আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার বন্ধু লিয়াকত

আর কয়েক দিন পর ছাব্বিশে মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া এ স্বাধীনতা। সে সময়ের কিছু চরিত্রকে নিয়ে গল্পটা লেখা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীর সৈনিকদের লেখাটা উৎসর্গ করা হলো।

ডিসেম্বর ১৯৬৫

বাবার বদলীর চাকুরী।

সে সূত্রে আমাদের কচুরি পানার মতো ভেসে বেড়াতে হয়। আমরা সেপ্টেম্বরে ফেনী এসেছি। আসার পর পরই বাবার পদের জোরে ফেনী পাইলট হাই স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলাম নবম শ্রেণীতে। সাথে সাথেই নবম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতি। যাক, কোনমতে পরীক্ষার পুলসিরাত পেরিয়ে একটু নিঃশ্বাস ফেলার ফুরসত পেয়েছি।

তবে, গত কদিন থেকে আবার ব্যস্ত। বাবা হলেন ফেনী মহকুমা অফিসারের পি আর ও – (পাবলিক রিলেসন্স অফিসার), মানে জন সংযোগ কর্মকর্তা। পঁচিশে ডিসেম্বর পাকিস্তানের জাতির জনক কায়েদে আজম মোহম্মদ আলী জিন্নাহর জন্মদিন। সে উপলক্ষে সরকারী উদ্যোগে সারা দিনব্যাপী নানা কর্ম-কাণ্ডের আয়োজন করা হয়েছে। তার অংশ হিসেবে স্কুলের হেড মাষ্টার সাহেব আমার ঘাড়েও কিছু দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছেন।



সন্ধ্যেয় মহকুমা লাইব্রেরীতে কায়েদে আজমের জীবনীর উপর এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। হলে টেবিল/চেয়ার সাজানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আমাকে সহ কয়েক জনকে। তাদের একজন, আমার বন্ধু লিয়াকত। ফেনীতে আসবার পর লিয়াকতের সাথেই আমার প্রথম বন্ধুত্ব হয়। ওর ভদ্র এবং বিনীত স্বভাবই বোধহয় আমার দৃষ্টি কাড়ে।

তাই ওর সাথে প্রথম কথা বলার পর পরই আমি ওর ভক্ত হয়ে গেলাম।

আলোচনা সভা উপলক্ষে মোহম্মদ আলী জিন্নাহর উপর একটা রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিলো। তাতে নিখিল চন্দ্র দাস নামে একটা ছেলে প্রথম পুরষ্কার পায়। পুরষ্কার হাতে তুলে দিতে গিয়ে সভার পরিচালক তার বক্তব্যে সারা মহকুমার সকল বয়সের জন্য উন্মুক্ত এই প্রতিযোগিতায় নবম শ্রেণীর একটা ছাত্রের এই সাফল্যে তাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানান।

আমাদের ক্লাসের ছেলেই তো।

অন্য সেকশনের বোধ হয়। কই, কখনো দেখিনাই তো। সভার মাঝেই ফিস ফিস করে বলি লিয়াকতকে।

না, ও আমাদের স্কুলের না; সেন্ট্রাল হাই'এর ছেলে।

চিনিস নাকি?

চিনবোনা মানে? আমাদের বাসার কাছেই বাসা।

আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সারাদিন আমাদের বাসাতেই পড়ে থাকে। তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিব।

লিয়াকতের মাধ্যমে নিখিলের সাথে আমার পরিচয় হয়; আর বন্ধুত্ব হতেও সময় লাগেনা। দিনে দিনে আমাদের তিন বন্ধুর ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।

তবে মুশকিলের কথা হলো, ওরা দুজন যখন নিজেদের মধ্যে ফেনী/নোয়াখালীর র স্থানীয় ভাষায় কথা বলে, আমি এক বর্ণও বুঝতে পারিনা। কথায় কথায় জানতে পারি, লিয়াকতও একসময় সেন্ট্রাল হাইতে নিখিলের সাথে একই ক্লাসে পড়তো। সেখানে লিয়াকত প্রতিবছর ফার্স্ট আর নিখিল দ্বিতীয় হতো। ক্লাস সিক্সে লিয়াকত ফেনী পাইলটে চলে আসবার পর থেকে নিখিল এখন প্রতিবছর ফার্স্ট হয়।

একদিন নিখিলকে প্রশ্ন করি, ওই পচা স্কুলে পড়ে আছিস কেন।

পাইলটে চলে আয়।

আমি দয়া করে যে পজিশনটা দিয়ে এসেছিলাম, সেটা পাহারা দেবার জন্যে বসে আছে। এখানে আসলে তো আর ফার্স্ট হতে পারবেনা, তাই আসতে চায়না। ফোঁড়ন কাটে লিয়াকত।

