আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মন্তব্য প্রতিবেদন : শেয়ারবাজারে তুঘলকি কারবার : প্রথম পর্ব মাহমুদুর রহমান

শেখ হাসিনা তার দুই দফার শাসনামলে সাফল্যের সঙ্গে শেয়ারবাজারের লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে নিঃস্ব করতে পেরেছেন। কিন্তু বিস্ময় ও দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, জনগণের এত বড় ক্ষতিসাধন সত্ত্বেও তার কিংবা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-কর্মকর্তাদের মধ্যে কোনোরকম অনুশোচনাবোধ জাগ্রত হয়েছে এর কোনো চিহ্ন এ পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়নি। উল্টো মূলধন হারিয়ে পথে বসে যাওয়া বিনিয়োগকারীদের দোষারোপ করে সরকারের হর্তাকর্তারা নসিহত করছেন যে, পুঁজিবাজারে লেনদেন ঝুঁকিপূর্ণ এটা জেনেই তাদের ওই বাজারে টাকা খাটাতে হবে। অথচ ২০০৯ সালে এই সরকার ক্ষমতা হাতে নিয়েই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিত এসইসি’র (SEC) তত্কালীন চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার চাঙ্গা করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন ধরনের সমস্যা থাকলেও আবুল মাল আবদুল মুহিত পুঁজিবাজার চাঙ্গা করার বিষয়টিকে এতটা অগ্রাধিকার কেন দিয়েছিলেন? শেয়ারবাজারের চিহ্নিত খেলোয়াড়দের নানারকম কারসাজির মাধ্যমে অর্থমন্ত্রীর ঘোষণার দুই বছরের মধ্যে মূল্যসূচক ও লেনদেন বিপজ্জনক উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া হলে বিনিয়োগকারীদের আশু বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করার পরিবর্তে একই অর্থমন্ত্রী জোর গলায় বলেছেন, ছিয়ানব্বইয়ের পুনরাবৃত্তি কিছুতেই হতে দেয়া হবে না।

ডিজিটাল সরকারের মিথ্যা আশ্বাসে আস্থা স্থাপন করে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা চূড়ান্তভাবে ঠকেছেন। ১৯৯৬ সালে লুটপাটের পরিমাণ দশ হাজার কোটি টাকার পরিবর্তে এবার লক্ষ কোটি টাকারও অধিক লুণ্ঠন করা হয়েছে। আমি জেলে যাওয়ার দিনদুয়েক আগে মূল্যসূচক যখন ৬০০০-এর কাছাকাছি ছিল, তখনই মন্তব্য প্রতিবেদন লিখে জনগণকে সাবধান করার সাধ্যমত চেষ্টা করেছিলাম। টেলিভিশন টক শোতে অংশ নিয়েও অব্যাহতভাবে বলেছি, সূচক ও দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতির আয়তনের তুলনায় বাস্তবসম্মত নয়। আমার লেখা ও কথায় কারও সংবিত্ ফেরেনি।

জেলে থাকতেই খবর পেয়েছি সূচক বাড়তে বাড়তে ৯০০০-এর চূড়া ছুঁয়েছে। দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণী তাদের সব সঞ্চয় নিয়ে মুগ্ধ পতঙ্গের মতো হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে শেয়ারবাজারের আগুনে ঝাঁপ দিয়েছে। কেবল সঞ্চয় ভেঙেই নয়, লোভের ফাঁদে পড়ে অনেকে সম্পত্তি বিক্রি করে এমনকি ধারদেনা করেও শেয়ারে বিনিয়োগের নামে জুয়া খেলায় মত্ত হয়েছে। জনগণের এই বেকুবি দেখে চৌর্যবৃত্তিতে লিপ্ত শ্রেণী তাদের প্রাত্যহিক বিশেষ প্রকৃতির আমোদ-প্রমোদের আসরে দলবল নিয়ে মনের আনন্দে উল্লাস করেছে। অর্থনীতির অবধারিত নিয়মে কৃত্রিম মূল্যসূচকের সেই অতিকায় বেলুন আমি জেলখানায় থাকতেই ফেটেছে।

