ইরানের দিনগুলো - ১ , ২ , ৩ , ৪ , ৫ , ৬ , ৭ , ৮ , ৯
প্রতিযোগিতা আর তার ফলাফল নিয়ে বলেছি, পুরস্কার নিয়েই কিছু বলা হয়নি। যারা প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় হয়েছিল প্রত্যেকের জন্য পুরস্কার হিসেবে ছিল বিখ্যাত ইরানী কার্পেট। বহন করার সুবিধার্থে কার্পেটগুলো ভাঁজ করে কম্বলের প্যাকেটে করে দিয়েছিল। আকারে ছোট হলেও এগুলো ছিল হাতে বানানো সবচেয়ে ভালো মানের কার্পেট। এটা নিশ্চিত হয়েছিলাম ইরানবাসী সেই বাঙালী মহিলার কাছ থেকে।
উনি একদিন আমাদের রুমে এসে কার্পেটগুলো দেখে বলেছিলেন, এটাই সবচেয়ে ভালো মানের কার্পেট, হাতে বানানো, মেশিনে বানানোগুলোর মান ভালো হয় না, আর সেগুলো কমদামী।
আমাদের সার্টিফিকেটটাও ছিল বিশাল আর লেদার দিয়ে মোড়ানো।
পুরস্কার ছাড়াও সবাইকেই কিছু উপহার দেয়া হয়েছিল। তার মধ্যে ছিল একটা সবুজ ভেলভেটের বক্সের ভিতর একটা কুরআন শরীফ। এছাড়া ফুলের ছবিওয়ালা কয়েকটা গ্রিটিং কার্ড আর একটা ছোট্ট সুন্দর ডাইরীও দিয়েছিল।
ঐ ডাইরীতে সবাই বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগীদের নাম ঠিকানা লিখে নিচ্ছিল। আমার কাছ থেকেও অনেকে আমার নাম ঠিকানা লিখিয়ে নিল। যদিও এদের কেউই আমার সাথে আর যোগাযোগ করেনি। আমিও কয়েকজনের নাম ঠিকানা নিলাম। বিশেষ করে শ্রীলংকার মেয়েদের সবার ঠিকানা নিলাম।
এদের সাথেই সবচেয়ে বেশি কথা হত। শ্রীলংকার সুপারভাইজার তার মেয়ের নাম ঠিকানাও দিয়ে দিলেন। বললেন, আমার মেয়ে তোমার বয়সীই, তুমি ওকে চিঠি লিখলে ও খুশী হবে। আফসুস, কেউ কথা রাখেনি। এই সুপারভাইজারের মেয়েকে আমি চিঠি দিয়েছিলাম, সে কোন উত্তর দেয়নি।
শ্রীলংকার ক্বারীয়াকে নিয়ে তো আরেক কাহিনী হয়েছিল। তাকে চিঠি দেয়ার পর প্রথমে একটা বিশাল চিঠি নিয়ে উত্তর পেলাম তার কাজিনের কাছ থেকে। যাকে চিঠি দিয়েছি তার নামে নানান রকম তথ্য দিয়ে সে জানাল যে সে আর চিঠি লিখতে পারবে না, তাই এই কাজিন আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চায়। মেজাজটা এমন খারাপ হয়েছিল। আমি কোন উত্তর দিইনি।
এরপর আরেক কাহিনী। ঐ মেয়েই আমাকে উত্তর দিল। সে আমার চিঠি পেয়ে খুব খুশী। এরপর নিজের সম্পর্কে যা যা তথ্য দিল তার কোনটাই ঐ কাজিনের কথার সাথে মিলে না। এইবার আমি উত্তর দিলাম, ঐ কাজিনের চিঠির কথা উল্লেখ করে।
আর কোন উত্তর পাইনি। এই কাহিনী এখানেই শেষ।
যা বলছিলাম। লদানের কাছে একটা ছোট রাইটিং প্যাড থাকত সব সময়। সে ছিল ফ্রিল্যান্সার সাংবাদিক, একটা স্কুলের শিক্ষক আর পার্টটাইম দোভাষী।