টিচাররা আসতে দেন না।

হতাশার সুরে বলে নিখিল।

কেন? আমার প্রশ্নের উত্তরে নিখিল আর লিয়াকত মিলে যা বলে, তার সারমর্ম হলো - ভাল ছাত্র বলে ওনারা নিখিলকে হারাতে চান না। কারণ সে ভাল ফল করলে স্কুলের সুনাম হবে। আর মেট্রিক পাশ করার পর ও আর পড়বে না। সংসারের প্রয়োজনে ওকে চাকুরী করতে হবে।

সুতরাং ভাল স্কুলে গিয়ে লাভ কি?

আস্তে আস্তে লিয়াকতদের সাথে আমাদের পারিবারিক বন্ধুত্ব হয়ে যায়। তদুপরি, ওর সাথে আমার দূর সম্পর্কের একটা মামা-ভাগ্নে সম্পর্কও বের হয়ে আসে। তাই মাঝে মধ্যে আমরা একে অন্যকে মামা (ফেনীর ভাষায় মাউ) বলরে শুরু করি।

লিয়াকতের বাবা (যাকে আমি ক্ষীণ সম্পর্কের কারণে নানা বলতাম) পাকিস্তান আন্দোলনে নোয়াখালী অঞ্চলের একজন প্রথম সারির নেতা ছিলেন। তবে আমার ফেনীতে স্বল্পকালীন অবস্থান কালে তাকে অন্য রূপে দেখতে পাই।

তিনি রাজনীতি ছেড়ে সমাজ সেবায় আত্মনিয়োগ করেন; সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষায় অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি বলতেন, অখণ্ড ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য আন্দোলন করে পাকিস্তানের সৃষ্টি করেছি। আজ যদি আমরাই আবার সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার চালাই, তাহলে আমাদের নীতির সাথে বেঈমানি করা হবে। সম্ভবতঃ তার অনুপ্রেরণার কারণে শহরের প্রায় সকল হিন্দু পরিবারেরে সাথে লিয়াকতের অত্যন্ত আন্তরিক সম্পর্ক ছিল।

উনিশ শ ছেষট্টির প্রথম দিকে ফেনীতে কি একটা কারণে সামান্য সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

নানা সে সময় হিন্দুদের বাড়ীতে বাড়ীতে গিয়ে সাহস যুগিয়েছিলেন। সে সময় একদিন বিকেলে আমরা ফেনী সার্কিট হাউজের কাছে আড্ডা দিচ্ছিলাম। কথায় কথায় রাত হয়ে যায়। নিখিল বললো, সে এত রাতে বাসায় যাবে কি করে? ওর ভয় লাগছে। উত্তরে লিয়াকত বলেছিল, যতক্ষণ ওর দেহে প্রাণ আছে, কারো সাধ্য নাই, নিখিলের একটা চুলও স্পর্শ করে।




ডিসেম্বর ১৯৬৯

ফেনী কলেজে বি কম পড়ার সময় থেকে ফেনী থেকে প্রকাশিত নতুন দেশ নামের একটা সাপ্তাহিক পত্রিকার সাথে আমি আর নিখিল জড়িয়ে পড়ি। না, নিখিলের পড়াশুনা বন্ধ হয়নি। লিয়াকতের বাবা এবং নতুন দেশ পত্রিকার মালিক/সম্পাদক রায়হান ভাই 'এর অর্থানুকূল্যে সে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে থাকে। ট্রাঙ্ক রোডে ছিলো পত্রিকাটার অফিস। একদিন দুপুরের পরে অফিসে ঢুকতেই দেখি, পত্রিকার কম্পোজিটার করিম চাচার হাতে কাঠের রুলার।

আর, অল-ইন-ওয়ান আবদুল মতিন, যাকে আমরা পিচ্চি বলে ডাকি, সে মারের ভয়ে রুমের এক প্রান্তে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে; পারলে চিচিং ফাঁক বলে দেয়াল ফাঁক করে অদৃশ্য হয়ে যায়। চোখে মুখে ভয়ের সাথে দুষ্টুমি মাখানো হাসিটা মেঘের ফাঁকে সূর্যালোকের মতো চিকমিক করছে।

হুয়রের (শুয়োরের) বাইচ্চা, তোরে আঁই (আমি) আইজ্জা (আজকে) কাঁচা খাই হালামু (খেয়ে ফেলবো)। ইমুই (এদিকে) আয়। আবার লাঠি উঠিয়ে পিচ্চির দিকে ছুটে যান করিম চাচা।

(গত চার বছরে আমি ফেনী/নোয়াখালীর ভাষার বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছি)।

আমি দুহাতে ওনাকে জড়িয়ে ধরি। থামেন চাচা। কি হইছে? মতিন্নারে মারেন কিয়ের লাই?

