ইরানের দিনগুলো - ১
ইরানের দিনগুলো - ২
ইরানের দিনগুলো - ৩
ইরানের দিনগুলো - ৪
ইরানের দিনগুলো - ৫
ইরানের দিনগুলো - ৬
ইরানের দিনগুলো - ৭
আজকে একটু মূল আলোচনায় আসি। মানে যে উদ্দেশ্য ইরানে যাত্রা করেছিলাম, সেই প্রতিযোগিতার কথায়। প্রতিযোগিতার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, লটারী এগুলো নিয়ে আগে বলেছি।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পরদিন সকালে শুধু মেয়েদের নিয়ে গেল অডিটোরিয়ামে। আজ এখানে গিয়ে একটা ধাক্কা খেলাম।
সবাই মেয়ে, প্রতিযোগী তো বটেই, গাইড, অনুষ্ঠান সঞ্চালক, দর্শকের সারিতে বেশ কয়েকটা মাদ্রাসা থেকে দলে দলে আসা মেয়েরা, এমন কি অনুষ্ঠানের ভিডিও ক্যামেরাম্যানও মেয়ে। মনটাই ভরে গেল। প্রতিযোগিতা শুরু হল। চারজন ক্বারীয়া ও চারজন হাফিজার প্রতিযোগিতা হবার কথা ছিল, কিন্তু সময়ের অভাবে দুইজন করে হল। প্রথম দিন কোন কোন দেশের প্রতিযোগিতা হয়েছিল অত মনে নেই, শুধু মনে আছে ইরানের ক্বারীয়া আর পাকিস্তানের হাফিজা ছিল।
ওদের তিলাওয়াত শুনে চুপসে গেলাম। আমি তো এদের ধারে-কাছেও যাই না। দ্বিতীয় দিন মালয়েশিয়ার ক্বারীয়ার তিলাওয়াত শুনে আরও চুপসে গেলাম। সাহস যা সামান্য ছিল প্রথম দুই দিনেই খতম। পুরস্কার পাওয়াতো অনেক দূরের কথা, এদের পাশাপাশি আমার মিনমিনে তিলাওয়াত শুনতে কেমন হাস্যকর লাগবে, সেটাই তখন চিন্তা।
সেই বাঙালীদের নিয়ম অনুযায়ী শেষ দিক থেকে প্রথম না হয়ে যাই। পরে অবশ্য পাকিস্তান আর শ্রীলংকার প্রতিযোগীদের তিলাওয়াত শুনে একটুখানি ভরসা পেলাম। ওরাও ভালো তিলাওয়াত করেছিল, তবে আমি মনে হয় অন্তত ওদের কাছাকাছি যেতে পারব।
দ্বিতীয় দিনের প্রতিযোগিতা শেষে বাসে উঠে মালয়েশিয়ার ক্বারীয়াকে অভিনন্দন জানালাম। বললাম, তোমার পারফর্মেন্স সবচেয়ে ভালো লাগল।
সে মিষ্টি হেসে ধন্যবাদ জানাল। সেদিন খবরের কাগজে আগের দিনের প্রতিযোগিতার কথা লিখেছিল। গাইডরা খুব উচ্ছ্বাসের সাথে খালাম্মাকে অনুবাদ করে শোনাল, এখানে লিখেছে, প্রথম দিনের প্রতিযোগিতায় ইরানের ক্বারীয়া সবচেয়ে ভালো পারফর্মেন্স করেছে। খালাম্মা বললেন, তাহলে কালকের কাগজে এই জায়গায় মালয়েশিয়ার নাম আসা উচিৎ। এই কথায় গাইডরা মনে হল একটু মন খারাপ করল।
ওহ, এর আগের দিন আবার আমাদের সেই গ্রুপ ছবিগুলো খবরের কাগজে এসেছিল।
সেই সাংবাদিক মেয়েটা একদিন আমাদের রুমে এল। সাথে দোভাষীর কাজ করার জন্য আমাদের গাইড লদান। আমার সাক্ষাৎকার নিল সেদিন। আমার নাম, বয়স, কোন ক্লাসে পড়ি এসব তথ্য নেয়ার পর জানতে চাইল ইরানে আসার সুযোগ পেয়ে কেমন লেগেছিল।
