বিয়ে বাড়ীতে বর এসেছে। হৈহৈ রব পড়ে গেল চারিদিকে। বরকে দাঁড়িয়ে রেখে শুরু হলো গেট ধরার নাটক। পাত্রীপক্ষের ডিমান্ড বরপক্ষ মানছে না। খুনসুটি থেকে আস্তে আস্তে তা তর্কাতর্কিতে পরিণত হলো।
একজন মন্তব্য করে বসলো-"বিয়ের আগেই দেখা যাচ্ছে এদের কি অবস্থা। সামান্য বিষয় নিয়েই এই?" অপরপক্ষ বলে উঠল, "কি, এত বড় কথা। আমাদের ইজ্জত সম্মানের হানি করা হচ্ছে? ঐ, সবায় আয়, এ বিয়ে হবে না। " ব্যস ভেঙে গেলো বিয়ে। অসহায় পাত্র-পাত্রীর চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকল না।
বিয়ের পর এক বন্ধুর দেখা হয়েছে আরেক বন্ধুর সাথে। সাথে স্ত্রীকে দেখে একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করল, "কিরে, এটা কে?" বলল-"আমার স্ত্রী"। "তুই বিয়ে করেছিস আর আমাকে জানাসও নি? যাহ, তোর সাথে সম্পর্কই শেষ"। একই কারণে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায় পাত্র-পাত্রীর পিতামাতার সাথে কোন কোন আত্মীয় বা কলিগের।
বিয়েবাড়ীতে বরের দূরসম্পর্কের মামা খেতে বসেছেন।
খবারের মাঝপথে রাগারাগী করে উঠে গেলেন তিনি। কারণ বরের মামা হিসাবে আস্ত মুরগীর রোস্ট তার পাতে দেয়া হয়নি, এটা কেমন ছোটলোকী? পরিণতিতে সম্পর্ক নষ্ট দুই পরিবারের।
এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বোধ করি এদেশের অধিকাংশ পরিবারেরই আছে। বল্গাহীন শপিং থেকে শুরু করে জাঁকজমকপূর্ণ গায়ে হলুদ, জমকালো খাওয়া এমন সব কাজে পানির মতো টাকা খরচ করার পরও এই অভিজ্ঞতা থেকে কোন মুক্তি নেই কোন বিয়ের অনুষ্ঠানেরই। অথচ কি সহজ সরল ও কি অসাধারণ ছিলো রাসুলুল্লাহ সাঃ ও ইসলামের শিক্ষা তা মাত্র দুটি হাদিস বিশ্লেষণ করলেই জানা যায়।
আসুন দেখা যাক।
আনাস বিন মালিক রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাঃ আবদুর রাহমান বিন আউফের জামায় হলুদ রঙ দেখে জিজ্ঞেস করলেন, "কি ব্যাপার আবদুর রাহমান?" আবদুর রাহমান উত্তর করলেন, "ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমি আনসারদের একটি মেয়েকে বিয়ে করেছি"। রাসুলুল্লাহ সাঃ বললেন, "তুমি তাকে কি (মাহর) দিয়েছ?" আবদুর রাহমান বললেন, "এক খেজুরের আঁটি সমান সোনা মাহর দিয়েছি"। রাসুলুল্লাহ সাঃ বললেন,"আল্লাহ্ তোমাদের উপর রহমত বর্ষণ করুন। তুমি একটি ভেড়া দিয়ে হলেও ওয়ালিমা দাও"।
(বুখারীঃ ৮/৩৯৫)
জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজনের একজন আবদুর রাহমান বিন আউফ ছিলেন একজন মুহাজির সাহাবী যিনি মক্কায় ছিলেন সবচেয়ে ধনীদের ভেতর একজন। হিজরত করে তিনি মদীনায় এসেছিলেন শূণ্য হাতে। মদীনায় এসে তিনি ব্যবসা শুরু করেন ইয়াহুদীদের অধ্যুষিত বাজার বনু কায়নুকায়। আল্লাহ্র ইচ্ছায় অচিরেই তাঁর ব্যবসায় ব্যাপক লাভ হতে থাকে এবং এক সময় তিনি আবার মদীনার সেরা ধনীদের একজনে পরিণত হন। মদীনায় আবদুর রাহমানের কোন আত্মীয় ছিল না, সকল ক্ষেত্রেই রাসুল সাঃ ছিলেন তাঁর সবচেয়ে কাছে মানুষ।
