ইরানের দিনগুলো - ১
ইরানের দিনগুলো - ২
ইরানের দিনগুলো - ৩
ইরানের দিনগুলো - ৪
এবার কী বিষয় দিয়ে শুরু করা যায় ভাবছি। ঘুরাঘুরি, খানা-পিনা, না কি প্রতিযোগিতা। ঘুরাঘুরি দিয়েই শুরু করি। ঐটাই ছিল এই ভ্রমণের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়।
আমাদের রুটিন ছিল সকালবেলার শিফটে মেয়েদের প্রতিযোগিতা হত, ঐ সময় ছেলেদের নিয়ে ঘুরতে যাওয়া হত।
আর বিকালের শিফটে ছেলেদের প্রতিযোগিতা আর মেয়েদের ঘুরাঘুরি সেই একই জায়গায়। এতে আমাদের মেয়েদের জন্য একটা সুবিধা ছিল, প্রতিযোগিতার যা কিছু টেনশনের ব্যাপার, সকালেই শেষ। বিকালে আরাম করে ঘুরাঘুরি করা যেত। তখন রোদ-গরমের ব্যাপারটাও থাকত না।
প্রথম দিন পার্ক, আন্ডারগ্রাউন্ড এ্যাকুইরিয়াম মিউজিয়াম আর দ্বিতীয় দিন পাহাড়ে টেলিকেবিনে বেড়ানোর কথা বলেছি।
এরপর থেকে শুরু হল মিউজিয়াম ঘুরে দেখানো। একটা মিউজিয়ামে গিয়ে একটু অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। অনেকগুলো নগ্ন ভাস্কর্য ছিল। ইরানীরা দেখলাম এতে খুবই অভ্যস্ত। আমি এগুলোর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাচ্ছিলাম।
তবে একটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে বাধ্য হলাম। এত সুন্দর ছিল মূর্তিটা। একজন মা কোলে একটা দুধের শিশুকে নিয়ে দুধ খাওয়াচ্ছে আর সামনে বসা আরও দুইটা যমজ বাচ্চা, এক বছর বয়সের হবে, তারা খাওয়ার জন্য পাখির ছানার মত হা করে আছে আর মা এক হাতে খাবার তুলে তাদের মুখের উপর ধরে আছে আর হাসছে। আমরা সবাই ঘুরে ঘুরে চারপাশ থেকে ভাস্কর্যটা দেখতে থাকলাম। মিউজিয়ামে ছবি তোলা নিষেধ বলে খুব মন খারাপ হচ্ছিল।
ঐ মিউজিয়ামে অনেক মূর্তির মধ্যে একটা হিন্দু দেবতার মূর্তিও ছিল। ওরা অবশ্য ওটার নাম জানত না। আমি জানিয়ে দিলাম, এটা গণেশের মূর্তি। বের হয়ে আসার সময় দেখলাম একটা স্যুভেনিরের দোকান। মালয়েশিয়ার প্রতিযোগী কয়েকটা পোস্টার কিনল ক্যালিগ্রাফির।
আমাদের গাইড লদানও দেখলাম টুক করে কি যেন কিনে নিল। পরে রাতে বিদায় জানানোর সময় সে আমার হাতে দুইটা ছবি ধরিয়ে দিল। দেখলাম সেই ভাস্কর্যের ছবি।
ইরানের রাজতন্ত্রের শেষ রাজা মোহাম্মদ রেজা শাহ্-এর পতনের পর তার ছয়টি প্রাসাদকে মিউজিয়ামে পরিণত করা হয়। এর মধ্যে বড় দুইটাতে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
দেখে ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। একেকটা প্রাসাদ আমাদের দেশের আহসান মঞ্জিলের সমান, ভিতরে আরও অনেক বেশি আলিশান করে সাজানো। এইরকম ছয় ছয়টা প্রাসাদ দিয়ে লোকটা করত কী? একেকটা ফার্নিচার একেক দেশ থেকে অর্ডার দিয়ে বানানো, তার ডিজাইনের যে কত বাহার। ঝাড়বাতিগুলোর একেকটাতেই মনে কয়েক হাজার টুকরো ক্রিস্টাল। নাহ বর্ণনা দিতে গেলে আর পারব না।
দোতলা না তিনতলা যেন ছিল প্রাসাদগুলো মনে নেই। বের হয়ে এসে সবাই মিলে প্রাসাদের সিড়িতে আবার সেই ফটোসেশন। এবারও সেই সাংবাদিক মেয়েটা ঝামেলা করলই। আমাকে টেনে সবার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল, এদিকে আমার পিছনে কয়েকজন একটু খাটো মেয়ে দাঁড়ানোয় তারা গেল ঢাকা পড়ে। ফটোগ্রাফারের ইশারা বুঝতে পেরে আমি নিজেই সরে একপাশে দাঁড়ালাম।