২০১১ সালের মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে আমার মুক্তির আগেই শাসকশ্রেণীর শেয়ারবাজার থেকে এক লক্ষ কোটি টাকারও অধিক লুণ্ঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। দেশের সাধারণ জনগণের টাকা লুটে নেয়ার প্রক্রিয়ায় সরাসরি জড়িত ছিলেন বর্তমান সরকারের মন্ত্রী, এমপি এবং শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা। তারা কী পরিমাণ সম্পদশালী হয়েছেন, তার কোনো আন্দাজ আমাদের মতো নাগরিকের পক্ষে কল্পনাতে আনাও সম্ভব নয়। সংবাদমাধ্যমে কাজ করার সুবাদে তাদের বিলাসবহুল জীবন-যাপনের নানারকম খবর কানে আসে। এগুলো অবশ্য এখন পর্যন্ত শোনা কথাই, কাজেই কোনো তথ্যপ্রমাণ দিতে পারব না।

ভবিষ্যতে কখনও কাগজপত্র হাতে পেলে আমার দেশ পত্রিকায় অবশ্যই নাম-ধামসহ তাদের কীর্তি-কাহিনী ছাপা হবে। বাংলাদেশের বিত্তশালীদের বিদেশে বাড়ি-ঘর কেনার গল্প অনেক পুরনো হয়ে গেছে। এসব বাড়ি কেনার অর্থ হুন্ডিসহ অন্য যেসব পন্থায় তারা বিদেশে পাচার করেন, সে সম্পর্কেও পত্রপত্রিকায় অতীতে কিছু লেখালেখি হয়েছে। তবে এই সরকারের আমলে নতুন উপসর্গ জুটেছে। শেয়ারবাজার এবং কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ইজ্জতের মাপকাঠি আগের মতো কেবল দেশ-বিদেশে প্রাসাদোপম অট্টালিকার মালিক হওয়াতে নির্ধারণ করা হচ্ছে না।

এখন তারা নাকি কয়েকশ’ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ব্যক্তিগত জেটবিমান কিনছেন। তাদের এই বিমানগুলো এমন দেশে রাখা হয়, যেখানে ঢাকা থেকে তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে বাণিজ্যিক বিমানে চড়ে পৌঁছানো সম্ভব। সেখানে পৌঁছানোর পর ইউরোপ, আমেরিকায় তারা ব্যক্তিগত জেটেই সাধারণত উড়ে বেড়ান। ভারতের ধনকুবের মুকেশ আম্বানি একবার তার স্ত্রীর জন্মদিনে বিশেষভাবে নির্মিত বোয়িং-৭৩৭ বিমান উপহার দিয়ে সেদেশের গণমাধ্যমে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। অথচ মুকেশ আম্বানির সেই ভারতেই পৃথিবীর সর্বাধিক সংখ্যার এমন হতদরিদ্র মানুষ বসবাস করে, যারা সপ্তাহে একদিন ভাত খেতে পেলে বর্তে যায়।

বাকি ছ’দিন বন-জঙ্গল থেকে আহরিত শাক-পাতা খেয়েই এই হতভাগ্য দরিদ্র ভারতীয়রা জীবনধারণ করে থাকে। মহাশ্বেতা দেবী এবং অরুন্ধতী রায় আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারতের এই শোষিত শ্রেণীকে নিয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছেন। একই দেশের নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের এমন ভয়াবহ অসম বণ্টনের অবধারিত প্রতিক্রিয়ায় ভারতের অন্ধ্র থেকে পশ্চিমবাংলা পর্যন্ত বিস্তৃত কথিত ‘রেড করিডোরে’ (Red Corridor) বামধারার সশস্ত্র সংগ্রাম বিস্তার লাভ করেছে। বাংলাদেশের ডিজিটাল সরকারও তাদের তিন বছরের শাসনামলে বেশকিছু এ দেশি আম্বানি সৃষ্টি করে বিশেষ শ্রেণীর রাতারাতি উন্নয়নের ম্যাজিক দেখিয়েছে। প্রকৃত আম্বানিরা তবু ভারতের শিল্পায়ন ও জাতীয় আয়বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে।