তিনি যদি বিয়ে করেন তাহলে প্রথম দাওয়াত যে রাসুলের পাবার কথা তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। অথচ তিনি বিয়ে করেছেন রাসুলের অজ্ঞাতে। এই কথা শুনে রাসুলুল্লাহ সাঃ কি বলেছেন? তিনি বলতে পারতেন-"এটা কি করলে তুমি? বিয়ে করলে অথচ আমাকে জানালেও না?" না তিনি শুনে বরং দোয়া করলেন ও ওয়ালিমা করার আদেশ দিলেন। এই হাদিস থেকে বেশ কিছু সিদ্ধান্তেও আসা যায়।
- বিয়ের আগে রঙ ও রঙিন সুগন্ধী ব্যবহার করা যাবে।
আমাদের প্রচলিত হলুদ যদি পরপুরুষ ও পরনারী বর্জিত (যথাযথ পর্দায় নারী ও পুরুষের ভিন্ন কক্ষ থাকতে পারে), মিউজিক-গান বিহীন হয় তাহলে তাতে সমস্যা নেই।
- নির্দিষ্ট কাউকে জানাতেই হবে এমন বাধ্য বাধকতা নেই।
- সচ্ছল পাত্রের বিয়েতে তার সামর্থ অনুযায়ী মাহর দেয়া আবশ্যক (সেটা রাসুলুল্লাহ সাঃ খবর নিয়েছেন)
- কনের পক্ষের কোন অনুষ্ঠান করার প্রয়োজন নেই।
- বরের অবশ্যই ওয়ালিমা করতে হবে। যত ধনীই হোক একটি ভেড়া বা ছাগল দিয়ে ওয়ালিমা করলেই হবে।
- বিয়ের অন্যান্য কেনাকাটা বা আনুষ্ঠানিকতার কোন আবশ্যকতা নেই।
- বিয়ের অনুষ্ঠানে অনেকেই কিছু কাজকে এমনভাবে পালন করেন যেন সেগুলো না করলে অন্যায় হবে। আসলে সেগুলো অন্যায় তো নয়ই, বরং তা আবশ্যক মনে করলে কুসংস্কার ছড়ানোর দোষে দোষী হবে।
এবার দেখা যাক দ্বিতীয় হাদিসটি।
সাহল বিন সা'দ রাঃ থেকে বর্ণিত।
তিনি বলেন, একটি মহিলা রাসুলুল্লাহ সাঃ এর কাছে এসে বলল, "ইয়া রাসুলুল্লাহ, আপনি আমাকে বিয়ে করুন"। তিনি তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে মাথা নীচু করলেন। মহিলাটি যখন দেখল রাসুল সাঃ তার ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত দেননি তখন বসে পড়ল সেখানে। এ সময় একজন সাহাবা উঠে দাঁড়ালেন ও বললেন, "ও আল্লাহ্র রাসুল, আপনি যদি তাকে বিয়ে না করেন তবে আমার সাথে তার বিয়ে দিন"। রাসুল সাঃ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, "তোমার কাছে তাকে (মাহর) দেয়ার মতো কিছু আছে কি?" লোকটি বলল, "আল্লাহ্র শপথ ইয়া রাসুলুল্লাহ, কিছুই নাই"।
রাসুল বললেন, "তোমার বাড়ী যাও আর গিয়ে দেখ কিছু পাও কিনা"। কিছুক্ষণ পর লোকটি ফিরে এসে বলল, "ও আল্লাহ্র রাসুল, আমি কিছুই খুঁজে পাইনি"। রাসুল সাঃ বললেন, তুমি আবার যাও। দেখ একটি লোহার আংটি হলেও পাওয়া যায় কিনা"। লোকটি আবার ফিরে এল।
