একজন যুগ্ম জেলা জজের অধীনে ঢাকায় একটি পরিবেশ বিষয়ক আদালত থাকলেও ‘মামলাশূন্যতায়’ তা অনেকাংশে নিষ্ক্রিয়।
এ আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল পরিবেশ বিষয়ের মামলার বিচারের জন্য। মামলা পরিচালনার জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছিল রাষ্ট্রের একজন কৌঁসুলি ও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারী। কিন্তু তেমন মামলার সংখ্যা একেবারেই কম হওয়ায় এ আদালতে এখন সাধারণ দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলারই বিচার চলে।
মামলার তালিকা ও নিবন্ধন খাতা ঘেটে দেখা যায়, চলতি বছর এ আদালতে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে মামলা হয়েছে মাত্র পাঁচটি।
আর পুরনো মামলা আছে শ’ খানেক।
এ ধরনের প্রতিটি মামলাতেই নিয়ম অনুযায়ী পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন চান এ আদালতের বিচারক বেগম ফাইজুন্নেসা। কিন্তু তারিখের পর তারিখ পার হলেও অধিদপ্তর প্রতিবেদন না দেয়ায় মামলার নিষ্পত্তি আর হয় না।
একই পরিস্থিতি চট্টগ্রামের পরিবেশ আদালতেও। সেখানে এ বছর মামলা হয়েছে মাত্র তিনটি।
আর চারটি হয়েছে নগরীর বিভিন্ন থানায়। চট্টগ্রামে পরিবেশ বিষয়ক পুরনো মামলা রয়েছে ২৪৩টি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অনুসন্ধানে জানা যায়, পরিবেশ অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমাণ আদালত জরিমানার মাধ্যমে অনেক অভিযোগের নিষ্পত্তি করে দেয়। ফলে ঢাকাসহ দেশের পরিবেশ আদালতগুলোতে পর্যাপ্ত মামলা আসে না।
গত ১৬ মে ইটভাটার দূষণের অভিযোগে চন্দনাইশের শাহ আমানত ব্রিকসের তিন মালিক রহিম আহমেদ, মফিজুল আলম ও জসীম উদ্দিনের প্রত্যেককে ৬ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়।
চট্টগ্রামের আদালতের বিশেষ পিপি আব্দুল হান্নান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মামলা হলে আমরা দ্রুত তা নিষ্পত্তির চেষ্টা করি। অথচ অধিদপ্তরের অসহযোগিতার কারণে আদালতে পর্যাপ্ত মামলা নেই। ”
ভ্রাম্যমাণ আদালতের শাস্তি দেয়ার ও বিচারিক ক্ষমতা সীমিত হওয়ার পরও গুরুতর অনেক বিষয়েই শেষ পর্যন্ত আদালত পর্যন্ত আসে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ঢাকার পরিবেশ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ কৌঁসুলি কাজী ফিরোজুর রহমান মন্টু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বুধবার বলেন,“পরিবেশ অধিদপ্তর পরিচালিত অভিযানে প্রতি সপ্তাহেই এ রকম দোষী প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়। কিন্তু কিছুদিন পর তারা আবারো একই ধরনের অপরাধে জড়ায়।
ফলে অধিদপ্তরের উদ্যোগ তেমন কোনো কাজেই আসছে না। ”
পরিবেশ আইন বাস্তবায়নে অধিদপ্তরের ভূমিকা অনেকটাই ভারসাম্যহীন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
“অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে পরিবেশ বিষয়ক আইনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ বিভিন্ন ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করতে হলে তাকে আগে আইন অনুযায়ী নোটিস দিতে হবে। কিন্তু অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা যেভাবে যে পরিমাণ জরিমানা করছেন তাতে সবক্ষেত্রে সঠিকভাবে আইন মানা হচ্ছে না।
”
অধিদপ্তরের কিছু কর্মকর্তা ‘বিশেষ উদ্দেশ্যে’ অল্প জরিমানা করে দোষী শিল্প কারখানাকে ছেড়ে দেয়ায় সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন এই আইনজীবী।
তবে বিচারপ্রার্থীদের অভিযোগ, অধিদপ্তর ও আদালতের কাজে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। মামলা তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা ও বিচার বিলম্বিত হয় বলে ক্ষতিগ্রস্ত অনেকেই আদালতে যেতে চান না।
চলতি বছর ঢাকার পরিবেশ আদালতে হওয়া পাঁচটি মামলার মধ্যে একটি গত ১৭ ফেব্রুয়ারি দায়ের করেন ঢাকার শ্যামপুরের নতুন আলী বছর এলাকার ডিএনএ সড়কের বিক্রমপুর হাউজিং সোসাইটির মো. আলমাছ তালুকদার। বিবাদী করা হয়, পার্শ্ববর্তী আল অমিন হার্ডওয়ার ওয়ার্কস এর মালিক মো. আবদুল্লাহ খানকে।
অভিযোগে আনা হয়, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই ওই হার্ডওয়ার কারখানা ঝালাই, রিরোলিং কাজ সহ অন্যান্য কাজ চলছে। যার কারণে শব্দ দূষণ, মাটিতে কম্পনের পাশাপাশি পরিবেশ দূষণ হচ্ছে।
