সারাটা দিন আজ আকাশ ছিলো মেঘলা। থমথমে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে হঠাৎ হঠাৎ এক চিলতে রোদ্দুরের দেখা যে মেলেনি তাও নয়। তবু সকাল গড়িয়ে বিকেল পর্যন্ত সময়টা যেনো শুধু বৃষ্টি আসবো আসবো করেই কেটে গেলো। এখন এই পড়ন্ত বেলায় চারিদিকে এসে জমা হয়েছে কেমন যেনো একটা অস্থিরতার ভাব।
বাতাসের ঘূর্ণি, শুকনো ঝরাপাতার মাতলামি আর পায়রাগুলোর অস্থির ডানা ঝাপটানি স্পষ্ট বলে দিচ্ছে একটা কিছু। ঝড়... ঝড় ধেয়ে আসছে এবার।
ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে একপাল গরু-বাছুর রওনা হয়েছিলো পশ্চিমের মাঠে- হাম্বা হাম্বা রব তোলে। একই পথ ধরে বিকেল বেলা তারা এখন ঘরে ফিরে আসছে দৌদ্দাড় ধুলো-মাটি উড়িয়ে। তাল মিলিয়ে ছুটছে রাখালেরাও ।
দলছুট বাছুরগুলোকে তটস্থ করে রাখছে হাঁকডাকে। আর নিজেরা চঞ্চল হয়ে আছে কত তাড়াতাড়ি কাজ সেরে পেটে দানাপানি ভরার আগে নাইতে যাবে।
বাড়ীর পেছনে মজা পুকুর পাড়ে পাতি হাঁসের দল হৈ চৈ করে যাচ্ছে এক সুরে। এইমাত্র একরাশ কচুরিপানার দঙ্গল ঠেলে ওরা উঠে এসেছে পানি ছেড়ে। এখন সগর্বে পালকের ঘুম ভাঙাতে ব্যস্ত।
কিছু দুরে সবুজ বেতের ঝোপ আর কচি বাঁশঝাড়। তারই ফাঁক গলে দেখা যায় মাঠে কামলারা হাতের কাজ শেষ করছে দ্রুত তালে। আধপোড়া বিড়ি আর দেশলাইয়ের বাক্সটা গামছার খুঁটে গুঁজে রেখে তাড়াতাড়ি হাত চালাচ্ছে। আকাশে এক নজর তাকিয়ে কেউ কেউ সঙ্গীদের তাড়াও দিচ্ছে গলা হাঁকিয়ে । মেঘ ভাঙিয়ে বৃষ্টি এবেলা বোধহয় নেমেই আসবে।
সোনালী রোদ, শুকনো মাটি আর ঝরা পাতার ঘ্রাণ মেশানো মাতাল হাওয়ার বৃষ্টি। আয় বৃষ্টি আয়।
আজ থেকে প্রায় ঊনিশ বছর আগের বৈশাখের ঐ বিকেলটিতে উঠোনের দাওয়ায় বসে ছিলো একটি সদ্য কিশোর ছেলে। খানিকটা অসুস্থ বলে মা আটকে রেখেছিলো, ছুটে চলে যেতে দেয়নি আম কুড়োতে। কিংবা পুকুর ধারে- বৃষ্টিরা কি করে জলে নেমে আসে দেখবে বলে।
ছেলেটির তাই মন খারাপ। তবু বসে বসেই সে যেনো শুষে নিলো চারিদিক। এঁকে নিলো ঝড়োদিনের সেই স্মৃতি। মিশে গেলো চিরতরে, তার অস্থিত্বে। আজও, এই পরবাসে, হঠাৎ কোনোদিন দমকা হাওয়ার ঝড় উঠলে ছেলেটি থমকে তাকায়।
অস্থির দৃষ্টিতে খোঁজে ফেরে একঝাঁক পাতিহাঁস-বাঁশবন-একফালি জাফরানী আকাশ। কি যে ভুল হয়ে যায় তখন! চারিধারে সারিবাঁধা ঘরদোর, বিবর্ণ পথঘাট আর যান্ত্রিকতার জঙ্গল এক অবশ অনুভূতি ছড়িয়ে দেয় তার স্মৃতিমূলে। ভুতুড়ে হাওয়ার শিষধ্বনি ছাপিয়ে ছেলেটি অস্ফুটস্বরে শুধু বলে উঠে 'হায়রে'!
