একটা ভাল পাঠ্যপুস্তককে স্বীকৃতি দিল না, ভাল কথা। তাই বলে সেই বইটা রেফারেন্স হিসাবে ছেলেপুলে পড়বে- সেই রাস্তাও বন্ধ করে দেওয়ার মানে কি? আশ্চর্যজনক হইলেও সত্য, হুমায়ুন আজাদের 'নারী', তসলিমা নাসরীনের 'ক' এর মত ডঃ শাহজাহান তপন- ডঃ রানা চৌধুরী-মুহম্মদ আজিজ হাসান স্যারের উচ্চমাধ্যমিক পদার্থবিজ্ঞান বইটিও এখন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ একটি বই!
যারা জানেন না তাদের জানাচ্ছি, উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে অবশ্যপাঠ্য হিসেবে শাহজাহান তপন-রানা চৌধুরী-মুহম্মদ আজিজ হাসানের যে বইটি গত কয়েক দশক ধরে শিক্ষার্থীরা পড়ে আসছে (সত্যি কথা বলতে যে বইটি না পড়ে অনেকেই পাশ করার কথাও চিন্তা করে না), সে বইটি এইবার জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের অনুমোদন পায়নি। অবাক করা ব্যাপার- যে ১৩টি বই অনুমোদনের জন্য জমা পড়েছিল, তার মধ্যে ১০টি অনুমোদন পেলেও তপন-রানা-আজিজ স্যারদের বইটি ১৩তম স্থান দখল করে! যে বইটি গত কয়েক দশক ধরে এক নম্বর বই হিসেবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা পরে আসছে সে বই এক বছরেই এত খারাপ হয়ে গেল? তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেই বইটি আসলেই নিম্নমানের তাহলে গত কয়েক দশক ধরে এই বইয়ের অনুমোদন দিয়ে সরকারীভাবে কি কয়েক কোটি শিক্ষার্থীকে ভুল শিখানো হয়েছে?
বইটির অন্যতম লেখক রানা চৌধুরী (যিনি আমার শিক্ষক) গত সপ্তাহেই বই অনুমোদন না পাওয়ার ব্যাপারটি তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে তুলে ধরেন। দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা তাঁর ছাত্রদের মাধ্যমে সবাই এ ব্যাপারে জানার পর তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে অনুমোদন না পাওয়ার পরও বইটি লেখকদের সম্মতিক্রমে প্রকাশিত হয় শিক্ষার্থীদের পাঠ-সহায়িকা হবে বিবেচনা করে।
কিন্তু স্যারের আজকের স্ট্যাটাসের মাধ্যমে জানলাম পাঠ্যপুস্তক বোর্ড থেকে আজকে জাতীয় দৈনিকে (ইত্তেফাক, সমকাল- ৬জুলাই) বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে অনুমোদনহীন বইয়ের প্রকাশনা-ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়েছে! স্যারের আজকের স্ট্যাটাসটি নিচে হুবুহু তুলে দিলাম লিংকসহঃ
"Rana Chowdhury
সত্যি বন্ধুরা আমি দু:খিত । লেখাটি দীর্ঘ হয়ে গেছে !
সত্যি সেলুকাস ! সত্যি বিচিত্র এই দেশ!
মহামতি আলেকজাণ্ডার ; আপনার উপলব্ধি আজো আরো সত্য !!
গাণিতিক ভাষায় যদি বলি সত্যি টু দি পাওয়ার ইনফিনিটি । নইলে আমাদের পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (NCTB ) জনগণের লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে পত্রিকায় একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির জন্য এই রকম একটি বিজ্ঞাপন দিতে পারতেন না “ পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত তালিকার বাইরে কোনো পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ, ক্রয় ও বিক্রয় না করতে নির্দেশ প্রদান করা হলো। ” যে কোন মতামত (পুস্তক প্রকাশতো পরের কথা )প্রকাশ করা এদেশের জনগণের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার। যদি কোনো পুস্তকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা থাকে , সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে ।
কিন্তু কেউ এভাবে কী নির্দেশ দিতে পারে ?
[ তাও যদি ১ম শ্রেণি থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের মতো প্রতিটি বিষয়ে বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত একটিমাত্র বই পাঠ্যপুস্তক হিসেবে বিনামূল্যে বিতরণ করা হতো । উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে কোনো কোনো বিষয়ে দশটিরও অধিক বই এর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এবং বেসরকারী প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিতও হয়েছে । তাহলে আরো দুই চারটি উন্নত মানের রেফারেন্স বই প্রকাশিত হলে অসুবিধা কোথায় ?]