তবে বিচারক বার বার প্রতিবেদন চাইলেও অধিদপ্তর প্রতিবেদন দেয়নি। ইতোমধ্যে বিবাদী আলমাস ওই মামলায় জামিন নিয়ে নিয়েছেন।
৪ মার্চ সদর ঘাটের ঢাকা নদীবন্দরের (অভ্যন্তরীণ নৌ কর্তৃপক্ষ) যুগ্ম পরিচালক মো. সাইফুল হক খান তুরাগ নদীর তীরে বালুর গদি নির্মাণ করে নদীর স্বাভাবিক গতি প্রবাহকে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির অভিযোগে ঢাকার শাহ আলীবাগ থানায় পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে মামলা করেন।
আসামি করা হয়, মিরপুরের দিয়াবাড়ি ও জহুরাবাদের মো. রিপন ও মো. সেন্টুকে।
পরের দিন মামলাটি ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালত থেকে এ আদালতে পাঠানো হয়। বিচারক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দিলেও প্রতিবেদন পাঠায়নি পরিবেশ অধিদপ্তর।
আর ১৫ এপ্রিলে একই ব্যক্তি বাদী হয়ে রাজধানীর দারুস সালামের মো. আলমাস উদ্দিন সেন্টু, মো. রিপন, কাজী মো. জহির, হাজী মো. আবুল বাসার, মো. মিয়াজ দেওয়ান, মো. সুমনের বিরুদ্ধে তুরাগ নদীর সীমানা অতিক্রম করে তীর ভূমিতে নদীর সীমানা পিলারের অভ্যন্তরে বালুর গদি নির্মাণ করে নদীর গতিতে প্রতিবন্ধকতা অভিযোগ এনে মামলা করেন সংশ্লিষ্ট থানায়। গত ১৬ মে তারিখে এ আদালতে মামলাটি বিচারের জন্য আসে।
এ মামলাটির বিচারও অধিদপ্তরের প্রতিবেদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
এই দীর্ঘ সূত্রতার বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. গোলাম রব্বানীর কাছে জানতে চাওয়া হলে অধিদপ্তরের পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) মো. আলমগীরের সঙ্গে কথা বলার জন্য তিনি পরামর্শ দেন।
তবে মো. আলমগীরকেও কথা বলার জন্য পাওয়া যায়নি।
পরে অধিদপ্তরের জলবায়ু পরিবর্তনও আন্তর্জাতিক কনভেনশনের পরিচালক আলমগীর মো. মনসুরুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি পরিবেশ অধিদপ্তরকে ‘সফল’ হিসাবে উল্লেখ করে বলেন, “অধিদপ্তর নয় বরং মানুষ আদালতের বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে আদালতে যান না। আর গেলেও আইনজীবী নিয়োগ অর্থ খরচ করতে চান না।
যে কারণে আদালতে মামলা কম হয়। ”
তিনি জানান, ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রায় ১১০ কোটি টাকা জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। আদায় করেছে প্রায় ৮০ কোটি টাকা অধিদপ্তর পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতগুলো। ”
পরিবেশ বিষয়ক মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী মাহবুবব হাসান রানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভ্রাম্যমাণ আদালত অন্যান্য ক্ষেত্রে যত সফলই হোক না কেন পরিবেশ বিষয়ক আইন ভাঙ্গার বিষয় বিচারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। ”
২০০০ সালে পরিবেশ দূষণ বিষয়ক মামলা পরিচালনার জন্য পরিবেশ আদালত চালু করা হয়।
প্রথম দিকে কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি সরাসরি ক্ষতিপূরণ চেয়ে আদালতে মামলা করতে পারতেন না। ২০১০ সালে আইনে সংশোধনী আনার পর এখন যে কেউ আদালতে পরিবেশ দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ মামলা করতে পারেন, যদিও এ তথ্য অধিকাংশ মানুষই জানেন না।
সত্যতা মিলল বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ড. এম এ মতিনের কথায়ও।
শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পরিবেশ অধিদপ্তরের নানা রকম আমলাতান্ত্রিকতা রয়েছে। পরিবেশ দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত কেউ সরাসরি আদালতে মামলা করতে পারবে বলে আইন হয়েছিল।
কিন্তু সে আইনটি বিদ্যমান রয়েছে না তুলে দেয়া হয়েছে সে বিষয়টি আমি নিজেই নিশ্চিত নই। ”
তিনি বলেন,“যেখানে দেশের প্রত্যেকটি জেলায়ই পরিবেশ বিষয়ক আদালত স্থাপন করা জরুরি সেখানে শুধুমাত্র ঢাকা ও চট্টগ্রামে মাত্র দুই পরিবেশ বিষয়ক আদালত রয়েছে। আর সে আদালতগুলোও আবার মামলা শূন্য। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিবেশ দূষণের মামলার বিচারে পর্যাপ্ত ভূমিকা রাখতে পারছে না। ”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।