দুচোখ বন্ধ, দুহাত কোমরে। ঘাড় বাঁকিয়ে হতাশা নিয়ে দাঁড়িয়ে মাহেলা জয়াবর্ধনে। পাশেই কুমার সাঙ্গাকারা। আড়াআড়ি দুহাত বুকে। চোখ খোলা, তবে শূন্যদৃষ্টিতে যেন কোন সুদূরে তাকিয়ে! যেন এই জগতে থেকেও নেই।
গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শেষের ছবি। প্রেমাদাসায় দুই কিংবদন্তি, দুই বন্ধুর ওই ছবিটি যেন শ্রীলঙ্কার ফাইনাল হতাশার প্রতীক। শ্রীলঙ্কা ফাইনালে ওঠে। শ্রীলঙ্কা ফাইনালে হারে। প্রেমাদাসার আগে ওয়াংখেড়ে, লর্ডস কিংবা ব্রিজটাউন।
ভিন্ন জায়গা, ভিন্ন অভিব্যক্তি, কিন্তু ছবির মূল সুর একই—হতাশা!
এই সাত বছরে আরেকটা ছবিও মোটামুটি নিয়মিত। মহেন্দ্র সিং ধোনির হাতে আইসিসি ট্রফি! ওয়ান্ডারার্স থেকে ওয়াংখেড়ে হয়ে লর্ডস। বদলেছে ট্রফির চেহারা। বদলেছে ধোনির চুলের স্টাইল। বদলায়নি স্মিত হাসিতে ট্রফি হাতে পোজ দেওয়ার ছবি।
কী রেখেছে আজকের মিরপুর? নতুন আবহে পুরোনো ছবি, নাকি তরতাজা নতুন কিছু দৃশ্যের চিত্রায়ণ! ক্রিকেটবিশ্বের কেন্দ্র আজ মিরপুর।
এমনিতে গত কয়েক বছরে বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে নিয়মিত দৃশ্য ভারত-শ্রীলঙ্কা ম্যাচ। অতি ভোজে তো অমৃতেও অরুচি ধরে! কিন্তু মঞ্চটা এত বড়, উপলক্ষের বিশালত্ব এমন যে ম্যাচের স্বাদ নেওয়ার জন্য তর সইছে না অনেকের। বিশ্বকাপ ফাইনাল বলে কথা। আর নিয়মিত দুই দলের লড়াইয়ের মাঝেও আছে অনেক প্রাপ্তির হাতছানি, আক্ষেপ ঘোচানোর অভিযান, অনেক বোঝাপড়া, হিসাব-নিকাশ।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ হয়ে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি—তিনটি আইসিসি টুর্নামেন্টেরই শিরোপাজয়ী একমাত্র অধিনায়ক ধোনি। এখন আরেকটি ‘একমাত্র’ কীর্তি গড়ার অপেক্ষা, প্রথম অধিনায়ক হিসেবে একসঙ্গে তিনটি আইসিসি ট্রফি জয়ের ইতিহাস গড়া! ২০১১ বিশ্বকাপ জয়ের পরই তো সৌরভ গাঙ্গুলী বলে দিয়েছিলেন, ভারতের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক ধোনি। আজ আরেকবার ট্রফি ছুঁতে পারলে সৌরভের সঙ্গে দ্বিমত করার লোক থাকবে না হয়তো একজনও।
একটি বিশ্ব শিরোপার জন্য শ্রীলঙ্কার অপেক্ষা দেড় যুগের। দলের দুই মহিরুহের জন্য অপেক্ষাটা যেন অনন্ত! ১৯৯৬ সালের ১৭ মার্চ গাদ্দাফিতে যখন বিশ্বজয়ের উৎসব করছেন ডি সিলভা-রানাতুঙ্গারা, কলম্বো ও ক্যান্ডির দুই তরুণ তখন স্বপ্নাতুর চোখে তাকিয়ে টিভি পর্দায়।
একজনের জাতীয় দলে অভিষেক হয়েছে পরের বছরই, আরেকজনের আরও তিন বছর পর। তরুণ প্রতিভা থেকে ক্রমে বিকশিত হয়েছেন দুজন, দলের সেরা থেকে মিলেছেন বিশ্বসেরার কাতারে। হাত ধরাধরি করে পথচলায় সতীর্থ থেকে দুজন হয়ে উঠেছেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দুজনে মিলে খেলেছেন ১১৫৫টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ, রান করেছেন ৫০ হাজারের বেশি। জুটির রেকর্ড, ব্যক্তিগত রেকর্ড, আরও কত কত অর্জন।
ধরা দেয়নি শুধু একটি বিশ্ব শিরোপা। মাহেলা জয়াবর্ধনে ও কুমার সাঙ্গাকারার সমৃদ্ধ ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় আক্ষেপ, শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের দুঃখ!
