য নির্ধারণ করা যাবে। আইনটি মন্ত্রী পরিষদ থেকে আরো যাচাই বাছাইয়ের জন্য ফেরত পাঠানো হয়েছে। এ আইন কার্যকর হলে সরকার পানি সঙ্কটপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে এসব এলাকায় পানি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করবে।
ফলে আগামী দিনগুলোতে এখনকার মতো পানি আর সহজলভ্য থাকবেনা।
পানি ব্যবহারে ধনী গরিব বৈষম্যঃ
জাতিসংঘের মানবিক উন্নয়ন রিপোর্ট, ২০০৬ এ বলা হয়েছে-একজন আমেরিকান ৫ মিনিট গোসল করতে যে পরিমান পানি ব্যবহার করেন তা উন্নয়নশীল দেশে এক জনের সারাদিনের পানি ব্যবহারের সমান। উন্নয়নশীল বিশ্বে খাদ্য চাহিদা মেটাতে সিংহভাগ পানি ব্যবহার হয় কৃষিতে। এই দেশগুলোতে ৭০% পানি ব্যবহার হয় কৃষিতে আর ৩০% ব্যবহার হয় শিল্প,গৃহস্থালী ও অনান্য কাজে। উন্নত বিশ্বে পানির ব্যবহার ঠিক বিপরীত।
শিল্প এবং গৃহকাজে ৭০% আর ৩০ % ব্যবহার হয় কৃষিকাজে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য মতে, এক লিটার গরুর দুধ উৎপাদনের জন্য ২'শ লিটার পানি, একটি আপেলের জন্য ৭০ লিটার, একটি ডিম উৎপাদনের জন্য এক'শ ৩৫ লিটার পানির দরকার হয়।
জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত একটি প্রতিষ্ঠান ওয়াটার সাপ্লাই এ্যান্ড স্যানিটেশন কোলাবোরেটিভ কাউন্সিল (ডাব্লিউএসএসসিসি) এর হিসেবে, উত্তর আমেরিকায় একজন ব্যক্তি প্রতিদিন ৪’শ লিটার পানি ব্যাবহার করে, সেখানে উন্নয়নশীল বিশ্বে প্রতিদিন প্রতিজন মাত্র ১০ লিটার পানি ব্যবহার করে।
পানি বিশেষজ্ঞদের মতে কোন এলাকায় পানির প্রাপ্যতা জনপ্রতি বাৎসরিক ১৭’শ কিউবিক মিটারের নীচে হলে “পানি সমস্যা” ধরা হয়। এক হাজার কিউবিক মিটারের নীচে হলে ধরা হয় “পানি সংকট” আর ৫’শ কিউবিক মিটারের নীচে হয় তাহলে “অত্যন্ত পানি সঙ্কট” ধরা হয়।
এক কিউবিক মিটারে এক হাজার লিটার পানি।
World Wildlife Fund Living Planet Report 2008 অনুযায়ী-পৃথিবীতে যে পাচটিঁ দেশ প্রতিবছর মাথাপিছু সবচেয়ে বেশি পানি ব্যবহার করে থাকে তারা হলো- যুক্তরাষ্ট্র-২ হাজার ৫’শ কিউবিক মিটার, গ্রিস-২ হাজার ৪’শ কিউবিক মিটার, মালয়শিয়া-২ হাজার ৩’শ কিউবিক মিটার, ইটালি-২ হাজার ২’শ কিউবিক মিটার ও স্পেন ২ হাজার ১’শ কিউবিক মিটার।
বাংলাদেশে রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন মাথাপিছু পানি ব্যবহারের চাহিদা ধরা হয় ১০০ লিটার। বছরে ৩৬ হাজার লিটার বা ৩৬ কিউবিক মিটার পানি। যদিও ওয়াসা কখনোই চাহিদা অনুযায়ী পানি সরবরাহ করতে পারেনি।
Water and Sanitation Program (June 2009) অনুযায়ী দেশের ১১ টি বড় শহরে দৈনিক মাথাপিছু ৮৮ লিটার পানির সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে। তবে জাতিসংঘের মানবিক উন্নয়ন রিপোর্ট ২০০৬ অনুযায়ী দৈনিক মাথাপিছু পানি ব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৯ তম এবং ব্যবহৃত পানির পরিমাণ ৪৬ লিটার। প্রথম অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র যার মাথাপিছু ব্যবহৃত পানির পরিমাণ ৫’শ ৭৫ লিটার। ভারতের অবস্থান ১৭ নম্বরে। তাদের মাথাপিছু প্রতিদিন ব্যবহৃত পানির পরিমাণ ১৩৫ লিটার।
পানির প্রাপ্যতা আর ব্যবহারের এ ব্যবধানই এখন ধনী গরীব নির্ধারণ করে দিচ্ছে।
পানি এবং যুদ্ধঃ
