আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইরানের দিনগুলো - ২

ইরানের দিনগুলো - ১ যাত্রাপথে কী কী হয়েছিল ডাইরীতে মোটামুটি লিখে রেখেছিলাম। কোন কাজ ছিল না, তাই একটু পর পর ডাইরী বের করি আর লিখি। এয়ার হোস্টেজ সবাইকে ড্রিংকস দিচ্ছিল। সামনের এক লোক কি জানি নিল, হার্ড ড্রিংকসই হবে। আমার কাছে এসে কী নিব জানতে চাইলে প্রথমে বোকার মত চা খেতে চাইলাম।

জানাল যে চা দেয়া হবে লাঞ্চের পর, এখন চাইলে জুস খেতে পারি। কমলার জুস নিলাম আমার আর আমার সাথের প্রতিযোগিনীর জন্য। বরফ দিতে চাইলে মানা করে দিলাম। বরফ ছাড়াই যে ঠান্ডা, খেয়ে গলা খুসখুস শুরু হয়ে গিয়েছিল। লাঞ্চের সময় খাবার দিতে এলে কেন যেন আরও বোকা হয়ে গিয়েছিলাম।

চিকেন আমার প্রিয়, অথচ আমি নিলাম মাছ-ভাত। তাও যদি মজার রান্না হত। অর্ধেকও মনে হয় খেতে পারিনি। অবশ্য আমার আরেকজন সহ-প্রতিযোগী (মোটামুটি রাক্ষসের মতই খেতে পারে) আমার দুরবস্থা দেখে প্লেট খালি করতে সাহায্য করল। আমার খাওয়া কম হয়েছে এটা নিয়ে সমস্যা হয়নি।

টেনশন আর উত্তেজনা সব মিলিয়ে ক্ষুধাবোধ টের পাচ্ছিলাম না। পাশের প্রতিযোগিনী (সে ক্বুরআনের হাফিজা) আমার চেয়েও বেশি উত্তেজিত। কিছুক্ষণ পর পর শুধু বলছিল, কী আজব! আমরা আকাশে উড়ে যাচ্ছি। করাচী এয়ারপোর্টে কী যন্ত্রণার মধ্যে পড়েছিলাম সেটা ডাইরীতে লিখে রেখেছি। একটা অদ্ভূত ব্যাপার হল, অনেক কিছু মনে থাকলেও এই কষ্টটুকুর কথা এখন খুব একটা মনে পড়ছে না।

অথচ ডাইরীর লেখা দেখে বুঝতে পারছি অসহ্য লাগছিল ঐ সময়। এরকমই হয়, যে কোন ভ্রমণের কষ্টের অংশটুকু ভুলে গিয়ে আনন্দটুকুই মনে থাকে। এই অংশটুকুর সাথে তাই আর কিছু যোগ করতে পারলাম না। যা হোক, সব কষ্ট আর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আমরা ইরানে রওনা দিলাম। তেহরানে ল্যান্ড করার পর প্লেন থেকে নামার সময় আমাদের পাসপোর্ট বারবার চেক করা হচ্ছিল নিশ্চিত করতে যে আমরা সত্যি বাংলাদেশী নাকি ইন্ডিয়ান কিংবা আমরা ইন্ডিয়ায় ৬ দিনের কম সময় ছিলাম কিনা।

এর কারণ ছিল ঐ সময় ইন্ডিয়ায় প্লেগের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল আর সারা বিশ্বে এ নিয়ে আতংক ছড়িয়ে পড়েছিল। এরপর আমাদের এয়ারপোর্টে রিসিভ করা, হোটেল মারমারে নিয়ে যাওয়া আর আমার টানা সাড়ে ঊনত্রিশ ঘন্টা জেগে থাকার কথা ডাইরীতে লিখেছি। এরপর কেন যেন আর ডাইরীটা নিয়ে বসা হয়নি। এখন মনে হচ্ছে লেখাটা চালিয়ে গেলে খুব ভালো হত। এখন অনেক কিছুই মনে নেই।

দেখি চেষ্টা করে কতটুকু লিখতে পারি। ডাইরীটা লেখা শেষ করে রেখে দিতেই খালাম্মা (সুপারভাইজার) বললেন, তুমি একটু শোও তো, একটুও ঘুমাওনি তুমি, অসুস্থ হয়ে পড়বে তো। আমি বললাম, আমার তো ঘুম আসছে না। খালাম্মা একরকম জোর করেই শুইয়ে দিলেন। আর আমি শুয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম।

অবশ্য খুব বেশিক্ষণ ঘুমানো হয়নি। একটু পরেই আমাদের সকালের নাস্তার ডাক পড়ল। আমরা তৈরী হয়ে নেমে এলাম নীচে। ডাবল ডিম পোচ আর ব্রেড, এই হল নাস্তার মেনু। তাও আবার খেতে হবে কাঁটা চামচ দিয়ে।

আজব জ্বালা। পোচ ডিমের কুসুম কেমনে কাঁটা চামচ দিয়ে খায়? জানি না অন্যরা কিভাবে খেয়েছে, আমি শুধু সাদা অংশটুকুই খেলাম। আমার সেই খাদক সহ-প্রতিযোগী বড়ই আফসোসের দৃষ্টিতে আমার প্লেটের উজ্জ্বল কমলা দুইটা ডিমের কুসুমের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি তো কিছুই খেলে না। নাস্তার টেবিলেই আমাদের সাথে পরিচিত হল সবুজ কোট পরা একজন ভদ্রলোক। ইনিই হবেন বাংলাদেশের প্রতিযোগীদের গাইড।

