ভুল করেও যদি মনে পড়ে...ভুলে যাওয়া কোন স্মৃতি.. ঘুমহারা রাতে..নীরবে তুমি কেঁদে নিও কিছুক্ষণ...একদিন মুছে যাবে সব আয়োজন... ‘আরে! এখানে! কোন পক্ষের?’
‘এই তো -কনে আমার বউয়ের খালাতো বোন। সেই সুবাদে..’ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমিও হাসি হাসি মুখ করে হ্যান্ডশেক করি। লোকটার চেহারা খুবই চেনা চেনা লাগছে। লোক বলব? আমারই বয়সী। আবার পুরুষ হলেও ‘ছেলে’ বলা যায় -অতোটা কমবয়সী বলে নিজেকে নিশ্চয়ই দাবী করতে পারি না।
‘অ-নে-ক দিন পর দেখা, তাই না?’
‘হ্যাঁ ,অনেকদিন পর। ’ উত্তর দেই। কিন্তু কতদিন? স্কুল-কলেজের ফ্রেন্ড না শ্বশুরপক্ষীয় কোন আত্মীয়? শ্বশুরপক্ষের লোক হলে তো পুরাই বেইজ্জতি হবে। না চিনতে পারলে বলবে, জামাইয়ের তো বড়ই অহংকার!
‘সে-ই ইন্টার্নীর পর তো আর দেখাই হয়নি। ’
ইয়েস -মনে পড়েছে।
মেডিক্যাল কলেজে আমরা একসাথে পড়তাম। ওহো! ও তো হোস্টেলে আমার দুই রুম পরেই থাকত। ইন্টার্ণীর পর পরই বিসিএসে চাকরী পেয়ে যায়।
‘হ্যাঁ -আট বছর প্রায়। তো..’ তো পর্যন্ত বলে সামলে নিলাম।
তোর না তোমার? কি বলতাম ওকে? ভাবনাকে টাইম মেশিনে বসিয়ে মেডিক্যাল কলেজের দিনগুলোতে খানিকক্ষণ ঘুরিয়ে এনেও তুই-তুমির কুলকিনারা করতে পারলাম না। অগত্যা সম্বোধন বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম- ‘তো.. পোস্টিং কই এখন?’
‘বগুড়া সদরে। তুই কি করিস এখন?’
ঠিক হ্যায়- তুই-ই সই। ও যখন তুই বলছে, নিশ্চয়ই তুই-ই বলতাম। আমিও তুই শুরু করলাম।
কমিউনিটি সেন্টারে ঢোকার পর থেকেই আমার ‘উনি’ আমার কাছ-ছাড়া। তার খালাতো বোনের বিয়ে; তাই তাকে বোনের সাথে সাথেই থাকতে হচ্ছে। বংশের বড় জামাই হওয়ার কারণে গুরুজনদের পাশে বসে দেশ, রাজনীতি, আবহাওয়া থেকে শুরু করে বিয়ে, আতিথেয়তা, অতীত প্রজন্ম-বর্তমান প্রজন্ম ইত্যাদি গুরুগম্ভীর আলোচনা আমাকে অত্যন্ত আগ্রহের ভান করে শুনতে হচ্ছিল। মাঝে মাঝে মাথা ঝাঁকিয়ে ‘জি জি’ করে খুব একটা কিছু বুঝে ফেলছি এরকম ভাবও দেখাচ্ছিলাম। যদিও ভেতরে ভেতরে এই ‘নাগপাশ’ থেকে মুক্ত হওয়ার ব্যাকুল আকাংখায় অস্থির হয়ে উঠেছি।
আমার এই ব্যাচমেটটি আসায় তার সাথে গল্প করার ছলে সেখান থেকে উঠে বাইরে বেরিয়ে এলাম। এই বিয়ের ‘বর’ আবার ওর বউয়ের আত্মীয়।
এবার আরেক সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। আমি ওর নামটা কিছুতেই মনে করতে পারছি না।
কথায় কথায় আমরা চলে গেলাম আমাদের ফেলে আসা দিনগুলোতে।
সে-ই কলেজ চত্বর, বোরিং লেকচার, ডাইনিংয়ের ফিস্ট, ইন্ডিয়া ট্যুর। অনেক কিছু মনে পড়ছে, ওর কথার সূত্র ধরে আমিও অনেক কথা বলছি, কিন্তু ওর নাম আর মনে আসে না। কি যন্ত্রণা! এতোক্ষণ ধরে কথা বলছি, নাম ধরে ডাকিনি। ইদানীং এই রোগটা হয়েছে - ‘নাম-ভুলে-যাওয়া’ রোগ। নাকি ছিল বহু আগে থেকেই, টের পাচ্ছি এখন?
