আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জনাব বরবটি ওরফে মিস্টার বিন

গল্পের রাজত্বে বসবাস করছি আপাতত মিস্টার বিন আধঘন্টার একটি টিভি সিরিজ। ১৪ পর্বের এই ব্রিটিশ কমেডির নাম চরিত্রে অভিনয় করেছেন রোয়ান এটকিনসন। এর বিভিন্ন পর্বগুলো লিখেছেন রোয়ান এটকিনসন, রবিন ড্রিসকল, রিচার্ড কুর্টিস এবং একটি পর্ব লিখেছেন বেন এলটন। এর প্রথম পর্বটি প্রচারিত হয় ১৯৯০ সালের ১ জানুয়ারি আইটিভি-তে এবং শেষ পর্বটি প্রচারিত হয় ১৫ নভেম্বর ১৯৯৫, হেয়ার বাই মিস্টার বিন অভ লন্ডন নামে। পাঁচ বছরে এই টিভি পর্বসমূহ ব্রিটেন ছাড়াও সারা বিশ্বে অগুণিত দর্শককে মুগ্ধ করে এবং বহু পুরস্কার জিতে নেয়।

বিশ্বের প্রায় ২০০ চ্যানেলে এই শো বিক্রি হয়েছে। এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে দুটি পূর্ণদৈর্ঘ চলচ্চিত্র এবং একটি কার্টুন সিরিজও তৈরি হয়েছে। সু ভার্চু প্রযোজিত, পিটার বেনেট জোনস কার্যনিবাহী প্রযোজক। বিনের সূচনা রোয়ান এটকিনসন বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালেই এই চরিত্রের সূচনা হয়। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির এমএসসি’র ছাত্র এটকিনসন ১৯৮০-এর দশশতের গোড়ায় সালে এডিনবরা ফ্রিঞ্জে রবার্ট বক্স চরিত্র নিয়ে একটি কমেডি করেন।

এই চরিত্র নিয়ে ১৯৭৯ সালে আইটিভি’র সিটকম কেনড লাফ -এ তিনি অভিনয় করেন। রবার্ট বক্স চরিত্র থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে মিস্টার বিনের সৃষ্টি। ১৯৮৭ সালে জাস্ট ফর লাফ নামে কানাডা মন্ট্রিয়ালে এক কমেডি উৎসবে এটকিনসন প্রথম মিস্টার বিন চরিত্রে অভিনয় করেন। এই উৎসবের কোঅর্ডিনেটরদের এটকিনসন জানান, তিনি ইংরেজিভাষী নয়, বরং ফরাসীভাষীদের জন্যে আয়োজিত অংশে অভিনয় করবেন। আয়োজকরা বুঝতে পারেনি একটিও ফরাসী সংলাপ না থাকা সত্ত্বেও কেন তিনি এই নাট্যাংশ ফরাসীদের মাঝখানে করতে চাচ্ছেন।

এটকিনসন আসলে পরীক্ষা করে দেখতে চাইছিলেন, ভিন্নভাষীদের কাছে প্রায় সংলাপহীন তার এই কমেডি কি প্রভাব সৃষ্টি করে। বিনের বৈশিষ্ট্য রোয়ান এটকিনসনের মতে মিস্টার বিন হলেন ‘একজন প্রাপ্ত বয়স্কের শরীরে বাস করা একটি শিশু। ’ যে কিনা দৈনন্দিন জীবনের নানা সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে হাস্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। প্রথম অনুষ্ঠানের আগ পর্যন্ত এই চরিত্রে নাম মিস্টার বিন হিসাবে চিহ্নিত হয়নি। শুরুতে মিস্টার কুলিফ্লাওয়া (ফুলকপি) ইত্যাদি সবজির নামেও নামকরণের চেষ্টা করা হয়।

এটকিনসন প্রথম যুগের ফরাসী কমেডি মঁসিয়ে হুলো দেখেছিলেন। ফরাসী কমেডিয়ান ও পরিচালক জ্যাকুয়াস তাতি’র এই চরিত্র মিস্টার বিন তৈরিতে প্রভাব রেখেছে। অন্যদিকে নির্বাক যুগের একাধিক চলচ্চিত্রের ফিজিক্যাল কমেডির প্রভাবও এর মধ্যে প্রবল। উল্লেখ্য সেই সময়ের ব্রিটিশ টিভি কমেডি শোগুলো মূলত সংলাপ নির্ভর ছিলো। মিস্টার বিন তুলনায় সংলাপ নেই বলেই চলে।

