সমাজবদ্ধ একজন সচেতন মানুষ হিসেবে সংবাদ পত্রে প্রকাশিত সংবাদ গুলোর সত্য-মিথ্যা নিরুপণের একটা অবচেতন প্রচেষ্টা সবসময়ই থাকে।
গত ১৪ জুন ২০১১ তারিখ থেকে প্রতিদিন প্রায় সবগুলো জাতীয় দৈনিকে একটা খবর গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছ। খবরটি হলো-গত ৫জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষিকা রুমানা মঞ্জুর স্বামীর হাতে নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনাটি পত্রিকায় প্রতিদিন গুরুত্ব সহকারে ফলোআপ আসতে থাকে। এ কারণে ঘটনাটি নিয়ে সবার মাঝে কম-বেশি আলোচনা হতে থাকে।
অনেকে এ ঘটনাকে নিয়ে সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তোলেন। আবার কিছু পত্রিকার বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো তারা এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেনসেশন তৈরি করছে। মূলত ঘটনাটিকে পত্রিকা গুলো কীভাবে উপস্থাপন করেছে,তারা কতটা পক্ষপাতিত্বহীন তথা নিরপেক্ষ থেকে সংবাদটি প্রকাশ করেছে, এবং কতটা সাংবাদিকতার নীতিমালা মেনে চলেছে; এ বিষয় গুলোই আমি আমার এই লেখাটিতে দেখার চেষ্টা করব।
রুমানা মঞ্জুরের ঘটনায় মিডিয়া কাভারেজ ও গণমাধ্যমের এজেন্ডা সেটিংঃ
এজেন্ডা সেটিং বা আলোচ্য সূচি নির্ধারণ বলতে বোঝায় অনেকগুলো ইস্যুর মধ্যে হতে এক বা একাধিক ইস্যুকে এমনভাবে কাভারেজ দিবে যাতে দর্শক -শ্রোতা -পাঠক সে বিষয়টি নিয়ে ভাবে বা ভাবতে বাধ্য হয়। এজেন্ডা সেটিং মূলত এক ধরনের ধারণা যাতে গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ বা প্রচার বা আলোচনার মাধ্যমে কোন বিষয় জনগনের সামনে নিয়ে আসে যেন জনগন তা নিয়ে চিন্তা করে এবং কথা বলে।
গত ৫ জুন রুমানা মঞ্জুর তার স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার হন,১৩ জুন ঘটনাটি মিডিয়াতে আসে। মূলত বাংলাদেশের গণমাধ্যম সে থেকেই রুমানা মঞ্জরের ঘটনা নিয়ে এজেন্ডা সেটিং শুরু করে। এখনও তা চলছে।
সাধারণত প্রিন্ট মিডিয়া রুমানা মঞ্জরের ঘটনার সংবাদ প্রথম বা শেষ পৃষ্ঠায় অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে ছাপায়। এ দ্বারা সহজেই বোঝা যায় যে, ক্রসফায়ার বা বিচার-বহির্ভূত হত্যাকান্ড গণমাধ্যমের একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা।
মিডিয়া আমাদের মনোভাব তেমন পরিবর্তন করতে পারে না। কিš‘ এজেন্ডা সেটিং এর মাধ্যমে কোন বিষয় সম্পর্কে ধারণা পরিবর্তন করতে পারে। তবে এ পরিবর্তন নেতিবাচক বা ইতিবাচক দু’ভাবেই হতে পারে। যেমন- প্রথমে লোকজন রুমানা মঞ্জুরকে সমর্থন করতে থাকে। পরে আবার কিছু পত্রিকায় রুমানার পরকীয়ার কথা শুনে হাসান সাঈদের পক্ষে কথা বলতে থাকে।
গণমাধ্যমের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য জনমত গঠন করা। জনমত গঠন করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম সমূহের প্রধান হাতিয়ার এজেন্ডা সেটিং। গণমাধ্যম বিকাশের শুরুর দিকে মনে করা হতো গণমাধ্যমের বিশাল শক্তি রয়েছে। গণমাধ্যম ম্যাজিক বুলেটের মতো কাজ করে। গণমাধ্যম কোন বার্তা দিলে গ্রাহক সাথে সাথে প্রভাবিত হবে।