মাইরলাম কোনানে? মারনের কি দেইখছে হেতে (সে)?

আমি জোর করে ওনাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দেই। হাঁপাতে হাঁপাতে উনি রেলগাড়ির মতো গড় গড় করে বলে যেতে থাকেন নিজের দুঃখের কাহিনী।

হেতেরে গেরাম-তুন কাম হিয়ানের (শেখানোর) লাই (জন্য) আইনছি। আর হেতে ভাদাইম্যা গরুর মত রাইত-দিন আছে মিছিলের হিছে (পেছনে) .........।

করিম চাচার দীর্ঘ বক্তব্যের সারমর্ম হলো, ক্লাস এইট পাশ করার পর পিচ্চির বাবা অনেক অনুরোধ করে ওকে করিম চাচার সাথে জুড়ে দিয়েছেন, ছাপাখানার কাজ শেখার জন্যে। কিন্তু পিচ্চির কাজে মনোযোগ নেই। কাজের চেয়ে অকাজ করে বেশী।

সারাদিন কাটে মিছিলের পেছনে। চার মাসের উপর হলো, এখনো কোন অক্ষর কোন বাক্সে থাকে, তাও শেখেনি। কাল ওকে ম্যাটার ভেঙ্গে অক্ষর গুলো নিজ নিজ খোপে রাখার একটা ছোট্ট কাজ দিয়েছিলেন। আজ কম্পোজ করতে বসে দেখেন, অক্ষর সব জগাখিচুড়ি হয়ে আছে। দুপুরে ওকে অক্ষরগুলো ঠিক করে রাখতে বলেছিলেন।

সে তা না করে ভাষানীর মিছিলে গেছে।

আমি অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে চাচার রাগ ভাঙ্গাই। মনে মনে ভাবি, পিচ্চির দোষ কি? কম্পোজ শেখার সময় কোথায় ওর? নুনের মতো সাপ্তাহিক নতুন দেশ অফিসের সব কাজেই ওর ডাক পড়ে - পত্রিকা বিলি, চিঠি বিলি, মালিক/সম্পাদক রায়হান ভাই 'এর দৈনিক বাজার, অফিসের টি-বয়, রিপোর্টার; কোনটা নয়? আর ভাষানীর মিছিলে যাবার আদেশটা রায়হান ভাই 'এর নিজের। বাজার দর, খেলার খবর, মিছিলের খবর – এসবের আনঅফিসিয়াল রিপোর্টার হচ্ছে আবদুল মতিন ওরফে পিচ্চি। ওর কাছ থেকে সংবাদ নিয়ে প্রায়ই রায়হান ভাই নিজের এবং ঢাকার পত্রিকার জন্য রিপোর্ট লেখেন।

নিখরচায় এমন একজন সাব-রিপোর্টার পেলে মন্দ কি?

আমি আমার ডেস্কে বসে মতিনকে ডাকি। মতিন, ইমুই (এদিকে) আয়। ওর দিকে দুটো এক টাকার নোট বাড়িয়ে দিয়ে বলি, যা, হরেশের (পরেশের) মিষ্টি দোয়ান-তুন (দোকান থেকে) চাইরগা রসগোল্লা আর দুই কাপ চাঁ লই আয়।

সেদি সকালের দিকে মাওলানা ভাষানী দাবী/দাওয়া নিয়ে এস ডি ও অফিস ঘেরাও করেছিলেন। আমি বসে নিউজ-প্রিন্টের প্যাডে তার উপর একটা প্রতিবেদন তৈরি করতে থাকি।

একটু পর নিখিল আসে। সে কারু সাথে কথা না বলে রুমের এক কোনে একটা চেয়ারে মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে পড়ে। করিম চাচার কম্পোজিং 'এর খট খট ছাড়া কোন শব্দ নাই। আমি একটু পর নিখিলের কাছের চেয়ারে বসে ওকে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করি, কি অইছে? এতক্ষণ নিখিল কোন মতে কান্না থামিয়ে রেখেছিলো। আমার কথায় ওর চোখ দিয়ে বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতের মতো অশ্রু নেমে আসে।



হেতে আঁরে কয় হিন্দুস্তান চলি যাইতো।

কনে কয়?

