" সাহিত্যের কাজ হচ্ছে মানুষকে খেলাচ্ছলে শিক্ষা দেওয়া " - প্রমথ চৌধুরী আসলেই, আমি অনেক বদলে গেছি......। মাঝে মাঝে নিজের আগের অবস্থার কথা চিন্তা করে আমার এ কথাই মনে হয়। আশপাশের সবাই, এমনকি আমার মা ও একটু অন্যরকম সুরে কথা বলে।
অনেক দিন পর আমার এক বন্ধুর সাথে দেখা হল আজ। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম, এমন সময় পাশ থেকে চিকন কণ্ঠের ডাক শুনতে পাই।
- অফিসার সাহেব......!
আমি একটু অবাক হলাম। কেননা আমার পরিচিত সবাই আমার দুর্ভাগ্যের কথা জানে*। অবাক ভাবটা চেপে রেখে শব্দের উৎসের দিকে দৃষ্টি দিলাম।
এক মহিলা ( দূর থেকে দেখে আমার এরকমই মনে হয়েছিল ) আর এক আমাদের বয়সী ছেলে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। আবার সেই কণ্ঠ শুনতে পেলাম, “এখন তো আমাগ আর চিনবেনই না......বড় হয়ে গেসেন না ! !”
এবার আমি চিনতে পারলাম।
আমাদের আগের বাসার পাশের বাসায় থাকত মেয়েটি, নাম সোনিয়া। ওর মা আর আমার মার মাঝে বেশ সখ্যতা ছিল। আমার সাথেও যে তার সখ্যতা ছিল না, তা বলব না। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত আমরা একসাথেই বড় হয়েছি। এরপরে স্বাভাবিক কারনেই কমে গেছে সখ্যতা।
এরপরে বাসা বদলের পর ওর সাথে আর ওরকমভাবে দেখাও হত না। মাঝে মাঝে আমারই মনে হত, যাই ওর বাসায় গিয়ে ওদের খবর নিয়ে আসি। কিন্তু আর খবর নেওয়া হত না। এভাবেই যে কোন দিক দিয়ে তার সাথে দূরত্বটা বেড়ে গেছে, তা নিজেও জানিনা। ওর সঙ্গের ছেলেটাকেও চিনলাম, রবিন নাম।
আমাদের সাথেই পড়ত। খুব মেধাবী ছাত্র ছিল সে। নিজের কাছেই একটু লজ্জা লাগছিল এতদিন ওদের খবর না রাখার কারনে।
আমার মনের ভাবগুলো চেপে রেখে বললাম, “না না, তোগ না চিনার কি আছে????? কেমন আছস তোরা????”
রবিন ই উত্তর দিল, “আমাগ ভাল খারাপ দিয়া কার কি আসে যায়...আসি, আল্লায় রাখসে এক রকম...তোর খবর ক...”
- আমিও আল্লার রহমতে ভালই আসি.........অনেকদিন ধইরা এদিকে আসা হয়না তো......তোগ লগে দেখাও হয়না...।
এবার মুখ খুলল সোনিয়া, “বুজসি তো, ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়......কিন্তু তোর তো আমাগ লগে যোগাযোগ রাখার ইচ্ছাটাও নাই.........সবই বুজি রে, এহন তো আমি আর ক্লাস ফাইভে পড়ি না।
“ বলে একটু মুচকি হাসল সে।
অমনি যেন একসাথে অনেক ঘটনা মনে পড়ে গেল আমার। আসলেই তো, ও তো আর এখন সেই ছোট্টটি নেই। অনেক বড় হয়ে গেছে সে......অনেক বড়......।
তারপর অনেক কথা হল আমাদের মাঝে।
আগের অনেক কথাই উঠে এল। আগের বন্ধুদের সবার খবরই নিলাম। সবারই কোন না কোন ভার্সিটিতে হয়ে গেছে। দুর্ভাগ্যক্রমে রবিনেরই শুধু কোনখানে হয়নি। বেচারা খুব অশান্তিতে আছে।
পরের বছর আবার ঢাকা ভার্সিটিতে পরীক্ষা দিবে সে। এখন থেকেই আবার উঠেপড়ে লেগেছে সে।
- বুঝসস নি, পরের বার ও কোথাও না হইলে ঢাকায় গিয়া রিক্সা চালামু। বহুত ইনকাম ওগো। পরে দেখবি সোনিয়া মাড্যাম একদিন আমার রিক্সায় চরতে আইব।
আর আমারে চিন্নাও না চিনার ভান করব......
