আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশের বিখ্যাত জল্লাদ বাবুল মিয়ার নতুন জীবন

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫ ঘাতককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাতারাতি সেলিব্রেটিতে পরিণত হন বাংলাদেশের সবচেয়ে পরিচিত জল্লাদ বাবুল মিয়া। পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয় তার ছবি। এখন তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করছেন। বিয়ে করেছেন। স্ত্রীর নাম কবিতা আকতার।

তাদের ঘরে আসছে সন্তান। তাকে নিয়ে বাবুল মিয়া ও কবিতার অনেক স্বপ্ন। বাবুল মিয়া ২২ বছরের জেল জীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে নিজের গ্রামে শান্তি ফেরানোর চেষ্টা করছেন। তার সেই নতুন জীবন নিয়ে অনলাইন বিবিসি’তে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন লিখেছেন সাংবাদিক ইথিরাজন আনবারাসান। এর শিরোনাম- ‘বাংলাদেশজ মোস্ট ফেমাস হ্যাংম্যান’।

এতে বলা হয়েছে, বাবুল মিয়াকে একটি হত্যার দায়ে যাবজ্জীবন জেল দেয়া হয়েছিল। এই সাজা খাটার সময় ১৭ জনের ফাঁসি কার্যকর করা ও সদাচরণের কারণে আগেভাগেই তাকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। গত বছর তিনি মুক্তি পান। তার আগে ২২ বছর জেল খাটেন। সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের নাটোর জেলায় নিজ গ্রামে ফিরে গিয়েছেন।

বাংলাদেশে কয়েক ডজন জল্লাদ আছেন, কিন্তু তার মধ্যে বাবুল মিয়াকে সবচেয়ে বিখ্যাত বলা হয়। বাংলাদেশে সব জল্লাদই বন্দি। তাদেরকে ফাঁসি দেয়ার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এখন জেল থেকে মুক্তি পেয়ে জল্লাদ বাবুল মিয়া নতুন করে জীবন গড়ার চেষ্টা করছেন তার পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে। তার চারপাশের পরিবেশ পুকুর, ধানক্ষেত আর বাঁশঝাড় নিয়ে।

১৯৮৯ সালে নিজ গ্রামে একটি খুনের জন্য তাকে দায়ী করা হয়। তখন তার বয়স ছিল ১৭ বছর। কিন্তু বাবুল মিয়া ওই খুনের অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি এখন স্বাভাবিক জীবন গড়ার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেছেন, আমি ইচ্ছার বিরুদ্ধে জল্লাদ হয়েছিলাম।

যখন জেলে ছিলাম তখন জেল কর্তৃপক্ষ আমাকে বলেছিল- আমি যদি জল্লাদ হই তাহলে প্রতিটি ফাঁসি কার্যকর করার বিনিময়ে আমার সাজা দু’মাস করে কমবে। আমি সব সময়ই আগেভাগে জেল থেকে মুক্ত হতে চেয়েছি। তাই তাদের সেই প্রস্তাব আমি মেনে নিয়েছি। অভিযুক্ত কয়েদিদের মৃত্যুদণ্ড ফাঁসিতে যেসব দেশে কার্যকর করা হয় তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ১৯৭১ সালে এ দেশ পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।

তারপর থেকে ৪ শতাধিক মানুষকে এদেশে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। কর্মকর্তারা বলেন, এখনও মৃত্যুদণ্ড রয়েছে ১ হাজারেরও বেশি বন্দির বিরুদ্ধে। জেলখানায় বন্দিতে গাদাগাদি হওয়ায় গত বছর সাধারণ ক্ষমায় ১০০০ বন্দিকে মুক্তি দেয়া হয়। তার মধ্যে বাবুল মিয়া একজন। তখন দুই দশক পরে বাবুল মিয়া জেল থেকে বের হন এক নতুন জীবন নিয়ে।

তিনি বলেন, মুক্তি পেয়ে আমি আনন্দ ধরে রাখতে পারছিলাম না। আমি যখন ঢাকার ভিতর দিয়ে আসি তখন তা ছিল আমার কাছে এক নতুন দুনিয়া। ঢাকা শহর ততদিনে পুরোপুরি পাল্টে গেছে। যখন নিজ গ্রামে পৌঁছি তখন দেখি সেখানেও পরিবর্তন। অনেক মানুষকে চিনতে পারছিলাম না।

তারাও আমাকে চিনতে পারছিল না। তার পরপরই বাবুল মিয়া স্থানীয় এক যুবতী কবিতা আকতারকে বিয়ে করেন। এখন তারা পিতা-মাতা হতে যাচ্ছেন। কিন্তু বাবুল মিয়ার হাতে প্রতিদিন কাজ থাকে না। তাই তিনি ভাইয়ের কৃষিক্ষেতে কাজ করেন।

গবাদি পশু দেখাশোনা করেন। কখনও পাশের গ্রামে দিনমজুরির কাজ করেন। এসব করে মাসে তিনি উপার্জন করেন ৫০০০ টাকা। বাবুল মিয়া বলেন, অনেক মানুষ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন- তারা আমাকে কাজ দেবেন, না হয় কিছু টাকা দেবেন যাতে আমি ব্যবসা করতে পারি। কিন্তু তা সে পর্যন্তই।

