সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............ প্রসংগঃ সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থী
প্রতিবছরই এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর প্রায় সকল পত্রিকায় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মেধাবীদের পরিচয় তুলেধরা হয়। সেই পরিচিতিতে আমরা এমন অনেক মেধাবীদের মুখ দেখে আপ্লুত হই-যারা আর্থীক জীবন সংগ্রামে পরাজিত হয়েও স্কুল-কলেজ জীবনের পরীক্ষায় জয়ীহয়ে আবারো উচ্চশিক্ষা জীবনের এক অনিশ্চিত আশংকায় পতিত হয়!
বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। সেই দারিদ্রসীমায় বাসকরা প্রত্যেক মা-বাবাও আশা করে তার সন্তান স্কুলে যাক, লেখাপড়া শিখে বড় হোক। কিন্তু আর্থিক অনটনের কারণে শিশু বয়সেই তাদেরকে শিশুশ্রমে বাধ্য হতে হয়। তারপরেও অনেক দরিদ্র সন্তান পড়া লেখার অদম্য আকাঙ্ক্ষায় শিক্ষা গ্রহনে সচেস্ট থাকে।
স্কুলে শিক্ষকের অপ্রতুলতা এবং অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে শিক্ষকের দ্বারা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর বিশেষভাবে খোঁজখবর নেয়াও সম্ভব হয় না। অনেক শিক্ষার্থী আছে, যারা কোন কোন বিষয় ঠিকভাবে বুঝতে পারে না বিধায় প্রাইভেট কোচিং/টিউটরের প্রয়োজন বোধ করে, কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে অনেকের পক্ষেই সেই প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হয় না। আবার অনেক পিতামাতা নিরক্ষর বা স্বল্পশিক্ষিতহেতু বাড়িতে সন্তানদের বিষয়ভিত্তিক কোন সমস্যার সমাধান করতে পারেন না। ফলে অধিকাংশ দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা কোনরকমে না বুঝে, অস্পষ্টতার মধ্যে থেকে শিক্ষাজীবন চালিয়ে যায়। এসব কারণে অধিকাংশ শিক্ষার্থী লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয়ে পড়ে, স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে ফলশ্রুতিতে শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়ে।
তারপরেও অনেকেই শুধু মনের জোড় আর গড গিফটেড মেধার জোড়ে ভালো ফলাফল করে আমাদেরকে চমকে দেয়!
গণসাক্ষরতা অভিযান-এর গবেষণা (সূত্র: প্রথম আলো) থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া প্রায় অর্ধেক শিশু প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়েই ঝরে পড়ে। যে সকল শিশু মাধ্যমিক স্তরে ভর্তি হয় তাদের মধ্য থেকে প্রায় ৮০ শতাংশ এই স্তরেই ঝরে পড়ে। এর অর্থ, ২০১০ সালে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া ১০০টি শিশুর মধ্যে ২০১৯ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেবে মাত্র ২০ জন। এরপর উচ্চশিক্ষার জগতে প্রবেশ করে মাত্র ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী। এ ছাড়াও গণসাক্ষরতা অভিযানের আর এক গবেষণায় দেখা যায়, ষষ্ঠ শ্রেনীতে যেসব শিক্ষার্থী ভর্তি হয় তাদের প্রায় ৮০ শতাংশ ঝরে যায় মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে।
বর্তমান সময়ে অনেক উন্নত দেশেও সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং জাতিসত্ত্বাভেদে শিক্ষাগত বৈষম্য বিদ্যমান। এই বৈষম্য কোটি কোটি গরীব ছেলেমেয়ের সম্ভাবনাময় জীবনকে স্থিমিত করে দিচ্ছে। এটি সমাজে তাদের নাগরিক অংশগ্রহণ ও ভবিষ্যৎ উপার্জনমূলক কর্মকাণ্ডকেও নানাভাবে ব্যাহত করছে। আমার ধারনা-এই শিক্ষাগত বৈষম্যের তিনটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত কারণ রয়েছে।
প্রথম কারণ, যেসব ছেলেমেয়েরা স্বল্পআয়ের অবস্থানে বসবাস করে তারা উচ্চআয়ের এলাকায় বসবাসরত ছেলেমেয়েদের তুলনায় অধিক বাঁধার সম্মুখীন হয়।
