একদিন দূপুরের কিছুপরে বাইরে বের হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটু দূরে। নিছক বেড়াতে গিয়েছিলাম। সবুজ প্রকৃতি দেখতে। আমার রবের নিখুঁত সৃষ্টি দেখতে।
ইতোমধ্যে আসরের নামাযের সময় হয়ে গেল। জায়গাটা ছিল একদম গ্রাম তাই মসজিদগুলো দূরে দূরে ছিল। আমি খুঁজতে খুঁজতে একটি হাফিজিয়া মাদ্রাসা পেয়ে গেলাম। মাদ্রাসার পাশে একটি বড় মাঠ। চারদিকে গাছ লাগানো।
সেখানে ১২-১৩ বছর বয়সের মাদ্রাসা পড়–য়া কিশোর ছেলেরা রয়েছে। কেউ কেউ খেলা করছে, কেউ বা বাদাম খাচ্ছে, কেউ আবার ঝাল মুড়ির দোকানে ভিড় করে আছে। বুঝতে পারলাম নামাযের জামায়াত শেষ হয়ে গেছে। তাই একা একা পরে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
আমি মাদ্রাসার ভিতরে ঢুকে গেলাম।
মাদ্রাসাটি বেশ বড়। ভিতর থেকে ছেলেরা বের হয়ে আসছিল। আমি তাদের মধ্যে একজনকে ল্য করলাম। শুভ্র চেহারা। সাদা টুপি আর সাদা পাঞ্জাবী।
নীল করে পড়েছে এগুলো। হয়তবা স্নেহময়ী মাতার হাতের স্পর্শে কাপড়গুলো আরো উজ্বল হয়ে উঠেছে। ছেলেটার লাবণ্যময় মুখখানা যেন জ্বল জ্বল করছিল। আমি তাকে বললাম-
-আস্সালামু আলাইকুম। ওযুখানাটা কোথায়?
সে আমাকে বলল-
-ওয়াআলাইকুম আসসালাম।
আমার সাথে আসেন।
তার নিজের যাত্রা ভঙ্গ করে সে আমাকে নিয়ে উল্টো পথে অর্থ্যাৎ মাদ্রাসার ভিতরের দিকে চলল। আমি চিন্তা করতে লাগলাম- কি অমায়িক তার ব্যবহার! আমি নতুন করে এই কিশোরের কাছ থেকে সৌজন্যতা শিখলাম। কোন দিন চিন্তাও করিনি যে এভাবে একজন আগন্তুককে সাহায্য করা যায়। আমরা যারা সাধারণ শিা ব্যবস্থায় শিতি হয়েছি বিশেষ করে আমি এরকম েেত্র হয়ত বলতাম- ‘‘সামনে গিয়ে ডানে, তারপর বামে’’- এরকম কিছু।
সে আমাকে নিয়ে ওযুখানায় বসিয়ে দিল। আমি বললাম-
-বেশ পিপাসা পেয়েছে। তোমরা পানি খাও কোথা থেকে? টিউবওয়েল কোথায়?
