পি এম বাহার আহমেদ তোমার স্মৃতিগুলো মনে পড়ে
পি এম বাহার আহমেদ
ধুম করে একটা ঘুশি দিলো সোহানা। সহিদ বলে, 'তুমি একটা দিয়েছ, আমি দুটো ঘুশি মেরে শোধ নেবো!' সোহানা শুনে অবাক হয়। 'সত্যি তুমি ঘুশি দেবে!' 'অবশ্যই দেবো। ' সহিদ হাত বাড়ালো। সোহানা প্রতিবাদ করে বললো, 'এই, না ভাইয়া! আজকের জন্যে মাফ করে দাও।
' 'তাহলে কানে ধরো, তবে মাফ করতে পারি। ' সহিদের কথায় কানে ধরল। বললো', উঠ্-বস করতে হবে নাকি'? 'কেনো নয়? জলদি উঠ্-বস কর। তা' না হলে এই দিলাম......। ' ঘুশি খাওয়ার ভয়ে তিনবার উঠ্-বস করল সোহানা।
তারপর সোহানা কান ছেড়ে দাঁড়ালো। সহিদ মুখ ফিরিয়ে অন্য রুমের দিকে যেতেই ফের সোহানা পেছন থেকে ধুম করে একটা ঘুশি দিলো। ফিক্ করে হেসে দিয়ে দৌড়ে পালালো সে।
সোহানা সহিদের চাচাতো বোন। ইন্টারমিডিয়েট ২য় বর্ষের ছাত্রী।
সহিদ সবেমাত্র অনার্স শেষ করেছে। দু'জনেই খুব মেধাবী। অথচ একে অন্যের আচার-ব্যবহারে মনে হয় না ওরা এখন পরিণত বয়সে পা-দিয়েছে। ছোট থেকেই ওরা কিল-ঘুশি খেলায় অভ্যস্ত। এখন ওরা অনেক বড়ো হয়েছে।
কিন্তু ছোটবেলার দুষ্টুমি আজো কেউ ভুলতে পারেনি। সোহানা সুযোগ পেলেই সহিদকে কিল-ঘুশি দিয়ে পালিয়ে যায়। কখনও ধরা পড়লে হলো, কানে হাত রেখে প্রতিজ্ঞার কথা শুনাবে। ভবিষ্যতে আর এমন দুষ্টুমি করবে না। আবার হাত জড়ো করে সহিদের কাছে ক্ষমা চাইতেও ভুল হয় না।
তবে এই মাফ চাওয়া, প্রতিজ্ঞার কথা বেশিক্ষণ ওর মনে থাকে না। এভাবে তাদের জীবন কেটে যাচ্ছে। দুষ্টুমিও দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে। একরকম বলা চলে, দুষ্টুমি ছাড়া তাদের জীবন চলে না। এইতো কিছু দিন আগের কথা।
সহিদের বড় ভাই সোহেল সবেমাত্র বিয়ে করেছেন। সোহেল ঢাকায় থাকে। অফিসে গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকায় ছুটি পাচ্ছিল না। সোহেলের স্ত্রী তখন বাপের বাড়িতে। সোহেল সহিদকে ফোন করে জানিয়ে দিলো, গ্রামে আসতে পারবে না।
ফলে বাপের বাড়ি থেকে ভাবীকে আনতে দেবরের ওপর দায়িত্ব পড়লো। সোহেল চঞ্চল প্রকৃতির। বেড়ানোর সখ বেশি তার। সিদ্ধান্ত নিলো, পরদিন বড় ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ি যাবে। সোহানাও বায়না ধরলো সহিদের সঙ্গে যেতে।
বেচারি নাছোড়বান্দা। বাধ্য হয়ে পরদিন সোহানাকে সাথে নিয়ে বড়ো ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ি এলো। সোহেলের শ্বশুর বাড়ির সবাই ধর্মীয় অনুভূতির লোক। তারা সোহেলের সাথে সোহানাকে একা দেখে ভালো মন্তব্য করার মতো কথা খুঁজে পেলো না। তবুও ওরা মেহমান।
নতুন আত্মীয়, কোনোরকম মন বজায় রাখা দরকার মনে হলো। তাই ইচ্ছে না থাকলেও তাদেরকে সবাই আদর-সমাদর করে যাচ্ছে। যাতে বাড়িতে ফিরে কেউ কিছু বলতে না পারে। তবে সোহেলের দাদী শ্বাশুড়ি ভিন্ন প্রকৃতির মহিলা। বয়স সত্তরের কম হবে না।
সহিদ ও সোহানার মধ্যে একে অপরের হাত ধরাধরি আর কানে-মুখে ফিস্ফিস কথা-বার্তা ভালো ঠেকলো না তার কাছে। একবার প্রতিবাদ করতে গিয়েও আর করেনি। সোহেলের শ্বশুর বললো, 'থাক না-মা। ওরা এখনও ছোট। বুঝের হলে সবার সামনে কি এমন করতো?' সহিদের ভাবী অবশ্য ফ্রি-টাইপের মেয়ে।