বিশ্বে স্বাদু পানির চাহিদা যেভাবে বাড়ছে আর যেভাবে উজানে অবস্থানরত দেশগুলো কৃত্রিম উপায়ে নদীর পানি প্রত্যাহার প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে তাতে আগামীতে পানি নিয়েই বিশ্বে অস্থিরতা বাড়বে বলেই গত ২৫ বছর ধরে সবাই ধারণা করছেন। এর আগে খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০ থেকে ২৩৫০ এর মধ্যে পানি নিয়ে সুমেরিয়ান দুটি রাষ্ট্র লাগাস এবং উম্মা এর মধ্যে যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সিরিয়া জর্ডান নদীর পানি প্রত্যাহার করতে গেলে ইসরাইল বোমা হামলা চালিয়েছে। মিশর নীলনদের উজানের কোন দেশ বাঁধ নির্মাণ করলে সামরিকভাবে প্রতিহত করা হবে বলে হুমকি দিয়েছে।
বিভিন্ন নদনদী নিয়ে দিন দিনে উত্তেজনা বাড়ছে। মিশরের সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বুট্রোস ঘালি বলেছিলেন,“The next war in the Middle East will be fought over water, not politics” আরেক মহাসচিব কফি আনান বলেন,“Fierce competition for fresh water may well become a source of conflict and wars in the future” বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসমাইল সিরাজেলদিন বলেন, The wars of the next century will be over water unless significant changes in governance occurred.
এদিকে পানি নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে দেখা দেয়া অস্থিরতার কোনটারই পুরোপুরি সুরাহা এখনো সম্ভব হয়নি। যেসব নদ-নদী বিভিন্ন দেশসমূহের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর উত্তেজনার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে তার কয়েকটি উল্লেখ করা হলো।
নীল নদ : তানজানিয়া, উগান্ডা, রুয়ান্ডা, বুরুন্ডি, কেনিয়া, কঙ্গো, ইথিওপিয়া, মধ্য আফ্রিকা, সুদান ও মিশর।
টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদী : তুরস্ক, সিরিয়া ও ইরাক।
মেকং নদী : চীন, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও লাউস।
জর্দান নদী : জর্দান, ফিলিস্তিন, ইসরাঈল, সিরিয়া ও লেবানন।
লেক চাদ: আলজেরিয়া, ক্যামরুন, মধ্য-আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, চাদ, লিবিয়া, নাইজার, নাইজেরিয়া ও সুদান।
গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র : বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপাল, মায়ানমার, চীন।
টুম্যান : চীন, উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া।
লেমপা : এল সালভাদর, গুয়েতামালা, হুন্ডরাস।
লাপাটা : আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে, উরুগুয়ে।
সেনেগাল : গায়েনা, মালে, মৌরিতানিয়া, সেনেগাল।
পানি সহযোগিতায় বিদ্যমান আইনঃ
দেখা যাচ্ছে বিশ্বের বড় নদীগুলোর কোনটিই একক কোন দেশের সম্পদ নয়। সহযোগিতার ভিত্তিতে এসব নদীর পানি স্বার্থসংশ্লিষ্ট দেশগুলো ব্যবহার করলে সকলেই লাভবান হতে পারে।
আন্তর্জাতিক পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট ও অরিজন স্টেট ইউনিভার্সিটির এক যৌথ গবেষণার ফলাফলে এটাই প্রতীয়মান হয়েছে। ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম দানিয়ুব নদীটি ৯টি রাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হলেও এর পানি ১৩ রাষ্ট্রের মধ্যে ভাগাভাগি হচ্ছে। ১৩টি রাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন দানিয়ুব নদী কমিশন গঠন করে সবাই সমতার ভিত্তিতে পানি ব্যবহার করছে। সর্বশেষ হোয়াংহো নদীর পানি কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, লাওস ও কম্পুচিয়া ৫টি দেশ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ব্যবহার করে সবাই উপকৃত হচ্ছে। নদীর পানি বণ্টন নিয়ে দ্বিপাক্ষিক-বহুপাক্ষিক বিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য ১৯৬৬ সালে হেলসিংকিতে গৃহীত হয়েছে আন্তর্জাতিক আইন বা নীতিমালা।