আমি আর সোনিয়া হাসলাম। ও সবসময়ই এরকম। নিজে হাসবে, সঙ্গে অন্যকেও হাসাবে। ঐ ছোটবেলায় সে যেরকম ছিল, এখনও ঠিক সেরকমই আছে। হঠাৎ আমার মাথায় চিন্তা আসল......আচ্ছা, ওকেও কি ওর বন্ধুরা বলে যে “তুই খুব বদলে গেছিস???”......কি জানি......।
হঠাৎ রবিনের কণ্ঠ কানে এল, “ওই তোরা দুইটা এহানে দাঁড়া, আমি মোবাইল এ টাকা ভইরা আসি......বেশিক্ষণ লাগব না। “
বলে সে উধাও হয়ে গেল কোথায় যেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম আমি আর সোনিয়া। নীরবতা ভাঙল সোনিয়াই।
- তুই অনেক বদলাইসস রে।
- হুম.........মনে হয়......।
- মনে হয় না.........আসলেই তুই অনেক বদলাইসস......।
- বদলানো ছাড়া আর কোন উপায় নাই রে.........আচ্ছা, তোর সাথে এর আগে কবে দেখা হইসিল আমার???
- আর এক বছর আগে মনে হয়।
- এই এক বছরে তুই ও অনেক বদলাইসস......তুই আর আগের সোনিয়া নাই.........আচ্ছা, তোর সাথে তো আগে অনেক কিছুই করতাম, মনে আসে ত্তোর?????
- মন থাকব না কেন??সব মনে আছে......একবার না দুইজন এ একলগে বাসা থেইকা পালাইসিলাম, মনে আসে তোর????
ওই ঘটনা আমি ইচ্ছা করলেও ভুলতে পারব না, জানি। ঐদিন মনে হচ্ছিল আমি যেন আসলেই সোনিয়াকে নিয়ে বাসা থেকে পালাচ্ছি।
স্বীকার করতে বাধা নেই যে, ও ই আমার শৈশব জীবনের প্রথম প্রেম। তারপর যে ওকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছি, সেগুলো লিখতে গেলে হয়ত এ স্বল্প পরিসরে কুলাবে না।
হঠাৎ আমি জিজ্ঞেস করলাম তাকে...
- প্রেম করস এখন??
- না, তবে করুম......এই কয়েকদিনের মাঝেই......।
- তাই নাকি???
- হ.........আমার ইচ্ছা হইল পোলার যাতে আমার চেয়ে কম গুন থাকে.........তাইলেই আমার উপর আর ঝাড়ি মারার চান্স পাইবনা.........।
আমার মনে প্রশ্ন জাগলো, সে কি আমার প্রতি উদ্দেশ্য করে কথাটা বলছে? ভাবনাটা মন থেকে এক ঝটকায় দূর করে দিলাম।
বললাম...
- ভাল ভাল......দেখ তোরে কোন পোলায় পছন্দ করে......দিনে দিনে যেমনে পেত্নী হইতাসস.........হাহাহাহা......। ।
- তরে আমি......
বলে সেই পুরনো দিনের মত কিল দিতে হাত উঠালো সে। কিন্তু কি মনে করে হাত নামিয়ে নিল সে। আমি তার চোখের দিকে তাকালাম একটু।
পড়ার চেষ্টা করলাম তার চোখের ভাষা। একটু পর বললাম......
- আসলেই তুই অনেক বদলাইসস রে.........
- মনে হয়......কিচ্ছু করার নাই।
ততক্ষণে রবিন এসে পড়েছে। “ভালই গল্প জমাইসস তোরা......” বলে সেও যোগ দিল আমাদের সাথে। আর কিছুক্ষণ গল্প করে, ফোন নং দেওয়া-নেওয়া করে বাসায় আসলাম।
ঘুমানোর আগে সোনিয়াকে নিয়ে চিন্তা করছিলাম। ইসস, সে যদি আগের মত থাকত, তবে কতই না ভাল লাগত। মন চাচ্ছিল আবার আগের দিনগুলোতে ফিরে যাই। চিন্তার ঘোর ভাঙল মোবাইল এর মেসেজ টোনে। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি সোনিয়ার নং থেকে মেসেজ এসেছে।
“ওইসময় কিলটা না দিয়া ভুল করসি......এখন তোরে কিলাইতে ইচ্ছা করতাসে......”......
বুঝলাম, শুধু দূরত্ব আমাদের সম্পর্ক ঘুচাতে পারেনি। এক অদ্ভুত প্রশান্তি নিয়ে ঘুমাতে গেলাম আমি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।