আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শাকিব খান, বাপ্পী লাহিড়ী এবং

আমি প্রথম সিনেমা হলে যাই প্রাইমারী স্কুলে পড়ার সময়। গত শতকের নব্বই-এর দশকের শুরুর দিকে। সিনেমার নাম ছিল সম্ভবত 'চাঁদনী'। আমার মা ছিলেন সাথে, আরও দু-একজন আত্মীয়া। এরপরও সিনেমা হলে গেছি মার সাথে।

'পদ্মা নদীর মাঝি' দেখেছি। আমার মা বাংলা সিনেমার ভক্ত ছিলেন, রাজ্জাক-কবরী বা ফারুক-ববিতার সিনেমা তাঁর ছোটবেলায় হলে গিয়ে দেখতেন। এটা খেয়াল করার বিষয় যে, মফস্বল শহরের একজন গৃহিণী আজ থেকে মাত্র কুড়ি বছর আগেও মূলধারার বাংলা মুভি হলে গিয়ে দেখতেন। এখন যে দেখেন না তা বলছি না, কিন্তু তার সংখ্যা যে তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে, তা যেকোনো হল মালিকের হাহাকার শুনলেই বোঝা যায়। বাংলাদেশের সিনেমা হলগুলোতে বা অধুনা মাল্টিপ্লেক্সগুলো তিন কিসিমের সিনেমা দেখায়।

এক হোল এফডিসির মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমা (সব মুভিই তো বাণিজ্যিক, কাজেই আমরা এই আলোচনায় পরবর্তীতে এই ধারাকে ঢাকাই সিনেমা বা ঢালিউডি সিনেমা বলব)। দ্বিতীয়ত, 'বিকল্পধারা' নামে পরিচিত সিনেমা, হলিউডে এদের বলা হয় ইনডিপেন্ডেন্ট মুভি, একজন চলচ্চিত্র আলোচক (সম্ভবত ফাহমিদুল হক) তাই এই ধারার নাম প্রস্তাব করেছিলেন, স্বাধীণ ধারা। এই নামটাই অধিকতর যৌক্তিক। আর শেষ হোল, বিদেশী, প্রধানত হলিউডি সিনেমা, এই সিনেমাগুলো মফস্বলের থিয়েটারগুলোতে 'এক টিকেটে দু'খানা রঙিন ছবি' এভাবে দেখানো হয়, যদিও কোন ছবিই পুরোটা দেখায় না। ঢাকার মাল্টিপ্লেক্সগুলো অবশ্য এভাবে প্রদর্শন করে না।

ঢাকাই সিনেমার ইতিহাসে নব্বই দশক ইম্পরট্যান্ট। এই দশকের শুরুর দিকে মুক্তি পায় অন্যতম ব্যবসা সফল সিনেমা 'বেদের মেয়ে জোৎস্না' (১৯৮৯)। নব্বই দশকে একজন চলচ্চিত্র অভিনেতার আগমন ঘটে, যার নাম সালমান শাহ। ১৯৯৬ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বেশ কিছু সফল সিনেমা উপহার দেন। তাঁর মৃত্যুর পর কিছু ভক্ত সুইসাইড করেন।

ঢাকাই সিনেমার এক নায়ককে নিয়ে এই ক্রেজ এখন বিশ্বাস করা কঠিন। আবার এই দশকেরই শেষ হাফে সিনেমায় ঢোকে 'কাটপিস'। আমাদের তখন হাইস্কুল চলে। আমার অনেক সহপাঠীই স্কুল ফাঁকি দিয়ে সিনেমা হলগুলোতে যেত। ঐ সময় পর্নো এতটা সহজলভ্য ছিল না, মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেট হাতে হাতে দেখা যেত না।

সহজে এবং সুলভে পর্নো সাপ্লাই দিত ঐ সিনেমাগুলো। গল্পের গরু গাছে উঠত, এর ফাঁকে ফাঁকে অথবা বিরতিতে দেখানো হত ইংলিশ মুভিগুলো থেকে কেটে নেওয়া সঙ্গম দৃশ্য, অথবা পরিচালকেরা বা প্রযোজকেরা স্থানীয় শিল্পী (বা পতিতাদের) দিয়ে ঐ অংশগুলো শুট করতেন। আর থাকতো অশ্লীল গান এবং নৃত্য। মধ্যবিত্ত দর্শক মুখ ঘুরিয়ে নিলেন এবং এখনো কেউ কেউ বাংলা সিনেমা হলে গিয়ে দেখে এসেছেন বলতে লজ্জাবোধ করেন। তবে গত দশকে অবস্থার উন্নতি লক্ষ্য করার মতো।