বহু দেশই এ নীতিমালা অনুসরণ করে তাদের মধ্যকার অভিন্ন নদীর পানি প্রবাহ ও বণ্টন সমস্যার সমাধান করেছে। এই নীতিমালার ৪ ও ৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত দেশ, অভিন্ন নদী ব্যবহারের ক্ষেত্রে অন্য দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজন বিবেচনা করবে। এ জন্য অবশ্যই যেন অন্য দেশের কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। একই আইনের ২৯(২) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, একটি রাষ্ট্র নদী অববাহিকার যেখানেই অবস্থান করুক না কেন, তার যে কোনো প্রস্তাবিত অবকাঠামোর নির্মাণ এবং স্থাপনের ব্যাপারে নদী অববাহিকায় অবস্থিত অন্য যে কোনো রাষ্ট্র, এই কাজের ফলে অববাহিকায় ঘটা পরিবর্তনের কারণে যার স্বার্থহানি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাকে এ ব্যাপারে নোটিশ দিতে হবে। নোটিশ গ্রহীতা দেশটি যেন প্রস্তাবিত পরিবর্তনের সম্ভাব্য ফলাফলের বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী থাকতে হবে।
প্রায় অনুরূপ কথা বলা হয়েছে ১৯৯৭ সালে গৃহীত জাতিসংঘের নদী কনভেনশনের ১২ নম্বর আর্টিকেলে। কিন্তু আন্তর্জাতিক নদীগুলোর উজানে অবস্থিত শক্তিশালী দেশগুলো এসব আন্তর্জাতিক আইনের থোড়াই পরোয়া করছে।
অসম পানি বণ্টনঃ
নীলনদ হলো ঝুঁকিপূর্ণ নদী অববাহিকার মধ্যে অন্যতম। নদীটি উগান্ডার ভিক্টোরিয়া হ্রদ ও ইথোপিয়ার তানা হ্রদ থেকে উৎপন্ন হয়ে ১০টি দেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ১০ টি দেশই নীল নদের উপর নির্ভরশীল।
এ পর্যন্ত নীলনদের উপর মিশর ৫ টি, সুদান ৪ টি ও উগান্ডা একটি- মোট ১০ টি বাঁধ নির্মাণ করেছে। পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে উজানের দেশ ইথিওপিয়া ৮৫% পানি সরবরাহ করলেও অপক্ষাকৃত কম ব্যবহার করতে পারে। আর ভাটির দেশ হয়েও পানি নিয়ন্ত্রণ করছে মিশর। ফলে ভাটির দেশগুলোতে এর পানির ব্যবহার ও সম্পদ নিয়ে উত্তেজনা বিরাজমান। এর মধ্যে মিশর ও সিরিয়ার রাজনৈতিক নেতারা একে অন্যকে একাধিকবার হুমকি দিয়েছে।
সুদান ও মিশর নীলনদের পুরোপুরি সুবিধা নিতে পানি চুক্তির মাধ্যমে পানি ভাগাভাগি করে নিয়েছে। ১৯২৯ সালের সুদান- মিশর একটি পানি চুক্তি করে যাতে মিশরকে ৪৮ বিলিয়ন ও সুদানকে ৪ বিলিয়ন পানি ব্যবহার করার অধিকার দেয়া হয়। চুক্তি অনুয়ায়ী জানুয়ারী ২০ থেকে জুলাই ১৫ তারিখ পর্যন্ত নীলনদের সম্পূর্ন পানি মিশর নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলা হয়। পরে ১৯৫৯ সালে নীলনদের পানি নিয়ে সুদান ও মিশরের মধ্যে আরো একটি চুক্তি সই হয়। চুক্তি মোতাবেক নীল নদের বার্ষিক পানি প্রবাহ ধরা হয় ৮৪ বিলিয়ন কিউবিক মিটার।
এতে ৫৫.৫ মিশর এবং ১৮.৫ বিলিয়ন কিউসেক পানি সুদান ব্যবহার করবে। দেখা যাচ্ছে বড় এবং শক্তিশালী দেশগুলোর অবস্থা উজানে বা ভাটিতে যেখানেই হোকনা কেন-নদীর পানির ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে এর থেকে সুফল লাভ করছে।