এই সংলাপহীনতার কারণেই মিস্টার বিন প্রায় অপরিবর্তিতভাবে বিশ্বের বহুদেশে প্রচারিত হয়েছে নির্বিঘেœ। মিস্টার বিন চরিত্রগতভাবে শিশুর মতো সরল এবং স্বার্থপর, বুদ্ধিশুদ্ধি কম এই লোকের মধ্যে ভাঁড়ের লক্ষণ আছে। প্রতিদিনের কাজে অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা তার স্বভাবগত। উত্তর লন্ডনের হাইবারি-তে ছোট্ট একটা ফ্লাটে তিনি বসবাস করেন। তাকে প্রায় সদাই উলেনের রুক্ষ¥ জ্যাকেটে দেখা যায় সাথে লাল টাই।

একটা ডিজিটাল ক্যালকুলেটর ঘড়ি পরেন তিনি, যেটা কখনোই হারাতে চান না। তিনি খুব কম কথা বলেন, কথা বললেও প্রায় বিড়বিড় করে নিচু কণ্ঠে একটা দুটা সংলাপ দেন। পৃথিবী যেভাবে চলে সেটার ব্যাপারে এই লোকটির যেন কোন ধারণা নেই। একধরণের প্রতিবাদ ওর মধ্যে আছে। টিভি দেখা, সাঁতার কাটা, চার্চে যাওয়ার মতো সরল বিষয়গুলোকে তাই সে ভীষন জটিল করে ফেলে।

অবাস্তব সমাধান দিয়ে সবকিছুকে দেখেন তিনি। প্রতি পর্বের শুরুতে তাকে দেখা যায় আকাশ থেকে পরতে। সে যেন ভিন গ্রহের কোন বাসিন্দা। পৃথিবীর জটিলতাগুলি তাকে ছোঁয় না। তার কোন বন্ধু নেই, আÍীয়স্বজন নেই।

একমাত্র টেডি বিয়ারটির সাথেই তার গল্পগুজব। তার সঙ্গে টেডি আচরণে মনে হয় টেডি জীবন্ত। মিস্টার বিন তার টেডিকে সম্মোহন করালে দেখা যায়, সে নিজে টেডিকে হাত দিয়ে ঠেলে ঘুম দিয়ে দিচ্ছে। সকাল বেলা টেডিকে ঘুম থেকে না উঠানো, টেডির জন্য ক্রিসমাস উপহার কেনা সবই টেডিকে প্রাণ দিয়েছে। জরুরি মুহূর্তে টেডি নানা কাজে লাগে, যেমন ব্রাশ হিসাবে কাজে লাগানো।

হেয়ার বাই মিস্টার বিন পর্বে দেখি সে একটা পোষা প্রাণীদের শো-তে বিজয়ী হয়। বিনের গাড়ি গাড়ির একটা আলাদা ভূমিকা আছে মিস্টার বিন সিরিজে। বিন এখানে ব্রিটিশ লেল্যান্ড মিনি ১০০০ সিরিজের গাড়ি চালান। প্রথম পর্বে তার গাড়িটি ছিলো ১৯৬৯ সালের বিএমসি মিনি এমকে ২-এর একটি কমলা গাড়ি। এই গাড়িটি একটা দূর্ঘটনায় শেষ হয়ে গেলে তারপর থেকে ১৯৮৫ মডেলের সবুজ গাড়ি যার বনেট কালো ব্যবহার করেন তিনি।

এই প্রায় এন্টিক গাড়িতে তিনি চলন্ত অবস্থায় কাপড় বদলান, দাঁত মাজেন, গাড়ির উপরে সোফা বসিয়ে তাতে চড়ে বেড়ান। পার্কি টোল এড়ানোর জন্য এই গাড়ি নিয়ে তিনি নানা কৌশল ব্যবহার করেন। আবার এই গাড়ি দিয়ে প্রায়শই পার্কিংয়ের সময় অন্যের গাড়ি ঠেলে দেন। এই গাড়িটিও যথেষ্ট অদ্ভুত। এই গাড়ির নিরাপত্তার জন্য মিস্টার বিন সাধারণ তালা ব্যবহার করেন।

