অশরীরির আর্তনাদ - (প্রথম অধ্যায় )
তখন ব্যাচেলার লাইফ। চার পাঁচটা টিউশুনি করে-ফুটবল ক্রিকেট,ক্যারাম,তাস-দাবা খেলেই কেটে যাচ্ছে বেশ দিন গুলি। মাঝে মাঝে এই দিদির বাড়ি, না হয় মামার বাড়ি আর এখান ওখান এই ছিল আমার বেকার জীবনের রুটিন। তবুও থামাইনি চালিয়ে যাচ্ছিলাম আমার সেই পুরানো চর্চা। লিখে রেখেছিলাম এ ঘটনা আমার ডাইরীতে।
এও এক সত্য ঘটনা। রাতটা ছিল ২৪শে ভাদ্র, ১৩৯৮। বিছানায় শুয়ে আছি, প্রচন্ড গরম। সিলিঙ্এ বন বন করে ঘুরছে পাখা - তাতেও
শরীর ঠান্ডা হয় না। শেষ ভাদ্রে জানিয়ে যাচ্ছে গরম কাকে বলে।
বিছানাও তেতে গরম হয়ে উঠেছে। ঘুম আর আসে না। অগত্যা ছাদে পায়চারি বা চুপ করে বসে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে ছাদে এলাম। উফ কি ভীষন কালো ঘুটঘুট্টি জমাট বাঁধা অন্ধকার। মনে হয় কৃষ্ণপক্ষের কোন এক রাত।
আকাশের মিটিমিটি তারাও যেন ক্লান্ত। ভ্যাপসা গরমে বাইরেও টেকা যায় না এমন অবস্থা। গভীর রাতে নিকষ কালো অন্ধকারে কিছুই বোঝা যায় না। বাড়ির চারপাশে গাছপালা আর অন্যের বাড়িঘর গুলিকে যেন বড়ো বড়ো দৈত্যের মত মনে হচ্ছে , যেন কুঁজো হয়েথাবা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। আমার হাতে আছে টর্চ লাইট ও সিগারেট প্যাকেট ও দেশলাই।
এমনিই যখন ঘুম আসে না ছাদে এসে পায়চারি করি আর সিগারেট খাই। ভোররাতে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় গেলেই ঘুমে কাদা। যদিও খুব গরম-তবুও এই কালো ঘুটঘুট্টি রাতটা ভালোই লাগছিল। চোখের দৃষ্টিও চলে না এমন অন্ধকার। বেশ রহস্য রহস্য মনে হচ্ছিল।
মনে হচ্ছিল এ রাতের বোধহয় শেষ নেই। সকাল আর হবে না। টর্চ জ্বালিয়ে দেখতে ইচ্ছা করছিল এদিক ওদিক, ভাবলাম না এ অন্ধকার কে ভাঙ্গার কোন দরকার নেই। যেমন আছে তেমন থাকুক। হাতের আড়ালে শুধু
দেশলাই জ্বালিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম।
সুখের একটা টান দিতেই মনে পড়ল ছোটবেলার কথা। এই অন্ধকারকেকতই না ভয় পেতাম। সন্ধ্যে হলে আর ঘরের মধ্যে এখান থেকে ওখানে যেতাম না। খাটে পা ঝুলিয়ে বসতাম না। এমনি আরও কত কি।
সত্যিই কি বিচিত্র মনুষ্য জীবন। সারাদিন কত লোকজনের আনা-গোনা, হৈ-হল্লা, কাজে কর্মেব্যস্ত আর রাত হলেই কে কোথায় চলে যায় যে যার আশ্রয়ে। নিঃস্তব্ধ হয়ে যায় চারিদিক। তখন কোথায় থাকে কাজকর্ম, কোথায় থাকে চিল্লা-চিল্লি, রাগ-অভিমান। শুধু ই কি মানূষ ? নিশাচর বাদে সমস্ত জীবজগত।
বড়োই বিচিত্র। ভাবছিলাম আমার মতো এ রাতে আর কেউ জেগে আছে কি না ? যদি থাকে সেও কি আমার মতই ভাবছে। কি জানি। এসব ভাবতে ভাবতেই হটাত কানে এল এক কান্নার আওয়াজ। বেশ মনে হোল কোন নারীকন্ঠের।