ব্রহ্মপুত্র নিয়ে উত্তেজনা ও ক্ষোভঃ
বিশেষজ্ঞদের মতে,এই অঞ্চলে চীন ও ভারতের মধ্যে একটি ‘পানিযুদ্ধ’ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। চীন ইতোমধ্যেই কয়েকটি নদীতে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার শুরু করেছে। চীনা ভূখণ্ড ১০টি আন্তর্জাতিক নদীর উৎস।
বর্তমানে চীন খরাপীড়িত প্রদেশে পানির প্রবাহ সরিয়ে নিতে ব্রহ্মপুত্র নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। চীনের এ পরিকল্পনার বিরোধিতা করছে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলের সরকারগুলো। ভারতের অরুণাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী নাবাম তুকি এবছরের ১৬ ফেব্রুয়ারী সাংবাদিকদের বলেছেন, তিব্বতে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর চীনের তিনটি হাইড্রোপাওয়ার বাঁধ প্রকল্প নিয়ে আমরা শঙ্কিত। চীনের ওই তিনটি বাঁধ ভাটি অঞ্চলের এলাকার স্বার্থে আঘাত হানবে।
আমাদেরও শঙ্কিত হওয়ার কারণ রয়েছে।
ব্রহ্মপুত্র নদের উপর এ বাঁধ হলে বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়বে। কারণ দুই হাজার ৯০৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ব্রহ্মপুত্র বঙ্গোপসাগরে পতিত হওয়ার আগে তিব্বতে এক হাজার ৬২৫ কিলোমিটার, ভারতে ৯১৮ কিলোমিটার ও বাংলাদেশে ৩৬৩ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বয়ে গেছে। গত ৩১ শে জানুয়ারী ভারত চীনকে অভিন্ন নদীর ওপর দুই দেশের অধিকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছে, নদীর ওপর চীনের এমন স্থাপনা নির্মাণ করা উচিত নয় যাতে তা ভারতের কৃষি ও শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
বাস্তবতা হচ্ছে ভারত এখন নদীর উজানে চীনের বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করে অভিন্ন নদীতে পানির প্রবাহ অক্ষুণ্ন রাখতে চীনকে অনুরোধ করলেও, নিজে বাংলাদেশের সাথে নদীর পানি ভাগাভাগি করতে দীর্ঘদিন থেকে গড়িমসি করে আসছে। গঙ্গা নদীর ওপরে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণসহ শতাধিক অভিন্ন নদীতে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করে বাংলাদেশের পানির অধিকার ক্ষুণ্ন করে চলেছে ভারত।
বাংলাদেশ ও ভারত আর্ন্তজাতিক নদীর পানি বন্টন সমস্যাঃ
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্য ৫৪ টি আর্ন্তজাতিক নদী রয়েছে । এর মধ্য ভারত বিভিন্ন সময়ে তার উন্নয়ন প্রকল্পের নামে ৫২ টি নদীতেই বাঁধ নির্মাণ করে। যখন শুষ্ক মৌসুমে পানি হ্রাস পায় তখন এসব নদীর প্রবাহ একেবারে বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে বাংলাদেশ তার প্রাকৃতিক অধিকার নদীর পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত কোন দেশ ব্রহ্মপুত্র ও সুরমা নদীর ওপর কোন বাধঁ নির্মাণ করেনি।
ব্রহ্মপুত্র নদীতে বাধ নির্মাণ না করলেও ভারত স্পার নির্মাণের মাধ্যমে ১০ হাজার কিউসেকের ও বেশী পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। সকলেই অবগত যে ভারত টিপাইমুখ বাধঁ দিয়ে সুরমা নদীর পানি প্রত্যাহারের জন্যও প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
গঙ্গার পানি বণ্টনঃ
