কথায় বলে মানুষ হৃদস্পন্দনের শেষ শব্দটি পর্যন্ত বাঁচার চেষ্টা করে। কিন্তু এমন কিছু ঘটনা ঘটে যখন মানুষ পিতৃপ্রদত্ত প্রাণটিকেই নিতান্ত তুচ্ছ করে। সে দৌড়ে বাঁচতে চায়। এ দৌড় জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়ার দৌড়।
বলছিলাম অভিশপ্ত শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারী কাজী লিয়াকত আলী যুবরাজের কথা।
শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে লোকসানের পর লোকসানের আঘাতে পরিবার ও সমাজের কাছে লাঞ্ছনা আর হাহাকার সইতে না পেরে রাজধানীর গোপীবাগের আরকে মিশন রোডের ৬৪/৬-জে নম্বরে নিজগৃহে সিলিং ফ্যানের সাথে লটকে যান লিয়াকত।
লিয়াকত ভাই আপনি মারা গেছেন। রেখে গেলেন কিছু দুঃসহ স্মৃতি যা আমাদের আজও বেদনা আর রাগে নিরন্তর দগ্ধ করে। আপনার এই একই শোকে শোকাতুর যে আমরাও। আপনি চলে গিয়ে জীবনের দৌড় থেকে স্বেচ্ছা অবসর নিয়েছেন।
তবে আমরা আছি। জীবন সংগ্রামে দুটো রুটি রুজির ধাণ্ধায় ওই মরীচিকার পেছনে পেছনে আজও ধাওয়া করে চলেছি। উত্তপ্ত বালুকাবেলায় ছুটতে ছুটতে আমাদের পায়ের নিচে বার বার ফোষ্কা পড়ে গেছে। পুরোদেহ আজ ঝলসে গেছে। তবু আমাদের এ পথচলার বিরাম নেই।
আমাদের বাঁচার জন্য যে আজ ছুটতেই হবে।
আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংক সিকিউরিটি হাউজের বিও অ্যাকাউন্টধারী ৫৩১ ট্রেডিং নং এর বিনিয়োগকারী লিয়াকত হয়তো ছিলেন একজন শান্তশিষ্ট নিরীহ স্বভাবের মানুষ। জীবনের সঙ্গে এই লড়াইয়ে আর পেরে ওঠেননি। তাইতো শেয়ারবাজারে সর্বস্ব খোয়ানো লিয়াকতের মাত্র ৪ বছরের শিশুকন্যা মনীষার হতাশাভরা করুণ মুখটিকে আর সহ্য হয়নি। বারবার হতাশা আর পরাজয়ের গ্লানি লিয়াকতকে করে তুলেছিল নিজ জীবনের প্রতি আস্থাহীন, বিরক্ত আর বীতশ্রদ্ধ।
স্ত্রী সাথী আর একমাত্র সন্তান মনীষাকে অকূল পাথারে ভাসিয়ে নিজেই জীবন থেকে ছুটি নিতে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছেন। একটি কিণ্ডার গার্টেন স্কুলের প্লে গ্রুপ পড়ুয়া মনীষা হয়তো কোনদিন জানবেই না কেন তার বাবা তদের ছেড়ে চলে গেলেন।
আর শহীদ নবী স্কুলের শিক্ষিকা অসহায় সাথী হয়তো বাকি জীবন শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে যতবার মেয়েটির দিকে দৃষ্টি দিবেন ততবার একটি বিষয়ের প্রতি তার মুখ ঘৃণা আর বোবাকান্নায় তেতো হয়ে উঠবে। সেটি শেয়ারবাজার। এটি শুধু তাদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়েই ক্ষান্ত দেয়নি।
এটি তার স্বামীকে তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে তাকে বাধ্য করেছে মাত্র ২৮ বছরেই বিধবার বেশ নিতে। শিশুকন্য মনীষার কাছ থেকে বাবাকে কেড়ে নিয়েছে, শিশুটিকে করেছে পিতৃহারা আর তিনি হয়েছেন স্বামীহারা।
লিয়াকতভাই আপনি চলে গেছেন। কিন্তু আমরা আছি। ঠিক আপনারই মতো সর্বস্ব খুইয়ে অনেকটা জীবম্মৃতের মতো দিন পার করছি।
আমি জানিনা আমাদের এই অসহায় কান্না আপনার কাছে পৌঁছুবে কিনা। তবুও এটুকু বলতে পারি আমরা আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি। আমরা আপনার হত্যাকারী এই শেয়ার বাজারের কিছু করতে পারছি না। এই শেয়ার বাজার যে আমাদের একইভাবে সর্বস্বহারা করেও কোন মন্ত্রবলে আজও চলছে! মানুষ এখানে আজও স্বপ্ন দেখে!
