আমরা হেরে যাইনি। এশিয়া কাপ না জিতলেও তোমরা আমাদের হৃদয় জয় করেছ। আমরা গর্বিত টিপাইমুখ বাঁধ : নির্মিত হচ্ছে বিপর্যয়ের আরও একটি স্মৃতিসৌধ ভারতের মণিপুর রাজ্যে বরাক নদীর ওপর নির্মাণ করা হবে প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের প্রচারণা অনুযায়ী, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলবিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য বাঁধটি নির্মিত হচ্ছে। ৩৯০ মিটার লম্বা ও ১৬২.৮ মিটার উঁচু টিপাইমুখ বাঁধ কারিগরি সংজ্ঞা অনুযায়ী বৃহত্ বাঁধের শ্রেণীভুক্ত।
টিপাইমুখ এলাকাটি বিশ্বের সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। ১৯৯৮ সালের ৬ আগস্ট ওই অঞ্চলে ৬.৬ মাত্রার একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। প্রস্তাবিত বাঁধের কাছ থেকে ওই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের দূরত্ব ছিল মাত্র ২৪০ কিলোমিটার।
এ ধরনের একটি বিপজ্জনক স্থানে এরকম একটি বৃহত্ বাঁধের অবস্থানের কারণে সেখানে ভূমিকম্পের প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। এর ফলে ভারত ও বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন ও সম্পদ বিপন্ন হবে।
কাজেই এটা অপ্রত্যাশিত নয় যে, ভারত ও বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত এবং সচেতন জনগোষ্ঠী ওই বাঁধের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করছে।
বরাক নদী উত্তর-পূর্ব ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম নিষ্কাশন ব্যবস্থা (Drainage System)। নয়শ’ কিলোমিটার দীর্ঘ বরাক নদীর অর্ধেকেরও বেশি পড়েছে ভারতের মধ্যে আর বাকি অর্ধেক বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনা নাম গ্রহণ করে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। ভারত সরকার এই বাঁধ নির্মাণের কথা কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে ভাটিতে অবস্থিত বাংলাদেশকে অবহিত করেনি। তাদের এই উদ্ধত আচরণ হেলসিংকি চুক্তি ১৯৯২, জাতিসংঘ কনভেনশন ১৯৯৭, বার্লিন রুলস ২০০৪ এবং এমনকি ১৯৯৬ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত গঙ্গা চুক্তিরও সরাসরি লঙ্ঘন।
১৯৭২ সালে যৌথ নদী কমিশনের প্রথম বৈঠকে বন্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বরাক নদীতে জলাধার নির্মাণের প্রসঙ্গ সর্বপ্রথম উত্থাপিত হয়। তবে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত এ বিষয়ে আর কোনো আলোচনা হয়নি। সে বছর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, ‘উভয় দেশের সংশ্লিষ্ট তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীরা বরাক নদীর টিপাইমুখে জলাধার নির্মাণের ভারতীয় পরিকল্পনার বিষয়টি যৌথভাবে খতিয়ে দেখবে। ’ এরপর থেকে ভারত তার প্রকৃত অভিলাষ সম্পর্কে বাংলাদেশকে একেবারেই অন্ধকারে রেখে একতরফা কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। বাংলাদেশের জনগণ প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার আগেই মণিপুরের বরাক উপত্যকার অধিবাসীরা ওই বাঁধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠেন।
সামাজিক ও পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতির বিবেচনায় প্রায় একই সময় এ ধরনের বৃহত্ বাঁধের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী আন্দোলনও জোরালো হয়ে ওঠে।
