আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আঁচল পেতেছি,স্বপ্ন কুড়াবো বলে...

বর্তমানে ঘুম আর জাগরণের মাঝামাঝি অবস্থায় আছি । ঘুমিয়ে আছি বলতে চোখদুটো বন্ধ,এই যা । আর, আমার আশেপাশের সবার কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি,এই হিসেবে জেগে আছি তাও বলা যায় । মা তারস্বরে চেঁচাচ্ছেন । ঝাড়া আধা ঘন্টার(আনুমানিক) উপর এই চেঁচামেচি সহ্য করে যাচ্ছি ।

প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে এক চোখ একটুখানি মেলে দেখার চেষ্টা করলাম । বিশেষ সুবিধা করতে পারলাম না । খাটের উপর ডানকাত হয়ে শোয়া । চোখ মেলে সামনে দেয়ালটাই যা চোখে পড়লো । পৃথু পাশে নেই ।

নির্ঘাত মা বিশেষ কোন অকারণে পৃথুর উপর চটেছেন । আসলে কি হচ্ছে তা পুরোপুরি বোঝার জন্য,শরীর বাঁকিয়ে পিছে তাকাতে হবে । এইটুকু করার কোন ইচ্ছা বর্তমানে হচ্ছে না । আমার ঘুমানো দরকার । পুরোটা রাত নির্ঘুম কেটেছে ।

সকাল ৪টার সামান্য আগে চোখদুটো একটু লেগে এসেছে । আধোঘুমের মাঝে শুয়ে শুয়ে আমি আমার পুরো দিনের সমস্ত কাজের প্ল্যান করে ফেলি । তাই এই মূহুর্তে সর্পদশার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি । সর্পদশাটা আগে একটু পরিষ্কার করি । সাপ নাকি একটা নির্দিষ্ট সময় পর তার খোলস পরিবর্তন করে ।

আমার কম্বল বর্তমানে সেই খোলসের ভূমিকায় তার উপযোগিতা প্রদান করে যাচ্ছে । যেমন,একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এইমাত্র । আজ ভার্সিটিতে যাব না । সকালে ভার্সিটিতে গেলে হিমেল নামক এক বেহায়া মানব সন্তানের মুখ দেখতে হবে,তাই ঘর থেকে বের হওয়ার চিন্তা প্রথমে বাতিল করে দিলাম । রাতভর তার সাথে ঝগড়া করেছি ।

ওর চেহারা দেখে মেজাজ আরো খারাপ করার আপাতত কোন প্রয়োজন দেখছি না । ঝগড়া বিষয়বস্তু তেমন কিছু না । আমাকে বিয়ের জন্য দুদিন আগে দেখতে এসেছিলো,আর আমি শাড়ি পরে নিজেকে কিভাবে ছেলেপক্ষের সামনে উপস্থাপন করলাম রসিয়ে রসিয়ে তারই বর্ণনা দিচ্ছিলাম । হঠাৎ করে হিমেল রেগে গেলো । আগা-মাথা নেই এমন রাগ ।

বলে বসল,"তোমাকে দেখতে আসায় খুব খুশি মনে হচ্ছে ?" আমি বললাম,"ওমা !! খুশি হব না ?? ছেলেপক্ষ দেখতে এলে কি খালি হাতে আসে নাকি ?? কত কিছু নিয়ে আসলো । কুমিল্লার রসমালাই পর্যন্ত নিয়ে এসেছে । আমার রসমালাই কি যে প্রিয়,তুমি তো জানোই । আর যাওয়ার সময় আমার হাতে দুই হাজার টাকাও দিয়ে গেলো । আমার এক মাসের টিউশনের বেতন ।

হি হি হি... - হাসছো কেনো ? এখানে হাসির কি হলো ? - হাসির কিছু হয়নি । কিন্তু,খুব খুশি খুশি লাগছে । কাল তোমাকে খাওয়াবো । ফখরুদ্দিনের বিরিয়ানি পাওয়া যায় ইস্পাহানির মোড়ে,জানো তো ? হঠাৎ ই হিমেল রেগে মেগে অস্থির । চেঁচিয়ে বলে উঠলো,"ফাজিল মেয়ে,বেয়াদবীর আর জায়গা পাওনা,না ? অসভ্যতার একটা সীমা থাকে ।