ছাত্র-ছাত্রীরা কোন বিষয়ে তাদের জ্ঞান ভান্ডারকে সম্প্রসারিত করতে যে কোন বইয়ের আর আজকাল ইন্টারনেটের সাহয্য নেবে – সেটাই স্বাভাবিক । আর বেশি পড়াশোনা করে বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করে জ্ঞান আহরণে তাদেরকে উৎ সাহিত করাই আমাদের সকলের দায়িত্ব । সেখানে বিপরীতটাই করছে জ্ঞান বিজ্ঞান প্রসারণে যাদের কাজ করার কথা তারাই ।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদ কী তাদের উত্তর পুরুষেরা যাতে জ্ঞান বিজ্ঞানে উচ্চতর দক্ষতা অর্জন করতে না পারে তার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন ? আমাদের তিনলক্ষ মা-বোন কী তাদের ছেলে মেযে ,নাতি নাতনীরা সৃজনশীলতা আর কর্মে বিশ্বের সাথে পাল্লা দিতে না পারে তার জন্য নিজেদের ইজ্জত দিয়েছিলেন ? আর আমরা কী স্বাধীনতা পূর্ব শিক্ষার যাবতীয় সংগ্রামে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবনকে বাজী রেখে অংশ নিয়েছিলাম আমাদের সন্তানদের, আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের, আমাদের দেশের আগামী দিনের কর্ণধারদের অন্ধাকারচ্ছন্ন ও কূপমণ্ডূক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ?
আমাদের দেশের প্রাত:স্মরণীয় পণ্ডিতদের, বিশিষ্ট ও শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদদের এবং অভিজ্ঞ শিক্ষকদের জ্ঞান বিজ্ঞানের বিশেষ করে গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, অর্থনীতি. হিসাববিজ্ঞান, ভূগোল প্রভৃতি বিষয়ে রেফারেন্স পুস্তক প্রকাশ ও বিক্রয় না করার জন্য পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের মাননীয় সচিব নির্দেশ দিয়েছেন । তার এই নির্দেশের সাংবিধানিক ও আইনগত প্রশ্ন উথ্থাপন না করেও বলা যায় , তাহলে কি আমাদের বর্তমান প্রজন্ম বোর্ডের অনুমোদিত ( অনেক ক্ষেত্রে ভুল তথ্য ও তত্ত্ব সম্বলিত, বোর্ডের পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমের সাথে অসংগতিপূর্ণ , ক্ষেত্র বিশেষে বিপরীত ) বই এর বেশি জ্ঞান লাভ করতে পারবে না ? আমাদের বর্তমান শিক্ষার্থীরা কী বোর্ডের অনুমোদিত জ্ঞান ব্যতীত উপরে উল্লেখিত পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ ও শিক্ষকদের সহজবোধ্য ও আকর্ষণীয় করে রচিত জ্ঞান বিজ্ঞানের বই পড়ে নিজেদের বর্তমান জ্ঞান ভাণ্ডার সম্প্রসারিত এবং ভবিষ্যৎ উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের পথ সহজতর করতে পারবে না ? বিশ্বের অন্যান্য দেশের তাদের সমবয়েসী এবং সমক্লাশের ছাত্রছাত্রীদের সমমানের জ্ঞান আহরণ করতে পারবে না ?
বন্ধুরা আপনারা / তোমরা ভাগ্যবান / ভাগ্যবতী । পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী থেকে শুরু করে এদেশের স্বৈরাচারী সরকারও উচ্চতর জ্ঞান বিজ্ঞানের পুস্তক রচনা , প্রকাশ , ক্রয়-বিক্রয় করতে নিষেধাজ্ঞা জারী করে নি ।
এই নির্দেশ অনুসারে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর ছাত্রদের উপযোগী করে ব্যাংকিং এর কোনো বই রচনা করতে পারবেন না, আমাদের অর্থনীতির বিশ্বখ্যাত গবেষকরা বা অধ্যাপকরা একাদশ শ্রেণীর ছাত্রদের অথনীতির জ্ঞান লাভের জন্য কোনো পুস্তক প্রকাশ করতে পারবেন না , BCSIR এর মানণীয় চেয়ারম্যান ছাত্রছাত্রীদের উপযোগী করে রসায়নের কোনো পুস্তক প্রকাশ ও বিক্রয় করতে পারবে না , পারমাণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান তার অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞানের আলোকে আমাদের ছাত্র ছাত্রীদের জন্য বই লিখতে পারবেন না ।
মজার ব্যাপার আমাদের দেশের যে কোন পর্যায়ের ( জাতীয় বা স্থানীয় )নির্বাচনে অংশ গ্রহণের জন্য যেমন কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগেনা, কেবল ভোটার হলেই চলে ; তেমনি কোনো বই এর বোর্ডের অনুমোদন পেতে হলে লেখকদের কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে না ।
