আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাফল্য আর ব্যর্থতা হাতে হাত ধরেই আসে। ব্যর্থতা যতই আসুক না কেন, উঠে দাঁড়াতে হবে, নিজেকে গুছিয়ে নিতে হবে। যে কাজ যেভাবে করার কথা, ঠিক সেভাবেই করে যেতে হবে।

আমারে দিবো না ভুলিতে সোনালি আলোয় ঝিকমিক করছে ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র। তখন বিকেল। শীতের সূর্য আস্তে আস্তে বিদায় নিচ্ছে দিগন্তের ওপারে। কিন্তু ৭ জানুয়ারির বিকেলটি ছিল আর সব শীতের বিকেলের চেয়ে অনেক আলাদা। কারণ, সম্মেলন কেন্দ্রের ভেতরে সমাগত হয়েছেন সার্কভুক্ত আটটি দেশের এক ঝাঁক প্রাণোচ্ছল তরুণ-তরুণী।

সার্ক চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এবং এফবিসিসিআইয়ের উদ্যোগে আয়োজিত ‘লিড ২০১২’ সম্মেলনে অংশ নিতে এসেছেন তাঁরা সবাই। সকালে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়ে গেছে। আয়োজকদের সুবাদেই জানা আছে বিকেলের সেশনটি হবে তরুণ উদ্যোক্তাদের নিয়ে। এ অধিবেশনের জন্য প্রতীক্ষারত সবাই। সেখানে তরুণদের মাঝে আসবেন পৃথিবীর সর্বকনিষ্ঠ সিইও, যিনি মাত্র ১৪ বছর বয়সেই নিজের করপোরেশন খুলে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।

চারদিকে গুনগুন। হাজির হলেন আমন্ত্রিত অতিথিরা। নীরবতা। শুরুতেই সবাইকে অভিনন্দন জানালেন অনুষ্ঠানের মডারেটর, বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টারের (বিওয়াইএলসি) প্রতিষ্ঠাতা এজাজ আহমেদ। তাঁর কাছ থেকেই এল প্রথম চমক।

খান একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা সালমান খান, স্বয়ং বিল গেটসও যাঁকে অভিহিত করেন ‘আমার প্রিয় শিক্ষক’ নামে, সেই সালমান লিড ২০১২ তে আগত তরুণদের জন্য একটি ভিডিও বানিয়ে পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সালমান এমন সফল একজন উদ্যোক্তা, যিনি সারা বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থাকে বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেন, উপস্থিত সবাই তাঁর নিজের মুখে শুনলেন খান একাডেমির গল্প। সালমান খানের দেখানো স্বপ্নের রেশ কাটতে না-কাটতেই মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে স্বভাবসুলভ হাসিতে সারা মিলনায়তনে নতুন আলো ছড়িয়ে দিলেন বাংলাদেশে ‘আলোকিত মানুষ চাই’ আন্দোলনের প্রাণপুরুষ, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপ্রধান আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তাঁর মুখে আবার যেন নতুন করে শোনা হলো কিছু অমর শব্দ, মানুষ তাঁর স্বপ্নের সমান বড়। তরুণ উদ্যোক্তাদের মাঝে এসে তিনি স্মৃতিচারণা করলেন সেই দিনগুলোর কথা, একটু একটু করে কীভাবে তিনি গড়ে তুলেছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।

তিনি বললেন, ‘বড় হতে চাইলে তার যথাযথ মূল্য দিতে হয়। একাত্তরে আমরা যে স্বাধীনতা পেয়েছি, তার মূল্য আমরা দিয়েছিলাম ত্রিশ লাখ শহীদের বুকের রক্ত দিয়ে। আজকের তরুণদেরও সেভাবেই সাহসী হয়ে, শিক্ষিত হয়ে, মানুষের মতো মানুষ হয়ে সমাজ পরিবর্তনের কাজে এগিয়ে আসতে হবে। দেশকে ভালোবেসে, বুকের ভেতর স্বপ্ন নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, তবেই স্বপ্ন সফল হবে। ’ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের পর বক্তব্য দিতে এলেন অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ, সুহাস গোপীনাথ।