নাম শাহরম। তার চেহারাটা কেন যেন চেনা চেনা লাগছিল। পরে খালাম্মা (যিনি বয়স্ক হলেও ভীষণ রসিক ছিলেন) মনে করিয়ে দিলেন, আমাদের এই গাইডের চেহারা একটা ইংলিশ কমেডি সিরিয়ালের চরিত্রের মত, "পারফেক্ট স্ট্রেঞ্জারস"-এর বাল্কি। এরপর যখনই খালাম্মা শাহরমকে নিয়ে কিছু বলতেন, তাকে বাল্কি নামেই অভিহিত করতেন আর খিক খিক করে হাসতেন। যা হোক, আমাদের ডিজি স্যারের সাথে শাহরমের খুব খাতির হয়ে গেল।

সে খুব মাথা নেড়ে নেড়ে স্যারের সাথে গল্প জুড়ে দিল। এদিকে পাশের টেবিলে আরেকজন গাইড একটা কাজে শাহরমকে ডাকছিল "অ্যায় অ্যায়" করে। কিন্তু শাহরম তখন গল্পে এতই মশগুল যে কোনদিকে মনোযোগ নেই। সেই গাইড একটু বিরক্ত হয়ে চড়া গলায় স্পষ্ট স্বরে ডেকে উঠল, "শাহরম!" এত জোরে নিজের নাম শুনে সে আক্ষরিক অর্থে লাফ দিয়ে উঠে জবাব দিল। মনে করেছিলাম এই হোটেলই হবে আমাদের আগামী দশদিনের বাসস্থান।

কিন্তু নাস্তা শেষে আমাদের আবার লাগেজ গুছিয়ে নিতে বলা হল। আমাদের থাকার জায়গা এখানে না, এখন নিয়ে যাওয়া হবে নির্ধারিত জায়গায়। আবারও সব গুছিয়ে নিয়ে বাসে উঠলাম। একটা ব্যাপার ছিল, বাসে ওঠার ব্যাপারে আমরা দুই পিচ্চি খুবই তৎপর থাকতাম সবার আগে ওঠার জন্য। সবচেয়ে ভালো সিটটা দখল করাই উদ্দেশ্য, এতে মোটামুটি সফলই ছিলাম।

বাসে যেতে যেতে রাস্তার দুই পাশের দৃশ্য গোগ্রাসে গিলতে থাকলাম। প্রথমবারের মত ফ্লাই-ওভার দেখে পুরাই মুগ্ধ। এখানে কাপড়ের দোকানগুলো ভারী আকর্ষণীয়। বড় কাঁচের দেয়ালের ঐপাশে ভীষন সুন্দর বিয়ের সাদা পোষাকগুলো সাজানো। একটা দোকানের নাম পড়ার চেষ্টা করলাম, ফারসি তো পড়তে পারি না, তবে দেখে আন্দাজ করলাম, নামটা ছিল "পোশাক"।

শাহরম তো এদিকে মোটামুটি তার গল্প চালিয়েই যাচ্ছে। আমিও একটু মনোযোগ দিয়ে শুনতে চাইলাম কী বলছে। শুনলাম সে একটা বড় ক্যাম্পাস দেখিয়ে বলল, এটা উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। একটা চৌরাস্তার সিগনালে বাস থামার পর সে বলল, সামনে দিয়ে যে রাস্তাটা গিয়েছে, এটা ইরানের সবচেয়ে দীর্ঘ রাস্তা। রাস্তায় অনেক যানবাহন থাকলেও ট্রাফিক জ্যাম তেমন একটা ছিল না।

অবশেষে শহরের কোলাহল ছেড়ে আমরা একটু নিরিবিলি এলাকায় ঢুকলাম। দেখলাম একপাশে উঁচু দেয়াল ঘেরা একটা বিশাল এলাকা। একটু খেয়াল করে দেখে মনে হল সম্ভবত সেটা ক্যান্টনমেন্ট এলাকা, দেয়াল ঘেঁষে একটু পর পর ওয়াচ টাওয়ার আছে, আর প্রতিটায় একজন করে সৈন্য পাহাড়া দিচ্ছে। রাস্তার অন্যদিকে একটা বাগান ঘেরা দালান, দুই বা তিনতলা ছিল, এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। এটাই আমাদের থাকার জায়গা।

প্রথমে হোটেল মনে করলেও পরে জেনেছি এটা ছিল টিচার্স ক্লাব। শিক্ষক সম্মেলনের সময় এখানে সারা দেশ থেকে শিক্ষকরা এসে থাকেন। এর নাম হল, "বাসগাহে ফারহানদিয়ান"। আমাদের সবার হাতে এই জায়গার ম্যাপসহ ঠিকানা লেখা একটা গোলাপী রঙের কার্ড দেয়া হয়েছিল যাতে কখনও কোথাও হারিয়ে গেলে কাউকে এই কার্ড দেখিয়ে এই জায়গায় ফিরে আসতে পারি। চলবে.............. ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.