ওয়ার্ল্ড কমিশন অন ড্যাম-এর ২০০০ সালের প্রতিবেদনে জীববৈচিত্র্য ও প্রতিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাবের কথা উল্লেখ করে পরিবেশ বিধ্বংসী এ ধরনের প্রকল্প হাতে নেয়ার আগে জনগণের মতামত নেয়ার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়। ২০০৫ সালে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে বাংলাদেশ সুনির্দিষ্ট ও দৃঢ়ভাবে ভাটির দেশের ওপর টিপাইমুখ বাঁধের ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। এরপর থেকেই এ নিয়ে বাংলাদেশে তীব্র বিতর্ক চলে আসছে। নাগরিক সমাজ গভীর উদ্বেগ নিয়ে বাঁধের পরিবেশগত, কারিগরি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
ভারতের প্রতি অনুগত ও সহযোগী হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের বর্তমান মহাজোট সরকার সর্বৈব মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে ও তাদের প্রভাবশালী মন্ত্রীরা নিয়মিত বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে টিপাইমুখ বাঁধের পক্ষে জনমত তৈরির অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
২০১০ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় প্রকাশিত যৌথ ইশতেহারে এই স্পর্শকাতর ইস্যুটিকে একেবারেই অস্পষ্টভাবে এভাবে উল্লেখ করা হয় : ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী আবারও আশ্বাস দিয়েছেন যে ভারত টিপাইমুখ বাঁধে এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না, যাতে বাংলাদেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে (দফা-৩০)। ’ যৌথ ইশতেহারে বর্ণিত ভারতের কৌশলগত অবস্থানের সঙ্গে ১৯৫১ সালে ফারাক্কা বাঁধ প্রসঙ্গে পাকিস্তান সরকারকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির লক্ষণীয় সাদৃশ্য রয়েছে। সে সময় ভারত পাকিস্তানকে আশ্বাস দিয়েছিল যে, ফারাক্কা ও গন্ডক প্রকল্পের সম্ভাব্যতা প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে মাত্র এবং গঙ্গার পানিসম্পদের ব্যবহার ও উন্নয়নে সহযোগিতামূলক যে কোনো প্রস্তাবকে ভারত স্বাগত জানাবে।
১৯৫১ সালে তত্কালীন অখণ্ড পাকিস্তান সরকারের আনুষ্ঠানিক উদ্বেগ প্রকাশের ২৪ বছর পর ১৯৭৫ সালে ভারতীয় নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবের ওপর তাদের প্রভাব খাটিয়ে কোনো পানি বণ্টন চুক্তি ছাড়াই একতরফাভাবে ফারাক্কা বাঁধ চালু করে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সহযোগিতা প্রদানের বিনিময়ে ভারত আমাদের কাছ থেকে যেসব সুবিধা আদায় করে নেয়, একতরফাভাবে ফারাক্কা বাঁধ চালু ছিল তার অন্যতম। বাংলাদেশের সব দেশপ্রেমিক নাগরিকের ঐক্যবদ্ধ দাবি হচ্ছে—কালবিলম্ব না করে একটি সন্তোষজনক পানি বণ্টন চুক্তিতে উপনীত হওয়ার আগপর্যন্ত টিপাইমুখে ভারতকে সব ধরনের নির্মাণকাজ বন্ধে বাধ্য করতে হবে। আন্তর্জাতিক জলাধার সংক্রান্ত আইন ও কনভেনশন অনুসারে আমরা যদি টিপাইমুখ বাঁধের ইস্যুটি এখনই উপযুক্ত আন্তর্জাতিক ফোরামে উত্থাপন করতে ব্যর্থ হই, তবে ফারাক্কার মতো বেদনাদায়ক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব হবে না।
নদীসংযোগ প্রকল্প : বাংলাদেশের কফিনে শেষ পেরেক
১৯৭২ সালে ভারতের তত্কালীন পানিসম্পদ মন্ত্রী ড. এল. কে. রাও প্রথমবারের মতো সে দেশে একটি ‘ন্যাশনাল ক্যানেল গ্রিড’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। তার প্রস্তাবে মূলত উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলে পানি সরিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে ভারতের অধিকাংশ নদী সংযুক্ত করার কথা বলা হয়।