মনে পড়ছে, ও আমাদের ক্রিকেট টিমের বোলার ছিল।
স্পিন করতো বলে আমরা ওকে ‘মুশতাক’ ডাকতাম। ‘মুশতাক’? না ‘মুরালিধরণ?’ আচ্ছা, ওর নামও না ছিল ‘ম’ দিয়ে ? মাসুম? মামুন? ঊঁহূ। নাকি ‘ল’ দিয়ে ? লাবিব? লিখন? দূর, নিজের উপরই মেজাজ খারাপ হচ্ছে।
ভাবছি, বরপক্ষের কেউ এসে ওকে নাম ধরে ডাক দেয় না কেন? তাহলেই তো ঝামেলাটা চুকে যায়।
হঠাৎ আমাকে ও জিজ্ঞেস করলো- ‘ভাবী কই, ভাবীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিবি না?’
মরার উপর খাড়ার ঘা! পরিচয় করাতে হলে তো নাম বলতে হবে।
এখন নিজের যে কয়টা চুল আছে মাথায় সেগুলোও ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে আগেই কেন সারেন্ডার করলাম না এটা ভেবে। আগেই যদি বলতাম, কিছু মনে করিস না, তোর নামটা ঠিক মনে করতে পারছি না, আমার মাঝে মাঝেই হচ্ছে আজকাল এরকম। কিন্তু এতক্ষণ সারা দুনিয়ার গল্প করে কেমনে জিজ্ঞেস করি -তোর নাম কি?
আচ্ছা, এক কাজ করলে হয় না? বউকে নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দেই। বলি, এ হচ্ছে আবীর। ও যখন বলে উঠবে, আরে আমি তো আবীর না, আমি ‘অমুক’; আমি অত্যন্ত অবাক হওয়ার ভান করে বলব, ‘দেখ কান্ড! আমি এতক্ষণ তোকে আবীর ভেবেছি! তুই দেখি আবীরের মতোই মোটা হয়ে গেছিস, চুলেও পাক ধরেছে।
সেজন্যেই চিনতে পারিনি। ’
হ্যাঁ, এই বুদ্ধিটা পছন্দ হলো। বললাম, ‘হ্যাঁ আছে ভিতরে, দেব পরিচয় করিয়ে। ’
তবে তার আগেই ও বললো,‘ ঐ যে আমার বউ বসে আছে। চল পরিচয় করিয়ে দেই।
’
তা-ই সই। আগে ওর বউয়ের সাথেই পরিচয় হোক।
আমার মনে পড়ল, এই ‘মুশতাকের’ (অথবা মুরালিধরণের) আমাদের এক ব্যাচমেটের সাথে প্রেম ছিল- স্নিগ্ধা। স্নিগ্ধা? না স্বপ্না? থাক, এক নামের চিন্তায় বাঁচি না, আবার আরেক নাম!
‘মুন্নি, ও হচ্ছে সেলিম ,আমার ব্যাচমেট, ডাক্তার। হোস্টেলে আমরা পাশাপাশি রুমে থাকতাম।
’
ওর কথা শুনে আমি আনন্দে মনে মনে তিনটা ডিগবাজি খেলাম। মনটা একদম ফুরফুরে হয়ে গেল। নিমিষেই সকল অস্থিরতা উধাও। মুশতাক বা মুরালিধরণের দিকে কিছুটা করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম- ‘সেলিম না রে,আমি মারুফ। ’
আমার কথা শুনে ওর চোখ যেন কপালে উঠল, মুখ ‘হা’ হয়ে গেল।
কন্ঠস্বরে প্রচন্ড বিস্ময়- ‘আরে মারুফ? তোকে আমি এতক্ষণ সেলিম মনে করে আসছিলাম? তুই তো দেখি সেলিমের মতোই মোটা হয়ে গেছিস! এজন্যই কনফিউজড হয়ে গেছি। এই বয়সেই টাকও তো বানিয়ে ফেলেছিস বিশাল একটা!’’..
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।