দেবর-ননদিনীর সব ঘটনা তার কাছে হাসির মতো মনে হলো। ফলে ভাবীর কাছ থেকে কোনো প্রতিবাদ নেই।
সেদিন সন্ধার একটা ঘটনা বাড়ির অনেকেই মেনে নিতে পারেনি। তা আবার ওই বুড়ির চোখে না পড়লেই হতো। সহিদ খাটের কোণায় হেলান দিয়ে বসে আছে।
পায়ের দিকে সহিদের ভাবী। তার একটু পাশে বৃদ্ধা মহিলা। এরা তিনজন কথা বলছিলো। এ সময় সোহানা এলো। সহিদের মাথার পাশে বসে ওর দু'গাল ধরে টানতে টানতে বলছিলো, 'এতো সকালে বাবু মশাই ঘুমাচ্ছে নাকি!' বৃদ্ধা মহিলা সোহানের চরিত্রটা খুব কাছে থেকে দেখলো।
প্রথমে বৃদ্ধা আকাশ থেকে পড়ার ভাব দেখালেন। বললেন, 'ছি! ছি! ছি! কলির যুগে কী দেখছি এসব! দুনিয়া কি জাহান্নাম হয়ে গেছে নাকি! ঐ ছেমরি লজ্জা-শরমের মাথা খেয়েছ বুঝি? বাপের জন্মে এমন একটা মেয়ে দেখিনিরে বাবা!' উপস্থিত সবাই অবাক হলো। বৃদ্ধা তরতর করে রুম ছাড়লেন। ঘরের সবাইকে ডেকে ঘটনাটা বলতে লাগলেন। এ' দেখছি ছাড়ার গরু ঘাড়ে এসে বসলোরে বাবা।
কলির যুগে আর কী দেখাবে খোদা!'
পরের দিন ভাবীকে নিয়ে দেবর-ননদিনী বাড়ি ফিরলো। বাড়িতে এসে সোহানা কাঁদতে শুরু করলো। সে কি কান্না। সবাই বুঝায়, সান্ত্বনা দেয়। সহিদও একথা ওকথা বলে।
তবু সোহানার কান্না থামে না। কয়েকদিন হয়ে গেলো, সোহানা কারো সাথে অপ্রয়োজনীয় কথা বলে না। নাওয়া-খাওয়া একদম ছেড়ে দিয়েছে। আগে যেমন সহীদের সঙ্গে সারাদিন দুষ্টুমি করে সময় কাটাতো, এখন তা' করছে না। কেনো যেনো শুধু সহিদের কাছ থেকে দূরে সরে থাকতে চায়।
লজ্জায় না অভিমানে কেউ জানে না। ইদানীং সহিদ খুব একা হয়ে গেছে। সারাক্ষণ যে মেয়েটি আনন্দে মাতিয়ে রাখতো, সেও এখন কাছে আসে না। কেমন যেনো গোমড়া হয়ে গেছে। তাই জেদ করে সহিদ একদিন ঢাকায় চলে যায়।
ঢাকার অলি-গলি ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে ওর। বড় ভাই সোহেলের সাথে থাকে-খায়। একদিন সহিদের জীবনে এক সুন্দরী মেয়ের দেখা হয়। পরিচয় হয়। কথাও হয় মোবাইলে।
কিছুদিনের মধ্যে শহরের এধারে-ওধারে ডেটিং শুরু হয়। মেয়েটিকে সহীদের ভালো লাগে। তাই মনের অজান্তে মন দিয়ে ফেলেছে। মেয়েটির নাম অহনা। অহনা খুব সুন্দরী।
ওর মতো দু'চারটি মেয়ে শহর খুঁজলেও হয়তো পাওয়া যাবে না। যেমন নম্র তেমনই ভদ্র। বেশ হাসি-খুশি কাটে সারাক্ষণ। অহনা অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী। সে বুঝতে পারে সহিদ তাকে ভালোবাসে।
তাই সেও সহিদকে ভালোবাসতে শুরু করে।
অহনা একদিন বাসায় নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে সহিদকে পরিচয় করিয়ে দেয়। উচ্চ বিত্তের মানুষ হলেও তাদের ব্যবহার খুব সুন্দর। মনে হচ্ছে সুন্দর মন-মানসিকতার কারণে মেয়ের পছন্দকে তারা স্বাগত জানান। সহিদ এখন প্রতিদিন অহনাদের বাসায় আসে।
সবাই মিলে গল্প করে। একদিন সহিদের বড় ভাই সোহেল অহনাদের বাসায় যায়। সেদিন থেকে বলতে গেলে সহিদ ও অহনার ভবিষ্যত নিশ্চিত হয়। ওরা দু'জন বুঝতে পারে, সেদিন আর বেশি দূরে নয়। যেদিন ওরা দু'জনে শয্যাসঙ্গী হবে।