আমাদের নকল আম্বানিরা সাধারণ জনগণের টাকা লুটপাট করে নির্লজ্জ ফুটানিতে মত্ত হয়েছে। আমাদের দেশের বামধারার অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সরকারগুলোর পুঁজিবাদী অর্থনীতি অনুসরণকেই এ অবস্থার জন্য প্রধানত দোষারোপ করে থাকেন। কিন্তু জীবনের সুদীর্ঘকাল বেসরকারি খাতে মোটামুটি শীর্ষ পদগুলোতে চাকরি করার অভিজ্ঞতায় আমি মনে করি, এদেশে প্রকৃত পুঁজিবাদের চর্চাও ঠিকমত হচ্ছে না। ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের নামে বাংলাদেশে যেটা হচ্ছে, তাকে দেশ ও জনগণের সম্পদের নির্ভেজাল ডাকাতি ছাড়া অন্য কোনো নামে ডাকার সুযোগ নেই। পুঁজিবাদের নিয়ম-নীতি মেনে চললে দুর্বল জনগোষ্ঠীর শোষণ সত্ত্বেও কিছুটা অন্তত জাতীয় পুঁজি (National Capital) সঞ্চিত হয়।

কিন্তু বিদেশে ব্যক্তিগত জেটবিমান, লন্ডনের হাইড পার্ক সংলগ্ন পার্ক লেন (Park Lane) অথবা ক্যালিফোর্নিয়ার বেভারলি হিলসে (Beverley Hills) লুটেরাদের বাড়ি অর্থনৈতিক তত্ত্ব অনুসারে কোনো হিসাবেই দেশের সম্পদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে না। বিদেশে সম্পত্তি ক্রয় এবং পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের বাহামা, কেইম্যান আইল্যান্ড (Cayman Island) ইত্যাদি রাষ্ট্রে দুর্নীতিলব্ধ বিপুল অর্থ সঞ্চয় করার জন্য বাংলাদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মার্কিন ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির চিত্রও জনগণ এতদিনে দেখে ফেলেছেন। মাত্র এক বছরের মধ্যে ডলারের ১৫ টাকা মূল্যবৃদ্ধি অধিক মাত্রায় অর্থ পাচারেরই (Money Laundering) অশুভ পরিণতি। অবৈধ সঞ্চয় লুকিয়ে রাখার জন্য একসময় সুইজারল্যান্ড নিরাপদ দেশ হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করলেও এখন পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশগুলো আন্তর্জাতিক মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত আলোচনায় মিডিয়ায় বেশি করে আসতে শুরু করেছে। লোকমুখে শুনি, চৌকস বাংলাদেশী লুটেরারা নাকি সেসব স্বল্প পরিচিত দেশের সন্ধানও পেয়ে গেছেন।

শেয়ারবাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বিপুল অংকের টাকাও বাংলাদেশের অধিকাংশ নাগরিকের কাছে অপরিচিত এসব বিভিন্ন গন্তব্যে বর্তমান শাসক শ্রেণীর জ্ঞাতসারেই পৌঁছে যাওয়া বিচিত্র নয়। দিনবদলের সরকারের সম্ভবত এই মেয়াদের মতো শেয়ারবাজার লুণ্ঠন সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হওয়ার পর গত প্রায় ছয় মাস ধরে দেশবাসী বাজার স্থিতিশীল করার নামে নানারকম নাটক দেখে চলেছে। সেসব বিষয় নিয়ে আগে একাধিক মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছি। সেই লেখাগুলো থেকে কোনোরকম পুনরাবৃত্তি না করে এবারের দুই পর্বের মন্তব্য প্রতিবেদনে কেবল তিনটি প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করব। বহুল আলোচিত কালোটাকা দিয়েই শুরু করছি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তারই আন্দোলনের ফসল মইন-ফখরুদ্দীনের সরকার কর্তৃক দুর্নীতির অভিযোগে ডজনেরও অধিক মামলা দায়ের হলেও এবং দেশের অধিকাংশ জনগণ সততার বিষয়ে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করলেও বক্তব্য-বিবৃতিতে তিনি সর্বদা নিজেকে, তার পরিবার ও দলকে ধোয়া তুলসিপাতা রূপেই প্রচার করে থাকেন। বিএনপি নেতৃবৃন্দকে অবশ্য তিনি সরাসরি চোর ছাড়া অন্য কোনো নামে অভিহিত করেন না। ২০০৮-এর নির্বাচনের আগে ‘দিনবদলের সনদ’ নামে যে নির্বাচনী ইশতেহারটি আওয়ামী লীগ মহা সাড়ম্বরে জনগণের সামনে উপস্থাপন করেছিল, সেখানেও দুদককে প্রকৃত স্বাধীনতা প্রদান ছাড়াও দুর্নীতি দমনের বিষয়ে অনেক গালভরা প্রতিশ্রুতি ছিল। শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগ করলে কোনো সংস্থা থেকে কোনো প্রশ্ন করা হবে না—স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এমন ঘোষণা দিয়ে দুর্নীতিকে প্রকারান্তরে উত্সাহিত করেছেন। বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগ সব সরকারের আমলেই বৈধতা পেয়েছে।