থাপড়ায়ে তোমার চাপার দাঁত ফেলে দিবো । এতো খুশি হলে,আমার সাথে রাত জেগে কথা বলার দরকার কি ? তোমার রসমালাই ওয়ালারে বিয়ে কর না গিয়ে । সারাজীবন রসমালাই খেতে পারবা । স্বামীর রসে মাখা কথা শুনতে পারবা । " এই কথা বলেই ফোন রেখে দিলো ।

কি আশ্চর্য !! এই ছেলে এতোদিনেও আমার ঠাট্টা ধরতে পারে না !! এরপর আমিই আবার ফোন দিলাম । আরএ !! ফোন সুইচ্‌ড অফ্‌ !! সাথে সাথে মাথা ধরে গেলো । রাত চারটা পর্যন্ত একটু পরপর ফোন দিতে লাগলাম । জানি,ও আর ফোন অন করবে না । তবুও কেমন যেনো জিদ্‌ চেপে গিয়েছিলো ।

ফোন দিতেই থাকলাম,দিতেই থাকলাম । কোন বন্ধ সেলফোনে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক বার ফোন দিলে,সেলফোন অন হয়ে যাবে,এই ধরনের কোন সিস্টেম থাকলে ভালো হতো । ধৈর্যচ্যুতি ঘটল একসময় । এবার আমি ফোন অফ্‌ করে দিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম । ঘুম ঠিক না,তন্দ্রামত এসেছিলো মনে হয় ।

একটু পরেই দেখি সকাল হয়ে গেছে । আমার প্রতিদিন ঘুম ভাঙ্গে মায়ের গলার আওয়াজে । আজও তাই । কাক আবার এইদিক থেকে ব্যার্থ । সকালে ঘুম থেকে উঠে দাঁত মেজে ফ্রেশ হয়েই আমার প্রথম কাজ হয়,বারান্দায় বসে কয়েক চিমটি কালিজিরা চিবানো ।

বহুদিনের অভ্যাস আমার । স্বভাবমতো তাই ই করছি,বড় আপার মেয়েটা এসে আমার সামনে বেতের মোড়া টেনে বসলো । চার বছরের ছোট্ট টুকুটুকে একটা মেয়ে; আমার বড় আদরের । সারাদিন যা ই করুকনা কেনো,আমার সামনে এলেই একদম শান্ত । তখন কোলে উঠে কি সুন্দর টুকটুক করে কথা বলে ।

শুনলেই মন ভালো হয়ে যায় । নামটাও সুন্দর "পৃথা" । আপার দেয়া নাম । - খালামণি,কাইজিলা(কালিজিরা) খাও ? - হু,আম্মু । - কাইজিলা খেলে কি হয় ? - এটা খেলে মানুষ অনেকদিন বাঁচে ।

দেখিস না,আমি সারাদিন খাই । তুই খাবি ? - উহু । এটা খেলে কাশি হয় । আর বেশি কাশি হলে আমার বাথরুম পায় । আমি হেসে ফেললাম ।

মেয়েটাকে মোড়া থেকে টেনে কোলে বসিয়ে মাথায় সিথি কেটে কেটে হাত বুলাতে লাগলাম । আস্তে আস্তে পৃথু কথা বলে যাচ্ছে । আমি শুনছি । - আচ্ছা খালামণি,সত্যি সত্যি কাইজিলা খেলে মানুষ বেশি বাঁচে ? - হু আম্মু । তাই,কাশি হলেও একটু করে খেতে হয় ।

আমার সাথে প্রতিদিন অল্প করে খাবে,কেমন ? - আমি তাহলে অনেক অনেক দিন বাচব ? নানুমণির মতো ? আমি পৃথুর গাল টিপে দিয়ে বললাম,"হ্যাঁ আম্মু,একদম নানুমণির মতো । " - তাহলে তো আমিও নানুমণির মতো এতো পঁচা হয়ে যাবো । নানুমণি আমাকে বেশি বেশি বকা দেয় খালি । তাই আমি আম্মুর মতো তাড়াতাড়ি মরে যাবো । আম্মু অনেক ভালো,তাই না খালামণি ? হঠাৎ পৃথুর এই কথা শুনে থমকে গেলাম ।

অনেক্ষণ কি বলবো খুঁজে পেলাম না । পৃথুকে আমার দিকে ফিরিয়ে জড়িয়ে ধরে বসে থাকলাম শুধু । আপার মৃত্যুর সময়টার কথা ভাবতে ভালো লাগে না । তবুও,বাচ্চা মেয়েটার নিষ্পাপ কথায় মাথায় চলে আসা ভাবনা গুলো ফেরাতেও পারি না । পৃথুর জন্মের আগে আগে আপা আমাদের বাসায় চলে আসে ।