সহিদ আজ তিনদিন হলো গ্রামে ফিরেছে। কিন্তু অহনার কথা বাড়ির কাউকে বলেনি। চারদিন পর সোহেল আসবে। তারপর সহিদ অহনাকে নিয়ে সব কথা হবে।
আজকাল সোহানাকে ভিন্ন ধাঁচের মানুষ মনে হচ্ছে।
প্রায়ই সহিদের কাছে আসে। আগের মতো আর দুষ্টুমি করে না। সহিদের মনের খোঁজ-খবর নেয়। নিজে খাবার এনে খেতে দেয়। গভীর দৃষ্টিতে সহিদের দিকে চেয়ে থাকে।
যেমনি করে ঢাকার মেয়ে অহনা তার দিকে চেয়ে থাকতো। এদিকে সোহেল এসে সহিদ-অহনার বিয়ের কথা আলাপ করে। বাবা-মা এতে রাজি হননি। ঘরের মেয়ে সোহানাকে তাদের পছন্দ। ভাইজিকে তারা ঘরের বউ দেখতে আগ্রহী।
বাবা-মায়ের এ আগ্রহ শেষে কাজে আসেনি। সোহানা নয়, এখন অহনার সাথে সহিদের বিয়ে হবে। তা' হবে পরের মাসে। সোহানার বিশ্বাস হয় না, সহিদ অন্য মেয়েকে বিয়ে করবে। কিন্তু কথা ফেলেও দেয়া যায় না।
এলাকার সবাই বলাবলি করছে। দু' পরিবারের সবাই জানে। তবু সোহানার মন বলছে সব মিথ্যে সাজানো গল্প। সহিদ উঠোন দিয়ে কোথাও যাচ্ছিল। সোহানা ডাকলো, বললো, 'তুমি শুনেছি ঢাকার এক মেয়েকে বিয়ে করছ! এটা কি সত্যি?' সহিদ সহজে উত্তর দেয়, 'হঁ্যা-সত্যি'।
সোহানার মাথায় যেনো বজ্রপাত হয়েছে। নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দু' চোখে কয়েক ফোঁটা জল নেমে এলো। সোহানা বুঝলো এখানে দাঁড়িয়ে থাকার অধিকার আর নেই। অধিকার সে হারিয়ে ফেলেছে।
ঘরে নিজ রুমে এসে বালিশে মুখ লুকিয়ে অনেক কাঁদলো সে। কান্না ক্রমশঃ বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে কয়েকদিন গেলো। অসুস্থ হয়ে পড়লো সে। ডাক্তার এসেছে।
ওষুধ দিয়ে গেছে। কিন্তু অসুখ কমেনি। সাধারণ জ্বর এখন টাইফয়েড জ্বরে পরিণত হয়েছে। রাত তিনটার দিকে ঘরে কান্নাকাটি শুরু হয়। আশেপাশের ঘরের সবাই কান্না শুনে আসে।
সহিদ এসে সোহানার পাশে বসে। জ্বরের তাড়নায় সোহানা বলছে, 'তোকে খুব ভালবাসি-রে। আমাকে বেনারশিতে খুব মানবে না? এই যাহ্! তুইতো ঢাকার মেয়েকে বিয়ে করবি। এখন আমার কি হবে-রে। ' এরকম অনেক কথাই বললো সে।
এক সময় সোহানা ঘুমিয়ে পড়ে। মা-বাবা ডাকে, সহিদ ডাকে, বাড়ির সবাই মিলে ডাকে কিন্তু ঘুম ভাঙ্গে না সোহানার। সে অভিমান করেছে। তাই কারো কথা শুনবে না। আর জেগে ওঠবে না।
সহিদ এতোদিন বুঝতে পারেনি সোহানা তাকে কতো ভালোবাসতো। আজ তার মৃতু্যর মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিলো সে। সোহানার মৃতু্য সহিদের জীবনকে এলোমেলো করে দিয়েছে। তাই সে অহনাকে বিয়ে করেনি। একা এক মানুষ সে।
একাই দুনিয়ায় এসেছে। একাই ফিরে যাবে। তাই কোনো সঙ্গীর দরকার পড়ে না তার। কিন্তু একা থাকার কষ্ট সে বুঝতে পারে। তবু কষ্টগুলো ভালো লাগে তার।
আজ অনেক বছর কেটে গেছে। সহিদের কষ্টের দিনগুলো কাটছে না। সোহানার স্মৃতিগুলো তার জীবনকে যন্ত্রণার মাঝে ঠেলে দেয়। মরণব্যাধি যন্ত্রণা অনুভব হয়। তবু সে সোহানার কথা ভাবে।
সব কষ্ট সহিদের কাছে সুখ হয়। সোহানার স্মৃতিগুলো মনে রাখতে চায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।