গণমাধ্যমের সরাসরি ও তাৎক্ষনিক প্রভাবের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে ম্যাজিক বুলেট বা হাইপোডারমিক নিডল তত্ত্ব । পরবর্তী সময়ে দেখা গেলো গণমাধ্যমের প্রভাব যতোটা সরাসরি ও তাৎক্ষণিক মনে করা হতো আসলে ততোটা নয়। অর্থাৎ গণমাধ্যম কিছু সচেতন মানুষের ভাবনায় পরিবর্তন আনলেও তা এখনো বেশির ভাগ মানুষকে প্রভাবিত করতে পারেনি।
মতাদর্শের ভিন্নতা, গণমাধ্যমের পলিসি এবং এজেডা সেটিং আন্ত:সম্পর্কিত একটি বিষয়, ফলে একটি বিষয় বা ইস্যুকে গণমাধ্যম ভিন্ন ভিন্ন পলিসির কারণে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে উপস্থাপন করে।
গবেষণার পূর্বানুমান ঃ
সংবাদপত্র নিরপেক্ষ নয়।
আদালত দোষী হিসেবে রায় দেওয়ার আগেই সংবাদপত্র অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দোষী হিসেবে উল্যেখ করে।
অনেক সময় সাংবাদিকতার নীতিমালার পরিপন্থী রিপোর্ট প্রকাশ করে।
যে সকল পত্রিকার রিপোর্ট পর্যালোচনা করা হয়েছেঃ
১.দৈনিক প্রথম আলো- বাংলাদেশী পত্রিকা গুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ সার্কুলেশনের দাবিদার হিসেবে দৈনিক প্রথম আলোকে গবেষণায় নমুনা হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে।
২.দৈনিক কালের কন্ঠ-দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার প্রতিদ্বন্দি হিসেবে দৈনিক কালের কন্ঠ কে নির্বাচন করা হয়েছে।
৩.দৈনিক আমার দেশ -ডানপন্থী’ পত্রিকা গুলোর প্রতিনিধি হিসেবে এই পত্রিকাটি নির্বাচন করা হয়েছে।
৪.দৈনিক মানব জমিন-টেবলয়েড পত্রিকার প্রতিনিধী হিসেবে এই পত্রিকাটি নির্বাচন করা হয়েছে।
পত্রিকার রিপোর্টবিশ্লেষণঃ
“গতকাল দুপুরে এভাবেই সাংবাদিকদের সামনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষিকা রুমানা মঞ্জুর পাষণ্ড স্বামীর হাতে নির্যাতিত হওয়ার ঘটনার বর্ণনা দেন। গত ৫ জুন স্বামী সাইদ হাসান সুমনের নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হন তিনি। আহত শিক্ষিকা রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় এসব কথা বলেন”। (দৈনিক আমার দেশ-১৪ জুলাই)
এখানে সাংবাদিক নিজের আবেগকে সংবরন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
তিনি সম্ভবত রুমানা মঞ্জুরের নির্যাতিত হওয়ার ঘটনার বর্ণনা শুনে আবেগের বশে অভিযুক্ত হাসান সাঈদেও নামের আগে ‘পাষণ্ড’ শব্দটি যোগ করেন। যা নিরপেক্ষতার প্রতি হুমকি স্বরূপ।
“মামলার এজাহারে সাইদের পরিচয়ে বলা হয়েছে তিনি বুয়েট থেকে পাস করা ইঞ্জিনিয়ার। চোখে সমস্যা থাকার কারণে চাকরি করতে পারেননি। পরবর্তীকালে ব্যবসায় নেমেও লোকসানের মুখ দেখেন।
তার মা-বাবা প্রবাসী”। (দৈনিক আমার দেশ-১৪ জুলাই) “বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ভর্তি হলেও চোখের সমস্যার কারণে তৃতীয় বর্ষেই তাঁর পাঠ চুকাতে হয়েছে”। (দৈনিক প্রথম আলো-১৭ জুলাই)
পত্রিকা গুলোতে হাসান সাঈদের শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি নিয়ে অস্পষ্ঠতার সৃষ্টি করা হয়েছে। কিছু সংবাদে বলা হয়েছে- সে ৩য় বর্ষ পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে। আবার কখনো বলা হয়েছে সে বুয়েট থেকে পাস করা ইঞ্জিনিয়ার।
“গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানার নির্যাতনকারী পলাতক পাষণ্ড স্বামীকে গ্রেফতারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তবে বিভিন্ন অসমর্থিত সূত্রমতে, সরকারের লোকজনের সঙ্গে যোগসাজশ করে সাঈদ আমেরিকায় থাকা তার বাবা-মায়ের কাছে চলে যেতে চাচ্ছে”। (দৈনিক আমার দেশ-১৫ জুলাই)
