স্বাধীনতা, সে তো আমার প্রিয় মানুষের এক সাগর রক্তের বিনিময়ে কেনা
ইরানের পরমানু কর্মসুচি নিয়ে সংকট প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে! আর ইরান-যুক্তরাস্ট্র বিরোধ প্রায় গত ৩৫ বছর ধরে ! এই দুই দেশের বিরোধ ও সংকটের ইতিহাস যাদের জানা আছে তারা নিশ্চয় আজ ভোরে ইরান ও ছয় বিশ্ব শক্তির মধ্যকার সম্পাদিত সমঝোতার দিকে চোখ রেখেছেন । এই সমঝোতার মাধ্যমে ইরান ও ছয় বিশ্বশক্তি বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম একটি মাইল ফলক স্থাপন করলেন । আলোচনার মাধ্যমে সবকিছুরই সমাধান সম্ভব সেটা শুধু বুঝেন না আমাদের হাসিনা ও খালেদা !
বিশেষ করে ইরান ও যুক্তরাস্ট্রের বিরোধ কারো অজানা নয় আর এই দুই দেশের বিরোধ শুধু ইরানের পরমানু কর্মসুচিতে সীমাবদ্ধ ছিল না । এ বিরোধের ইতিহাস অনেক পুরনো। সেই ১৯৭৯ সাল ইরানের ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে এক বিপ্লবে যুক্তরাস্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের অন্যতম সেবাদাস, মিত্র রেজা শাহ পাহলভির পতনের মাধ্যমেই সূত্রপাত হয়েছিল।
রেজা শাহ পাহলভির পতন যুক্তরাস্ট্র কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি । এর ফলাফল তৎকালীন ইরানি ছাত্ররা মার্কিন দুতাবাস দখল করে যুক্তরাস্ট্রকে উচিৎ শিক্ষা দিয়েছিল! যুক্তরাস্ট্র কমান্ডো্ বিমান পাঠিয়েও কুল কিনারা পায়নি ! যুক্তরাস্ট্র এর প্রতিশো্ধ হিসাবে সৌদি আরব ও অন্যান্য রাজতান্ত্রিক, স্বৈরশাসক আরবদের সহায়তায় ইরাকের সাদ্দামকে লেলিয়ে দিয়েছিল ইরান আক্রমনে । সেই ইতিহাসও সবার জানা ।
ইরান-যুক্তরাস্ট্র বিরোধ কি রকম তার একটা উদাহরণ দেই । ইরানে এখন পর্যন্ত প্রতি জুম্মার নামাজে ইরানের মুসল্লিরা যুক্তরাস্ট্র নিপাত যাক ও ইসরায়েল ধ্বংস হোক বলে স্লোগান দেয় আর তাদের বিপ্লবের বিভিন্ন বার্ষিকিতে তারা যুক্তরাস্ট্র ধ্বংস হোক বলে মিছিলও বের করে! বিশ্বের আর কোনো দেশে প্রকাশ্যে এরকমটি করা হয় বলে জানা নেই ।
তো যুক্তরাস্ট্র সেই ১৯৭৯ সাল থেকে এমন কোনো চেষ্টা বা হীন চেষ্টা করেনি ইরানের বর্তমান শাসনযন্ত্রকে উৎখাত করতে আর এটাই ছিল স্বাভাবিক । আর সর্বশেষ যুক্তরাস্ট্র ইরানকে ঘায়েল করতে ব্যবহার করতেছিল ইরানের পরমানু কর্মসুচি । এজন্য যুক্তরাস্ট্র, ইউ, জাতিসংঘ কতশত অবরোধ আরোপ করেছে তার হিসাব নেই ! কিন্তু ইরানও পিছিয়ে ছিল না। নিত্য নতুন কলা কৌশল প্রয়োগ ও যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসাবে আধুনিক সমারা্স্ত্র শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ঈর্ষনীয় সাফল্য, ইরানি জনমত ও জাতীয়তাবোধ যুক্তরাস্ট্র, ইসরায়েলকে বিরত রেখেছে ইরান আক্রমনে ।
যে দেশ প্রকাশ্যে যুক্তরাস্ট্রের ধ্বংস কামনা করে সেই দেশের সাথে বিশ্বের একমাত্র সুপার পাওয়ার যুক্তরাস্ট্র কোনো সম্মানজনক সমঝোতায় বা চুক্তিতে উপনীত হবে -এটা ছিল কল্পনারও অতীত ! কিন্তু বর্তমানে বিষ্ময়করভাবে হলেও সেটাই ঘটেছে।