কিন্তু এ সংক্রান্ত ঘোষণা এতদিন সচরাচর এনবিআর থেকেই দেয়া হতো। এবার প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এমন কথা বলায় স্বাভাবিকভাবেই সমাজের সকল স্তরে বেশ খানিকটা সমালোচনারও সৃষ্টি হয়। এরই প্রেক্ষিতে শুরু হয় ডিজিটাল সরকারের তুঘলকি আচরণ। বিশেষত গত সপ্তাহে মাত্র ৯ ঘণ্টার মধ্যে তিনবার শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সংক্রান্ত নীতিমালা পরিবর্তন নীতিনির্ধারকদের অপ্রকৃতস্থতার প্রমাণ দেয়। ১৬ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার সাপ্তাহিক বৈঠকে ১৯৭৯ সালের একটি নীতিমালার প্রসঙ্গ টেনে সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

এই নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় ১৭ তারিখ পড়ন্ত বাজার দ্রুততর গতিতে ডুবতে শুরু করলে বিনিয়োগকারীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে থাকেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার ভয়ে সরকার সেদিনের মতো ঢাকা ও চট্টগ্রাম শেয়ারবাজারে লেনদেন বন্ধ করে দেয়। ১৮ তারিখ বেলা ১১টায় সংবাদ সম্মেলনে এসইসি চেয়ারম্যান দাবি করেন যে, পূর্বসন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর স্বয়ং প্রেস সচিবের ব্রিফিংয়ে ঘোষিত নিষেধাজ্ঞার খবর সঠিক নয়। মন্ত্রিসভা ওই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলেও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নাকি গ্রহণ করেনি। এসইসি চেয়ারম্যানের এই আশ্বাসবাণীতে কোনো কাজ হয়নি, সারাদিনে সূচকের ১৬৭ পয়েন্ট পতন ঘটে।

বিক্ষোভকারীরা ডিএসই’র সামনের রাস্তায় অবরোধ সৃষ্টি করে আগুন ধরিয়ে দেয়। এদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত প্রতিপালনকল্পে পরিপত্র জারি করে জানিয়ে দেয় যে, সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শেয়ারবাজারে লেনদেন করতে পারবেন না। সচিবালয় থেকে আকস্মিক পরিপত্র জারিতে মতিঝিলে বিক্ষোভের অগ্নিতে ঘৃতাহুতি পড়ে। অবস্থা বেগতিক দেখে দুপুরে জারি করা পরিপত্র সন্ধ্যায় প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। উন্মাদেরও বোধহয় অসুস্থতার একটা লেভেল থাকে।

১৮ তারিখে সারাদিন ধরে সরকারের যেসব নীতিনির্ধারক এই প্রকৃতির বিকৃত মস্তিষ্ক আচরণ করেছেন, তাদের জনস্বার্থে অনতিবিলম্বে পাবনার মানসিক হাসপাতালে ভয়ানক উন্মাদদের সঙ্গে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে আটক রাখা আবশ্যক। নইলে দেশের আরও ব্যাপক সর্বনাশ ঠেকানো যাবে না। পরিপত্র নাটক অন্তে সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে বিস্ময়করভাবে মূল্যসূচক একদিনে ২৫০ পয়েন্ট বৃদ্ধি পায়। কেবল সরকারি কর্মকর্তাদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ পূর্ববত্ আইনসিদ্ধ রাখাতেই যদি এই বৃদ্ধি হয়ে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে আমাদের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা এখনও সাবালকত্ব অর্জন করতে পারেননি। ২০১০ সালের ডিসেম্বরের সর্বোচ্চ প্রায় ৯০০০ সূচকের বর্তমানে অর্ধেকে নেমে আসার সময়কালে এসব সরকারি কর্মকর্তা পুঁজিবাজারে তাদের টাকা পূর্ববত্ কোনো বাধা-বিঘ্ন ছাড়াই খাটিয়েছেন।