তো সেই রাইটিং প্যাডে সে আমাদের সবার নাম ঠিকানাই লিখে নিয়েছিল। আমিও তার নাম ঠিকানা আমার ডাইরীতে লিখে নিলাম। দেশে ফিরে একদিন পরেই তাকে চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু কোন উত্তর পাইনি। মন খারাপই হয়েছিল, লদানের তো এমন করার কথা না।
অবাক কান্ড হল, প্রায় দেড় বছর পর ঐ চিঠি আবার আমার কাছে ফেরৎ এল। তার মানে লদানের হাতে এই চিঠি পৌঁছায়ইনি।
এর ছয় বছর পর কী মনে করে যেন আবারও লদানের এই ঠিকানায় একটা চিঠি দিলাম। উত্তরের কোন আশাই করিনি। কিন্তু আবারও আমাকে অবাক করে দিয়ে এইবার লদানের উত্তর পেলাম।
সেও আমার চিঠি পেয়ে বিশ্বাস করতে পারছিল না এতদিন পরেও আমি চিঠি দিতে পারি। যা হোক, কাহিনী হল লদানের পরিবার ঐ সময়ই বাসা বদল করেছিল, এইজন্য ঐ আগে চিঠি তার হাতে পৌঁছায়নি। এইবার চিঠিটা এমন এক পুরনো প্রতিবেশীর হাতে পড়েছিল যে ইংরেজী বোঝে। তাই সে চিঠিটা রেখে দিয়েছিল, পরে লদানের সাথে দেখা হওয়াতে হস্তান্তর করেছিল। যা হোক, এই চিঠিতে লদান তার ই-মেইল অ্যাড্রেসসহ ফেসবুক আইডিও দিয়ে দিয়েছিল।
আর আমাদের পায় কে? এখনও তার সাথে যোগাযোগ হচ্ছে ফেসবুকের কল্যাণে।
দেশ থেকে রওনা দেয়ার সময় মেজপা আমাকে দুই জোড়া কানের দুল দিয়ে বলেছিল যেন কাউকে উপহার দিই। লদানকে দিয়েছিলাম এক জোড়া। যেদিন ওর হাতে দিয়েছিলাম সেদিনই সকালে আমরা শপিং-এ গিয়েছিলাম। লদান ভেবেছিল ওখান থেকেই কিনেছি, প্রথমে তাই নিতেই চাচ্ছিল না।
পরে বললাম, এটা বাংলাদেশ থেকে আনা। তখন সাথে সাথে খুব খুশি হয়ে নিয়ে নিল। এর পরের দিন দেখি সে একটা প্যাকেট নিয়ে আমাদের রুমে হাজির। প্যাকেট খুলে বের হল একটা মাটির দেয়াল ফুলদানী। ডিজাইনটা খুবই অদ্ভূত।
একটা জুতা পরা পা, জুতার সামনের অংশ ছেঁড়া, ছেঁড়া অংশ দিয়ে পায়ের আঙ্গুলগুলো বের হয়ে আছে। লদান বলল, এটা আমার পক্ষ থেকে তোমাদের তিনজনের জন্য। তিনজন তো আর একটা ফুলদানী ভাগাভাগি করে নিতে পারি না, অন্য দুজনের কেউই এটা রাখতে চাইল না, তাই আমার কাছেই থাকল। অনেক দিন আম্মার ড্রইংরুমের দেয়ালে এটা টাঙানো ছিল। একদিন হঠাৎ পড়ে ভেঙে গিয়েছে।
একদিন সকালের নাস্তার সময় ইরানের এক প্রতিযোগী এসে খালাম্মাকে একটা রঙীন ফিতা কেটে বানানো প্রজাপতি দিয়ে বলল, এটা আমি আপনার জন্য কাল রাতে বানিয়েছি। খালাম্মা খুব খুশি হয়ে নিলেন, কিন্তু পরে রুমে এসে বললেন, এটা বাচ্চাদের জিনিস আমি নিয়ে কী করব, তুমিই নিয়ে যাও। অতএব এটাও আমার স্যুটকেসেই ঢুকল। এটা মনে হয় এখনও আমার পুরনো আলমারীতে আছে। অবশ্য আঠা শুকিয়ে ফিতাগুলো আলগা হয়ে গিয়েছে।
আমাদের একটা করে সাইড ব্যাগও দেয়া হয়েছিল। দেশে ফেরার সময় সবার কার্পেট আর সাইডব্যাগগুলো একসাথে বেঁধে একটা পোটলা করে আনা হয়েছিল। এছাড়া প্রতিযোগীদের সবাইকে একটা করে ভিডিও ক্যাসেট দেয়া হয়েছিল যেখানে উদ্বোধনী আর সমাপনী অনুষ্ঠানসহ যার যার পারফর্মেন্সের ভিডিও ছিল।