ইরানিরা যুক্তরাস্ট্রকে ভাল করেই চিনে। বুশের বিপরীতে তারা নির্বাচিত করেছিল আহমাদিনেজাদকে আর এবার ওবামার বিপরীতে রোহানি ! চুক্তির এগ্রিমেন্টটি পড়লে বুঝা যায়-ছয় বিশ্বশক্তি ইরানের দাবির কাছে নি:সন্দেহে মাথা নতই করেছে! ইরান শুধু ছয় মাসের জন্য ২০% ইউরেনিয়াম পরিশোধন করা বন্ধ রাখবে, তবে ৫% ইউরেনিয়াম পরিশোধন করতে পারবে, কোনো নিউক্লিয়ার স্থাপনা বন্ধ করবেনা ও এর উন্নয়ন কাজও থেমে থাকবে না। এর বিনিময়ে যুক্তরাস্ট্র, ইউ, জাতিসংঘ ইরানের উপর থেকে পেট্রোলিয়াম অবরোধ প্রত্যাহার, বিদেশী ব্যাংকে ইরানের গচ্ছিত সম্পদ ফেরতসহ আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবে। যে যুক্তরাস্ট্র ইরানকে কোনো পরমানু কর্মসুচিই চালাতে দিবে না বলে সংকল্প করেছিল সেই যুক্তরাস্ট্রের ইরানের পরমানু কর্মসুচি মেনে নেওয়া -এটাকে ইরানের এক মহাবিজয় বলা যেতে পারে! এরই সাথে নি:সন্দেহে সবচেয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছে ইসরায়েল ও সৌদি আরব! সমঝোতার পরপরই নেতানিয়াহুর উক্তি-’ It's a great mistake in history for ever...এটা একটা খারাপ চুক্তি। ইরানিরা যা চেয়েছে তাই পেয়েছে।
’
ইরানিদের জয় শুধু পরমানু কর্মসুচিতে নয়-সিরিয়াতে ইরান রাশিয়া অক্ষের জয়। একদিকে সকল আরব, তুরস্ক, যুক্তরাস্ট্র, আল কায়েদা, পুরো ইউরোপ আর অন্যদিকে শুধু ইরান ও রাশিয়া আর মৌন চীন । তো ইরান-রাশিয়া অক্ষও শেষ পর্যন্ত সিরিয়াতে জয়ী হলো । এর সুফল এখন ইরান রাশিয়া ঘরে তুলবে।
প্রশ্ন: যুক্তরাস্ট্র কেন এ চুক্তি করতে বাধ্য হলো ?
ইরানের শত্রু সাদ্দামকে তাড়ালো আমেরিকা কিন্তু আমেরিকার জন্য অত্যন্ত দু:খের বিষয় সেই ইরাক এখন ইরানের নিয়ন্ত্রনে।
ইরাক আমেরিকার চেয়ে ইরানের কথাই বেশি শুনে। একই ঘটনা ঘটতেছে আফগানিস্থানে। কারজাই সরকারের সাথে ইরানের দহরম মহরমও কম নয়। আফগানিস্থানে যুক্তরাস্ট্র এখন সম্মানজনক বিদায় চায় সেখানে ইরানর সহায়তা অবশ্যই দরকার।
শুধু তাই নয় , মধ্যপ্রাচ্যের সংকটগুলিতে ইরান প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত যেমন জড়িত যুক্তরাস্ট্র।
এখানে ইসরায়েল সৌদিও খেলোয়ার। তবে তারা উভয় ইরানের কাছে পরাজিত হয়েছে বিশেষ করে সিরিয়া, হামাস ও হিজবুল্লাহ ইস্যুতে। যাইহোক-আমেরিকার অর্থনৈতিক অবস্থাও ভাল না । ওবামা নিজেই বলেছেন-ইরানের সাথে এখন চুক্তি না করার অর্থ আমাদেরকে ইরানের সাথে যুদ্ধ করতে হবে।
আর বিশ্বে যুক্তরাস্ট্রের আধিপত্য আর আগের মত নেই ।
যুক্তরাস্ট্রের অবরোধও খুব একটা কাজে আসছে না । এছাড়া, মার্কিন ও ইউরোপিয়ান কোম্পানিগুলো ইরান ঢোকার জন্য তাদের নিজ নিজ সরকারকে চাপ দিচ্ছে । এটাও একটা কারণ।
আর ইরানের যে রেভ্যুলুশনারি যে গার্ড আছে যুক্তরাস্ট্র এখন চাচ্ছে তার সাথে সম্পর্ক বাড়াতে। বিশেষ যুক্তরাস্ট্রকে এটা করতে হবে ইরানর সামরিক শক্তি ঈর্ষনীয় বৃদ্ধির কারণে।
এটা করতে না পারলে পারসিয়ান উপসাগরে যুক্তরাস্ট্রের স্বার্থ ক্ষুন্ন হবে ।
আরো অনেক বিষয় জড়িত আছে। যেমন বিশ্বে চীনের আধিপত্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। সবচেয়ে অবাক করার বিষয়-যুক্তরাস্ট্র এই প্রথমবার ইসরায়েলের কথায় কান দিল না !