বললাম, বিশ্বাসই হচ্ছিল না। এই কথাটুকু লদানকে অনুবাদ করে দিতে হল না, সাংবাদিকটা হেসে বলল, এটা আমি বুঝতে পেরেছি। তারপর আমি প্রথম কত বছর বয়সে ক্বিরাত প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি জানতে চাইলে বললাম ৮-৯ বছর বয়সে। ভয় পেয়েছিলাম কি না সেটাও জানতে চাইল। বললাম, তখন তো ভয় পেয়েছিই, এখনও পাই।
এই প্রতিযোগিতার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কোন ব্যাপারটা সবচেয়ে ভালো লেগেছে সেটাও জানতে চাইল। আমি একটু চিন্তা করছি দেখে সে মনে করিয়ে দিল, ঐ যে উপর থেকে কুরআন নেমে আসছিল, সেটা? আমি বললাম, সেটাও ভালোই ছিল, তবে আমার কাছে ছোট্ট ছেলেটার কুরআন তিলাওয়াত সবচেয়ে ভালো লেগেছে। এই বয়সেই এত সুন্দর করে কিভাবে তিলাওয়াত করছিল সেটাই আমার কাছে অবাক লেগেছে। ইরান কেমন লাগছে জানতে চাইল। বললাম, অবশ্যই খুব ভালো লেগেছে, বিশেষ করে এখানকার মানুষদের আন্তরিকতা বেশি ভালো লেগেছে।
আর জানতে চাইল এই প্রতিযোগিতার ব্যাপারে আমার কী ধারণা? বললাম, এরকম প্রতিযোগিতা হওয়া ভালো, এতে করে কুরআন শিক্ষার প্রতি উৎসাহ বাড়বে, এইসব আর কি। আরও কী কী প্রশ্ন করেছিল এখন মনে নেই।
সেদিন শুধু প্রশ্নোত্তর পর্ব সেরেই চলে গিয়েছিল মেয়েটা। আরেকদিন সে এল একজন ফটোগ্রাফার নিয়ে। আমার রুমমেটরা তখন বিশ্রাম নিচ্ছে, আমিও শুয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।
সে বলল, একটু তৈরী হয়ে বাইরে আসো, তোমার ছবি তোলা হবে। আমি ঝটপট তৈরী হয়ে নিলাম। আমাদের রুমের বাইরের দেয়ালে একটা বড় পেইন্টিং ঝুলছিল। ওটার সামনে দাঁড়াতে বলল। আমি চুপচাপ দাঁড়ালাম।
কিন্তু তাদের আবার চুপচাপ ছবি তোলা পছন্দ না। বলল, তুমি কথা বলছ এরকম ছবি তোলা হবে, মনে কর তুমি সাক্ষাৎকার দিচ্ছ। কথা বলার সময় ছবি তোলা আমার একটুও পছন্দ না। আমি বললাম, কী বলব? বলল, যে মনে আসে বলতে থাকো। আমি আমার নাম-ধাম-বয়স বলতে থাকলাম।
বলতে গিয়ে এমন হাসি পাচ্ছিল যে হি হি করে হেসে দিলাম। আর ঐ সময়ই ছবিটা তোলা হল।
পরদিন কাগজে আমার ছবিসহ সাক্ষাৎকার ছাপা হল। আমি দাঁত কেলিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। গাইডরা আর অন্য দেশের সুপারভাইজাররা সবাই এসে বলতে থাকল, আরে তুমি তো হেব্বি একটা হাসি দিয়েছ।
আবার আমার বয়স নিয়েও সবাই হাসাহাসি শুরু করল। আমার বয়স বলেছি তের, আর ছাপায় ভুলের কারণে সেটা হয়েছে একশ তের। আমি নাকি একশ তের বছরের বুড়ি, তাই ফোকলা দাঁতে হাসছি।
আমার ছবির নীচেই শ্রীলংকার ক্বারীয়ার ছবিও দেয়া হয়েছিল। বোঝাই যাচ্ছে তাকেও ছবি তোলার সময় কথা বলতে বলা হয়েছে।
তার ছবিতে সে মুখটা বোয়াল মাছের মত হা করে আছে। এই কাগজের বেশ কিছু কপি দেশে নিয়ে এসেছিলাম। বাসায় সবাই দেখে বকা দিল, ছবি তোলার সময় এইভাবে দাঁত কেলায় নাকি? একটুও বুদ্ধি-শুদ্ধি নাই। আমি মনে মনে বলি, তাও তো দাঁত কেলানো ছবি আসছে, বোয়াল মাছের মত হা করা ছবি আসে নাই।