উত্তর তথা হিমালয় অংশে ব্রহ্মপুত্র ও শাখানদীকে গঙ্গার সঙ্গে এবং গঙ্গাকে মহানদীর সঙ্গে সংযুক্ত করার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়।
পেনিনসুলার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (Peninsular Develpoment Project) নামের এই প্রকল্পের মূল অংশ ছিল প্রধানত চারটি। প্রথমত মহানদী, গোদাবরী, কৃষ্ণা ও কাবেরীকে সংযোগ খাল দিয়ে যুক্ত করা হবে। দ্বিতীয়ত, যেসব নদী মুম্বাইয়ের পশ্চিম থেকে উত্তরে এবং টাপির দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছে, সেগুলোকে সংযুক্ত করা হবে। তৃতীয়ত, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তর প্রদেশে পানি সরবরাহে সুবিধা সৃষ্টির জন্য ‘কেন’ ও চম্বল নদীর মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা হবে।
এবং চতুর্থত, ওয়েস্টার্ন ঘাটসহ পশ্চিম দিকে প্রবাহিত যেসব নদী আরব সাগরে পতিত হয়েছে, সেগুলোকে সংযুক্ত করা হবে।
১৯৮২ সালে ইন্দিরা গান্ধী এই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব অর্পণ করেন ন্যাশনাল ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির ওপর। পরবর্তী দু্ই দশক ইস্যুটি প্রায় চাপা পড়ে ছিল। ২০০২ সালে জনস্বার্থে দায়ের করা একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সুপ্রিমকোর্ট অতীব উচ্চাভিলাষী ও বাস্তবায়ন অযোগ্য লক্ষ্য নির্ধারণপূর্বক ২০১৬ সালের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে একটি টাস্কফোর্স গঠনের জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দেয়। ১২ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়সাপেক্ষ এই অতিকায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ভারতের দুটি অংশের মধ্যে ১৭ হাজার ৮০০ কোটি কিউবিক মিটার পানি স্থানান্তরিত হবে, ৩ হাজার জলাধার তৈরি হবে এবং সর্বমোট ১৪ হাজার ৯০০ কিলোমিটার সংযোগ খাল নির্মিত হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ভারতের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি হবে এবং উজানের প্রতিবেশী বাংলাদেশের ওপর মহাবিপর্যয় নেমে আসবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে মরুকরণ প্রক্রিয়া ও বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা লবণাক্ত পানির মিলিত আগ্রাসনে এই বদ্বীপ জাতিটি চূড়ান্ত ধ্বংসের মুখোমুখি হবে। এমনকি ভারতের মন্ত্রীরাও এই নদীসংযোগ প্রকল্প নিয়ে পরস্পরবিরোধী মত দিচ্ছেন। ২০০৯ সালে তত্কালীন পরিবেশ ও বনমন্ত্রী জয়রাম রমেশ বলেছিলেন, প্রকল্পটি তার দেশের ‘মানবতা, প্রতিবেশ ও অর্থনীতি’তে বিপর্যয় ডেকে আনবে। তিনি এটাও বলেছিলেন, ‘কাগজপত্রে নদীসংযোগ সহজ কাজ।
এই ধারণার (প্রস্তাবিত প্রকল্পের) অববাহিকা মূল্য (Basin Value) সামান্যই। কিন্তু বৃহত্ আকারে নদীসংযোগ প্রকল্প হলে তা হবে বিপর্যয়কর। ’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ইতিপূর্বে প্রকল্পটি নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখাননি। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ‘নদীসংযোগ হলো এমন একটা বিষয় যেটি আমাদের সেচ এলাকা সম্প্রসারণে সাহায্য করবে। কিন্তু এর সমস্যাও আছে।
পরিবেশ নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ আছে। ’ এ অবস্থায় সম্প্রতি দ্বিতীয় বারের মতো এই বিতর্কিত প্রকল্পটিকে ভারতের সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক উত্সাহিত করার বিষয়টি বিস্ময়কর।