সে উত্তর করল-
-আপনি ওযু করতে লাগেন। আমি নিয়ে আসছি।
একথা বলে সে দৌড়ে চলে গেল।
আমি ভাবতে লাগলাম এইতো ভ্রার্তৃত্ব, এইতো মানবপ্রেম, এইতো মহানুভবতা। প্রায় ১৬-১৭ বছর ধরে লেখা-পড়া করছি। এই ছেলেটির বয়সও এতো হয়নি। কিন্তু সে যে শিা গ্রহণ করেছে, আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তা পাইনি। নির্লজ্জ ভাবেই সত্য স্বীকার করে নিচ্ছি- “এই সেকুলার শিা ব্যবস্থা আমাকে একটা র্ধূত শিয়াল বানিয়েছে।
আমি একটা প্রশিণ প্রাপ্ত পশু, আমি শুধু জানি কিভাবে শিকার ধরতে হয়”।
কিছুণের মধ্যেই একটি সাদা মগ ভর্তি পানি নিয়ে এসে ছেেেলটি আমার পাশে দাঁড়াল। ওযু শেষে আমি প্রাণভরে পাসি পান করলাম। আল্লাহ তায়ালা এরকমই মাদ্রাসার ছাত্রদের দিলকে প্রসারিত করেছেন। আর করবেন না কেন? তারা যে রাসূলে উম্মত।
উমরের উত্তরসূরী।
আর একদিনের কথা। আমি বাড়িতে গিয়েছি। বিকেল বেলা বাজারে গেলাম। তেমন কোন কজে ছিল না।
এই চা-স্টলে বসে পুরাতন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া। মাগরিবের নামাযের একটু আগে বাড়ি ফিরছিলাম। রাস্তার পাশে একটি মাদ্রাসা ছিল। সেখানে ছাত্ররা খেলা করছিল। ক্রিকেট।
আমি ওদের সাথে মাগরিবের নামায পড়ার নিয়ত করলাম। মাদাসার ভিতরে ঢুকে গেলাম। একজন শিককে দেখতে পেলাম বেঞ্চ পেতে বসে আছে। তিনি আমাকে তার পাশে বসতে দিলেন। মাদ্রাসার অন্যান্য হুজুরদের সাথে পরিচয় থাকলেও উনার সাথে আমার পরিচয় ছিল না।
দুজনেই পরিচিত হয়ে নিলাম। এরপর নানা রকম গল্প করলাম। এদিকে ছাত্ররা খেলা করছে। কখনও ছয়, কখনও চার, আবার কখনও আউট। বেশ হইচই হচ্ছে।
আমিও মাঝেমাঝে বাহবা দিচ্ছি। এরমধ্যেই পাশের মসজিদ থেকে আযানের ধ্বনি এল। সবাই খেলা ফেলে চলে এল। একে এক ওযু করতে লাগল। একজন গিয়ে মাঠের একপাশে গিয়ে আযান দিয়ে দিল।
আমি তাকিয়ে এসব দেখছিলাম। সবকিছুই যেন হচ্ছে অদৃশ্য কোন শক্তির ইশারায়। কোন রকম বিশৃঙ্খলা নেই। পত্রিকাতে দেখেছি, সমাবেশে যোগ দিতে গিয়ে ছাত্ররা বিশৃঙ্খলা করেছে। তাও আবার সামান্য বিষয় নিয়ে।
সামনের চেয়ারে বসা নিয়ে। আর এই মাদ্রাসার ছাত্রগুলো! এত অল্প বয়স। ওদের তো একটামাত্র টিউবওয়েলে ওযু করতে গিয়ে ঝগড়া বাঁধিয়ে ফেলার কথা ছিল। কিন্তু না, একজন চাপ দিচ্ছে, আর কয়েকজন মিলে পানি ব্যবহার করছে। পরম করুণাময় যেন তার ওয়াদা পূর্ণ করেছেন।
তিনি তাদের অন্তরকে পরস্পরের সাথে জুড়ে দিয়েছেন।
এরপর নামায শুরু। একজন এসে আমাকে ঠিক ফ্যানের নিচে একটি জায়নামাজ বিছিয়ে দিল। আমি বিব্রতবোধ করতে লাগলাম। বললাম-
-না, না।
লাগবেনা। আমি নিজেই সব করে নিচ্ছি। তুমি কেন এত কষ্ট করবে?
ছেলেটা বলেছিল-
-আপনি তো আমাদের মেহমান। তাই আমাদের উপর আপনার হক প্রতিষ্ঠিত হয়েগেছে। আমাদের দ্বায়িত্ব আপনাকে এটুকো সম্মান করা।
নামায শেষে ওদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। মাদ্রাসা থেকে বেড় হয়ে এলাম। সোজা রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। আমি চিন্তা করতে লাগলাম- এইটুকো বাচ্চা যদি মেহমানের হকের ব্যাপারে এত সচেতন হয়, না জানি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে সে কি করবে। আমি মনের মধ্যে র্নিঘুম ওমরে খিলাফতের ছবি দেখতে পেলাম।
আনন্দে আমার চোখ দিয়ে পানি বের হতে লাগল। আমি সবকিছু ঝাপসা দেখতে লাগলাম। আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল- “নিশ্চয় আমার নামায, আমার কোরবাণী, আমার জীবন ও মরণ সবকিছুই সারা জাহানের রব আল্লাহ তায়ালার জন্য”।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।