আমি খুবি সাধারণ পেন্সিলে আঁকা সহজ স্বপ্ন আমার । স্বপ্ন দেখতে ভুল হলে ইরেজার দিয়ে সহজে মুছে ফেলা যায় । আমার স্বপ্ন ।
দীর্ঘ এগারোটি মাস ডিঙিয়ে উপনীত হল ডিসেম্বর । পলে পলে অনেক খেলাই পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে উপস্থাপিত হয়।
কোনটার সাফল্য অনুপ্রেরণাদায়ক আবার কোনটার বেদনা বিদুর। সৃতিতে অম্লান কিছু ঘটনা হৃদয়ে আলোকপাত করে। কখনও কাঁদায় আবার কখনও হাসায়। অর্জন যেমন আনন্দের তেমনি হারানোটা বেদনার। ফিরে দেখা ২০১১ এর আলোচিত আর সমালোচিত ঘটনাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এক বিশাল সংগ্রহ।
তার কিছু চম্বুক অংশ তুলে ধরা হল ।
সেদিন ছিল ৫ই জুন। তেমনি এক মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুমানা মঞ্জুরের। শিক্ষক রুমানা মঞ্জুর কম্পিউটারে কাজ করছিলেন ৷ এ সময় তার স্বামী সাঈদ হাসান রুমে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দেন ৷ রুমানা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সাঈদ তার মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করেন ৷ সঙ্গে সঙ্গে রুমানা পড়ে যান ৷ এরপর সাঈদ তার গলা চেপে ধরেন ৷ তার দু'চোখ আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে নষ্ট করে দেন ৷ তাদের সন্তান আনুষার সামনেই ঘটে এ ঘটনা ৷ আনুষা এ সময় মাকে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচাতে কান্নাকাটি করেন ৷ রুমানা ও আনুষার চিত্কাারে কাজের মেয়েসহ অন্যরা বাইরে থেকে দরজা খুলে তাকে রক্ষা করেন ৷ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করান স্বজনরা।
রুমানার দু'টি চোখেই ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে ৷ একটি চোখ নষ্ট হয়ে গেছে ৷ অপরটিও নষ্টের পথে ৷ মাথা ও সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন ৷ ডাক্তাররা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন অন্তত চোখ রক্ষা করতে ৷ প্রয়োজনে তাকে বিদেশে চিকিত্সারর জন্য বলা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ৷তার সারা শরীরের আঘাতের চিহ্ন।
স্বামীর কী নির্মম অত্যাচারের চিত্র ৷ নিজ স্ত্রীকে এমনভাবে একজন স্বামী নির্যাতন করতে পারে একবিংশ শতাব্দীতে ভাবতে কষ্ট হয় ৷ নির্যাতন শুরুর আগে রুমের ভেতর থেকে লক করে দেয়া হয়েছিল ৷ কোন কিছুতেই পিতার হৃদয় গলাতে পারেনি ওই শিশু ৷ রুমানার নাকের বাম পাশের অংশ কামড়িয়ে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে ৷ নাখ, মুখ, কানসহ শরীরের অনেক জায়গায় মাংস ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে ৷তার চোখ, মুখ, গাল, নাখ এবং কপাল বেয়ে অঝোরে রক্ত ঝরছিল৷ স্বামী নামক পশুটির কী বিভর্ষ চিত্র ৷ ভাবতে কষ্ট হয় একজন প্রকৌশলী স্বামী যদি এই তার স্ত্রীর প্রতি এমন বর্বরচিত নির্যাতন করতে পারে তাহলে সাধারণ মানুষের কথা তো ভাবাই যায় না ৷ছাত্র-ছাত্রী, ব্লগ, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ও সুশীল সমাজ রুমানা মঞ্জুরের পক্ষে জোড়ালো সমর্থনও এর প্রতিবাদ করেন। অতপর,সাইদ পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় হসপিটালে আত্মহত্যা করেন। সুরতহাল রিপোর্টে তাই আসে। ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যায় সাজানো সংসার । অনুশার স্বপ্নের পৃথিবীতে বাবা নেই।
আর মা তার আদরের মেয়েকে দেখার আলো হারিয়ে ফেলেছে । বর্তমানে রুমানা মঞ্জুর ডাক্তারের নিবিড় পরিচর্যায় রয়েছেন।
কানিজ আলমাস । সৌন্দর্য সচেতন নারীদের কাছে অনন্য নাম। সৌন্দর্য চর্চায় নারীরা পায় গতি।
পারসোনা স্বত্বাধিকারী এই নারী এ বছরে আলোচিত হয় অত্যন্ত লজ্জাজনক ভাবে। স্পা ও প্রসাধনী শয্যার কক্ষে তার লুকানো ক্যামেরা অনেক মেয়েকে আতঙ্কিত করে তলে। অনেক অভিজাত মেয়েরা যারা নিত্যদিন পারসোনায় যেতেন তারাও হয়ে পরেন আতঙ্কিত, ভয়ার্ত । তারা ভাবতে থাকেন তাদেরও থাকতে লুকায়িত কোন দৃশ্য। সামাজিক যোগাযোগ, ব্লগ এমনকি এমনকি ইউটিউবে হুমড়ি খেয়ে পড়ে লাখো ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা ।