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই ফারাক্কা ইস্যু দেশ দুটির আন্ত:রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব পায়। ১৯৭৫ সালের ১৮ ই এপ্রিল বাংলাদেশে ও ভারতের মধ্যে ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে মোট ৪১ দিনের একটি স্বল্প মেয়াদী চুক্তি সই হয়। চুক্তিতে পরীক্ষামূলকভাবে ভারতকে ১১ হাজার থেকে ১৬ হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহারের সুযোগ দেয়া হয় ।
তবে চুক্তিতে বাংলাদেশের জন্য ৪৪ থেকে ৪৯ হাজার হাজার কিউসেক পানি দেয়ার কথা বলা হয়। ১৯৭৫ সালের ৩১ মে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে ভারত একতরফা ভাবে প্রায় সম্পূর্ণ পানি প্রত্যাহার করতে শুরু করে। ফলে এদেশের অর্থনীতির এক তৃতীয়াংশ ধংসের মুখে পতিত হয়। দেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের শুরু এখান থেকেই।
১৯৭৭ সালে নভেম্বর মাসে বহু দেন দরবার শেষে দুদেশের মধ্য গঙ্গার পনি বণ্টনে একটি পাঁচ বছর মেয়াদি চুক্তি সই হয়।
এই চুক্তি অনুযায়ী ফারাক্কার মোট প্রবাহের ৫৫ হাজার কিউসেক পানির মধ্যে বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ করা হয় ৩৪ হাজার ৫ শত কিউসেক এবং ভারতের জন্য ২০ হাজার কিউসেক বরাদ্দ করা হয়।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পানি সমস্যা সমাধানের জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর উভয় দেশের নেতৃত্ব নতুন দিল্লিতে বৈঠক করে একটি ৩০ বছরের পানি চুক্তি সই করেন। এই চুক্তি অনুযায়ী ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ফারাক্কা থেকে দুই দেশের মধ্যে পানি ভাগাভাগি করা হয়। পূর্ববর্তী ৪০ বছরের গড় অনুযায়ী ভারত পানির ভাগ পেতে থাকে।
যে কোনো সংকটের সময় বাংলাদেশকে ৩৫ হাজার কিউসেক জল সরবরাহ করার গ্যারান্টিও দেওয়া হয়। কিন্তু কৌশলে ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ কমিয়ে ফেলা হয়েছে। তাই চুক্তি অনুযায়ী পানি পেলেও বাংলাদেশের প্রত্যাশিত পানি পাওয়া সম্ভব হচ্ছেনা- এটাই ধ্রুব সত্য।
তিস্তায় একতরফা পানি প্রত্যাহারঃ
তিস্তা নদী ভারতের সিকিমের সোহামো লেক থেকে উৎপত্তি হয়েছে। নদীটির মোট দৈর্ঘ্য ৩১৫ কিলোমিটার।
এটি লালমনিরহাট দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ফুলছড়ি ঘাটে যমুনা নদীতে গিয়ে মিশেছে। দেশের বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া ও আশপাশের উচ্চ ভূমি এ নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল। সত্তরের দশকের শেষের দিকে এ অঞ্চলে নিয়মিত জল সেচের জন্য তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প তৈরী করা হয়। এ প্রকল্পের কারণে দেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে আসে। কিন্তু ভারত বাংলাদেশের ডোমার থেকে একশ কিলোমিটার উজানে গজল ডোবায় এই নদীর ওপরে বিরাট বাঁধ দিয়ে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার শুরু করে।
ফলে শুষ্ক মৌসুমে কোন পানিই পাচ্ছেনা বাংলাদেশ। তিস্তা নদীর মোট প্রবাহের শতকরা ৪০ ভাগ পানির দাবী করে আসছে বাংলাদেশ। ১৯৮৩ সালে উভয় দেশের মন্ত্রী পর্যায়ে কথা পাকাপাকি হয় যে, তিস্তা নদীর পানির ৩৬% শতাংশ বাংলাদেশ এবং ভারত পাবে ৩৯% শতাংশ। আর নদী প্রবাহের জন্য ২৫% শতাংশ পানি সংরক্ষিত থাকবে। কিন্তু পরবর্তী আলোচনায় উভয় দেশের বিশেষজ্ঞ ও যৌথ নদী কমিশনের মতবিনিময় সভায় মতামত উঠে আসে- ভারত-বাংলাদেশ উভয় ৪০% শতাংশ পানি নেবে।