গত ২০ বছরে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। তিনি বলেন, এভাবে কতদিন উপার্জন করে সংসার চালাতে পারবো জানি না। ওদিকে তার স্ত্রী কবিতা আকতার বলেছেন, প্রথম দিকে একজন জল্লাদের সঙ্গে ঘর-সংসার করতে ভয় হতো। যখন আমি জেনেছি তিনি জেলে মানুষকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন তখন আমি ভয়ে শিউরে উঠতাম। কিন্তু আস্তে আস্তে বুঝতে পারি তিনি নির্দোষ।

তিনি জেলে শুধু তার দায়িত্বই পালন করেছেন। এখন তিনি আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক কথা বলেন। তিনি আমাদের সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার স্বপ্ন দেখেন, যাতে তার সন্তানকে তার মতো কঠিন সমস্যার মোকাবিলা করতে না হয়। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, বাবুল মিয়াকে জেলে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল কিভাবে ফাঁসি কার্যকর করতে হবে, কিভাবে ফাঁসির মঞ্চ বানাতে হবে, রশি প্রস্তুত করতে হবে- সব। বাবুল মিয়া বলেন, প্রথমবার যখন আমি একজনকে ফাঁসিতে ঝোলাই তখন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।

কিন্তু সেখানে আমার কিছুই করার ছিল না। কারণ, ওই ব্যক্তির আপিল আদালত প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তবে কেউ যদি মানসিকভাবে শক্তিশালী না হন, আবেগ যদি কাটিয়ে উঠতে না পারেন তাহলে সে জল্লাদ হতে পারবে না। আমি সব সময় একটি কথাই মনে রাখতাম। তাহলো- একটি ফাঁসি দিলেই আমার সাজা কমবে।

তিনি বলেন, যখন কাউকে ফাঁসির মঞ্চে নেয়া হয় তার গলায় পরিয়ে দেয়া হয় ফাঁসির রজ্জু। সে সময় ওই ব্যক্তি থর থর করে কাঁপেন। অনেক আসামিকেই তিনি ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘাতকদের ফাঁসিতে ঝোলাতে বলা হয়। ওই নির্দেশে তিনি সাবেক ৫ সেনা কর্মকর্তার ফাঁসি কার্যকর করেন।

বাবুল মিয়া বলেন, ওইদিন আমি তাদেরকে ফাঁসিতে ঝোলাতে উদগ্রীব হয়েছিলাম। কারণ, তারা এদেশের মহান নেতাকে হত্যা করেছিল। আমি সেই ৫ ঘাতককে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছি। যদি তাদের সংখ্যা এক শ’ও হতো তাহলে আমি তাদের সবাইকে ফাঁসি দিতাম কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়া। ওই ফাঁসি কার্যকর করার পর পরই বাবুল মিয়া রাতারাতি সেলিব্রেটিতে পরিণত হন।

পত্রিকায় তার ছবি ছাপা হয়। তার জেল জীবন নিয়ে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল একটি প্রোগ্রাম বানানোর উদ্যোগ নিয়েছিল। বাবুল মিয়া বলেছেন, বাংলাদেশে জেলে থাকা আর নরকে থাকা সমান কথা। সেখানে বন্দিতে উপচে পড়ছে। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাব রয়েছে।

এটাই সেখানকার সবচেয়ে বড় সমস্যা। অনেক বন্দি ত্বকের নানা রোগে ভুগছে। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের ৬৭টি জেলে রয়েছে প্রায় ৭৫০০০ বন্দি। স্বাভাবিক ধারণ ক্ষমতার চেয়ে এ সংখ্যা তিন গুণ বেশি। মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থাগুলো বলছে, জেলখানাগুলো অস্বাস্থ্যকর, নোংরা এবং কখনও কখনও তা সহিংসতাপ্রবণ।

বাবুল মিয়া বলেন, জেলের বাইরে যারা থাকেন তারা ভিতরের অবস্থা জানেন না। সেখানে পরিষ্কার পানির জন্য লড়াই করতে হয়েছে। সেখানে রয়েছে সহিংসতা, মাদক। আর রয়েছে বলাৎকারের ঘটনা। কিন্তু সামপ্রতিক বছরগুলোতে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে।

তাই নিজের ঘোর শত্রুর জন্যও তিনি জেলজীবন কামনা করেন না। জেলজীবনের কথা তিনি আর মনে করতে চান না। ওই পুরনো অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি নিজের গ্রামে শান্তি ফেরানোর চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন- যখনই গ্রামে ঝগড়া বা সংঘর্ষ হয় আমি সেখানে এগিয়ে গিয়ে তা মিটিয়ে দিই। তারা আইন সম্পর্কে জানে না।

আমি তাদেরকে বলি- আমার দিকে তাকাও। এরকমই এক সংঘর্ষের ঘটনায় আমাকে জেলে যেতে হয়েছিল। তারপর ২২ বছর পরে মুক্তি পেয়েছি। তোমরাও কি একই পরিণতি ভোগ করতে চাও? তারপরই তারা আলোচনায় বসে। সমস্যার সমাধান করে।

আরো জানতে শুধু ক্লিক  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.