যাইহোক-মূল কথা-যুক্তরাস্ট্র ইরানরে সাথে চুক্তি না করলে যুক্তরাস্ট্রকে সামরিক পথে অগ্রসর হতে হত যা যুক্তরাস্ট্রের জন্য আরো বেশি ভয়ংকর ও বিপর্যয় সৃষ্টি করত । এরচেয়ে শান্তিপূর্ণ পরমানু কর্মসুচির অধিকারী ইরান যুক্তরাস্ট্রের জন্য অনেক অনেক বেটার।
আমার মতে সমঝোতা ইরান ও যুক্তরাস্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ । আমেরিকার এক ইউনিভার্সিটি প্রফেসর যিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তিনি একটা আর্টিকেলে লিখেছেন- যুক্তরাস্ট্র এখন যে কাজটা করবে ধীরে ধীরে ইরানের সব দাবি মেনে নিবে। একসময় ইরানের সাথে যুক্তরাস্ট্রের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হবে। যুক্তরাস্ট্র তখন ধীরে ধীরে ইরানর প্রশাসনে ঢুকবে, বিশেষ করে সামরিক বাহিনীতে। ইরানের জেনারেলদের ছেলে মেয়ের জন্য যুক্তরাস্ট্র নাকি তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা সুবিধা দিবে।
এরপর ইরানের সামরিক বাহিনীকে যুক্তরাস্ট্র নিজ দেশে বিভিন্ন কাজ পাইয়ে দিবে। মানে বিনিয়োগসহ বিভিন্ন ইস্যুতে। আর যুক্তরাস্ট্রও একই কাজ করবে ইরানর ভেতরে ইনভেস্ট করবে। এতে যুক্তরাস্ট্র ও ইরান একসময় পরষ্পর নির্ভরশীল হয়ে যাবে। তখন ইরানি নেতারা আর ততটা যুক্তরাস্ট্রের বিষোদগার করবেন না নিজ স্বার্থেই এর কারণ হিসাবে উনি উল্লেখ করেছেন যুক্তরাস্ট্র আর সৌদি ও পাকিস্থানকে পছন্দ করতেছে না ।
কিন্তু আমার কথা এরকমটা হলে দোষ কোথায় ? তুরস্ক, মিসর সবাই তো ব্যবসা করতেছে যুক্তরাস্ট্রের সাথে। যুক্তরাস্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সাথেও যুক্তরাস্ট্রের অর্থনৈতিক সম্পর্ক । ব্যবসা এক জিনিস আর আদর্শ আর এক জিনিস। তবে যুক্তরাস্ট্র ব্যবসায়ই করুক আর যাই করুক -ইরানকে আরবদের মত ডমিনেট করতে পারবে না ও আরবদের মত ইরানিরা কখনো যুক্তরাস্ট্রের সেবাদাসও হবে না, আর ইরানরে বর্তমান শাসনযন্ত্র একটা আদর্শের উপর ভিত্তি করে দাড়িয়ে । এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য আপনি যদি যান ১৯৫৩ সালের ইরানিয়ান বিপ্লবে।
৫৬ সালে সেই বিপ্লব যুক্তরাস্ট্র ক্যু করে ছিনিয়ে নেয় আর ৭৯ সালে ইরানিরা আবার বিপ্লব ঘটায় । সেই বিপ্লবে যুক্তরাস্ট্রের গালে এক বড়সড় চড় দেয় যা যুক্তরাস্ট্রের সেই ব্যথা এখনো আছে।
যাইহোক, ইরান ও বিশ্বশক্তির সমঝোতা বিশ্বের বিভিন্ন সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ বাতলে দিবে বলে প্রত্যাশা করি। বিশেষ করে অশান্ত মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সংকটের হয়তো শান্তিপূর্ণ সমাধান ও সুবাতাস বয়ে যেতে পারে সেই সাথে এই সমঝোতা আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটেরও একটি দিক নির্দেশনা হতে পারে, কিন্তু হাসিনা ও খালেদা কি এই খবরগুলো রাখেন ? নাকি এখান থেকে কিছু শিখবেন কিভাবে সমঝোতা করতে হয় ও কিভাবে সম্মানজনকভাবে তুলনামুলক শক্তিশালি রাস্ট্রের কাছ থেকে অধিকার আদায় করতে হয় ?নাকি শুধু নিজেরা নিজেরা চুলোচুলি করে মরব ?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।