আর নদী প্রবাহের জন্য ২০% পানি সংরক্ষিত থাকবে। তবে ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিফলন অনুযায়ী ভারত ২৫ শতাংশ পানি দিতে রাজি মর্মে জানা যায়। তবে আগের রূপ রেখায় চুক্তি সই করার জন্য বাংলাদেশ আন্তরিকভাবে অপেক্ষা করছে। অন্যদিকে ভারত সরকারের সবোর্চ্চ পর্যায় থেকে চুক্তির ব্যাপারে আশ্বাস দেয়া হচ্ছে। এভাবেই নিষ্পিত্তহীন অবস্থায় পড়ে ঝুলে রয়েছে দেশের তিস্তা প্রকল্প এলাকার ৩ লাখ ৪২ হাজার হেক্টর জমি চাষাবাদের ভবিষ্যৎ।
টিপাইমুখ বাঁধঃ
অপরদিকে ২০০৪ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনোমহন সিং বরাক নদীর টিপাইমুখ নামক স্থানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলে বাঁধ নির্মাণের জন্য ভিত্তি স্থাপন করেন। বরাক নদীটি সুরমা নদী নাম ধারণ করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পরে মেঘনায় গিয়ে মিশেছে। ইন্সটিটিউট অব অয়াটার মডেলিং (আসামের) পরিচালিত এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, এ বাঁধ চালু হলে বরাক নদীর অমলশিদ পয়েন্টে পানি প্রবাহ কমে যাবে । জুন মাসে ১০% জুলাইয়ে ২৩% আগষ্টে ১৬% সেপ্টেম্বর ১৫% পানি কমে যাবে।
পানির গড় উচ্চতা অমলশিদ পয়েন্টে জুলাই মাসে এক মিটারের নীচে নেমে যাবে । এর গড় উচ্চতা ০.০১ থেকে ০.২৫ মিটারে নেমে যাবে। একই সময়ে সুরমা নদী ,কানাইঘাট ও সিলেট পয়েন্টে পানির গড় উচ্চতা হ্রাস পাবে .৭৫ থেকে .২৫ মিটার পর্যন্ত । এর ফলে নদীতে যান চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যাবে। সুনামগঞ্জ, সিলেট-মৌলভীবাজার ১০ হাজার হেক্টর জলাভূমি একেবারে শুকিয়ে যাবে এবং এই এলাকার হাওড়গুলো তার অতীত ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারবে না।
মেঘনা নদীর নাব্যতা থাকবে না।
চুয়াডাঙ্গার সুপেয় পানির বাস্তবতাঃ
চুয়াডাঙ্গা জেলা গাঙ্গেয় অববাহিকায় অবস্থিত; যার ওপর দিয়ে মাথাভাঙ্গা, ভৈরব, কুমার, চিত্রা এবং নবগঙ্গা নদীসমূহ প্রবাহিত হয়েছে। জেলার প্রধান নদী মাথাভাঙ্গা হলো পদ্মার দ্বিতীয় বৃহত্তম শাখা। এটি বর্ষাকালে দুকুল প্লাবিত হয়ে বয়ে চললেও শুষ্ক মৌসুমে পানি ক্ষীণধারায় প্রবাহিত হয়। ফলে জেলার কৃষি জমি আবাদে এ নদীর তেমন কোন ভূমিকা নেই বললেই চলে।
একসময় নদীটি পদ্মার পানি ভাটির দিকে বয়ে নিয়ে গেলেও বর্তমানে এর উৎস মুখের কয়েক কিলোমিটার এলাকা ভরাট হয়ে লোকালয়ে পরিণত হয়েছে। এরপরও পানির যেটুকু স্রোত বিদ্যমান রয়েছে তা অন্ত:সলীলা। মাটির নিচ থেকে পানি চুইয়ে নদীতে এসে পড়ছে। এ কারণে চুয়াডাঙ্গার খাল, বিল, পুকুর বা জলাশয়ে কোন পানি ধরে রাখা সম্ভব হয়না। অন্যদিকে ভৈরব নদী এখন মৃত প্রায়।
মুঘল আমলে চুয়াডাঙ্গার ভৈরব নদকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার। কলকাতাসহ ভারতের বড় শহর থেকে নৌকা বোঝাই মালামাল আসত চুয়াডাঙ্গাসহ আশপাশ এলাকায়। এখান থেকে যেত ঐতিহ্যবাহী খেজুরের গুড়সহ অনেক খাদ্যদ্রব্য ও পণ্য। সেই ভৈরব নদ আজ তার অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। বছরের পর বছরজুড়ে খননকাজ না হওয়ায় এর দুই পাশ পলি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