জানি আমাদের এই স্বপ্নদেখা কেবলি স্বপ্নভঙ্গ হওয়ার জন্যই। তবুও স্বপ্ন আমাদের দেখতেই হয়।
যদি স্বপ্ন নাই দেখি তবে কী আগলে বেঁচে থাকবো। আপনারা হয়তো এই স্বপ্ন দেখার ক্ষমতাটুকুই হারিয়ে গেছিল। আমরা ঠিক ততোদিন স্বপ্ন দেখে যাবো যতদিন আপনার মতো ক্ষমতা হারিয়ে না ফেলি।
লিয়াকত ভাই আপনি যাই বলেন, আমার খুব কষ্ট হলেও মনে হচ্ছে আমরা সেই জাতি। যারা কিনা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল, তবুও বায়ান্নোতে মাতৃভাষার অধিকার ছাড়েনি।
একাত্তরে ত্রিশ লাখ জীবনকে বিসর্জন দিয়েছে তবুও স্বাধীনতার লাল সূর্য্যকে কোনো রাহুগ্রাসে যেতে দেয়নি। এই কথা যখন মনে পড়ে তখন আরো বেশি কান্না পায়। আমার বাবা সেই একাত্তরে যখন জীবন বাজি রেখে লড়াই করে দেশ স্বাধীন করেছিলেন তখন তিনি হয়তো ভাবেননি এই স্বাধীন দেশে মানুষের এতটা দুরবস্থার সম্মুখীন হতে হবে!
লিয়াকত ভাই আপনার মতো আমার বাবাও এই দুনিয়ায় নেই। উনি বেঁচে থাকলে আমি উনার কাছে আজ প্রশ্ন করতাম- ‘বাবা তুমি এই স্বাধীন বাংলাদেশ চেয়েছিলে যে দেশে বিদেশি লুটেরারা এসে লুট করবে, তোমার ছেলে ষাট লক্ষাধিক টাকা বিনিয়োগ করে সর্বশান্ত হবে?’ বাবা তুমি চলে গেছ তাই এই প্রশ্ন আজ করছি জাতির বিবেকের কাছে। আমি জানি জাতির মৃত বিবেকের এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া দুরে থাক, কথা বলারও কোনো ক্ষমতাই নাই।
তবুও একথা বলে মনে কিছুটা হলেও শান্তি পেতে চাই।
বাবা তুমি আজ শান্তিতে ঘুমিয়ে আছ, ভেবেছো তোমাদের হাতে স্বাধীন করা দেশে তোমার সন্তানরা আর যাই হোক দু-মুঠো অন্যের জন্য ধুকে মরবে না। আজ অনেক পরিহাসের হলেও সেই ক্রান্তিকাল সম্মুখে উপস্থিত। বাবা তোমার সন্তান ষাট লাখ টাকা বিনিয়োগ করে আজ সর্বশান্ত। তাকে বলা হয় সে নাকি ‘ফটকাবাজ’।
বাবা তুমি কি তোমার সন্তানকে সর্বশান্ত করে, তারপর মাথায় একটা ফটকাজের টুপি পরাতে এই দেশ স্বাধীন করেছিলে!
আমার মনে হয় তোমরা অতোশত ভাবোনি। তোমাদের ভাবনাতে ঘাটতি ছিল বলেই আজ আমি ফটকাবাজ। আমার আরেক ভাই লিয়াকত ঝুলছে সিলিং ফ্যানে। ওপারের জগত থেকে একটি বার আওয়াজ দাও বাবা। তোমার সন্তানরা আজ আর সহ্য করতে পারছে না।
তুমি তো জানো তোমার সন্তানেরা ফটকাবাজ নয়।
একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কখনোই আত্মঘাতী হওয়ার মতো কাপুরুষ নয়। তবুও নির্মম নিয়তির কাছে আজ সে বাধ্য হয়েছে। লিয়াকত ভাই, তুমি চলে গিয়ে আমাদের সবাইকে অপরাধী করেছো। তাই তোমার মৃত্যুতে এই জাতির বিবেকও সমান অপরাধী।
জানিনা ক্ষমা পাবো কিনা। আমাদের জাতি তার অতীত গৌরব ভুলে গেছে। তবুও বলি, লিয়াকত ভাই তুমি এই পথভ্রষ্ট জাতিকে ক্ষমা কর।
লিংক
রিয়াজ ইসলাম রুবেল, ব্লগার, চেয়ারম্যান বেসিক ফার্মা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।