ডাক্তারের দেয়া সময় অনুযায়ী আনুমানিক আরো তিনমাস বাকি তখনো । দরজা খুলে আপাকে দেখে অবাক হয়ে যাই । আপা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন । হাসতে হাসতেই বললেন,তোদের কথা খুব মনে পড়ছিলো রে,তাই চলে এসেছি । আমি আপাকে জড়িয়ে ধরলাম ।

পিঠাপিঠি বোন খুব আমরা । সারাদিন এটা-ওটা নিয়ে ঝগড়া লেগেই থাকত । আপাটাকে কত ভালোবাসি,বুঝতে পেরেছিলাম আপার বিয়ের পর । তার সারপ্রাইজে তাই খুব খুশি হয়ে গিয়েছিলাম । অনেকদিন পর আমাদের সাথে দেখা হওয়ায় আপাও খুব খুশি ছিলেন ।

কিন্তু,কিছু একটা খটকা কেমন কাঁটা হয়ে গলায় আটকে রইলো । বাসায় আসার পর আপার মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন দেখতে পেলাম । ধরে নিয়েছিলাম,প্র্যাগনেন্ট হলে বুঝি সবাই একটু আধটু অস্বাভাবিক আচরণ করেই । কিন্তু,আপার ব্যাপারটা যে বেশি মাত্রায় অস্বাভাবিক ছিলো,বুঝলাম তার অল্প কিছুদিন পরেই । রাতে আপা আমার ঘরে ঘুমাতো,কোন কিছুর দরকার হলে কেউ যাতে পাশে থাকে তাই এই ব্যাবস্থা ।

তখন হিমেলও রাতে ফোন দিতো না । একদিন রাতে ঘুম ভেঙ্গে দেখি ,আপা জানালার পাশে বসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে । আমার পরীর মত আপাটা এতো রাতে জানালার পাশে বসে কাঁদছে ,দেখে বুকে কেমন ধাক্কার মতো লেগেছিলো । আমি বিছানা ছেড়ে উঠিনি । আপা একটু পর এসে বিছানায় শুয়ে গেলো ।

আমি আর পুরো রাত চোখের পাতাগুলো এক করতে পারিনি । সকালে উঠে আপা স্বাভাবিক । আমি ও সব ভুলে যাওয়ার ভাণ করতে লাগলাম । মা আপাকে জোর করে খাওয়ালো , আমি বসে বসে দেখলাম । আপার চেহারায় তার মনের অস্বাভাবিকতা খুঁজে দেখার চেষ্টা করতে লাগলাম ।

দুপুরবেলা গোসল করতে গেলে আপার স্যুটকেস ওলটপালট করে তার ডায়েরীটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে লাগলাম । আপা সব লেখে তার ডায়েরীতে । আপার কান্নার পেছনকার কারণ জানার তীব্র প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলাম তখন । এই অবস্থায় তো আপার এমন থাকার কথা না । দুলাভাই কি তাহলে কোন ভাবে এসবের সাথে সম্পৃক্ত ? আপা আসার পর থেকে দুলাভাই একবারও বাসায় আপাকে দেখতে আসেনি ,এমনকি ফোনেও তো খুব একটা কথা বলতে দেখতাম না ।

আপাকেও কিছু জিজ্ঞেস করলে,আপা এড়িয়ে যেতো । আমি জানি,আমার প্রশ্নের উত্তর আপার ডায়েরীতেই আমি পাবো । অল্প সময়ে সাধ্য মতো খুঁজে দেখার চেষ্টা করলাম কিন্তু কোথাও পেলাম না । হাঠাৎ দরজায় কার ছায়া চোখে পড়তেই সোজা হয়ে দাঁড়ালাম । আপা দাঁড়িয়ে সামনে ।

ভয় পেয়ে গেলাম আমি । আপা,তার ডায়েরীতে কারো হাত দেয়া পছন্দ করেনা । প্রচন্ড রেগে যায় । সেদিনও তাই হয়েছিলো । প্রচন্ড রেগে গিয়েছিলো আপা ।