নানা জল্পনা কল্পনার মধ্যদিয়ে এড়িয়ে যায় বাকি সময় নন্দিত এই মানুষ টি নিন্দিত হয়ে পরে সকলের চোখে ।
বছরের শেষে আলোচিত এক নারী হাওয়া আক্তার জুই। লেখাপড়া করতে চাওয়াই কাল হলো তাঁর। কেটে নেওয়া হলো তাঁর ডান হাতের চারটি আঙুল। স্বামীর অসম্মতিতে কলেজে ভর্তি হওয়ায় এই গৃহবধূর উপর অমানবিক নির্যাতন করা হয়।
ঘটনাটি ঘটেছে ৪ ডিসেম্বর। ভুক্তভোগী গৃহবধূ নরসিংদী সরকারি কলেজে দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী। ২০০৮ সালের ৩০ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার নূরজাহানপুর গ্রামের রফিকুল ইসলামের সঙ্গে হাওয়ার বিয়ে হয়। লেখাপড়ার প্রতি হাওয়ার প্রবল আগ্রহ থাকলেও তাঁর স্বামী জানিয়ে দেন, আর লেখাপড়া করা যাবে না। এরই মধ্যে হাওয়ার এসএসসি পরীক্ষার ফল বের হয় এবং তিনি ‘এ গ্রেড’ পান।
২০০৮ সালের শেষের দিকে রফিক হাওয়াকে তাঁর বাবার বাড়ি রেখে দুবাই চলে যান। লেখাপড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকায় জামাইকে না জানিয়েই তিনি মেয়েকে নরসিংদী সরকারি কলেজে ভর্তি করেন। সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনী পরীক্ষায় ভালো ফল করায় আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন হাওয়া। কিন্তু কোনোভাবে হাওয়ার লেখাপড়ার খবর জানতে পেরে রফিক খেপে যান। হাওয়ার শ্বশুরবাড়ির লোকজনও বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি।
রফিক গত ২৭ নভেম্বর দুবাই থেকে হাওয়াকে ফোন করে জানান, তিনি তাঁর জন্য মুঠোফোনের একটি সেট, কিছু স্বর্ণালংকার ও কসমেটিকস রফিকের বোনের বাসায় পাঠিয়েছেন। এগুলো তিনি তাঁর বোন নাঈমা বেগমের ঢাকার বাসা থেকে নিয়ে যেতে বলেন। পরে হাওয়া ১ ডিসেম্বর ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার জিয়া কলোনিতে তাঁর ননদের বাসায় যান। সারপ্রাইজ দেবে বলে রফিক জুঁইকে জানাইনি। এ সময় রফিক রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয়।
রফিক জুঁইকে বলে, আমি নিষেধ করা সত্ত্বেও তুমি তাহলে ঠিকই পরীক্ষা দিয়েছ, তোমার জন্য একটা পুরস্কার আছে। চোখটা বন্ধ করো। এ সময় আচমকা সে ওড়না দিয়ে আমার দুই চোখ টাইট করে বেঁধে ফেলে। মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে বলে, একদম চুপ। এরপর আমার ডান হাত টেনে ধারালো চাপাতি দিয়ে আঙুলে কোপ দেয়।
এভাবেই নারীরা নির্যাতিত হচ্ছে পদে পদে। বছরের শেষ দিকে আলোচিত এ নারীর জ্ঞান অর্জনই কাল হল হারাতে হল আঙ্গুল ।
শারমিন জাহান সুমি বরিশাল নগরের মুসলিম কবরস্থান সড়ক এলাকার নিবাসী। ১৯৯৯ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন লিয়াকত শাহরিয়ার খান ওরফে রাসেলের সাথে। লিয়াকত বিয়ের পর থেকেই যৌতুকের দাবিতে স্ত্রীর ওপর নির্যাতন চালাতেন।
নির্যাতন সইতে না পেরে শারমিন তাঁর বাবার বাড়ি থেকে ১৩ ভরি স্বর্ণ এবং দুই লাখ টাকা এনে দেন। কিন্তু নির্যাতন থামেনি। শারমিন বাধ্য হয়ে তাঁর দুই খালুর কাছ থেকে আরও ১৭ লাখ টাকা এনে দেন। এরপর গত ২৪ অক্টোবর শারমিনের পরিবারের কাছে আরও তিন লাখ টাকা দাবি করে লিয়াকত। এত টাকা শারমিনের পক্ষে দিয়া অনেকটা অসম্ভব ছিল শারমিনের।
অপারগতা জানালে নির্যাতন করে ছোট মেয়েসহ তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দেন লিয়াকত। গত ১৩ নভেম্বর বড় মেয়ে মেহজাবিনকে আনতে গেলে পুনরায় তিন লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেন। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাঁকে একটি কক্ষে আটকে রাখেন। সংবাদ পেয়ে শারমিন জাহানের বাবা ও ভাই ওই বাড়িতে গেলে তাঁদেরও মারধর করেন। এভাবেই এক সুকরুন সচিত্র চিত্র উঠে আসে গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে।