শুধু গ্রামের কথাই কেন, শহুরে ঝড়-বৃষ্টির স্মৃতি তো ছেলেটির আরো স্পষ্ট মনে পড়ে। একা ফিরছিলো একদিন স্কুল শেষ করে। পরিচিত অলি-গলি পার হয়ে বড় সড়কটার পাশ ধরে।
কাঁধে ব্যাগ, সাদা শার্ট, নীল প্যান্ট আর বুকে আঁটা স্কুল ব্যাজ। হঠাৎ আকাশ আঁধার করে ঝেপে আসে হিমহিম কালবোশেখীর বারতা। উত্তুরে হওয়ায় ছেলেটির হ্যাংলা শরীর কেঁপে উঠে । ফুটপাতের বেয়াড়া ধুলোবালি ছিটকে এসে লাগতে থাকে চোখেমুখে। চারিদিকে ততক্ষনে পড়ে যায় দৌড়ঝাপ।
হকারেরা উদভ্রান্তের মতো ঝটপট গুটিয়ে নেয় যার যার পসরা। কেউবা টানা দিয়ে বাঁধে বোঁচকা। সড়কের উপরে টাঙানো নানা সাজের ব্যানারগুলোও যেনো আচমকা প্রাণ ফিরে পায় । পতপত করে উড়তে থাকে আর থেকে থেকে প্রবল ঝাপটা মারে শুণ্যে।
একটা উড়ন্ত পলিথিন ব্যাগের পেছন পেছন ধাওয়া করে একদল টোকাই।
হল্লা করে অকারণেই। তাড়াহুড়ায় চলতে থাকা রিক্সাগুলো পড়ে যায় বাতাসের দমকা ঠেলায়। পেশী ফুলিয়ে চালকেরা প্যাডেল মারে সর্বশক্তিতে। আগায়না তবু একহাত। যাত্রীরা তাড়া দেয় ‘জলদি চলো’।
কেউবা বলে ‘পলিথিনটা দাও’। সাদা, কারোটা বা নীল। ওরাও উড়ছে প্রবল বেগে, যেনো ছেড়ে যেতে চায় এই আধোযান্ত্রিক শকটের গহ্বর।
এরই মাঝে ছেলেটি হেঁটে চলে। একা, আনন্দে।
পায়ের তালে তার কৈশোরের উচ্ছলতা, দৃষ্টিতে অকৃত্রিম ভালোলাগা। ভিজছে হাত-পা-মুখ-চুল-চশমা। পথচারী অন্যরা সবাই খোঁজে নিয়েছে সুবিধামতো আশ্রয়- গাছের নীচে, দোকানের বারান্দায় কিংবা ভেতরে। ছেলেটি ভিজতেই থাকে। সবাই তাকিয়ে দেখে।
হয়তো দস্যি ভাবে। বয়ষ্ক কেউ একজন হেঁকে বলে, 'এই ছেলে, এদিকে উঠে আসো। ভিজছো কেন? ঠান্ডায় বসে যাবে যে'।
সর্দি-জ্বরে ভুগেছে বেশ অনেকদিন। মা বকেছে।
তারপর ভেজা চুলে হাত বুলিয়ে বলেছে 'বাঁদর ছেলে'। অসুখ তার সেরে গেছে সেই কবে! সুখ সারেনি আজও।
তারপর ঊনিশটা বছর ফুরিয়েছে। ছেলেটি এখন আর বৃষ্টিতে ভিজে না। সর্দি-জ্বরও হয়না।
হাইওয়ে ধরে দূরন্ত গতিতে ড্রাইভ করতে করতে হঠাৎ কোনোদিন ঝড় আসলে বিরক্ত হয়। দাঁতে দাঁত ঘসে। অবহেলে ডানহাতে চেপে দেয় উইন্ডস্ক্রীন উয়াইপার।
তবু একেকটা দিন পালানো স্মৃতিরা ফিরে আসে। ছুটির কোনো দুপুরে জানালার শার্সিতে বৃষ্টি এসে টোকা দিলে ছেলেটি চমকে উঠে বসে।
পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকালে চোখে পড়ে মন মরা শীতের দুপুর। ক্লান্ত, অবসন্ন। সুদুর অতলান্তিক থেকে উড়ে আসা কনকনে হাওয়া দোলিয়ে যায় বোগেনভিলিয়ার ঝাড়। পেছনের ন্যাবা জঙ্গল থেকে নেমে আসে কাঠবিড়ালী। আবার ছুটে পালায় অকারনেই।
দূরে টিমটিমে ট্রাফিক লাইটের চূড়োয় ঝিমোতে থাকে একটি নিঃসংগ ম্যাগপাই। গ্যারেজের ছাদে বৃষ্টি ঝরে ফিসফিস, শব্দহীন । ঘাস, কাঠ আর নুড়ি বিছানো বাগানে খেলা করে বিশাল অশরীরি শূণ্যতা।
চার বছরের এক বাচ্চা ছেলে ঝাপিয়ে পড়ে পেছন থেকে। গলা জড়িয়ে আদুরে গলায় শুধায় 'হোয়াট আর য়ু্ ডুয়িং বাবা, আই মিন, কি করো?'
'বৃষ্টি দেখছি সোনামণি'
বাচ্চা ছেলেটা হাসে।
মন ভুলিয়ে । ‘'তুমি একটা পাগল, বাবা। '
এবার হাসে বড় ছেলেটাও । আত্মজকে দুহাতে জড়িয়ে গালে গাল ঘসে বলে 'মে বি'।
'বাবা, টেল মি আ স্টোরি অ্যবাউট রেইন'।
চোখ যেনো ছলকে উঠে বাবাটির। ছেলেকে কোলে তোলে নিয়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। শার্সি খুলে হাত রাখে বাইরে। নিঃশ্বাসে খোঁজে নেয় ঘ্রাণ।
'জানো সোনামণি, আমাদের শহরে একদিন সব বৃষ্টিরা এসেছিলো।
অনেক আনন্দ নিয়ে। তোমার মতো। '
বাচ্চাটা আবার হাসে। গুটিশুটি জড়িয়ে থাকে বাবার কোলে।
'ওরা বলে গেছে আবার আসবে।
তোমাকেও নিয়ে যেতে হবে। আবার সাজাবে রঙ-তুলি। তোমার ছেলেবেলার'। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।