আমার কাছে এসে হঠাৎ করে গালে চড় কষিয়ে দিলো । আপা কখনো আমার গায়ে হাত তোলেনি । তাই এমন কিছু আপা করে বসবে আমার দুঃস্বপ্নেও তা ছিলো না । চড় দিয়েই আপা ধপ করে বিছানায় বসে পড়লেন । এরপর খুব দ্রুত আমার চোখের সামনে অনেকগুলো ঘটনা ঘটে গেলো ।

আপা চিৎকার করতে লাগলো । আমি দেখছি রক্তে বিছানার সাদা চাদর লাল হয়ে যাচ্ছে । আমার জ্ঞান ছিলো কিনা তখন বলতে পারি না,প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলাম । আস্তে আস্তে রুমে মানুষ জড়ো হচ্ছে দেখতে পাচ্ছিলাম । দৌড়াদৌড়ি করে আপাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো ।

আমিও গিয়েছিলাম । জানলাম,বাচ্চা এখনো প্রিম্যাচিওরড্‌,তবুও অপারেশন করে বাচ্চা বের করে আনতে হবে । আপার অবস্থা খুব সুবিধার না । হাসপাতাল থেকেই দুলাভাই কে ফোন করলাম । ফোন রিসিভ করে সে আমাকে বললো,"আমাকে ফোন করলে কি ভেবে ? এসব আলতু ফালতু বিষয়ে ফোন করে আমাকে আর বিরক্ত করবে না ।

তোমার আপার শুভাকাঙ্খীর অভাব নেই । তাদের জানাও ফোন করে । " এরপর আমি হতবাক হয়ে তার কুৎসিত কতগুলো কথা শুনে গেলাম । এরপর সে মহান ব্যাক্তি(!) আপার মৃত্যু কামনা করে ফোনটা রেখে দিলেন । আমি তখনো ফোন কানে নিয়ে বসে আছি ।

ঘোর ভাঙ্গল মার গলার আওয়াজে । মা বললেন,শীলা তোর সাথে দেখা করতে চায় । আমি আপার পাশে বসে আছি । আপার মুখটা কাগজের মতো সাদা হয়ে আছে । মুখ তুলে তাকাতে পারছিনা ।

মনে হচ্ছে,আমার চেহারা দেখলেই আপা আমাকে বলা নরপশুটার সব কথা জেনে ফেলবে । আস্তে আস্তে আপা কথা বলে উঠলো,"খুব জোরে মেরেছিলাম রে ? লেগেছে খুব,না ? দেখ,এইজন্য আমি শাস্তিও পাচ্ছি । " আমি ডুকরে কেঁদে উঠলাম । আপাকে বললাম,চুপ কর আপা । শুয়ে থাকো চুপ করে ।

আপা না শোনার মত করে বলে যাচ্ছেন, "মা বলেছেন,মেয়ে হয়েছে । বাচ্চাটার চেহারা দেখতে ইচ্ছা করছে খুব । কিন্তু,আমি দেখবো না । অপারেশন থিয়েটারে ঢুকার আগে মাকে বলে দিয়েছিলাম,বাচ্চাকে যাতে আমার কাছে না আনা হয় । এই বাচ্চা আমার আর জামানের ঘৃণার ফসল ।

আমি চাইনা,আমার ঘৃণার সামান্যতমও ও পাক । জামানের প্রচন্ড রাগ ছিলো আমার উপর । তার শোধও সে নিয়েছে । ওকে বিয়ের পর প্রতি মূহুর্তে মনে প্রাণে আমি নিজের শরীরকে ঘেন্না করেছি । বাবা-মা আমার জন্য সবচেয়ে সুযোগ্য বর খুঁজে এনেছিলো,তাই না রে ? এই সুযোগ্য বর প্রতি রাতে আমার দেহটাকে পশুর মত ছিড়ে-কুড়ে ছুড়ে ফেলেছে ।

নিলয় নামের একটা ছেলেকে খুব ভালোবাসতাম । আমার সব স্বপ্ন ছিলো ওকে ঘিরে । কিন্তু,বাবার রাগের কাছে হেরে গিয়েছিলাম শেষ পর্যন্ত । আর দেখ,আজ জীবনের কাছেও হেরে গেলাম । আমি জামানকে সব বলেছিলাম,সব ।

ওকে বলেছিলামও,ওকে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে সময় লাগবে আমার । ও মেনে নিতে পারেনি কিছুই । সবসময়ই ও বলতো,আমি নাকি পবিত্র নেই । নষ্ট হয়ে গেছি আমি । আমি ওকে বিশ্বাস করাতে পারিনি ।