ভোটার বা বাংলাদেশের নাগরিক হতে হয় কী না – সেটা আবশ্য আমার জানা নেই ।
সত্যি সেলুকাস ! আমি ভাগ্যবান ! আমি ২০১৩ সালে মাধ্যমিক পাশ করিনি ।
আমি এই প্রজন্মকে মনে মনে হিংসে করতাম , তারা কত সহজে মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক, আইপ্যাড প্রভৃতি ব্যবহার করতে পারছে বলে । কিন্তু এখন দু:খ হচ্ছে তারা ইচ্ছেমতো এগুলোর তাত্ত্বিক ব্যাপার স্যাপারগুলো জানতে পারবে না । তাদেরকে অনুমোদিত বই এর বাইরে বই পড়তে তথা জ্ঞান লাভ না করতে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে ।
আমাদের সময় আমাদের অভিবাবক, শিক্ষক, কর্তৃপক্ষ পাঠ্য বই এর বাইরে বই পড়াকে উৎসাহিত করতেন । এদেরকে পড়তে হবে - কেবল যা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পড়তে বলা হয়েছে তা । একটা উদাহরণ দেই - পদার্থবিজ্ঞান থেকে । নতুন পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম তথা সিলেবাসে নিউটনের গতিসূত্র ও ভরবেগের সংরক্ষণশীলতার উদাহরণ হিসেবে পড়তে হবে (ক) ঘোড়ার গাড়ি (খ) নৌকার গুনটানা (গ) বন্দুকের গুলি ছোড়া আর (ঘ) মহাশূণ্যে অভিযান । আমার বর্তমান প্রজন্মের বন্ধুরা কেউ ঘোড়ার গাড়ি দেখেছে কী না ( অবশ্য শেরাটন হোটেলের মোড়ে ঘোড়ার গাড়ির ভাস্কর্য ছাড়া ) সন্দেহ আছে ।
এককালে নদীমাতৃক বাংলাদেশে বড় বড় মাল বোঝাই নৌকাকে স্রোতের অনুকূলে দাড় টেনে আর স্রোতের প্রতিকূলে গুনটেনে চলতে দেখা যেতো। আজকাল ইঞ্জিন চালিত নৌকার / ট্রলারের প্রচলন হওয়ায় আর নদী ও খালে বিপুল সংখ্যক সেতু, পুল , কালভার্ট তৈরি হওয়ায় অযান্ত্রিক নৌযানে তথা নৌকায় আর গুনটানা হয় না । কাজেই আমার তরুন বন্ধুরা বড় লোকের ড্রয়িংরুমের দেওয়ালে টানানো শিল্পীর আকা ছবি ছাড়া বাস্তবে গুনটানা দেখার কথা নয় । বন্দুক ছোড়লে পেছন দিকে ধাক্কা দেয় – এই তথ্য নব্য সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের কাজে লাগতে পারে !
আংশিক অন্তরীকরণ ( Partial Differentiation ) তো দূরের কথা অন্তরীকরণ না শিখায়েই শিক্ষাক্রমের একদম প্রথমদিকে ভেক্টর অধ্যায়ে তাদের মুখস্থ করানো হচ্ছে গ্রেডিয়েন্ট , ডাইভারজেন্স ও কার্ল । মজার কথা দুই বছরের ( একাদশ ও দ্বাদশ ) সারা শিক্ষাক্রম তথা সিলেবাসের কোনো অধ্যায়ের কোনো অনুচ্ছেদে বা কোনো বিষয়ে এগুলোর ব্যবহার বা উল্লেখ নেই – প্রয়োজনও নেই ।
উচ্চমাধ্যমিক পদার্থবিজ্ঞান শিক্ষার শুরুতে এই তিনটি জিনিষ মুখস্থ করলে ছাত্র ছাত্রীদের সৃজনশীলতা কত মাত্রায় উন্নীত হবে তা আমাদের মতো নগণ্য শিক্ষক বুঝতে অক্ষম ! বোস-আইনস্টাইন তত্ত্বের সত্যেন বসু , রমন প্রভাবের সি.ভি.রমন , তাড়িত দুর্বল বলের উদ্ভাবক আব্দুস সালাম থেকে শুরু করে অদ্যাবধি এই উপমহাদেশের সকল বিজ্ঞানী , ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পদার্থবিদ, পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক/অধ্যাপকরা একাদশ বা দ্বাদশ শ্রেণীতে গ্রেডিয়েন্ট , ডাইভারজেন্স ও কার্ল মুখস্থ না করেও তাদের স্ব স্ব পর্যায়ে উপনীত হয়েছেন ।
সত্যি বিচিত্র আমাদের এই দেশ । "
স্যারের আজকের স্ট্যাটাসের লিঙ্ক
বই অনুমোদন না পাওয়ার বিষয়ে স্যারের প্রথম স্ট্যাটাস
পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে কারা বসে আছে? তারা কি করে, কেন করে, কার/ কাদের জন্য করে খুব জানতে ইচ্ছা হচ্ছে। একটা গনতান্ত্রিক দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের এ প্রশ্নের জবাব রাষ্ট্র দিতে বাধ্য (যদি না ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ একটি ব্যার্থ রাষ্ট্র না হয়ে থাকে)। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।