আমাদের আরেকটা খুব সুন্দর উপহার দেয়া হয়েছিল। সেটা হল একটা অ্যালবাম, যেখানে ওদের অফিসিয়াল ফটোগ্রাফারের তোলা গ্রুপ ফটোগুলোসহ প্রত্যেক প্রতিযোগীর ছবি দেয়া হয়েছিল।
একদিন দুপুরের খাওয়ার পর ফটোগ্রাফার সবাইকে নিয়ে বাগানে গেল। সেখানে একজন একজন করে প্রত্যেক প্রতিযোগীর ছবি তোলা হচ্ছিল। শুরুতে শুরুতে সব ঠিকঠাকমতই হচ্ছিল। হঠাৎ একজন প্রতিযোগী ছবি তুলতে গিয়ে হাসতে হাসতে হেঁচকি তুলে ফেলল। কাহিনী কী বোঝা গেল না।
কিন্তু দেখা গেল যতবারই সে স্থির হয়ে দাঁড়ায়, যখনই ছবি তুলতে যাবে তখনই সে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। বহু কষ্টে অবশেষে তার ছবিটা তোলা গেল।
কিন্তু দেখা গেল ততক্ষণে ব্যাপারটা সংক্রামক ব্যাধির মত ছড়িয়ে পড়েছে। এরপর যে-ই ছবি তোলার জন্য দাঁড়ায় হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। কাহিনী কী বুঝলাম না।
আমার রুমমেটও একই কাহিনী করল। শেষে যখন আমি গিয়ে দাঁড়ালাম, তখন বুঝলাম কাহিনীটা কী। গিয়ে দাঁড়াতেই দেখি লদান সবার পিছনে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ পাকাচ্ছে। ওই কার্টুনমার্কা ভঙ্গী দেখে হাসি চাপা মুশকিল। সে কিন্তু সাথে সাথে লুকিয়ে পড়েছে, কেউ আর জানছে না যে সেই আসল দুষ্টুমিটা করছে।
এর মধ্যে শ্রীলংকার সুপারভাইজারের সাথে আমার চোখাচোখি হওয়ায় উনি মনে করলেন যে তাকে দেখে হাসছি। বললেন, আমি বরং লুকিয়ে যাই। উনি লুকালে আর কী হবে, আসল দুষ্টুটা তো একটু পর পর চোখ পাকিয়েই যাচ্ছে। ফটোগ্রাফারের তখন ছাইড়া দে মা কাইন্দা বাঁচি অবস্থা। যা হোক, লদানের কাছ থেকে চোখ সরিয়ে হাসি চাপার চেষ্টা করে ছবি তুললাম।
যদিও মিটিমিটি হাসি দিয়েই যাচ্ছিলাম, ঐটা আর বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।
লদানের সাথে আমাদের সম্পর্কটা খুব সুন্দর ছিল। সে আমাদের খুব যত্ন নিত। একবার মিউজিয়ামে বেড়াতে যাওয়ার সময় খালাম্মা বললেন, তোমরা দুজন ঘুরে আসো, আমি আজকে বিশ্রাম নিই। পরে লদান শুধু আমাদের দুজনকে দেখে জানতে চাইল খালাম্মা আসবেন না কেন? বললাম, খালাম্মা আজকে বিশ্রাম নিবেন।
লদান খুবই টেনশনে পড়ে গেল কী হয়েছে। পরে তাকে শান্ত করতেই বললাম, খালাম্মার মাথাব্যথা করছে। লদান সাথে সাথে কোত্থেকে দুইটা প্যারাসিটামল ট্যাবলেট নিয়ে এল খালাম্মার জন্য।
একবার আমার কাছ থেকে কয়েকটা বাংলা কথা শিখে নিল লদান। যেগুলো প্রতিদিন বলা হয় আমাদের সাথে।