এরপর জামানকে যত ঘৃণা করেছি,নিলয়ের জন্য ততোটাই কেঁদেছি । তোর জীবনটাকে নিয়ে কখনো কাউকে খেলতে দিস না,নীলু । কখনো না । আমার বাচ্চাটার নাম পৃথা রাখিস । নিলয়কে সবসময় বলতাম আমাদের বিয়ের পর মেয়ে বাবু হলে নাম রাখবো পৃথা,আর ছেলে বাবু হলে পৃথিবী ।

" আমি ছুটে বেরিয়ে এসেছিলাম কেবিন থেকে । আপাকে হাসপাতালে আনা হয়েছিলো দুপুরের দিকে,আপা মারা গেলেন সন্ধ্যায় । মা সবকিছু জেনেও শান্ত ছিলেন । আপাকে নিয়ে সেদিনই বাড়িতে রওয়ানা হয়েছিলাম । আমাদের গ্রামের বাড়িটা আপার সবসময় খুব পছন্দের ছিলো ।

ট্রেনে করে যেতাম আমরা । যাওয়ার সময় আমি নিজে সবসময় কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনতাম । আর,আপা ট্রেনের সিটে হাঁটু ভাজ করে বসে দুহাতে মুখ ধরে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকত । প্রতিবারই একই দৃশ্য,তারপরেও আপার মুগ্ধতা কমতোনা । সেই অবাক চাহনি সেদিন আর ছিলো না ।

বাহনটাও ভিন্ন ছিলো । আপার প্রাণহীন দেহ সামনে চোখের সামনে , এই দৃশ্য আমি সহ্য করে গেলাম । কিন্তু,মা পারেনি । তার মাথা খারাপের মতো হয়ে গেলো । আমরা আপাকে অচেনা শহরে একলা রেখে, চির চেনা সেই শহরে আবার ফিরে এলাম ।

মার প্রতি রাতে চিৎকার করা কান্না,ভয় পেয়ে ছোট্ট পৃথুর কান্না , সব অসহ্য লাগতো । তবুও স্বাভাবিক হয়ে গেছিলাম । মৃত মানুষের স্মৃতিও নাকি একসময় খুব তাড়াতাড়ি মরে যায় । আপাকেও আমরা ভুলে গেলাম একসময় । মা কিন্তু ভুলে জাননি ।

তার সব রাগ গিয়ে পড়লো,ছোট্ট পৃথুর উপর । মার ধারণা ছিলো,এই বাচ্চা পেটে আসার পরই নাকি আপার যত কষ্ট । মার মানসিক অবস্থা চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছিলো । এই ব্যাপারটা ভালো ভাবে বুঝেছিলাম,পৃথুর একমাস বয়সের সময় । সেদিন ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরেছি মাত্র ।

বাসায় ঢুকেই পৃথুর কান্নার আওয়াজ কানে এলো । কাছে গিয়ে দেখি,মার রুমের দরজা বন্ধ । ওপাশ থেকে আমি শুনলাম,পৃথু শুয়ে গলার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে কান্না করছে । আতঙ্কে অস্থির হয়ে গেলাম । ব্যাগ ছুড়ে ফেলে অনেক্ষণ দরজা ধাক্কানোর পর মা দরজা খুলে দিলেন ।

পৃথুর কাছে গিয়ে দেখি ভেজা বিছানার উপর মা বাচ্চাটাকে ফেলে রেখেছেন । আমি অবাক হয়ে মাকে বলেছিলাম,"এসব কি মা?" মা বললেন,"মেয়ের প্রাণ শক্ত আছে । সমস্যা নেই,আস্তে আস্তে বুঝে যাবে আমার মেয়েকে মেরে ফেলার শাস্তি কি ?" এরপর থেকে বাসায় যতক্ষণ থাকতাম না,কেউ না কেউ পৃথুকে দেখে রাখতো,বেশিরভাগ সময় আফিয়ার কাছেই থেকেছে পৃথু ,আর বাসায় এলে আমার কাছে । খুব করে চেয়েছিলাম,জামান নামের এই পশুটাকে কঠিন কোন শাস্তি দেই । পারিনি ।