আক্ষেপটা ঘোচানোর শেষ সুযোগ হয়তো আজই। ২০১৫ বিশ্বকাপ পর্যন্ত ওয়ানডে খেলে যাবেন দুজনই। কিন্তু কে জানে, হয়তো আঁততায়ী হয়ে দেখা দিতে পারে চোট। আর খেললেও অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশনে শ্রীলঙ্কার ফাইনাল খেলার নিশ্চয়তা কোথায়!
এমনিতে ফাইনালের মুখোমুখি লড়াইয়ের দুদলকে আলাদা করা মুশকিল।
নয়টি ফাইনাল জিতেছে ভারত, আটটি শ্রীলঙ্কা। কিন্তু এই পরিসংখ্যান শুধু বাস্তবতা নিয়ে ভুলই বোঝাবে। গত সাত বছরে আইসিসি টুর্নামেন্টের ফাইনাল মানেই শ্রীলঙ্কার হার! প্রথমবার অ্যাডাম গিলক্রিস্টের অতিমানবীয় ইনিংস, শেষবার হঠাৎ অতিমানব হয়ে ওঠা মারলন স্যামুয়েলস। মাঝে ধোনির দুর্দান্ত ফিনিশিং আর শহীদ আফ্রিদির চমকে দেওয়া পরিমিত পারফরম্যান্স। ফাইনালে শ্রীলঙ্কা আর ট্রফির মাঝে ঠিকই দাঁড়িয়ে গেছে কেউ না কেউ।
দুদলের ব্যবধানটা স্পষ্ট এই টুর্নামেন্টের বাস্তবতায়ও। প্রতিটি ম্যাচেই প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দিয়ে প্রথমবার অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কীর্তি গড়ার কাছাকাছি ভারত। শ্রীলঙ্কা সেখানে গ্রুপ পর্বেই ‘কেয়ার্টার ফাইনাল’ খেলে তবে উঠেছে সেমিতে। টুর্নামেন্ট শুরুর সময় দলের সেরা স্পিনার জায়গা হারিয়েছেন মাঝপথে এসে। আবার মাঝপথে এসে টিম ম্যানেজমেন্ট বুঝতে পেরেছে অধিনায়ক একাদশে জায়গা পাবারই যোগ্য নন।
সেমিফাইনাল জয়েও লেগে আছে খানিকটা বৃষ্টিভাগ্যের ছোঁয়া। তবে অদৃষ্টবাদী হলে এই বন্ধুর পথচলাই আশাবাদী করে তুলতে পারে জয়াবর্ধনে-সাঙ্গাকারাদের। সব সময় তো হেসেখেলে এগিয়ে হেরে যায় ফাইনালে এসে। এবার ফাইনালে আসতেই যেহেতু চড়াই-উৎরাই পেরোতে হয়েছে, শেষটায় কেন উল্টো হবে না!
সমস্যা হলো, ধোনির ভারত যে আইসিসি টুর্নামেন্টের ফাইনালে হারে না!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।