এত যমকালো আঁধারে কোথায় কে কাঁদছে বোঝাই যায় না। কিন্তু কাঁদছে কোন এক নারী এটা সত্য। কেনই বা কাঁদছে কি করেই বাবোঝা যায় এত দূর থেকে। কিন্তু গলাটা যেন চেনা চেনা লাগছে ! বুকের মাঝে ধরাস ধরাস করে কে যেন হাতুরী পেটাচ্ছে। কার কি বিপদ হলো এই মাঝরাতে- কেউ কোথাও জেগে নেই।
কেই বা যাবে বিপদত্তারিণী হয়ে ? এসব ভেবে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাবার জোগাড়। কি করা যায় কিছু ভেবেই উঠতে পারছি না। ঘরে কাউকে না জানিয়ে নীচে
নেমে গিয়ে দেখবো তাও কেমন লাগছে। মেয়েমানুষের ব্যাপার। শেষে কি না নিজেই বিপদে পড়বো।
তাতেও ভয় লাগছে। আবার কাঊকে ডাকবো তাতেও খুব সংকোচ হচ্ছে - আহা সব সারাদিনের কর্মক্লান্তির পর ঘুমাচ্চে তাদের ঘুম ভাঙ্গাবো?কান্নার আওয়াজ বেশ কানে এসে আমার অস্বস্তিও বাড়িয়ে তুলছিল। আরোও বাড়িয়ে তুলল গলাটা চেনা চেনা হয়ে। টর্চ জ্বালারও সাহস পাচ্ছিনা। কিজানি আর কেউ তার আশেপাশে আছে কি না।
সেখানেও এক মান-সম্মানের ব্যাপার। তবু কান্নটা ছিল বড়ো বেদনার ধ্বনি। গভীর বেদনার- ভিতর থেকে উভরে উভরে আসছে সে কান্না। সহসা কোন বিপদের কান্না বা যন্ত্রনার কান্না নয়। যেন হারিয়ে যাওয়া উথলে উঠা বেদনার কান্না।
কি করব ভেবেই পাচ্ছি না। মাথা ঠিক রেখে কান খাড়া করলাম কান্নার উৎস সন্ধানে। দীর্ঘক্ষণ অন্ধকারে থেকে থেকে বেশ কিছু দুরেও নজরে আসছে। আমাদের বাড়ির ডানদিকে দানুকাকার বাড়ি, বাঁদিকে শিবুদাদের বাড়ি পিছনে ছোট্ট একটা পুকুর। সামনে কিছুটা খোলাজায়গা তার পর লিলিদের বাড়ি।
এগুলিই আমাদের স্বজাতিও আত্মীয়দের। এর পর আরোও কত জনেদের কত বাড়ি। ভাবছি দানুকাকার বাড়িতে কাঁদার মতো কে আছে- কাকি,রুবিদি,মুনি না ওদের গলা নয়। শিবুদার মা নেই মানে মেয়ের বাড়ি গেছেন, বৌদি আর বুড়ো- না ওদের কারোর গলা নয়। বুড়ো তো সাত বছরের ছেলে।
ও হতেই পারে না। বাকি থাকে কাছাকাছির মধ্যে লিলিদের বাড়ি। লিলি আমার নিজের কাকাতো বোন, ওর গলা নয়। ওর খুবই ক্যাঁটকেটে গলা, কাকিমারও গলা নয়, আর ছোটকাকা ও ছোট্টু তো ছেলে ওরা হতেই পারে না। কিন্তু খুবই চেনা চেনা লাগছিল সে কান্না।
আমি আর থাকতে না পেরে ছাদ থেকে নেমে এলাম। একটা হাফহাতা শার্ট গায়ে দিয়ে হাতে একটা লাঠি ও টর্চ নিয়ে বেড়িয়ে গেলাম কাউকে কিছু না জানিয়ে। তখন আমার ছিল প্রচন্ড সাহস, সেই পিচ্চিকালের মতো ভিতু ছিলাম না আর। এরকম আমার অনেক রাত গেছে একা বেড়িয়ে গেছি ঘর থেকে বিভিন্ন রহস্য সন্ধানে। কোথাও সফল কোথায় অ-সফল।
তবুও কিছু রহস্য থেকে