মা-বাবার একটাই কথা,এখন যদি এসব ব্যাপার নিয়ে কথা ওঠে তাহলে নাকি আমাকে বিয়ে দিতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে । কষ্ট পেয়েছিলাম খুব । মাঝে মাঝেই ভাবতাম,বিয়েই কি মেয়েদের একমাত্র পরিণতি ? কেনো এর জন্য এইসব পশুর হাটে দাম দিয়ে মেয়েদের বিকিকিনির বস্তু হতে হয় ? আপার মুখে নিলয় নামের ছেলেটার কথা শুনে অবাক হয়েছিলাম । অভিমানও হয়েছিলো খুব । আপা আমাকে তো অন্তত বলতে পারতো ।

যদিও বুঝতে পারছিলাম,নিলয়কে ভালোবাসার পরেও আপার বিয়েটা মেনে নেয়ার কারণ । বাবা হার্টের রোগী ছিলেন । কোন কারণে বাবাকে হারানোর ভয় আপাকে পেয়ে বসেছিলো । আমরা খুব সংরক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে । ভালোবাসার বিয়ে মেনে নেয়ার মত মন-মানসিকতা আমাদের পরিবারে নেই ।

কিন্তু,তার পরিণতি এতো কঠিন হতে পারে,আমার ভয়ঙ্করতম দুঃস্বপ্নেও তা ছিলো না । আমি ভার্সিটির হলে থাকতাম । আর আপা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতো । ক্লাশের,পরীক্ষার ব্যাস্ততায় খুব একটা দেখাও হতো না আমাদের । তবুও জানতাম,ছেলেটার কথা ।

আপাকে নাকি সে পছন্দ করতো খুব কিন্তু,আপাও তাকে পছন্দ করতো,এই তথ্য অজানা ছিলো । আমি আর হিমেল মিলে নিলয়কে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলাম । তিনি মেসে থাকতেন । সেখানে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানলাম,অনেকদিন হল তিনি মেস ছেড়েছেন । হয়তো তার দেশের বাড়ি ফরিদপুরে চলে গিয়ে থাকতে পারেন ।

আমার তো আর সেখানে যাওয়া সম্ভব ছিলো না । কোন একটা অদ্ভুত কারণে হিমেল তাকে খুঁজে বের করেছিলো । সব জানালো তাকে । তিনি ছোট বাচ্চাদের মতো চিৎকার করে কেঁদেছিলেন নাকি । শুনে আমার প্রচন্ড রাগ হয়েছিলো ।

ভাবতাম আপাকে এতো ভালোবাসত,তো কেনো আপাকে বলেননি,"সব ছেড়ে চলে আসো আমার কাছে ?" পৃথুর বয়স যখন প্রায় তিন,একদিন দুপুরে ভদ্রলোক বাসায় আসেন । আমি খেতে বসেছিলাম । খাওয়া ছেড়ে উঠে গিয়ে দরজা খুলে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,"কাকে চাই?" আমাকে দেখেই তিনি পরিচিত ভঙ্গিতে বললেন,"পৃথাকে দেখতে এসেছিলাম । আমি নিলয় । " নাম শুনে চমকে উঠেছিলাম ।

মা যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেন এই মানুষটার ব্যাপারে,তাহলে সব রাগ পৃথার উপর ঝাড়বেন । আমি তাকে চট্‌ করে বললাম,"মা যদি কিছু জানতে চায় আপনাকে দেখে,বলবেন আপনি আমার ফ্রেন্ড । " তারপর তাকে বসার ঘরে বসিয়ে,আমি মা কে দেখতে গেলাম । মা ঘুমিয়ে ছিলেন । আমিও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম ।

আমি সোফার সামনে রাখা খাটটায় গিয়ে বসলাম । তিনিই প্রথম কথা বললেন । বললেন,"নীলু ভালো আছ?? " তার কথার উত্তর না দিয়ে জানতে চাইলাম,"কেনো এসেছেন আপনি ?" - বললাম তো, পৃথাকে দেখতে এসেছি । - কেনো ? পৃথা তো আপনার কেউ নয় । তাহলে তাকে দেখার ইচ্ছা কেনো হলো আপনার ? - ও আমার কেউ না হোক ।

শীলার তো মেয়ে । শুনে প্রচন্ড রেগে গিয়েছিলাম আমি । বলেছিলাম,"মহান সাজতে এসেছেন ? আপা তো বেঁচে নেই,এই অভিনয় দেখে ও খুব হয়তো আপ্লুত হতো । কিন্তু,আমার আপনাকে অসহ্য লাগছে । " কাঁদবো না,কাঁদবো না করেও কেঁদে ফেললাম ।