বাসে উঠতে যাব, তখন দেখলাম একটা পিচ্চি বাবুদের দল এসেছে, স্কুল ইউনিফর্ম পরা। লাইন ধরে সারিবদ্ধভাবে আসছে পুতুলের মত বাচ্চাগুলো, কোন হুড়াহুড়ি নেই, দৌড়াদৌড়ি নেই। সামনে ওদের ম্যাডামরাও আছেন। বাচ্চাগুলো একসাথে কিছু বলতে বলতে আসছিল। লদানকে জিজ্ঞেস করলাম, কী বলছে ওরা? লদান জানাল, ওদের স্কুলে শেখা কোন কবিতা আবৃতি করছে।
স্কুলের বাচ্চাদের কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ল, ইরানে প্রথমে এসে ভোরবেলা যে হোটেলটায় নিয়ে গিয়েছিল, ঐ হোটেল মারমারের রুমের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখেছিলাম, ছোট ছোট ইউনিফর্ম পরা বাচ্চারা স্কুল ব্যাগ আর পানির ফ্লাস্ক কাঁধে ঝুলিয়ে মায়ের সাথে স্কুলে যাচ্ছে। বাচ্চাগুলোকে দেখে ঠিক পুতুলই মনে হয়।
শাহ্-এর মূল যে প্রাসাদটা ছিল, সেটার সামনে একটা ভাঙা মূর্তি ছিল শাহ্-এর। ভাঙা মানে শুধু বুটজুতা দুটো ছিল, বাকীটুকু উপড়ে ফেলা হয়েছিল। ঐ বুটজুতার সাইজ দেখেই বোঝা যায় কত বিশাল ছিল মূর্তিটা।
একটা প্রাসাদের বাইরে একটা স্যুভেনিরের দোকান ছিল। এই দোকানটা একেবারে চষে ফেললাম। তবে পছন্দসই জিনিস খুব একটা পেলাম না। প্রাসাদের ভিতরের একটা ছাদের ডিজাইন নিয়ে একটা ছবি ছিল, সেটা কিনলাম। একটা সবুজ রঙের লেদারের অর্নামেন্ট বক্স, একটা খুব সুন্দর ডিজাইনের ছোট পকেট আয়নাও কিনলাম।
বড় দুই বোনকে দেয়া যাবে এগুলো। হয়ত আরও কিছু কিনতে পারতাম, কিন্তু আমার নিজে কেনাকাটার অভ্যাস একেবারে ছিল না বললেই চলে। এইটুক কিনেই আমি টেনশনে ছিলাম যে বকা খেতে হয় কি না। খালাম্মাকে বলতে তিনি হেসে বললেন, কি যে বল, শখ করে কিছু জিনিস কিনেছ, বকা দিবে কেন?
দুইদিন দুইটা প্রাসাদ দেখিয়ে মাথা খারাপ করার পর আমাদের একদিন নিয়ে যাওয়া হল ইমাম খোমেনী-র বাড়িতে। সেখানেও মিউজিয়াম করা হয়েছে।
কিন্তু এখানকার দৃশ্য একেবারেই বিপরীত। একেবারেই সাদামাটা দোতলা একটা বাড়ি, সাধারণ একটা কার্পেট বিছানো একটা হল আছে, তার উপর বারান্দার মত একটা জায়গা, একটা অতি সাধারণ কাঠের চেয়ার বসানো। এখানে বসে খোমেনী বক্তৃতা দিতেন, আলোচনা করতেন। এই হলে আমরা সবাই বসলাম। প্রজেক্টরে খোমেনীর জীবনের উপর তৈরী একটা প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হল।
ইরানীদের অনেকেই কেঁদে উঠেছিল এই সময়। শাহ্-এর মূর্তি উপড়ে ফেলার সেই দৃশ্যও ছিল এই প্রামাণ্যচিত্রে। পরে বের হওয়ার আগে এই হলেই সবার একসাথে ছবি তোলা হল।
ফেরার পথে লদান আমাকে জানাল যে ইমাম খোমেনীর সম্পর্কে কিছু বলার জন্য আমাকে ডাকা হতে পারে, আমি যেন একটা বক্তৃতা মোটামুটি তৈরী করে রাখি। আমি লিখে ফেললাম ঐ রাতেই।
অবশ্য পরে আর বক্তৃতা দেয়ার জন্য ডাকা হয়নি, বেঁচে গেছি।
আরেকদিন আমরা গেলাম ইমাম খোমেনীর মাজারে। ইমাম খোমেনীর বাড়িটা যত সাধারণ, তার মাজার ততই আলিশান। এত বড় মাজার আগে কখনও দেখিনি। বিশাল এলাকা নিয়ে করা, দামী কার্পেটে পুরোটা হল মোড়ানো।