চাবি না নিয়ে তিনি স্টিয়ারিং নিয়ে চলে যান যাতে চোর তার গাড়ি নিতে না-পারে। একটি একটু বলা যেতে পারে ব্যক্তিগতভাবে মিস্টার বিন কয়েক বিলিয়ন পাউন্ডের মালিক এবং তার অন্যতম প্রিয় বিষয় হলো গাড়ি। তার সংগ্রহে বিশ্বের দামী দামী গাড়ি আছে, একাধিক কার রেসে তিনি অংশ নিয়েছেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই একজন এক্সপার্ট ড্রাইভার। বিনের বান্ধবী দুটা পর্বে আমরা ইরমা গবকে দেখি যে মিস্টার বিনের গার্ল ফ্রেন্ড।

মাটিলডা জিগলার অভিনীত এই চরিত্রটিকে দেখে মিস্টার বিন গোজ টু টাউনে অন্য একজনের সাথে ডিস্কোতে নাচতে। আপাতভাবে তার প্রতি মনোযোগ না দিলেও বিন তখন খুব ঈর্ষাকাতর হয়ে উঠেন। মেরি ক্রিসমাস মিস্টার বিন পর্বে দেখি বিন প্রস্তুতি নিচ্ছেন ইরমাকে প্রস্তাব দেয়ার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠে না। এবং ইরমা তাকে চিরতরে ছেড়ে চলে যায়।

এ ছাড়াও রবিন ড্রিসকল একাধিক পর্বে একাধিক চরিত্রে অভিনয় করেছেন। রিচার্ড ব্রায়ার্স, এঙ্গুস ডেইটন, নিক হ্যানকক, পল বন-এর মতো নামজাদা অভিনেতারা মিস্টার বিনের বিভিন্ন পর্বে অভিনয় করেছেন। বিন কার্টুন ২০০২ সালে মিস্টার বিন এনিমেটেড কার্টুন হিসাবে দেখানো শুরু হয়। ২৬টি পর্বে পরিচালিত এই কার্টুনে কিছু নতুন চরিত্র দেখা যায়, যেমন বিনের বিরক্তিকর বাড়িওয়ালি মিসেস উইকেট এবং তার একচোখ কানা পাজি বিড়াল স্ক্রেপার। রোয়ান এটকিনস স্বয়ং কার্টুন বিনের কণ্ঠ দিয়েছেন।

এবং বিনের সব কর্মকাণ্ড মূল পর্বগুলোর প্রতি আনুগত্যশীল। বিন বই মিস্টার বিনকে নিয়ে এখন পর্যন্ত তিনটি বই প্রকাশ হয়েছে। মিস্টার বিন’স ডায়রি প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে আর মিস্টার বিন’স পকেট ডায়রি প্রকাশিথ হয় ১৯৯৪ সালে। এই দুটো বই বিষয়বস্তুর দিক থেকে প্রায় কাছাকাছি, আকার আর প্রকৃতিতে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। দুটো বই-ই আসলে বিনের রেখার ডায়রি, তার হাতের লেখায় ছাপা এই ডায়রিতে মিস্টার কোথায় থাকে, তার বাড়িওয়ালি, বান্ধবী সম্পর্কে কিছু তথ্য রয়েছে।

২০০২ সালে কার্টুন সিরিজের চরিত্র নিয়ে বাচ্চাদের জন্য প্রকাশ করা হয় মিস্টার বিন’স ডায়েরি। টেলিভিশন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষ করেই এটকিনসন ফানি ম্যান নামে একটি শো করেন। এঙ্গাস ডেটনকে নিয়ে তিনি সফরে বেরিয়ে পড়েন। এই শোটি পরে টেলিভিশনের জন্য ধারণ করা হয়। এই শোর সাফল্যের পরেই তিনি আইটিভির জন্য ক্যান্ড লাফটার করেন ১৯৭৯ সালে।

এরপর এটকিনসন তার বন্ধু প্রযোজক জন লিয়ডের নট দ্য নাইন ও ক্লক নিউজ এ অভিনয় করেন। অভিনয়ের পাশাপাশি এ শোর কিছু স্ক্রিপ্টিংও করেন তিনি। এই শোর সাফল্যর পর রিচার্ড কুর্টিসের সঙ্গে মধ্যযুগের প্রেক্ষাপটে দ্য ব্ল্যাক এডার লেখেন। এতে তিনি অভিনয়ও করেন। পরবর্তীতে ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল নাগাদ ব্ল্যাক এডারের একাধিক সিক্যুয়াল তৈরি হয়।

 ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।