হরিষে বিষাদ
আমি গাইতে পারি বিজয়েরই গান/ গান শুনে কেউ মারে না আজ বাণ/ আসে না কেউ কেড়ে নিতে প্রাণ/ নীল আকাশে ডাকছে যে আজ বিজয়েরই বান। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ জয়ের আনন্দে উদ্বেলিত হওয়ার দিন ১৬ ডিসেম্বর। ৪০তম মহান বিজয় দিবস। পৃথিবীর বুকে একটি স্বাধীন মানচিত্র আর নিজেদের মুক্ত আকাশে লাল-সবুজের পতাকা ওড়ানোর দিন।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার জন্য শুরু হয়েছিল যে প্রাণপণ যুদ্ধ, তার অবসান ঘটে এই দিনে: আমাদের চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে।
কিন্তু এ বিজয় এসেছিল এক সাগর রক্তের বিনিময়ে। তাই বিজয়ের আনন্দের বিপরীতে আছে স্বজন হারানোর বিষাদ। একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতার স্পৃহায় জেগে ওঠা বাঙালিকে স্তব্ধ করতে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যায় মেতে ওঠে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ২৫ মার্চ কালরাতে। সেই গণহত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষের ভাগ্যাকাশে নেমে এসেছিল ঘোর অমানিশা। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অবশেষে ঘনিয়ে আসে বিজয়ের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির নেতৃত্বে আত্মসমর্পণ করে ৯১ হাজার ৫৪৯ হানাদার সেনা। বিকেল চারটা ৩১ মিনিটে মুজিবনগর সরকারের পক্ষে গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারের উপস্থিতিতে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জ্যাকবের তৈরি করা আত্মসমর্পণ দলিলে সই করেন পাকিস্তানের পক্ষে লে. জেনারেল নিয়াজি এবং মিত্রবাহিনীর পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা।
আর অবিস্মরণীয় সেই মুহুর্তেই বিশ্ববাসীকে অবাক করে পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় বাংলাদেশ নামে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাঙালি জাতি পায় লাল-সবুজের একটি জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত এবং মানচিত্র। রক্তাক্ত পথ ধরে মুক্তিযুদ্ধের এই বিজয় অর্জন ছিল ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতি।
৫৫ হাজার বর্গমাইলের এই সবুজ দেশে ৪০ বছর আগে আজকের এই দিনে উদয় হয়েছিল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সূর্য। সেদিনের সেই সূর্যের আলোয় ছিল নতুন দিনের স্বপ্ন, যে স্বপ্নে অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল এ দেশের ৩০ লাখ মানুষ।
আজ ৪০ বছর পরও সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পায়নি, শেষ হয়নি মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রাম। বিজয়ের আনন্দের এই দিনে শহীদ পরিবারের সদস্যদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ থামেনি। গণহত্যা ও ধর্ষণের বিচারের জন্য তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তাঁরা।
মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম যুদ্ধের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে দাবি তুলেছিল, আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে পথচলাও এখনও শেষ হয়নি।
বাঙালির এই স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় অর্জনের ইতিহাস কেবল ১৯৭১ সালেই সীমাবদ্ধ নয়। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের এক বছরের মধ্যেই রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠী আঘাত করে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার ওপর। শুরু হয়ে যায় শোষণ-বঞ্চনা আর বৈষম্যের করুণ ইতিহাস।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সেই শোষণ থেকে মুক্তি পেতে বিক্ষুব্ধ বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রথম স্ফুরণ ছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। এই চেতনার ধারাবাহিক সংগ্রামের অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উত্থাপিত ১৯৬৬ সালে ৬ দফা তথা স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন, ১৯৬৯-এ গণতন্ত্র ও ন্যায্য অধিকারের জন্য গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০-এ নির্বাচনী বিজয়ের মাধ্যমে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্খার বিস্ফোরণ ঘটে। কিন্তু গণতান্ত্রিক সে বিজয় পাকিস্তানি সামরিক শাসকচক্র মানতে পারেনি। এর ফলেই, ১৯৭১ সালে শুরু হয় হানাদারদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার চূড়ান্ত প্রতিরোধ লড়াই, মুক্তিযুদ্ধ।
মূলতঃ স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের আবির্ভাব ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা।
সেই সময়ের বিশ্বপরিস্থিতিতে নতুন কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রের আবির্ভাব খুব সহজ ছিল না। কিন্তু সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিচল প্রত্যয়, অশেষ ত্যাগ স্বীকার, মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের সুযোগ্য ভূমিকা এবং ভারত ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সার্বিক সহযোগিতায় সেই অসম্ভবকে সম্ভব করা গিয়েছিল। বাংলাদেশের নিপীতিড় মুক্তিকামী জনগণের লড়াই সে সময় বিশ্বব্যাপী বিপুল আবেগ সঞ্চার করেছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ-দেশীয় সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি ঘাতক বাহিনীর গণহত্যা বিশ্বজুড়ে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়েছিল। সোনার বাংলার স্বপ্নে বাংলার ছাত্রসমাজ ও শ্রমিক, কৃষক, নারী, মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবীসমাজ এমনই উদ্দীপ্ত হয়েছিল যে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নকে নস্যাৎ করা কারও পক্ষেই সম্ভব ছিল না।
এবং সেই স্বপ্ন ছিল একটি গণতান্ত্রিক, মানবিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের। প্রত্যেক বিজয় দিবসে আমাদের সুযোগ আসে সেই গৌরবময় ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা স্মরণ করার, দেশের মঙ্গলের জন্য নিবেদিতপ্রাণে কাজ করার অঙ্গীকার নবায়নের। বিজয়ের এই দিনে সেই স্বপ্ন পূরণের শপথে বলীয়ান হোক জাতি, এমনটাই প্রত্যাশা দেশপ্রেমিক মানুষের। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।