গেছে জমাট বাঁধা অন্ধকারেই। বুঝে উঠতে পারিনি- কেউই তার ব্যাখা দিতে পারে নি। আছে শুধু আমার ডাইরির পাতায় লিপিবদ্ধ। তবুও অপেক্ষায় আছি যদি জীবনে কোনকালে কোনদিন পাই তার কিনারা। সে যাইহোক খিরকির দরজার চাবি খুলে বেড়োতেই কান্নার আওয়াজ আরও স্পষ্ট হলো- যে কোনদিক থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে।
বুঝলাম শিবুদার বাড়ির দিক থেকেই। কিন্তু শিবুদার বাড়িতে ওর মা নেই,বৌদিকেও কোনকালে কাঁদতে দেখিনি আর ও কাঁদলে শিবুদাও তো জাগবে-বুড়োও জাগবে। ঘরে আলোও জ্বলবে। আবার শিবুদার রাতে কোনকিছু হলে
আগে আমাকেই তলব করে। সে সবও নেই।
কিন্তু কাঁদে কে? এই ভেবেই আরও এগিয়ে যাই , শিবুদার বাড়ির খিরকির কাছে গিয়ে দেখি কোথাও কিছু নেই। না ওরা জেগে আছে না কেউ কাঁদছে। বার-দুয়েক শিবুদা - শিবুদা করে ডেকেও
কোন সাড়া পেলাম না। হতাশ হয়ে গেলাম। কান্নাও আর শুনতে পাইনা।
এ-কি মায়া জাল কে জানে। এদিক ওদিক টর্চ জ্বেলে দেখলাম কেউ নেই কোথথাও। ফিরে আসার উপক্রম করছি- হাতের লাঠি টা বেশ জোড়ে দেওয়ালে ঠকাস ঠকাস শব্দ করে দিয়ে বাড়ির পথে এগোচ্ছি - আবার শুনি কান্নার শব্দ। এবারে মনে হলো লিলিদের বাড়ির দিক থেকে। আবার আমাদের বাড়ির সামনে খোলা জায়গা দিয়ে এগিয়ে যাই লিলিদের বাড়ি।
এবার নিশ্চিত লিলিদের বাড়ির পাশে থেকেই কে
কাঁদছে। কাউকে না ডেকে ভালো করে শুনি- হ্যাঁ এতো খুবই চেনা। আমার তো এ গলা বহুদিনের চেনা- জানা- এ গলার ডাক শুনেছি, এ গলা থেকেই কত ছড়া-গান শুনেছি। শুনেছি কত রাজা-রাণী, রাক্ষসদের গল্প - শুনেছি কত বকা-ঝকা, আবার শুনেছি কত ভালোবাসা মাখা পরম-আদরে কত স্নেহে কত মায়ায় আমার ই ডাক নাম। আজ এত দিন পর এ গলা শুনে সেদিন সেই মুহুর্তে আমারই গলা শুকিয়ে গিয়েছিল - তবুও কেমন জানি হয়ে গিয়েছিলাম তখন, মনে হলো কে যেন আমায় বসিয়ে দিল চাপ দিয়ে।
হটাৎ বেশ চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিলাম আমি - পিসিগো - পিসি - ও বিনু পিসি করে। দেখেছিলাম আমার সেজপিসিকে। কাঁঠাল গাছের নীচে বসে কাঁদতে। আমি দেখেও বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি। তবুও বিশ্বাস না করি কি করে - যে আমায় কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে, খাইয়ে দিয়েছে, রাতে-দুপুরে ঘুম পাড়িয়েছে, কোলে করে স্কুল দিয়ে এসেছে নিয়ে এসেছে তাকে কি করে দেখেও বিশ্বাস না করে থাকি।
সেদিন কতক্ষণ কেঁদেছিলাম জানি না।
বেশ ভেঙ্গে পরেছিলাম , গায়ে জোড় পাচ্ছিলাম না। বসে থেকেই দেখেছিলাম পিসিকে সেই আটপোড়োশাড়ি পড়ে, হাতে চুড়ি পড়ে। পিসি কাঁদছে আর আঁচলে চোখ মুছছে আর আমাকে ইশারা করে কি যেন বলছে। আমি এগিয়ে যাবার চেষ্টা করেও উঠতে পারি নি।