কিন্তু তা সত্ত্বেও সূচকের ধস থামানো যায়নি। বাস্তবতা হলো, সূচকের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং শেয়ারের অবিশ্বাস্য দরপতন উভয় ক্ষেত্রেই বাজার কারসাজি (Market manipulation) ক্রিয়াশীল থেকেছে। এই কারসাজির মাধ্যমেই চিহ্নিত লুটেরারা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের নিঃস্ব করতে সক্ষম হয়েছে। সুতরাং গত বৃহস্পতিবার একদিনে বাজারমূল্যের গড়ে ৫ শতাংশ বৃদ্ধির মধ্যে আমি অন্তত অর্থনৈতিক কার্যকারণের পরিবর্তে আবারও কারসাজির গন্ধ পাচ্ছি। এরপরও সংবিত্ না ফিরলে বিনিয়োগকারীদের কপালে আরও দুঃখ বাকি আছে।

আমার সন্দেহ সঠিক প্রমাণিত হতে তিনদিনের বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। বর্তমান সপ্তাহের প্রথম দু’দিনেই সূচক ৩০০ পয়েন্টেরও অধিক নেমে গেছে। সর্বশেষ বাজার কারসাজির প্রতিবাদে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ঐক্যপরিষদ মঙ্গলবার মতিঝিল এলাকায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকলে সরকার গণহারে নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার শুরু করে। রিমান্ডে পিটুনির ভয়ে বিনিয়োগকারীরা শেষপর্যন্ত হরতাল প্রত্যাহার করে নেয়। আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত দেখা যাক শেয়ারবাজার নিয়ে কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়।

আমি দীর্ঘদিন ধরেই আশঙ্কা করছি যে, শেষপর্যন্ত সূচক চার হাজারেরও নিচে নেমে আসবে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে আমার আশঙ্কা সত্যে পরিণত না হলেই আমি আনন্দিত হবো। এদিকে কালোটাকার সংজ্ঞা নিয়েও এনবিআর বিপুল সংশয় তৈরি করে বসে আছে। তাদের সর্বশেষ প্রজ্ঞাপনে শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগ বৈধ করা হলেও সেখানে নিম্নোক্ত দুটি ডেমোক্লিসের তরবারি বিনিয়োগকারীদের মাথার ওপর ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে : ১. ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা হলে রাজস্ব বোর্ড টাকার উত্স নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করবে না—বলার সঙ্গে যোগ করা হয়েছে যে, অন্য কোনো সংস্থা থেকে সেই টাকার খোঁজ-খবর নেয়ার নামে হয়রানি করা হলে তার দায়িত্ব এনবিআর নেবে না। অর্থাত্ আওয়ামী লীগের লোকজন অবৈধ অর্থ শেয়ারবাজারে খাটালে অন্য সংস্থা যেমন—দুদক, এনএসআই, ডিজিএফআই অন্তত এই সরকারের শাসনামলে চোখ বন্ধ করেই রাখবে।

কিন্তু ভিন্নমতাবলম্বীরা একই কর্ম করিলে তাহাদের খবর আছে। নখদন্তহীন দুদক সেক্ষেত্রে হিংস্র মানুষখেকো ব্যাঘ্রে পরিণত হবে। আইনের শাসনের কী চমত্কার নমুনা! ২. উপরোক্ত শর্তে কালোটাকা বিনিয়োগ করা যাবে; কিন্তু এই টাকা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে অর্জিত হলে এনবিআর তাদের ছাড় দেবে না। সাদা চোখে দেখলে আইনটি ভালো। সত্যিই তো, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি থেকে অর্জিত টাকাকে বৈধ করার সুযোগ কেন দেয়া হবে? কিন্তু সমস্যা হলো, টাকার গায়ে তো আর উত্স লেখা থাকবে না।