মূল মাজারটা গ্রিল দিয়ে ঘেরা, আর আমাদের দেশের মাজারের মতই ঐ মাজারের চারপাশে মানতের টাকার ছড়াছড়ি। লদানসহ অন্য সব গাইডরাই বলছিল, এখানে মানত করে সবাই টাকা দেয়, কিন্তু এগুলো আসলে বেদাত। আমরা কবর ঘুরে দেখে শুধু কবর জিয়ারতের দোয়া পড়লাম। এরপর ঐ বিশাল চত্বরের এক কোণায় সবাই বসলাম। এখানে ছোটখাট একটা মাহফিল হল।
ইরানী প্রতিযোগীরা ছাড়াও আরও কয়েকজন তেলাওয়াত করে শোনাল। মুগ্ধ হবার সাথে সাথে টেনশনটাও বাড়ল, এদের সাথে আমাদের প্রতিযোগিতা করতে হবে।
একদিন আমাদের নিয়ে যাওয়া হল আরেকটা ছোট অডিটোরিয়ামে। সেখানে বাচ্চাদের অনুষ্ঠান হয় মনে হয়। স্টেজটা সেভাবেই সাজানো ছিল গাছপালা, পাখি, ফুল দিয়ে।
এখানে ছোট ছোট বাচ্চারা তেলাওয়াত করল, আরবী হামদ-নাত শোনাল। এইদিন ইরানী গাইডদের সুপারভাইজার তার স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন। বড় দুই ছেলে পুরাই বাপের কপি-পেস্ট। আর ছোট মেয়েটা ভীষণ কিউট আর ঠিক একটা পুতুল। বয়স খুব বেশি হলে আড়াই কি তিন হবে।
মিষ্টি গলায় পটর পটর করেই যাচ্ছে যার এক বর্ণও বুঝি না। বাসে উঠেই দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিল। ওর বাবা কি যেন বলতেই সে চিৎকার করে বলল, আই অ্যাম যাহরা। এই একটা ইংলিশই মনে হয় শিখেছে। আবার দেখি তার বাবা কি যেন বলল, আর সে সবাইকে টুক করে একটা ফ্লাইং কিস দিয়ে দিল।
সবাই ওকে টিপে ভর্তা করে দিতে চাইল, কিন্তু সে কি আর সুযোগ দেয়? অডিটোরিয়ামে গিয়েও তার দৌড়াদৌড়ির কোন কমতি ছিল না। স্টেজে উঠে হার্ডবোর্ডের গাছ-ফুল নিয়ে টানাটানি করে দেখছিল সেগুলো কতটা মজবুত।
আরেকদিন একটা ডিনারের দাওয়াত ছিল সম্ভবত মেয়রের পক্ষ থেকে। একটা বিশাল হলে খাওয়া-দাওয়ার পর আরও বিশাল অডিটোরিয়ামে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে বিভিন্ন মাদ্রাসার ছাত্ররা, আর আমাদের বয়সী ইরানী ক্বারীরা তেলাওয়াত করে শোনাল, আরবী হামদ-নাত শোনাল।
অনুষ্ঠানের মাঝখানে হঠাৎ দেখি অডিটোরিয়ামের বিশাল ছাদটা খুলে যাচ্ছে। হু হু করে ঠান্ডা বাতাস ঢোকা শুরু করল। সবাই শীতে কাঁপাকাঁপি শুরু করে দিতে আবার বন্ধ করে দেয়া হল ছাদ। এইদিন ফেরার সময় বাসে উঠে লদানকে আর খুঁজে পেলাম না। অথচ এমন কখনও হয় না যে রাতে সে আমাদের কাছ থেকে বিদায় না নিয়ে চলে গেছে।
খালাম্মা বললেন যে বাসে ওঠার সময় তাকে কে যেন ডেকে নিয়ে গেল। খুব টেনশনে পড়ে গেলাম। ওর কোন নাম্বারও তো নেই আমাদের কাছে। পরদিন সকালে দেখা হতেই সে নিজেই আমাদের বলল, অনেক দুঃখিত কালকে হঠাৎ একটা জরুরী কাজ এসে পড়ায় আমি বিদায় নিতে পারিনি আপনাদের কাছ থেকে। কিন্তু কী হয়েছিল সেটা আর বলতে চাইল না।
পরে, অনেক বছর পরে জেনেছিলাম, ঐদিন তার মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।
ঘোরাঘুরির গল্প তো দেখি বিশাল বড় হয়ে যাচ্ছে। এখনও তো আরও বাকী আছে। আরেক পর্বে যাওয়াই লাগবে।
চলবে....................
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।