কাগজটা ফারসি কাগজ ছিল।
কাজেই কী কী লেখা আছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। লদানকে বলতে পারতাম। কিন্তু এর মধ্যে ইরানে দশ-বারো বছর ধরে আছে এমন এক ভদ্রমহিলার সাথে দেখা হল, তার স্বামী এখানে বিশ বছর ধরে আছে, রেডিও-র সাংবাদিক। উনার কাছেই কাগজটা দিলাম, বললাম, একটু বলেন না এখানে কী লিখেছে। পরে উনি যা বললেন তাতে বুঝলাম আমি ঐ সাংবাদিককে যা যা বলেছিলাম তা-ই হুবহু লেখা হয়েছে।
পরে দেশে এসে দেখলাম ইরানী দূতাবাসের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থেকেও একটা পত্রিকায় আমার ছবিসহ একটা সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে, কিন্তু শুধু আমার নাম, বয়স এই তথ্যগুলো ঠিক রেখে বাকী সব বানিয়ে বানিয়ে লিখে রেখেছে। এমন রাগটা লেগেছে না।
যে বাঙালী ভদ্রমহিলার কথা বলছিলাম, তার স্বামীও এই প্রতিযোগিতার খবর কাভার করার জন্য এসেছিলেন। প্রথমে একদিন রেডিও থেকে একজন বাঙালী ভদ্রমহিলা এলেন সাক্ষাৎকার নিতে। ঐ সময় খুব ভীড় আর হাউ-কাউ হচ্ছিল।
এর মধ্যেই টেপ রেকর্ডারে সাক্ষাৎকার নিয়ে গেলেন। পরে সেই ভদ্রলোক এসে জানালেন যে ঐ দিনের রেকর্ডে আমার কোন কথাই আসেনি। তাই একটা ভালো রেকর্ডার এনে তিনি আরেকদিন আমার সাক্ষাৎকার নিলেন। এইদিন লবিতে নিরিবিলি বসে সাক্ষাৎকার দিলাম। প্রথমেই নাম, বয়স জানার পর জানতে চাইলেন কোন স্কুলে কোন ক্লাসে পড়ি।
সেটাও বলার পর বললেন, ক্লাসে তোমার রোল কত? মর জ্বালা, এখন কি পড়া ধরা শুরু করবে না কি রে! বললাম, আমার রোল ২। সাথে সাথে যেন চাঁদ হাতে পেয়েছে এমন করে ভাবে গদ গদ হয়ে উনি বলতে থাকলেন, ওহ, আমরা তাহলে দেখতে পাচ্ছি আমাদের বাংলাদেশের প্রতিযোগী শুধু কুরআন তিলাওয়াতেই না, লেখাপড়াতেও অনেক ভালো। আমি হাসি চেপে পরের প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে গেলাম। যা হোক, এই সাক্ষাৎকারের প্রচার আমি নিজে না শুনলেও পরে জেনেছিলাম যে মিডল ইস্টে থাকা আমার কিছু আত্মীয় নাকি শুনেছিল।
আরেক দিন আমার সাক্ষাৎকার নেয়া হল টিভিতে।
অডিটোরিয়ামের পেছনে একটা ছোট্ট করে ভ্রাম্যমান স্টুডিও বানিয়ে সাক্ষাৎকার নেয়া হল। এইদিন আমার সাথে দোভাষী হিসেবে লদানও ছিল। টেনশন হচ্ছিল। খুব অল্প কিছু প্রশ্নের উপর দিয়েই গেল, উত্তরগুলোও সংক্ষেপে দিয়ে যাচ্ছিলাম। তবে পরে মনে হচ্ছিল যে উত্তরগুলো আরেকটু সুন্দর করে গুছিয়ে দেয়া যেত।
যা হোক, দুঃখের বিষয় হল এই সাক্ষাৎকারের প্রচারও আমি নিজে দেখতে পারিনি।
প্রতিযোগিতার গল্প এক পর্বে শেষ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু অনেক কথা এখনও বলা বাকী রয়ে গেল। পরের পর্বেই শেষ করি।
চলবে................
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।