লিয়াকত। হেতে কয়, মালাউন, ইয়ানে কি করস? যা, হিন্দুস্তান চলি যা।

হেতে মশকরা কইচ্ছে বোদয় (মনে হয় সে রসিকতা করেছে)।

গোলমালে করিম চাচা কাজ ফেলে উঠে আসেন।

ওনার প্রশ্ন, কি অইছে। আমি পুরো ঘটনা ওনাকে খুলে বলি।

হেতে বহুত বদলি গেছে। করিম চাচা বলতে থাকেন। আগে আঙ্গো ইয়ানে রেগুলার আইতো।

এ-ন (এখন) আর আইয়েনা। হেতে হুইছি, ছাত্র সঙ্ঘে যোগ দিছে।

মতিন ফিরে এসে টেবিলের উপর চা আর মিষ্টি রাখে।

হেতের মত বালা হোলা কেন্নে এইচ্যা (কি করে এ রকম) বিগড়াই গেলো? ধর্ম কি এতই খারাপ? আমার প্রশ্ন।

না না, লিয়াকতও খারাপ ন, ধর্মও খারাপ ন।



তা হইলে?

এই হিচ্চি। হরিষ্কার হানি দি (পরিষ্কার পানি দিয়ে) বালা মত ধুই একখান হিরিচ (পিরিচ) দে। মতিনকে আদেশ দেন করিম চাচা।

মতিন একটা প্লেট ধুয়ে টেবিলে রাখলো।

এইযে দেইখছ- রসগোল্লাও বালা, হিরিচও বালা।

এ-ন আঁই এজ্ঞা ( এখন আমি একটা) মিষ্টি ধরি হিরিচে রাইখলাম। করিম চাচা তার কালি-ঝুলি মাখা হাতে একটা রসগোল্লা নিয়ে প্লেটে রাখলেন। এ-ন মিষ্টি কি আর বালা আছে? দোষ কার? দোষ মিষ্টির অ ন, হিরিচের অ ন। হেতের মাতার (ওর মাথার) মইদ্যে ইবলিশ হান্দাইছে (ঢুকেছে); দোষ অইলো হেই ইবলিশের।

লিয়াকতকে প্রায়ই কলেজে দেখা যেতো না।

বি এসসি প্রথম পর্বের পরীক্ষাই দিলো না। এর পরেও, সে যে ভেতরে ভেতরে এতখানি বদলে গেছে, তখনো আমি তা পুরোপুরি বিশ্বাস করিনি। এ ঘটনার দু মাস পরে আমাদের ফেনী কলেজ ছাত্র সংসদের বার্ষিক নির্বাচন। ফেনী কলেজ তখন বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের ঘাটি। আমাদের হিসেব মত এবার ছাত্র সংসদের সকল পদ বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নই পাবে।

দুপুরের আগ পর্যন্ত নির্ঝামেলায় ভোট দেয়া চললো। আমরা ভোট দিয়ে ফেলেছি সকাল বেলা। এখন কলেজের বারান্দায় বসে আড্ডা দিচ্ছি আর অপেক্ষা করছি কখন মেয়েরা ঝাঁক বেঁধে ভোট দিতে আসবে। ( কি কারণে জানিনা, ওরা বেশীর ভাগই দুপুরের পরে ভোট দিতে আসতো)। মেয়েরা আসা শুরু হয়েছে।

হঠাৎ খেলার মাঠের এক প্রান্তে একটা হইচই শোনা গেলো। তাকিয়ে দেখি, কয়েকজন যুবক হাতের লাঠি ঘুরাতে ঘুরাতে কলেজের মূল ভবনের দিকে ছুটে আসছে। মুহূর্তের মধ্যে কলেজ খালি হয়ে গেলো। আমরা জানের ভয়ে কলেজের এক কোনা দিয়ে ষ্টেশনের দিকে ছুটে পালালাম। পলায়নের মুখে পেছন ফিরে লিয়াকতের মুখটা চোখে পড়লো।



সেবার ফেনী কলেজের ছাত্র সংসদে বারোটা পদের মধ্যে চারটা পায় ইসলামী ছাত্র সঙ্ঘ; বাকীগুলো পায় বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন। সে বছর সারা পূর্ব পাকিস্তানে দুটো কলেজের ছাত্র সংসদে প্রথম বারের মতো ইসলামী ছাত্র সঙ্ঘ আসন পায়। তাদের একটা ফেনী কলেজ, অন্যটা উত্তর বাংলার কোন একটা কলেজ (এত বছর পর নামটা মনে আসছে না)।

জুন, ১৯৮৫

আমার বন্ধু লিয়াকতের গল্প এখানেই হয়তো শেষ হতে পারতো। কিন্তু আসল গল্পকারের সেটা ইচ্ছে ছিলো না।