বললাম,"আজ যে মমতা নিয়ে পৃথাকে দেখতে এসেছেন তার সামান্যতমও যদি আপা পেতো,তাহলে মারা যাওয়ার আগে এতো কষ্ট পেতো না আমার আপা । " নিলয় কিছুক্ষণ থেমে থেকে বললেন,"শুনো নীলু,তোমার আপা আমার আর তোমাদের কথা ভেবে খুব কষ্ট পেতো । তোমাদেরকে প্রচন্ড ভালোবাসত । আমাকে কষ্ট দেয়াও তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না । তাই,আমি ওকেই সিদ্ধান্ত নিতে বলেছিলাম ।

ওর কষ্ট আর বাড়বে না ভেবেই কাউকে কিছু না বলে চলে গিয়েছিলাম । কেনো জানি মনে হতো,ও বারবার আমার কাছে ফিরে আসতে চাইবে আর কষ্ট পাবে । এর চেয়ে নতুন জীবনেই অভ্যস্ত হয়ে যাক । ওর এমন কিছু হবে,এমনটি কিন্তু আমিও চাইনি । " বলতে বলতেই তার গলা ধরে এলো ।

চোখের কোণেও কি দুফোটা পানি চিক্‌চিক্‌ করে উঠেছিলো ? উঁহু,আমি দেখিনি । পৃথাকেও নিয়ে আসিনি । আবেগশূন্য হয়ে বসে ছিলাম । নিলয় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চলে গিয়েছিলেন । মাঝে মাঝে প্রচন্ড অপরাধবোধ কাজ করত ।

মনে হতো কাজটা কি ঠিক হলো ? কি হতো বেচারাকে একবার পৃথুকে দেখিয়ে দিলে । অনেকদিন মনেও ছিলো না । আজ আবার খারাপ লাগছে । আমি ফোনটা অন করলাম । অন করার সাথে সাথেই হিমেলের ফোন এলো,উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলতে লাগলো, - ফোন অফ্‌ করে দিলে যে ? এতো রাগ কর কেন ? এরপর আমতা আমতা করে বলতে লাগলো,"আমি আসলে খুব সরি ।

এ ঝগড়াটা আমি ই শুরু করেছি । এমনটা না করলেও পারতাম । তুমি তো জানোই এইসব কথা কে আমি কত ভয় পাই । এগুলা নিয়ে কেউ ঠাট্টা করে ? সকাল থেকে তোমাকে টানা ফোন দিচ্ছি । আর তুমি এতোক্ষণে অন করলে ।

তুমি পারো ও..." - খেয়েছো দুপুরে ? - খেলাম কই ? তুমি আজ ভার্সিটিতেও এলে না । ফোন ও অফ্‌ করে রেখেছো,টেনশন লাগে না নাকি আশ্চর্য !! - আচ্ছা,তুমি কি জানো,নিলয় সাহেব কোথায় থাকেন ? ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ কোন আওয়াজ পেলাম না । তারপর,বলে উঠলো, "হুম,জানি । এতোদিন পর একথা কেনো ? " - আমি উনার সাথে দেখা করতে চাই । সেটা কি সম্ভব ? এই মূহুর্তে রেল স্টেশনের কাছে দাঁড়িয়ে আছি ।

সকালের দিকে নিলয়ের পুরোনো মেসে গিয়ে জানলাম,সে গরীব ছেলে-মেয়েদেরকে গরম কাপড় দেয়ার জন্য স্টেশনের দিকে গিয়েছে । সাথে সাথে আমি,হিমেল আর পৃথু সেদিকে রওয়ানা হলাম । ও আচ্ছা বলা হয়নি,পৃথু হিমেলকে আগেই চেনে । আমি প্রায়ই ফোনে কথা বলাতাম দুজনকে,এই পর্যন্তই । তবে পৃথু জানতো,খালামণির জন্মদিনে একটা আঙ্কেল তাকেও কোন না কোন গিফ্‌ট দেয়,সেই আঙ্কেল টা অনেক ভালো ।

তাই দেখা হওয়ার পর থেকে কোন ঝামেলা তো করেই নি বরং বেশিরভাগ সময় পৃথু হিমেলের সাথে সাথেই আছে । যদিও আজ পৃথুকে বাসা থেকে বের করতে কষ্ট হয়েছে খুব । পুরো রাত মাথা থেকে পুরোনো কথাগুলো নামাতে পারিনি । এই কথাগুলো যতবারই মনে হয় ,প্রচন্ড অপরাধবোধ কাজ করে মনে । সারারাত ভাবলাম ।