এ বছর শিক্ষক পরিমল কর্তৃক নির্যাতিত হতে হয়েছে ভিকারুন্নিসা নুন স্কুল এন্ড কলেজের ছাত্রীকে । যা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম,ব্লগ, প্রিন্ট অ্যান্ড মিডিয়াতে ঘটনাটি অনেক আলোড়িত হয়েছিল। যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের মত নিষ্ঠুর আর পাশবিক কাজ।
নারীরা আজ ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। প্রতিবাদ করতে শিখছে।
ন্যায্য অধিকারটি সে আজ বুঝে নিতে পারছে। তেমনি এক উজ্জ্বল নারী হলেন ফারজানা ইয়াসমিন । ১৪ ই নভেম্বর। বিয়ের উজ্জ্বল আলোর রোশনি তখনও নিভে যায় নি। বিয়ের অনুষ্ঠানিকতা বলতে কন্যা সম্প্রদান অর্থাৎ বরের হাতে তুলে দেওয়া বাকি।
বিয়ের আগে কোন দাবি দাওয়া ছিল না বড় পক্ষের। বরের ফুপু বিয়ের পর পরই দাবি করলেন যৌতুকের। বিয়ের আসরেই জানিয়ে দিলেন, যৌতুক হিসেবে এসব না দেওয়া হলে মেয়েকে পাঁচ বছর বাপের বাড়ি থাকতে হবে। ফারজানা যখন শুনলেন এই অবস্থা তখন তাকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। এক জন শিক্ষিত নারী হিসেবে নিজের সত্ত্বাকে বিসর্জন দিতে অপারগ ছিলেন ফারজানা।
প্রধান শিক্ষক শিক্ষিত বর কি করে ফুফুর কথায় সায় দিল ! জ্ঞানের বাস্তব প্রয়োগ ঘটান তিনি । বলে দিলেন আমি এই মুহূর্তে তালাক দিব । আমি এই সংসার করব না। যাতে ভবিষ্যতে এর জের কিংবা অত্যাচার আমার সইতে হয় । তরুণী ও নারীদের প্রতি ফারজানার আহ্বান- প্রত্যেকটি মেয়েকে সচেতন হতে হবে।
তা দেখেশুনে হোক বা নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই হোক।
তিনি বলেন,“আমি কিন্তু বলিষ্ঠভাবে জানিয়ে দিয়েছি, বিয়ে হয়নি তো কী হয়েছে, প্রয়োজনে অমি আর বিয়েই করবো না,” দীপ্ত কণ্ঠ ফারজানার। এ জয় এ সাহস এই দুর্বার হুংকার যেন হোক প্রতিটি নারীর অন্যায়ের প্রতিবাদ। এই ঘটনাটি আলোচিত সকল ঘটনা থেকে আলাদা মাত্রা পেয়েছে।
ডা. সেলিনা হায়াত আইভী এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত নারী।
ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে লড়াই করে তিনি পর পর দুইবার হয়েছেন জনপ্রতিনিধি। তার বাবা আলী আহাম্মদ চুনকাও জীবনদ্দশায় ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে লড়াই করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাবার মতই কাজটি করলেন তার যোগ্য উত্তরসূরী তনয়া আইভী । এক সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইভীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রাক্কালে সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার পরামর্শ দেন। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দোয়াত কলম প্রতীক নিয়ে আইভী পেয়েছিলেন ১ লাখ ৮০ হাজার ৪৮ ভোট।
তার ধারে কাছে কেউ যেতে পারেনি। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ভোট পেয়েছেন ৭৮ হাজার ৭০৫ ভোট। আর অন্য প্রার্থীরা কেউ কেউ ১০ হাজার ভোট পর্যন্ত পায়নি। নাসিক এই নির্বাচনে অনেক রাজনীতির ঘোলা জলের অবসান ঘটিয়ে এই নারী এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। জয়ের বরমাল্য তার গলায় কেবল শোভা পায়।
এভাবেই গড়ায় সময়। সম্ভাবনায় থাকা এই বছরটি এভাবেই নিজেকে নিজের মত গুটিয়ে নিচ্ছে। চোখের পলকে কেটে গেল একটি বছর। ২০১১ তার ক্রান্তিলগ্নে হারানোর শেষ প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। নুতন কে আলিঙ্গন করার আকাঙ্ক্ষা সকলের।
নতুন স্বপ্নের আশাকে বাঁচিয়ে রেখে কিংবা ব্যর্থতা কে ভুলে এক আলোকিত বছরের প্রত্যাশা কার না থাকে। ফারজানা কিংবা আইভির মত দুঃসাহসিক নারীদের প্রতি রইল সুরঞ্জনার পক্ষ থেকে অশেষ শুভেচ্ছা আর ভাগ্যাহত সেইসব নারীদের প্রতি রইল সমবেদনা । নুতন একটি বছর তাদের জন্য আনন্দের আগমনী বার্তা বয়ে আনুক এই কামনা করি ।
ই-মেইলঃ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।