এসব বাঁধার মধ্যে আছে, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসুবিধা, পুষ্টি, গৃহায়ন এবং মানসম্মত প্রাক-বিদ্যালয় ব্যবস্থা।
দ্বিতীয়ত, বিদ্যালয়গুলোর বিদ্যমান অবকাঠামোগত অবস্থা ছাত্রছাত্রীদের অতিরিক্ত ও বিশেষ চাহিদা মেটানোর জন্য অপ্রতুল। বিদ্যালয়গুলোতে পেছনে পড়ে যাওয়া ছাত্রছাত্রীদের জন্য আলাদা কোনো সময় বরাদ্দ নেই। সেই সাথে উপযোগী মানসম্মত শিক্ষকদেরও অভাব রয়েছে। এ ছাড়াও এই সুবিধাবঞ্চিত ছেলেমেয়েদের দিকে বিশেষ নজর দিলে এরা যে অন্যান্য সুবিধাপ্রাপ্ত ছেলেমেয়েদের মতো ভাল করতে পারে, এমন ধারণাও শিক্ষকদের মধ্যে অনুপস্থিত।
তৃতীয়ত, সমাজে প্রচলিত বিশ্বাস শিক্ষক ও বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদেরকে প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন এবং এতদ সঙ্গে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করছে। তাই দারিদ্র্য, যেটার কারণে ছাত্রছাত্রীরা শ্রেণীকক্ষে মনোযোগ দিতে পারে না, তা নিরসনের জন্য বিনিয়োগ যুক্তিযুক্ত নয় বলে মনে করা হচ্ছে।
উপরোক্ত বিষয়গুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় মাধ্যমিক স্তর একজন শিক্ষার্থীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই স্তরে শিক্ষার্থীর ঝরেপড়ার ঝুকি থাকে সবচেয়ে বেশি এবং এই ঝরেপড়ার অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের সন্তান।
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তিপ্রাপ্ত সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের এসএসসি পরীক্ষায় পাশের হার শতভাগ নিশ্চিত করাসহ সামগ্রিক জীবনমান উন্নয়নে যা করণীয়ঃ
১।
দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করা।
২। বিদ্যালয়ে আন্তঃপরীক্ষায় দরিদ্র শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ শতভাগ নিশ্চিত করা।
৩। শিক্ষার্থীদের উন্নয়নে সমাজের শিক্ষিত ব্যক্তিদের স্বেচ্ছাসেবামুলক কাজে উদ্বুদ্ধ ও সম্পৃক্ত করা।
৪। শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করা।
৫। শিক্ষার্থীর সহায়তাকারীদের বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা বৃদ্ধি করা।
৬।
সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের সুবিধা প্রদানে সকল বিদ্যালয়কে বাধ্য করা।
হাজারো সমস্যাপীড়িত আমাদের এই দেশ। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও শিক্ষা এই অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন মেটাতেই হিমসীম খেতে হয় আমাদের দেশের অধিকাংশ দরিদ্র পরিবারের পিতামাতার। এই সকল সমাস্যায় যখন তারা হাবুডুবু খায় তখন তারা ভাবতেই পারে না সন্তানের শিক্ষার কথা। আর এভাবেই সময় গড়িয়ে যায় এবং হতভাগ্য শিশুটি একইভাবে পূর্ব পুরুষের দারিদ্রকে লালন করে চলে।
আমার ধারনা, সুবিধাবঞ্চিত ছেলেমেয়েদেরকে মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ করে দেয়া হলে, তারা এটাকে কাজে লাগিয়ে পরিপূর্ণভাবে উৎকর্ষতা লাভ করতে পারে।
এই সুবিধাবঞ্চিতদের জীবনে হাসি ফোটানোর জন্য আমাদের একটু ক্ষুদ্র সহযোগিতাই যথেষ্ট। আমরা প্রত্যেকে যদি স্বামর্থানূযায়ী এলাকা ভিত্তিক অন্তত একজন মাধ্যমিক/উচ্চ মাধ্যমিক মেধাবী শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নিই তাহলে তার জীবনটা হতে পারে সম্ভাবনাময়। আমাদের এই সামান্য আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমরা যেমন সমাজের জন্য একটা বড় কাজ করতে পারি। তেমনি গড়ে তুলতে পারি আত্মত্যাগী কিছু মানুষ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।