যেমন, চলুন বাসে উঠি, আসুন বাস থেকে নামি, ধন্যবাদ, সুপ্রভাত, কেমন আছেন? - এইসব কথা। শিখিয়ে দেয়ার পর সেগুলো ব্যবহারও করতে থাকল। তবে মাঝে মাঝে একটু গুলিয়ে ফেলত। একবার বাস থেকে নামার সময় সে বলল, চলুন বাসে উঠি। খালাম্মা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তে পড়তে কোনমতে সামলালেন।
লদান খুব অবাক হয়ে বললে, কী হয়েছে? পরে আমি ওকে বললাম যে ও উল্টা কথা বলছে। বেচারী খুব লজ্জা পেয়ে গিয়েছিল।
আরেক গাইড মারজানও আমার কাছ থেকে কিছু বাংলা শিখে নিয়েছিল, সেটা আমার রুমমেটের প্রতিযোগিতার জন্য। হিফজ প্রতিযোগিতার সময় ভুল করলে তাকে থামিয়ে আবার শুরু করতে বলা হয়, এই কথাগুলো ফারসি, আরবি বা ইংরেজীতে বললে রুমমেট বুঝবে না, এইজন্য এইটুকু বাংলা শিখিয়ে দিতে হয়েছিল মারজানকে।
আমরা যেদিন বাংলাদেশী হাইকমিশনারের বাড়িতে দাওয়াত খেলাম, সেদিন আমাদের ফিরতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল।
পরের দিন সকালে নাস্তার সময় খালাম্মা বললেন, কালকে তোমার বাসায় সবাই খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল, তাই না? লদান খুব মন খারাপ করে বলল, হ্যাঁ সবাই টেনশন করছিল, এত দেরী তো কখনও হয় না। খালাম্মা বললেন, তুমি বাসার সবাইকে খুব মিস কর সারাদিন, তাই না? লদান আরও মন খারাপ করে বলল, হ্যাঁ, তা তো করিই। খালাম্মা তখন বললেন, শোন, মনে কর আমি তোমার আরেক মা, আর এরা দুইজন তোমার দুই ছোট বোন, যতক্ষণ আমাদের সাথে থাকবে মনে করে নিবে যে তোমার আরেক পরিবারের সাথেই আছ তুমি। এইবার লদানের মুখে হাসি ফুটল। আমাদেরকে জড়িয়ে ধরল।
আর অন্য সব গাইডদের ডেকে ডেকে বলতে থাকল, এই দেখ আমার নতুন পরিবার।
মাশহাদে লদানের যাওয়ার কথা থাকলেও একটা সমস্যার কারণে যেতে পারেনি আমাদের সাথে। ওখানে গিয়ে আরেক গাইড মারজান আমাকে এক সময় বলছিল, আমি বুঝতে পারছি তোমরা লদানকে মিস করছ, লদানও তোমাদের মিস করছে, ও তোমাদের অনেক বেশি ভালোবাসে, যখনই আমরা একসাথে বসে গল্প করি ও সারাক্ষণ তোমাদের কথা বলতে থাকে।
মাশহাদে রওনা দেয়ার সময় লদানের মত অন্য যেসব গাইড যায়নি, সবাই বিদায় নিয়ে নিচ্ছিল, কারণ আর দেখা হবে না ওদের সাথে। সবাইকেই দেখলাম খুব কান্নাকাটি করতে।
লদান তো ভয়েই সেদিন দূরে দূরে রইল। ওর সাথে ভালো করে বিদায়টুকুও নিতে পারলাম না। বাসে উঠে বারবার ওর দিকে তাকাচ্ছি, সে কিছুতেই তাকায় না, ইচ্ছা করে মুখ ঘুরিয়ে রাখে। একবার চোখাচোখি হওয়াতে দেখলাম জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করল। কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করছিল সে।
যখন বাস ছেড়ে দিল, তখন সে তাকিয়ে হাত নাড়ল শুধু, আমি জানি চোখের পানি সে আর আটকাতে পারেনি।
আরও কত কথাই না মনে পড়ে। আরেক পর্বে বলি।
চলবে.............
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।