বলল, "আল্লাহ্র শপথ ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমি একটা লোহার আংটিও পাইনি। তবে এই চাদরটা পেয়েছি। এর অর্ধেক আমি তাকে দিয়ে দেব"। তিনি বললেন, "এই চাদর দিয়ে সে কি করবে? যদি সে এটা পরে তাহলে তুমি তা পাবে না আর যদি তুমি এটা পর তাহলে সে এটা পাবে না"। মন খারাপ করে অনেক্ষণ বসে রইল লোকটি।
এক সময় উঠে চলে যেতে লাগল। রাসুল সাঃ অন্য একজনকে দিয়ে তাকে ডাকিয়ে আনলেন। তিনি বললেন, "তুমি কুরআন কতটুকু জান?" সে বলল, "অমুক সুরা, অমুক সুরা"। তিনি বললেন, "তোমাকে আমি তার সাথে বিয়ে দিলাম তুমি কুরআনের যা জান তার বিনিময়ে"। (সহীহ বুখারী ৬২/২৪)
খুব সিম্পল শোনালেও অনেক কিছু এই একটি হাদিস থেকেই পাওয়া যায়।
মহিলা যখন রাসুলের কাছে নিজেকে বিয়ের জন্য উপস্থাপন করলেন তখন রাসুল তাকে বলেননি, "কেন তুমি লজ্জার মাথা খেয়ে নিজের বিয়ের প্রস্তাব নিজেই দিয়েছ?" অথবা বলেননি, "কেমন সাহস তোমার তুমি স্ব্যং রাসুলের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্চ?" লোকটা যখন মহিলাকে বিয়ে করতে চাইল, তখন তিনি বললেন না, "সে রাসুলকে বিয়ে করতে চাইছে আর তুমি মাঝখানে নিজেই বিয়ে করতে চাইছ?" মহিলাটিও লোকটির প্রস্তাব সরাসরি ফিরিয়ে না দিয়ে রাসুলের সিদ্ধান্ত মাথা পেত নিল কোন প্রতিবাদ ছাড়াই এবং শেষ পর্যন্ত কুরআনের জ্ঞানকেই মোহর হিসাবে নেমে নিল। এবার আসুন দেখা যাক এই একটি হাদিস থেকে কতটি দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়।
- মেয়েরা স্বেচ্ছায় যে কোন মুসলিমকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারে (তবে বিয়ের সময় মেয়ের পক্ষ থেকে ওয়ালি থাকতে হবে)।
- যতই অসমর্থ হোক না কেন, বিয়ের সময় মাহর দিতেই হবে।
- প্রস্তাব ও মতামতে পাত্র-পাত্রীর পূর্ণ স্বাধীনতা আছে।
- কোন আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই বিয়ে হতে পারে।
- পাত্রের সামর্থ অনুযায়ী মাহর নির্ধারিত হবে। সামর্থ কম হলে মাহরও কম হবে।
- পাত্রকে বেশী মহর দিতে বাধ্য করা হবে তার উপর জুলম।
- পাত্রের সামর্থ কম হলেও রাসুলের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে পাত্রীকেও তা বিনা দ্বিধায় মেনে নিতে হবে।
আল্লাহ্ কুরআনে বলেছেন, "লাক্বাদ কা-না ফী রাসুলুল্লাহি উসওয়াতুন হা'সানা" -"তোমাদের জন্য রাসুলের জীবনই হলো সর্বোত্তম আদর্শ"। সুতরাং বিয়ের অনুষ্ঠানে সেটুকুই কেবল আবশ্যক যা রাসুলুল্লাহ সাঃ করেছেন বা করতে বলেছেন। এর বাইরে কিছু পালন না করলে কেউ যদি অখুশী হয় তাহলে আমরা কেবল বলতে পারি, "দুঃখিত, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ঠ"। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।