যে ভাবে বসেছিলাম সেই ভাবেই বসে কেঁদে চলেছিলাম। ঘোরে আচ্ছন্ন হয়েছিলাম সেদিন সেই সময়। ঘোরকেটে যাবার পর দেখি পিসি আর নেই। নেই আর কোন কান্নার আওয়াজ। অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে বাড়ি ফিরে
ছিলাম আমি।
বাড়ি ফিরে জল খেয়ে নিজের ঘরে ফিরে যাই। সে রাতে আর আমি ঘুমাতে পারি নি। তার পরের দিন থেকে আমার দিন তিনেকের বেশ জ্বর হয়েছিল মনে আছে। পরের দিন জানলাম লিলি,কাকিমা,ছোটকাকাও বিনুপিসির কান্না শুনেছিল কিন্তু কেউই বাইরে এসে দেখার সাহস পায়নি। বিনুপিসি আমার নিজের সেজপিসি।
খুবই অমায়িক ছিলেন। ছোট্টবেলা
থেকেই দেখেছি পিসিকে। আমায় খাওয়ানো-ঘুমপাড়ানো, স্কুলে পাঠানো আনা সবই তিনি করতেন। বিয়ে হয় নি। বিনুপিসির পেটের মধ্যে টিউমার হয়েছিল।
অনেক চিকিৎসা করেও ভালো হয়নি। অপারেশন করাতে চায় নি ভয়ে। আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। স্কুল থেকে খবর পেয়ে ছুটি নিয়ে বাড়ি এসে দেখেছিলাম বিনুপিসিকে আমাদের বৈঠকখানার মেঝেতে নিথর হয়ে শুয়ে থাকতে। বোবা হয়ে গিয়ছিলাম,কাঁদতে পারিনি সেদিন।
রোগের জ্বালায় জর্জরিত হয়ে,মানসিক অবসাদে ভুগতো। সকলেই তাকে খুবই ভালোবাসত। আমার বাবা তার আগেই চলেগিয়েছিলেন। বিনুপিসিও সকলের অলক্ষ্যে বৈঠকখানার ঘরে গলায় দড়ি দিয়ে চিরমুক্তি নিয়ে গেল। এটা ছিল আমার জীবনের দ্বিতীয় বড়ো শোক।
আজ ১২ বছর পর দেখলাম বিনুপিসিকে। বুঝলাম রোগ-যন্ত্রনা থেকে মুক্তি নিলেও তাঁর আত্মার মুক্তি হয়নি। তার পরে আমরা তাঁর আত্মার শান্তি কামনায় এক শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করেছিলাম। জানি না তার পরেও তাঁর আত্মার মুক্তি পেয়েছে কিনা । তবে তার পরে আর কোনদিন তাঁর কান্নাও শুনিনি, দেখিও নি।
কি এক মায়ার টানে বিনুপিসি এসেছিল সেদিন জানিনা - তবে সেদিন ছিল কিন্তু তার মৃত্যুর দিন। এর রহস্য কি? পরে জানি এসব অপঘাতে মৃতর আত্মা ১২ বছর পর মুক্তি পায়। হয়তো মুক্তি পেয়ে অন্য কোথাও যাবার আগে শেষ দেখা দেখতে এসেছিল, নয়তো সে রাতে সবাই ঘুমালো আমার ঘুম আসেনি কেন ? কেনই বা আমায় দেখা দিল - আমায় সবথেকেবেশি ভালোবাসত বলে ? মনে হয় সেটাই । একেই বলে মায়ার মায়া। আজও ভুলিনি বিনুপিসিকে - ভোলা যায় না ।
নিজের বাড়ির সত্যঘটনা আজ আপনাদের শেয়ার করলাম শুধু জানাবার জন্য - যে এরকমও হয়। বিশ্বাস অবিশ্বাস পাঠকের কাছে।
পরের ঘটনা আবার শোনাব - আছে আরও অনেক কাহিনী যা সুর্যের মত সত্য । পরের অধ্যায় খুব শীঘ্রই লিখবো -
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।