নদীগুলোর এমন বেহাল দশার কারণে ভূগর্ভস্থ পানিই এখন এই এলাকার একমাত্র সম্বল। চুয়াডাঙ্গায় চাষাবাদ থেকে শুরু করে সকল চাহিদা মেটানো হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানি থেকে। প্রতিটি ফসলের ক্ষেতের পাশে নলকুপ বসানো রয়েছে। মটর বসিয়ে মাটির নিচ থেকে পানি তুলে তা দিয়ে ফসল উৎপাদন করা হচ্ছে। এছাড়াও জেলার ভূপ্রকৃতি উচু হওয়ার কারণে পানির স্তরও অনেক নিচে।
এভাবে অবাধে পানি উত্তোলনের ফলে পানির স্তর আরো অনেক নিচে নেমে গেছে। অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে আর্সেনিক দূষণও বেশি। অনেক ক্ষেত্রে মাটির নিচে পাথরের আধিক্য থাকার কারণে গভীর নলকূপও স্থাপন করা যাচ্ছেনা। ইতোমধ্যে পশ্চিমবঙ্গ কর্তৃপক্ষ অভিযোগ তুলছে এই বলে যে, সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশ অংশে মাটির নিচের পানি অতিরিক্ত উত্তোলনের ফলে ভারতীয় এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ও নিচে নেমে গেছে। ভবিষ্যতে তাদের এ অভিযোগের সুর আরো চড়া হবে বৈ কমবেনা।
এ জন্য এখনোই সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প নিয়ে মাঠে নামা প্রয়োজন।
সমস্যা উত্তোরণের উপায়ঃ
ভূগর্ভস্থ পানি কম ব্যবহার করতে হবে। প্রয়োজনে বর্তমানে প্রস্তাবিত পানি আইনে এর নিয়ন্ত্রণ করতে প্রয়োজনীয় ধারা সংযোজন করা যেতে পারে। ভূমির উপরিভাগের পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। এজন্য প্রাকৃতিক রিজার্ভার বাড়াতে হবে।
বিশেষ করে বৃষ্টির পানির সবোর্ত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বৃষ্টির পানিতে চাষাবাদের প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। চুয়াডাঙ্গা এলাকাকে বাচাঁতে হলে পদ্মার সঙ্গে মাথাভাঙ্গা নদীর সংযোগ পুন:স্থাপন করতে হবে। সবগুলো নদী খনন করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রতিটি কলকারখানায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে বর্জ্য শোধনাগার স্থাপনে বাধ্য ও কার্যকর করতে হবে।
পানিকে আর্সেনিকমুক্তকরণের জন্য সকল পদ্ধতি ব্যবহার করে সবার জন্য পানির অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সুপেয় পানি নিশ্চিত করতে প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা বাড়ানো দরকার। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগকে আরো কার্যকর করা দরকার। ইউনিয়ন পর্যায়ে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করার জন্য ইউনিয়ন পরিষেদে যে ২১% বরাদ্দ রয়েছে তার ব্যবহার করতে হবে। প্রয়োজনে অবস্থা ভেদে এ বরাদ্দ বড়ানো যেতে পারে।
সবোর্পরি জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।
উপসংহারঃ
ন্যাশনাল সেন্টার ফর গ্রাউন্ড ওয়াটার রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেইনিং এনসিজিআরটি-এর পরিচালক ক্রেইগ সায়মন্স তার গবেষণায় বলেছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে ভূগর্ভস্থ পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যেসব অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে সেচ কাজ, কারখানার চাহিদা ও নগরবাসীর চাহিদা পূরণ করা হয় সেসব অঞ্চলে সমস্যা প্রকট হয়ে উঠবে। বাংলদেশ এদিক থেকে অ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।