এই সংবাদটিতেও হাসান সাঈদকে পাষণ্ড হিসেবে উল্যেখ করা হয়েছে। আবার জেনে শুনেই অসমর্থিত সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যকে ছাপিয়ে দিয়েছে। আবার ভালো মানুষী দেখাতে গিয়ে সেটা যে অসমর্থিত সূত্র তাও উল্যেখ করেছে।
“আসামি হাসান সাইদের দুই দিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেছেন মহানগর হাকিম আদালত”। (দৈনিক প্রথম আলো-১৬ জুলাই)
এই সংবাদটিতেও আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই অভিযুক্ত ব্যাক্তিকে ‘আসামি’ হিসেবে উল্যেখ করা হয়েছে।
“রক্তাক্ত হাত আমার মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে কণ্ঠনালি ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করে। শত কাকুতি করেও সাহায্য না পেয়ে একপর্যায়ে পালানোর জন্য সর্বচেষ্টা করি। কিন্তু‘ ততক্ষণে নিজের রক্তে রক্তাক্ত পিচ্ছিল মেঝেতে পিছলে পড়ে যাই”।
(দৈনিক কালের কন্ঠ-২২ জুলাই)
উক্ত সংবাদ ভাষ্যটি যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে তা দূর্বল হার্টের লোকের পক্ষে সহ্য করা কঠিন। এভাবে ভাষা চিত্র আঁকা অনুচিত বলেই মিডিয়া বিদরা মনে করেন।
“রুমানা শুধু পরকীয়াই করেনি। নাভিদ বিন তাহের’র সঙ্গে পানশালায় গিয়েছে। মদ পান করে ফুর্তি করেছে।
একসঙ্গে আইস স্কেটিং ও ইয়োগা ক্লাস করেছে। এসব কীর্তিকলাপ জেনেও আমি ওকে ক্ষমা করেছিলাম। ভালবেসেছিলাম পাগলের মতো। কিন্তু‘ বিনিময়ে ও শুধু প্রতারণাই করেছে। ”(দৈনিক মানব জমিন-২৭ জুলাই)
“রুমানা ইরানি বয়ফ্রেন্ডকেই ভালবাসতো, আমাকে নয়।
”(দৈনিক মানব জমিন-২৭ জুলাই)
এই সংবাদটিতে শুধুমাত্র হাসান সাঈদের বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে রগরগে একটা কাহিনী ছাপিয়ে দিয়েছে। যা কোন ভাবেই সাংবাদিকতার নীতিমালার মধ্যে পড়ে না।
ফলাফল ঃ
সংগৃহিত তথ্য-উপাত্য গুলো বর্ণনাত্মক ভাবে বিশেøষণ করে যে ফলাফল পেলাম-
ক্স সংবাদ পত্র নিরপেক্ষ নয়, এই পূর্বানুমানটি সর্বাংশে সঠিক বলা ঠিক হবে না। তবে রুমানা মঞ্জুরের ঘটনায় অধিকাংশ পত্রিকায় ভিক্টিমের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে শুধুমাত্র রুমানা মঞ্জুরের পক্ষের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে; এক্ষেত্রে পত্রিকাগুলোতে অপর পক্ষের বক্তব্যকে হয় গুরুত্ব দেয়া হয়নি, নয়তো কোন বক্তব্যই নেয়া হয় নি।
ক্স আদালত দোষী হিসেবে রায় দেওয়ার আগেই সংবাদ পত্র অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দোষী হিসেবে উল্যেখ করে।
এ পূর্বানুমানটির যথার্ততা সঠিক। কারণ পত্রিকাগুলোয় অভিযুক্ত ব্যাক্তি হাসান সাঈদকে সরাসরি দোষী হিসেবে দেখানোর বা উল্যেখ করার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়েছে।
অনেক সময় সাংবাদিকতার নীতিমালার পরিপন্থী রিপোর্ট প্রকাশ করে। এ পূর্বানুমানটির যথার্ততা সর্বাংশে সঠিক বলে প্রমানিত হয়েছে। কারণ অনেক ত্রেই দেখা গেছে সংবাদের সূত্র উল্যেখ করা হয় না।
সকল পক্ষের বক্তব্য নেয়ার গরজ দেখায় না, যদিও তা সাংবাদিকতার নীতিমালায় রয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।