আরও দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী এপিজে কালামও তার মেয়াদকালে প্রকল্পটিকে সমর্থন করেছিলেন। এর মাধ্যমে এই প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ভাটিতে বসবাসরত কোটি কোটি মানুষের দুর্ভোগের প্রতি চরম অশ্রদ্ধা দেখিয়েছেন। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অবিলম্বে উপযুক্ত আন্তর্জাতিক ফোরামে ইস্যুটি উত্থাপন করা একান্ত আবশ্যক, জোরালোভাবে চ্যালেঞ্জ করতে হবে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের সাম্প্রতিক রায়টিকে।
উপসংহার
আন্তর্জাতিক আইন ও কনভেনশনের আলোকে এবার আন্তর্জাতিক নদী ব্যবস্থাপনার বিষয়ে ভারতের চার দশকের কর্মকাণ্ড যাচাই করার চেষ্টা করছি।
১. হেলসিংকি চুক্তি, ১৭ মার্চ ১৯৯২
ধারা : ২.১. (আন্তর্জাতিক নদীর ওপর) আন্তঃসীমান্ত প্রভাব (Transboundary Impact) রোধ ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পক্ষগুলো উপযুক্ত যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
ধারা : ২.২. বিশেষ করে পক্ষগুলো নিম্নে বর্ণিত সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করবে :
ক. পানির দূষণ কিংবা সম্ভাব্য দূষণের কারণ রোধ এবং সম্ভাব্য আন্তঃসীমান্ত প্রভাব হ্রাস ও নিয়ন্ত্রণ।
খ. সুস্থ প্রতিবেশ, যুক্তিসঙ্গত পানি ব্যবস্থাপনা, পানিসম্পদের সংরক্ষণ ও পরিবেশ রক্ষার লক্ষ্যে আন্তঃসীমান্ত জলরাশি ব্যবহার নিশ্চিতকরণ।
গ. আন্তঃদেশীয় জলপ্রবাহের যুক্তিযুক্ত ও ন্যায়সঙ্গত (Reasonable and Equitable) ব্যবহার নিশ্চিত করা আবশ্যক, বিশেষ করে নদীর ওপর প্রভাব ফেলতে পারে এমন কর্মকাণ্ড গ্রহণ করা হলে জলরাশির আন্তঃসীমান্ত চরিত্র বিবেচনায় নিতে হবে।
ঘ. ইকোসিস্টেমের সংরক্ষণ ও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে পুনর্বহাল নিশ্চিত করতে হবে।
২. আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহের নন-নেভিগেশনাল ব্যবহারের আইন সম্পর্কিত জাতিসংঘ কনভেনশন ১৯৯৭
ধারা-৫ : ন্যায়সঙ্গত ও যুক্তিসঙ্গত ব্যবহার ও অংশগ্রহণ
১. পানিপ্রবাহের দেশগুলো স্ব-স্ব ভূখণ্ডে ন্যায়সঙ্গত ও যুক্তিসঙ্গতভাবে (Equitable and Reasonable) আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহকে ব্যবহার করবে। বিশেষ করে, পানিপ্রবাহের রাষ্ট্রগুলো এমনভাবে আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহের ব্যবহার ও উন্নয়ন করবে, যার ফলে তারা এগুলোর সন্তোষজনক ও টেকসই ব্যবহারের মাধ্যমে উপকৃত হতে পারে এবং পর্যাপ্ত পানিপ্রবাহ রক্ষাসহ সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থরক্ষা হয়।
২. আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহের রাষ্ট্রগুলো ন্যায়সঙ্গত ও যুক্তিসঙ্গতভাবে পানিসম্পদের ব্যবহার, উন্নয়ন ও রক্ষায় অংশগ্রহণ করবে। বর্তমান কনভেনশন অনুসারে এ ধরনের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে পানিপ্রবাহ ব্যবহারের ওপর তাদের অধিকার থাকবে এবং এর সুরক্ষা ও উন্নয়নে সহযোগিতা করা দায়িত্ব হিসেবে বিবেচিত হবে।
ধারা-৭ : তাত্পর্যপূর্ণ ক্ষতি না করার বাধ্যবাধকতা
১. পানিপ্রবাহের দেশগুলো আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহকে তাদের স্ব-স্ব ভূখণ্ডে ব্যবহারের সময় অন্য পানিপ্রবাহের দেশের তাত্পর্যপূর্ণ ক্ষতি (Significant Harm) রোধ করার জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