সত্তরের প্রথম দিকে বাবা বদলী হয়ে রংপুর চলে যান। একই বছরেরে মাঝামাঝি আমি ফেনী কলেজ থেকে বি কম পরীক্ষা দিয়ে ফেনী তাগ করি। এর পর আমার আর ফেনী যাওয়া হয়নি। ঊনিশ শ চুয়াত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একাউন্টিং'এ এম কম পাশ করে এখানে সেখানে চাকুরী করার পর উনিশ 'শ পঁচাশী সালের মার্চে আমি সৌদি আরবের জেদ্দায় একটা কনস্ট্রাকশান ফার্মে একাউন্টেন্ট হিসেবে যোগ দেই। জেদ্দার নজলা এলাকায় বাসা।

সে সময় বাংলাদেশ দূতাবাসও নজলাতে অবস্থিত ছিল।

আমার বাসা থেকে তিনটা বাসা পরে মসজিদ। একদিন মাগরিবের নামাজ পড়ে মসজিদের সামনের মুদি দোকান থেকে কিছু সামান্য কিছু বাজার করে বের হতেই ভুত দেখার মতো চমকে গেলাম। দোকানের এক পাশে চার/পাঁচজন মানুষের একটা জটলার মধ্যে ধোপ-দুরস্ত কাপড় পরে দাঁড়িয়ে লিয়াকত কিছু বলছে। বাকীরা মনোযোগ দিয়ে শুনে যাচ্ছে।

আমি জটলার দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাকে দেখে লিয়াকতের কথা থেমে গেল। লোকগুলোকে আরবিতে কি বললো; ওরা চলে গেল। আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম। এতদিন পর দেখা।

কিন্তু ওর মাঝে কোন উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করা গেলো না।

কিরে কেমন আছিস? তোর সাথে বিদেশে এমন করে দেখা হয়ে যাবে ভাবতেও পারিনি। কেমন আছিস। কি করিস এখন? এখানে কোথায় এসেছিস?

এখানে তো আমি প্রায়ই আসি। আমার ......।

কথার মাঝে হঠাৎ করে থেমে গেলো লিয়াকত।

চল চল, আমার বাসায় চল। ঐ যে দোতালা বিল্ডিংটা, ওটার দোতালায় আমি থাকি। চল...। ওর হাত ধরে টান দেই আমি।



না আজকে না। আরেকদিন আসবো। বাসা তো চিনেই গেলাম। আমার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে সালাম দিয়ে চলে যায় সে।

এর পর এক দিন দুদিন করে কত সপ্তাহ, মাস চলে গেলো।

লিয়াকতের আর পাত্তা নেই। কত জনকে জিজ্ঞেস করলাম। কেউ ওর হদিশ দিতে পারলো না।

একদিন অনেক রাতে ঘুম ভাঙ্গতেই লিয়াকতের কথা মনে পড়ে যায়। ওকে খোঁজার সুত্র ধরে, ফেনীর দু-চারজন মানুষের কাছে একাত্তরে লিয়াকতের ভূমিকার কিছু ভাসা ভাসা তথ্য পেয়েছি।

শেষ দিকে ওর সাথে নাকি ওর বাবার বিরোধ চরমে পৌঁছেছিলো। নানা বলতেন, তোমরা যদি শিব সেনাদের মতো সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার কর, তবে তোমাদের সাথে ওদের নীতিগত পার্থক্য থাকলো কোথায়? তোমাদের পার্টির নাম বদলে শিবসেনা দিলেই পার। শুধু শুধু ইসলামী শব্দ জুড়ে দিয়ে ইসলামের অবমাননা কর কেন?

নিখিলদের পরিবার সহ কিছু পরিবারকে নানা অনেকদিন আশ্রয় দিয়েছিলেন। একাত্তরের মাঝামাঝি তাদের প্রায় সবাইকে তিনি নিরাপদে সীমান্ত পার করে দেন। নানার আশ্রয়ে নিজকে নিরাপদ ভেবে, না অন্য কোন কারণে নিখিল থেকে যায়।

সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে ফেনী কলেজের মাঠের এক কোনে কয়েকটি মৃত দেহ পাওয়া যায়। তাদের একটা ছিলো নিখিলের। কারা ওকে মেরেছিলো, জানা যায়নি। তবে গুজব আছে, লিয়াকত গ্রুপের সদস্যরাই নাকি সে জন্য দায়ী। লিয়াকতের সাথে দেখা হলে ওর চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করতাম, ও কি কিছু জানে?।

সোর্স: http://prothom-aloblog.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.