শিক্ষার্থী সমীপে বিশ্ববিদ্যালয়ের জবাবদিহিতা প্রসঙ্গ
নাদিমূল হক মণ্ডল
যুক্তরাজ্যের যে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে দীক্ষা নিচ্ছি আমি, তার ভাইস চ্যান্সেলরকে এক ভয়াবহ মুশকিলে পড়তে দেখলাম গত সপ্তাহে। বিখ্যাত বিজ্ঞানী, বিচক্ষণ প্রশাসক এবং নিরীহ প্রকৃতির এই ভদ্রলোককে একদল শিক্ষার্থী মোটামুটি তুলোধুনো করল। অভিযোগটি এ রকম-গ্যাসলাইনে লিক থাকতে পারে এই যুক্তিতে হিটিং এবং গরম পানির লাইন বেশ ক’দিন বন্ধ থাকায় সেইন্ট কুথবার্টস হলের জনা বিশেক শিক্ষার্থীকে শীতের কষ্ট একটু বেশিই সইতে হয়েছে অন্যদের তুলনায়। লন্ড্রি সার্ভিস বন্ধ ছিল, আর খাবারও এনে খেতে হয়েছে বাইরে থেকে। ভাইস চ্যান্সেলর বললেন, ‘হলের শিক্ষার্থীদের পরিষদ ও সিনিয়র টিউটরদের সঙ্গে নিয়ে প্রত্যেকে চেষ্টা করেছে সর্বোচ্চ দ্রুততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে সমস্যা সমাধানের।
এটি ছিল এমন এক অপ্রত্যাশিত দুর্যোগ, যেটির জন্য আমরাও প্রস্তুত ছিলাম না। ’ বলা বাহুল্য, তার এই উত্তর সন্তুষ্ট করতে পারেনি শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থীদের ভাষ্যমতে, অপরাধ খুব ভয়াবহ-যদিও সমস্যাটির সমাধান হয়েছে ক’দিনেই, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ও সেইন্ট কুথবার্টস হল কর্তৃপক্ষ আরও বেশি মুন্সিয়ানা প্রদর্শন করলে সমস্যাটির সমাধান হতো আরও দ্রুত, শিক্ষার্থীদের কষ্ট সইতে হতো না। প্রতি শিক্ষার্থীর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে দেওয়া ৬১ পাউন্ডকে ‘কিক ইন দ্য টিথ’ সাব্যস্ত করলেন গ্যাব্রিয়েল ক্যুরি নামের এক শিক্ষার্থী প্রতিনিধি।
ডারহাম ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন আয়োজিত ‘কোয়েশ্চেন টাইম’ অনুষ্ঠানে তর্কযুদ্ধ দেখছিলাম আর ভাবছিলাম আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জবাবদিহিতা প্রসঙ্গে।
একই সঙ্গে জবাবদিহিতার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব প্রসঙ্গেও। ক্লাস, ফ্যাকাল্টি, হলভিত্তিক শিক্ষার্থী এবং ক্লাব ও সোসাইটির রিপ্রেজেন্টেটিভদের সম্মিলনে ডারহাম ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন শিক্ষার্থীকণ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বরাবর তুলে ধরার এক ব্যাপক ও বিস্তৃত নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষার্থী জীবন সবে আড়াই মাসের।
এর মাঝেই শিক্ষার্থী প্রতিনিধি হিসেবে আমাকে আমার প্রোগ্রামের সব শিক্ষার্থীর সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগ ও সাক্ষাত্ দুটোর মাধ্যমেই সুবিধা-অসুবিধা ও দাবিনামা শনাক্ত করে উপস্থাপন করতে হয়েছে ‘স্টাফ স্টুডেন্ট কনসালটেটিভ’ সভায়। সেই সঙ্গে সভার ফলাফলও জানাতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের।
ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় বরাদ্দে চললেও সম্পূর্ণ স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও শিক্ষার্থীকণ্ঠ তুলে ধরায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মনে করতে পারছি না আমাদের দেশের ডাকসু বা জাকসুর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো মৃত্যুর কততম বার্ষিকী উদযাপন করেছে এ বছর, তবে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে জাকসু অফিস পরিত্যক্তই দেখেছি। অথচ কত দুর্দান্ত ভূমিকা এই প্রতিষ্ঠানগুলো রাখতে পারত।
ক্ষমতার পালাবদলে আমাদের দেশ রক্ষার ঠিকাদার দু’দলের ছাত্রসংগঠনকেই ব্যস্ত দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে নেগোসিয়েশনে, তবে এই দরকষাকষি শিক্ষার্থী স্বার্থ ইস্যুতে নয়, বরং ঠিকাদারি, দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির বণ্টন ও প্রক্রিয়াকরণ বিষয়ে। হল জীবনের অনেক গভীর রাতে অন্তরাত্মা কেঁপেছে ক্ষমতায় থাকা দু’দলের ছাত্রসংগঠন কর্তৃক নির্যাতিত সেইসব শিক্ষার্থীর আর্তচিত্কারে, যারা প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করেছে কোনো না কোনোভাবে।
বিশ্ববিদ্যালয় ও এর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর নানাবিধ অনুশীলন যেগুলো শিক্ষার্থী স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, সেগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা শিক্ষার্থীর হক। যে ডিগ্রির জন্য পয়সা দিচ্ছে শিক্ষার্থী, অভিভাবক কিংবা রাষ্ট্র, সেই পড়াশোনা, সেখানকার সুযোগ-সুবিধা এবং সামগ্রিক পরিবেশ ও প্রতিবেশ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বরাবর প্রশ্ন করা ও প্রত্যাশিত দাবিনামা তুলে ধরার সুযোগ অবশ্যই ন্যায্য অধিকারসমূহের অন্যতম। মতামত প্রকাশ ও দাবি উত্থাপনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর উপস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব প্রতিষ্ঠানের জন্যই স্বাস্থ্যকর। আর বিশ্ববিদ্যালয়কে ক্রিটিক করার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি ও সবল উপস্থিতি নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়েরই। এ উপলব্ধিটি দুর্বল রয়ে গেছে বরাবর।
পরিবর্তন সম্ভবত অসম্ভব নয়। তবে দায়িত্ব দু’পক্ষেরই।
লেখক : নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য
Published: Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।