২. তা সত্ত্বেও কোনো চুক্তি না থাকায় কোনোভাবে পানিপ্রবাহের কোনো রাষ্ট্রের যদি তাত্পর্যপূর্ণ ক্ষতি হয়, তবে যেসব রাষ্ট্র পানি ব্যবহারের মাধ্যমে অন্য কোনো রাষ্ট্রের এ ধরনের ক্ষতি করেছে, তারা ৫ ও ৬ ধারা অনুসারে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রের সঙ্গে পরামর্শ করে ক্ষতি দূর বা লাঘব করার জন্য উপযুক্ত সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। উপযুক্ত ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করবে।
৩. বার্লিন রুলস ২০০৪, ইন্টারন্যাশনাল ল’ অ্যাসোসিয়েশন
ধারা-১২ : ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার
১. অববাহিকা রাষ্ট্রগুলো তাদের স্ব-স্ব ভূখণ্ডে ন্যায়সঙ্গত ও যুক্তিসঙ্গত উপায়ে আন্তর্জাতিক জলরাশির নিষ্কাশন নিয়ন্ত্রণ করবে। তবে এক্ষেত্রে তারা অন্য অববাহিকা রাষ্ট্রগুলোর তাত্পর্যপূর্ণ কোনো ক্ষতি যাতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে বাধ্য থাকবে।
২. বিশেষ করে, অন্য অববাহিকার রাষ্ট্রের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে এবং জলরাশির পর্যাপ্ত সুরক্ষার ব্যবস্থাসহ অববাহিকা রাষ্ট্রগুলোকে জলরাশির সন্তোষজনক ও টেকসই ব্যবহার করতে হবে।
ধারা-১৩ : ন্যায়সঙ্গত ও যুক্তিসঙ্গত ব্যবহার নির্ধারণ
১. ১২ ধারার অর্থ অনুসারে প্রতিটি ক্ষেত্রে ন্যায়সঙ্গত ও যুক্তিসঙ্গত ব্যবহার নির্ধারণ করার সময় সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়কে বিবেচনায় নিতে হবে।
২. নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিতে হবে তবে কেবল এগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা যাবে না :
ক. ভৌগোলিক, জলভাগ সম্বন্ধীয় বিজ্ঞান (Hydrographic), পানি অনুসন্ধান সম্পর্কিত বিদ্যা (Hydrological), হাইড্রোজিওলজিক্যাল (Hydrogeological), জলবায়ু, প্রতিবেশ এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য;
খ. সংশ্লিষ্ট অববাহিকা রাষ্ট্রগুলোর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজন;
গ. প্রতিটি অববাহিকা রাষ্ট্রের জলরাশির ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী;
ঘ. একটি অববাহিকা রাষ্ট্রের ওপর অন্যান্য অববাহিকা রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক জলরাশির ব্যবহারের প্রভাব;
ঙ. আন্তর্জাতিক নিষ্কাশন অববাহিকার (International Drainage Basin) জলরাশির বর্তমান ও সম্ভাব্য ব্যবহার;
চ. আন্তর্জাতিক নিষ্কাশন অববাহিকার জলসম্পদের সংরক্ষণ, সুরক্ষা, উন্নয়ন এবং ব্যবহারে অর্থনৈতিক লাভ-অলাভ এবং এসব উদ্দেশ্য অর্জনে নেয়া পদক্ষেপের মূল্য;
ছ. বিদ্যমান ব্যবহারের সহজলভ্য বিকল্প কী আছে এবং তার তুলনামূলক মূল্য কত;
জ. প্রস্তাবিত অথবা বিদ্যমান ব্যবহারের স্থায়িত্ব; এবং
ঞ. পরিবেশের ক্ষতি যতটা সম্ভব হ্রাস করা।
৪. ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গার পানি চুক্তি ১৯৯৬
ধারা-৯ : সমতা, স্বচ্ছতা ও কোনো পক্ষের ক্ষতি না করার নীতির দ্বারা চালিত হয়ে উভয় সরকার অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন চুক্তি সম্পন্ন করতে সম্মত হয়েছে :
গঙ্গা চুক্তি স্বাক্ষরের পর ইতিমধ্যে ১৬ বছর পেরিয়ে গেছে। এই দীর্ঘ সময়েও ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত অন্যান্য আন্তর্জাতিক অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন বিরোধের কোনো সুরাহা হয়নি।