২০০৩ সালে মুক্তি পায় 'মনের মাঝে তুমি'। যৌথ প্রযোজনার ফিল্ম, চমৎকার গান আর সিনেমাটোগ্রাফি। অতিনাটকীয়তা আছে, কিন্তু সিনেমা হলের সামনের লাইন দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না বাণিজ্যিক মুভি সঙ্কটে আছে। এদিকে টিভি নাটকের কিছু পরিচালক ফিল্মকে সিরিয়াসলি নিলেন। ফারুকী করলেন 'ব্যাচেলর'।

'মনপুরা' নিখাদ বাংলাদেশী মুভি, যৌথ প্রযোজনা নয়। আমাদের তরুণ মিউজিশিয়ান অর্ণব-হাবিব-ফুয়াদ ঢাকাই ছবিতে চমৎকার চমৎকার সুর করছিলেন, কণ্ঠে নতুনত্ব আনছিলেন বাপ্পা মজুমদার-ন্যান্সি-পড়শিরা। কয়েকজন ক্যামেরার নবীন কারিগর সিনেমাটোগ্রাফিতে সুদিনের অঙ্গীকার করছিলেন। গত কয়েক বছরে ঢাকাই ফিল্মে পুঁজি আসছিল। এইতো আব্দুল আজিজ অনন্ত নামের এক ভদ্রলোক নিজেকে নায়ক করে কয়েকটা মুভি বানালেন।

হ্যাঁ, অভিনয় শিখতে তার অনন্তকাল লাগবে কিন্তু এটা তো ঠিক পুঁজি আসছে। তার মানে ঢাকাই ছবিও ব্যবসা দিতে জানে, এটা ক্রমশ প্রতিষ্ঠা পাচ্ছিলো। হোক না সেই সাউথ ইন্ডিয়ান কপি-পেস্ট, তাও তো তবু সিনেমা হলেও যে বিনোদন পাওয়া যায়, তা নতুন করে মনে করাচ্ছিল। বছরে দু'-পাঁচটা ব্যবসা করার বা পরিবারসহ দেখার মতো মুভি ইদানীং এফডিসি-তেই তৈরি হচ্ছিলো। ঠিক এমন সময়ই জানা গেল, সরকার ইন্ডিয়ান মুভির বাংলাদেশে বাণিজ্যিক মুক্তিতে অনুমোদন দিয়েছে।

২০০১-এ হলে ব্যাপারটা হজম করা যেত, কিন্তু ২০১১-তে? আমরা এতদিন ঠেকিয়ে রাখলাম, আর এক যুগ কি আটকানো যেতনা? এমনিতে আওয়ামী লীগ ভারত-বান্ধব বলে পরিচিত। এই ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত অনেক চিন্তা-ভাবনা করেই নিশ্চয় নিয়েছে সরকার। সিনেমা ব্যবসায় প্রযোজক-পরিবেশক এমন অনেক পক্ষ থাকে। পরিবেশকরাই মূলত এই সিদ্ধান্তের পেছনে। ঢাকাই সিনেমার প্রযোজকরা সিনেমা হলের পরিবেশ উন্নয়নের কথা বলেন।

প্রদর্শকরা যুক্তি দেখান, সিনেমার মান যেখানে নিম্নমুখী, সেখানে হল যতই চমৎকার হোক, ব্যবসা হবে না। এই চাপান উতরের মাঝে একটা বিষয় কিন্তু লক্ষণীয়, একটা পরিপূর্ণ ফিল্ম প্রসেসিং ল্যাব এখনো বাংলাদেশে নেই। নিয়মিত ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল হয় না, প্রতিবছর চলচ্চিত্র পুরষ্কার দেওয়া হয় না। সরকার যেটুকু করতে পারতো সেটা না করেই আমাদের সিনে-শিল্পকে একটা অসম প্রতিযোগিতার মাঝে ঠেলে দিল। ইন্ডিয়ান সিনেমা আনার পক্ষের লোকজন ব্যবসা ছাড়াও আর একটা যুক্তি দেখান।