সুতরাং, বাংলাদেশের বাস্তবতায় এখানেও আইনের প্রয়োগ লোক বুঝেই করা হবে। কালোটাকার মালিক কালো কোটধারী মুজিববাদী হলে কোনোই সমস্যা নেই, গায়ে বিএনপি কিংবা জামায়াতের গন্ধ থাকলে এনবিআর ও দুদকের ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগটি সুকৌশলে রেখে দেয়া হলো। একেই বলে আওয়ামী লীগের বুদ্ধি। অধিকাংশ পাঠকই জানেন, আমি চারদলীয় জোট সরকারের আমলে পাঁচ বছর রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে ছিলাম। তত্কালীন সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে আমি প্রায়ই বলতাম, প্রশাসনে দুর্নীতি কমাতে হলে মন্ত্রী, সচিবদের স্বেচ্ছানুসারে সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষমতা (discretionary power) হ্রাস করা আবশ্যক।

আর এই লক্ষ্য সাধন করতে হলে যথাসম্ভব স্বচ্ছতার সঙ্গে বিধি ও আইন প্রণয়ন করতে হবে। আইনের ভাষার মারপ্যাঁচ কমানো গেলেই রাজনীতিক ও আমলাতন্ত্রের যোগসাজশের (nexus) মাধ্যমে জনগণের অর্থ লুটপাটের সুযোগ সংকুচিত করা সম্ভব। সরকারি দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতার আলোকে সুশাসন বিষয়ক এই দর্শনের প্রতি আমার আগের আস্থা আরও দৃঢ় হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্তমান সরকার সার্বিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনাই করছে মূলত discretionary power-এর ওপর ভর করে। বিনা টেন্ডারে কার্যাদেশ দেয়ার বিধান করে বিদ্যুত্, জ্বালানি ও অন্যান্য খাতে অগাধ লুটপাটের যে মহোত্সব ক্ষমতাসীনরা চালাচ্ছেন, তার পেছনেও রয়েছে ওই discretionary power।

শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগ সংক্রান্ত যে নতুন বিধিমালাটি রাজস্ব বোর্ড প্রণয়ন করেছে, তারও ছত্রে ছত্রে discretionary power প্রয়োগের সুযোগ রেখে দেয়া হয়েছে। যেসব রথী-মহারথী আগে সুশাসন নিয়ে প্রায় প্রতিদিন সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করে বেড়াতেন, তাদের অধিকাংশই চিন্তা-চেতনায় কট্টর মুজিববাদী হওয়ায় হাওয়া বুঝে প্রকাশ্য দুর্নীতি দেখেও মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদেরও বাংলাদেশ সংক্রান্ত নীতির দৃশ্যমান পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলাদেশের বায়বীয় ইসলামী সন্ত্রাস দমনের বিনিময়ে দুর্নীতিপরায়ণ সেক্যুলার শাসকশ্রেণীকে সুশাসনের বিষয়ে ছাড় দিতে তাদের এখন তেমন একটা আপত্তি নেই। পশ্চিমাদের সর্বত্র ইসলামী নবজাগরণের ভীতিটিকে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজে লাগিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ থেকে সুশাসনকে নির্বাসনে পাঠিয়েছেন।

অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানকেও ‘ধর্মান্ধ’ বিশেষণে ভূষিত করা হচ্ছে। যেন সেনাবাহিনীর সেক্যুলার অংশ অভ্যুত্থান করলে কোনো সমস্যা নেই। ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করা বাংলাদেশের কোনো দলের পক্ষেই সম্ভব নয়। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারের যে সাম্প্রতিক সমস্যা চলছে, আমার ব্যক্তিগত ধারণা, তার পেছনে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি নিয়ে উদ্বেগের চাইতেও বেশি কাজ করেছে ড. ইউনূস ইস্যু। ব্যক্তিগত জিদ মেটাতে গিয়ে শেখ হাসিনা এক্ষেত্রে পশ্চিমাদের খানিকটা সাময়িক বিরাগের কারণ হয়েছেন।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.