ভেবে ভেবে ঠিক করলাম,"কি দরকার এই সমস্ত চিন্তা পোষার ? এর চেয়ে একবার দেখিয়ে আনলেই তো হয় । " মা অবশ্য বারবার বলছিলেন,শীতের দিনে এতো ভোরে পৃথাকে নিয়ে যাওয়ার দরকার কি ? ঢং যত্তসব !" আমি বললাম,"ভার্সিটিতে সবাই পৃথুকে খুব দেখতে চায় মা,তাই ওকে নিয়ে যাচ্ছি । আর সকালেই তো যাব,তানাহলে ট্রেন মিস্‌ করবো না? " বলেই বেরিয়ে পড়লাম । নিলয় শীতবস্ত্র বিতরন শেষে পিছনে ফিরতেই আমাদের কে দেখলো । বেশ খুশি হলো বলেই মনে হলো ।

তারপর আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন । পৃথু উনাকে দেখেই আমাদের পিছে লুকিয়ে গেলো । হিমেল নিলয়কে বলল,"চলেন ভাই,কোথাও বসি । " ঠিক করলাম শিশুপার্কে যাব সবাই । এ শহরে আসলে যাওয়ার তেমন জায়গাও নেই ।

তাই,দেরী না করে সি এন জি নিয়ে নিলাম । পৃথু আনন্দে প্রায় ষোলখানা । সি এন জি তে চড়লে এই মেয়ের খুব আনন্দ হয় । তখন খিল খিল করে হাসতে থাকে । নিলয় পুরো রাস্তা একদম চুপচাপ ছিলেন ।

মাঝে মাঝে কেমন অবাক হয়ে পৃথু কে দেখছিলেন । মাঝে একবার শুধু বললেন,"দেখেছো নীলু,পৃথা একদম শীলার মতো হয়েছে দেখতে । " আমি কোন জবাব দেইনি । সি এন জি থেকে নেমেই নিলয় "আসছি" বলে উধাও হলেন । ফিরে এলেন এক দিস্তার মতো কাগজ নিয়ে ।

পৃথু প্রথমে নিলয়ের কাছে যেতে কিছুতেই রাজী ছিলো না । নিলয় হাতি এঁকে দেখাবেন বলে পৃথুকে একটু দূরে বেঞ্চের উপর নিয়ে বসালেন । আমি চাচ্ছিলাম ওদের সাথে যেতে,কি ভেবে হিমেল আটকালো আমাকে । আমি আর হিমেল পাশাপাশি বসে আছি । পৃথু আর নিলয় কে দেখতে পাচ্ছি ।

নিলয় একটা হাতি এঁকে শেষ করেছেন বোধহয় । পৃথু হাসছে আর দুহাতে তালি দিচ্ছে । নিলয়ও আনন্দে ঝলমল করছেন । এখন আর দেখা যাচ্ছে না । চোখ আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে উঠছে ।

আজ এই আনন্দটার ভাগ হয়তো আপাও পেতো । এতো বছর পরে হতভাগা আপাটার কথা ভেবে অনেক্ষণ কাঁদলাম । মাঝে মাঝে নিজের কথা ভেবে ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছিলাম । হিমেল পাশে বসে আমার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে,যেনো ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাব । আমি আশ্বস্ত হই ।

নিজ মনেই আওড়াতে থাকি, একটা গল্প রুপকথার... ভালোবাসা যেখানে ছড়ায় শিউলি ফুলের শুভ্রতা আমি অপেক্ষা করি... রাত্রিপ্রাঙ্গণে মুঠো মুঠো জোছনার মাতাল নৃত্য দেখবো বলে, অপেক্ষা সাগরের আকাশ-নীল জলের ছন্দপতনে চার পায়ে আছড়ে পড়ার চকিতে অনুভব করি বহুপ্রতিক্ষীত সেই উষ্ণ স্পর্শ আমি আঁচল মেলে ধরি স্বপ্ন কুড়াবো বলে... একটা গল্প জীবনের... যেখানে লুকিয়ে থাকে আতঙ্কের নীল রঙ পৃথিবীর অন্ধকারতম কোণে ভীত আমি প্রতিদিন লক্ষবার অনুনয় করে বলি একবার ছুয়ে দিয়ে যাও ভেঙ্গে দাও মন্ত্রের কালো অভিশাপ ... - ফারহানা নিম্মী ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।