অন্যদিকে ভারত তিস্তাসহ প্রায় সব অভিন্ন নদীর উজানে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার বৃদ্ধি করেছে। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ ও হিমালয় অঞ্চলের নদীগুলো থেকে উজানের অন্যত্র এবং ভারতের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলে পানি প্রত্যাহারের লক্ষ্যে প্রতিবেশের জন্য বিপর্যয়কর নদীসংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নও অব্যাহত রেখেছে।
উজান ও ভাটির দেশের বিরোধপূর্ণ স্বার্থের মধ্যে ন্যায়সঙ্গত সমাধান পেতে হলে বছরের পর বছর আন্তরিক আলোচনা দরকার। বিশ্বের সর্বত্র শেষ পর্যন্ত ন্যায়সঙ্গত ব্যবহারের নীতির ভিত্তিতেই একটি সমাধানে পৌঁছানো হয়ে থাকে। এই নীতির সারকথা হলো : উজান-ভাটির সব দেশের অধিকার রক্ষা করতে হবে এবং একের পানিসম্পদ ব্যবহারের সময় যেন অন্যের অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করা না হয় এবং আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহেরও যেন ক্ষতি না হয়।
‘ডোনৌভারসিংকিং’ মামলায় স্পষ্টভাবে বিষয়টির ব্যাখ্যা করা হয়েছে এভাবে : আন্তর্জাতিক নদী যেসব দেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, সেসব রাষ্ট্র তাদের সার্বভৌম অধিকার প্রয়োগের সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অন্যান্য সদস্যের স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করতে পারবে না। আন্তর্জাতিক নদী যেসব রাষ্ট্রের ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, তাদের প্রত্যেককে অন্য রাষ্ট্রের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। কোনো রাষ্ট্রই এসব নদীর প্রবাহের স্বাভাবিক ব্যবহারের সময় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের তাত্পর্যপূর্ণ ক্ষতি করতে পারবে না।
ভারতের সঙ্গে আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহের ক্ষেত্রে আমাদের বিরোধ মীমাংসার ভিত্তি হতে পারে উপরিউক্ত অভিমতটি (Judgement)। জাতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য হেলসিংকি এগ্রিমেন্ট ১৯৯২, জাতিসংঘ কনভেনশন ১৯৯৭ এবং পানিসম্পদ বিষয়ে বার্লিন রুলস ২০০৪ অনুসারে এসব ইস্যু উপযুক্ত বিশ্ব ফোরামে উত্থাপনের জন্য বাংলাদেশের সময় এখনই।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সরকার ১৯৭৬ সালে যখন বিষয়টি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তখন ভারতের প্রবল বিরোধিতা উপেক্ষা করেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের সমর্থন করেছিল।
প্রবল ক্ষমতাধর প্রতিবেশী ভারত সবসময়ই গঙ্গার পানি বিরোধকে দ্বিপাক্ষিক বিষয় দাবি করে ইস্যুটির আন্তর্জাতিকীকরণের ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপকে নস্যাতের চেষ্টা করেছে। কিন্তু গত ৪১ বছর ধরে তাদের সঙ্গে আমাদের দ্বিপাক্ষিক আলোচনার অভিজ্ঞতা এক কথায় হতাশাব্যঞ্জক এবং চরম তিক্ততাপূর্ণ। আন্তর্জাতিক নদীর পানিসম্পদের ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র জাতিসংঘ কনভেনশন ১৯৯৭ অনুমোদন করেছে এবং হেলসিংকি এগ্রিমেন্ট ১৯৯২ ও বার্লিন রুলস ২০০৪-এর নীতি মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এমতাবস্থায় ষোলো কোটি জনগোষ্ঠীর ন্যায্য অধিকার সংরক্ষণে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি প্রাপ্তির আশা করতে পারি।
আমরা বিশ্বাস করি যে, ভাটির এই দেশটির জীবন ও জীবিকার প্রতি হুমকি এবং দুর্ভোগ-দুর্দশার ব্যাপারে তারা নীরব থাকতে পারে না।
ইমেইল :
(আমার দেশ, ৩১/১০/২০১২)
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।