সেটা হোল, অন্য কোন দেশের মুভি আনার ব্যপারে যেখানে নিষেধাজ্ঞা নেই, সেখানে শুধু ইন্ডিয়ান মুভি আনতে না দেওয়া অযৌক্তিক। আর বাংলাদেশে দর্শক যেখানে ড্রয়িং রুমেই হিন্দি শিখে ফেলে, সেখানে অপসংস্কৃতির অজুহাত দেওয়া যায় না। বাংলাদেশে ইন্ডিয়ান মুভি মুক্তি পাক কিন্তু বাংলাদেশী মুভি কি ইন্ডিয়াতে যাবে? সারা ইন্ডিয়া দূর অস্ত, পশ্চিমবঙ্গের একজন দর্শক, যার সামনে বলিউড, সাউথ ইন্ডিয়ান এবং কোলকাতার মুভি দেখার সুযোগ আছে, তিনি কি ঢাকাই সিনেমা দেখবেন? আমাদের টিভি প্রোগ্রামগুলোর ভালো চাহিদা আছে ইন্ডিয়াতে, সেই টিভি চ্যানেলগুলোই ইন্ডিয়ার দর্শক দেখতে পারছে না, অথবা আমরা ইন্ডিয়ার উপর সম্প্রচার নিষেধাজ্ঞা তুলতে চাপ দিতে পারছি না। সেখানে ঢাকাই ছবি বাণিজ্যিকভাবে মুক্তি পাবে, এই আশা করা স্রেফ বাড়াবাড়ি। পশ্চিমবঙ্গের প্রধান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি হোল টালিগঞ্জ, এর থেকেই এর নাম টালিউড।

এই টালিউডি মুভি ইদানীং ভালো ব্যবসা দিচ্ছে। প্রধানত অবাঙালী ব্যবসায়ীরাই ঐ ইন্ডাস্ট্রি চালান। এখন অনেক বাংলাদেশী দর্শকই হিন্দি মিউজিক চ্যানেলগুলো বাদ দিয়ে দেব-কোয়েল-জিতদের দেখেন সঙ্গীত বাংলায়। এই বাংলাদেশী দর্শকরা যখন এদের মুভির পোস্টার দেখবেন বাড়ির পাশের দেয়ালে, তখন তারা কি শাকিব খান-অপু বিশ্বাসদের সিনেমা দেখবেন, নাকি দেব-শুভশ্রীকে দেখতে যাবেন? বেচারা শাকিব খান! হাত পা বেঁধে আমাদের ঘরের ছেলেকে যুদ্ধক্ষেত্রে নামিয়েছি! তাকে শুধুমাত্র আমির খান বা শাহরুখ খানদের সাথেই নয়, পাল্লা দিতে হচ্ছে সদ্য পুঁজির স্বাদ পাওয়া কোলকাতার হিরোদের সাথেও। যুদ্ধটা হচ্ছে অসম।

উত্তম কুমার ছিলেন না বলেই তো আমরা রাজ্জাক-ফারুকদের পেয়েছি। ইন্ডিয়ান সিনেমা যদি আনতেই হয়, তবে অন্তত যেন বাংলা বানিজ্যিক সিনেমা যেন না আনা হয়। তাতে করে অন্তত বাংলা সিনেমার দর্শকদের পাবে ঢাকাই ফিল্ম। স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরও কেন যেন আমরা নিজেদের মূল্য বুঝি না। ২০১১ সালের ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপের অন্যতম আয়োজক ছিল বাংলাদেশ।

এই টুর্নামেন্টের থিম সং করলেন এ আর রহমান। বাংলা এডিশন গাইলেন পশ্চিমবঙ্গের এক শিল্পী। বাংলা ইন্ডিয়ার একটা প্রাদেশিক ভাষা, আর আমাদের জাতীয় ভাষা, কতো গর্ব আমাদের এই ভাষা নিয়ে। কিন্তু সেটা যে শুধুমাত্র ২১শে ফেব্রুয়ারির জন্যই, সেটা বোঝা যায় যখন দেখি, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড বিপিএল-এর থিম সঙও করায় বাপ্পী লাহিড়ীকে দিয়ে। আত্মমর্যাদা না থাকলে স্বাধীনতার দরকার কী? রাজশাহী ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।