মাত্র ২৬ বছর বয়সেই এই তরুণ যা করে ফেলেছেন, তা শুনে অনেকের চোখ কপালে ওঠে আর কি! সুহাস যখন ক্লাস নাইনে পড়েন, তখন কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই পাড়ার সাইবার ক্যাফেতে বসে নিজের চেষ্টায় তিনি শিখে ফেলেন ওয়েব ডেভেলপিংয়ের খুঁটিনাটি। ছেলেকে কম্পিউটার কিনে দেওয়ার সামর্থ্য বাবা-মায়ের ছিল না। কিন্তু এসব একটুও দমিয়ে রাখতে পারেনি তাঁকে। ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করে এক আমেরিকান কোম্পানিতে নিজের জীবনবৃত্তান্ত আর কী কী কাজ পারেন, তা লিখে পাঠিয়েছিলেন সুহাস, কিন্তু সেই কোম্পানি জানিয়ে দেয় কোনো স্কুলছাত্রের হাতে তারা তাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার দিতে অপারগ। সেদিনের সেই কিশোর তাতে হাল ছেড়ে না দিয়ে নিজেই নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেন, কিছু একটা করে দেখিয়ে দিতে হবে! একটু একটু করে দাঁড় করিয়ে ফেলেন অনলাইনে নিজের ওয়েব ডেভেলপিং ফার্ম, গ্লোবাল ইনকরপোরেশনস।

২০০৮ সালে বিশ্ব-অর্থনৈতিক ফোরাম তাঁকে ‘ইয়ং গ্লোবাল লিডার’ হিসেবে নির্বাচন করে। এক ঝাঁক তরুণ চোখ গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে, নিজের চেষ্টা আর ইচ্ছা দিয়ে যে অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়, তার এক অনন্য দৃষ্টান্ত সুহাস গোপীনাথ তখন বলে চলছেন, সফল হতে গেলে বয়স আদৌ কোনো বাধা নয়; কে কী পারে, সেই অভিজ্ঞতাই হলো বড় সম্পদ। এরপর পালা আরেক সফল উদ্যোক্তার, নেপাল থেকে আসা আনন্দ বাগারিয়া। অনেক সাফল্যগাথা শুনতে শুনতে যখন তরুণ প্রজন্ম আশায় উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে, তখন খুব সময়োপযোগী বক্তব্য দিয়ে তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন, সাফল্য আর ব্যর্থতা হাতে হাত ধরেই আসে। তিনি বললেন, ব্যর্থতা যতই আসুক না কেন, উঠে দাঁড়াতে হবে, নিজেকে গুছিয়ে নিতে হবে।

যে কাজ যেভাবে করার কথা, ঠিক সেভাবেই করে যেতে হবে। নিজের ব্যবসার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন তাঁর ব্যর্থতাকে জয় করে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। পড়াশোনা করছিলেন প্রকৌশল নিয়ে, কিন্তু চাইতেন নিজের কিছু একটা করতে, নিজের চেষ্টায় কিছু গড়ে তুলতে। প্রথমে শুরু করেছিলেন বলপয়েন্ট কলমের ব্যবসা, লাভের মুখ দেখতে পারেননি। পরবর্তীকালে একের পর এক জায়গায় কড়া নেড়েছেন, ভারত থেকে খাবার আমদানি এমনকি বাংলাদেশ থেকে পানীয় আমদানির চেষ্টাও করে বাদ দেননি।

কিন্তু কেন যেন কিছুতেই কিছু হয়ে উঠছিল না। অবশেষে শুরু করেন পশুখাদ্য উৎপাদন ও বিপণনের ব্যবসা। এখন তাঁর প্রতিষ্ঠান নেপালের শীর্ষ পশুখাদ্য প্রস্তুতকারক। সবার শেষে মঞ্চে এলেন এক অন্য ঘরানার উদ্যোক্তা, জাগো ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা করভি রাখশান্দ। তিনি কাজ করছেন বস্তিবাসী শিশুদের নিয়ে, যাদের স্কুলে যাওয়ার সামর্থ্য নেই।

তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে বললেন, ‘এসব কাজকে সবাই বলে দুস্থদের সাহায্য করা, কিন্তু আমি বলি, এ আমার দায়িত্ব। ’ আমরা সবাই স্বপ্ন দেখি। কিন্তু কেউ কেউ আছেন, যাঁরা নিজেদের স্বপ্ন দিয়ে উজ্জীবিত করেন তাঁদের আশপাশের হাজার মানুষকে। তাঁরা শুধু স্বপ্ন দেখেই ঝিমিয়ে পড়েন না, সেই স্বপ্নের বাস্তব রূপ দিয়ে তবেই তাঁদের তৃপ্তি মেলে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, সুহাস গোপীনাথ, আনন্দ বাগারিয়ার মতো মানুষের সংস্পর্শে এসে যেন নতুন আশার আলো দেখেন উপস্থিত তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিরা।

সন্ধ্যা নেমে আসে চারপাশে, কিন্তু তাঁদের চোখে ভেসে ওঠে অসীম স্বপ্ন আর সেই স্বপ্ন সফল করার দৃঢ় প্রত্যয়।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।